সবাইকে জানাই বিজয়ার একরাশ শুভেচ্ছা। শিরোনাম: #পতিতার_প্রত্যয়কলমে: #অমৃতা_ব্যানার্জী
বিষ্ণুপ্রিয়া, গ্রামে বেড়ে ওঠা বিধবা মা লক্ষ্মীমণির একমাত্র সন্তান। বিষ্ণুপ্রিয়ার বাবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধস্তন কর্মচারী ছিলেন।…
সবাইকে জানাই বিজয়ার একরাশ শুভেচ্ছা।
শিরোনাম: #পতিতার_প্রত্যয়
কলমে: #অমৃতা_ব্যানার্জী
বিষ্ণুপ্রিয়া, গ্রামে বেড়ে ওঠা বিধবা মা লক্ষ্মীমণির একমাত্র সন্তান। বিষ্ণুপ্রিয়ার বাবা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধস্তন কর্মচারী ছিলেন। লক্ষ্মীমণি যখন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন সীমান্তে গোলাগুলিতে ওনার স্বামীর মৃত্যু হয়। বিষ্ণুপ্রিয়া কোনদিন বাবাকে তাই দেখেনি স্বচক্ষে। মায়ের কাছে রোজ শোনে বাবার গল্প, দেশের গল্প, দেশের জন্য শত শত মানুষ আজও কিভাবে আত্ম বলিদান দিয়ে চলেছে সেই গল্প। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়ার এইসব গল্প অসহ্য লাগে, বিশেষ করে ওই দেশ শব্দটি। ও কি পেয়েছে এই দেশের থেকে? দেশের জন্য বাবা হলেন শহীদ। কিন্তু দেশবাসী শহীদদের কতদিন বা মনে রাখে! শহীদের মৃত্যুর পরে এক দুই বছর স্বাধীনতা দিবসে পাড়ার অনুষ্ঠানে মৃত ব্যক্তির ফোটোতে মাল্যদান, এই পর্যন্ত শহীদের সম্মান সীমাবদ্ধ। এই দেশের জন্য বিষ্ণুপ্রিয়া কোনদিন পায়নি তার বাবার স্পর্শ। বিধবা মা সামান্য কিছু টাকা সঙ্গে নিয়ে মামার বাড়ীতে চলে আসে। এই গ্রামের মামার বাড়ীতেই বিষ্ণুপ্রিয়ার জন্ম। মামার পরিবার কোনদিন ওদের সুনজরে দেখে না, উঠতে বসতে লাঞ্ছনা। দাদু কীর্তন গান করেন, মা সাহায্য করেন। সেইখান থেকে সামান্য অর্থ উপার্জন হয়। সঙ্গে বাবার পেনশনের টাকা। দুই মিলিয়ে অনেক কষ্টে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে বিষ্ণুপ্রিয়া।
অষ্টাদশী বিষ্ণুপ্রিয়ার বাড়ীতে পাত্র খোঁজা শুরু হয়েছে। মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারলে তবে মা ও দাদুর শান্তি। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়ার মন যে তার স্বামী নির্বাচন করে রেখেছে। এই গ্রামের কতিপয় অবস্থাপন্ন পরিবারের মধ্যে ঘোষাল পরিবারের সন্তান বিভাস। বিষ্ণুপ্রিয়ার থেকে এক বছরের বড়। স্কুল যাওয়ার পথে দুজনের আলাপ এবং সেই সূত্রে উভয়ের প্রণয়। বিভাস শহরে গেছে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। কথা দিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গ্রামে ফিরে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
তারপর পেরিয়ে গেছে পাঁচ বছর। বিষ্ণুপ্রিয়া এখন তেইশ বছরের নারী। অবশ্য বিষ্ণুপ্রিয়া নামে এখানে কেউ তাকে চেনে না। বিষ্ণুপ্রিয়ার নতুন নাম বিউটি। বিভাসের জন্য অপেক্ষা করতে পারেনি বিষ্ণুপ্রিয়া। পরিবারের চাপে বয়সে পনেরো বছরের বড় এক পুরুষের সাথে বিয়ে হয়। মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার চলে প্রতিনিয়ত। বিয়ের চার বছর পরেও সন্তান আসেনি বিষ্ণুপ্রিয়ার গর্ভে। সমাজের নজরে বাঁজা বিষ্ণুপ্রিয়া কাউকে বোঝাতে পারেনি তার স্বামীর শারীরিক দুর্বলতার কথা। একদিন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে নদীর তীরে যায় আত্মহত্যা করতে। সেই ঘাটেই নিষিদ্ধ পল্লীর এক কোঠার মালকিন সাবিত্রী ওকে দেখতে পায় এবং নিজের কোঠায় ওকে স্থান দেয়। নিষিদ্ধ পল্লীতে বিষ্ণুপ্রিয়া নাম বেমানান, তাই নতুন নাম বিউটি।
দেহ ব্যবসার কাজ শুরু করতে দ্বিধা হয়নি বিউটির। সমাজের নজরে সে তো বহুকাল আগেই পতিতা হয়েছে, নতুন করে কিছু তো হারানোর নেই। পরম প্রাপ্তি ঘটল, যখন নিষিদ্ধ পল্লীর এই ঘুন ধরা বাড়ীতে বিভাসের সঙ্গে দেখা হল। বিভাস বিবাহিত, ওর স্ত্রী সরমা। কিন্তু সরমার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো নয়। সরমার দৃষ্টি বিভাসকে যেন সর্বক্ষণ পোস্টমর্টেম করে। তাই কিছুক্ষণ মানসিক শান্তি ও শারীরিক আনন্দ উপভোগের জন্য বিভাসের এই নিষিদ্ধ পল্লীতে যাতায়াত। পুরানো সাথী বিষ্ণুপ্রিয়া ওরফে বিউটি কে দেখে বিভাসও উৎফুল্ল। বিউটির ঘর এখন বিভাসের আশ্রয়। বিউটি পতিতা নাম অর্জন করার পর নিজের মানস প্রেমী কে পেয়ে সাবিত্রী মাসির কাছে কৃতজ্ঞ।
বিভাস যেদিন আসে বিউটি সেইদিন গুলিতে সযত্নে নিজেকে সাজায়। বিভাসের সঙ্গে সঙ্গমে অনুভব করে পরম তৃপ্তি, পবিত্র অনুভূতি। কিন্ত সেইদিন রাতে বিভাস ঘুমিয়ে পড়ার পর বাজারে সদ্য আসা মুঠোফোন বিভাসের পকেটে দেখতে পায়। কৌতূহলবশত ফোনটি দেখতে গিয়ে শরীরের প্রতিটি শিরা দিয়ে ঠাণ্ডা স্রোত অনুভব করে বিউটি, বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।
******************************
নিষিদ্ধপল্লীর এই বাড়িটাতে সাবিত্রী মাসির কাছে আজকের টাকাটা জমা করলো বিভাস।তারপর ওপর তলার সিঁড়িতে পা রাখতেই মাসি পিছন থেকে ডাক দিল— "মেয়ে টা কোনও ঝামেলা করছে না তো বাবু! আছে তো ঠিকঠাক?’ আসলে এই লাইনে একদম নতুন কিনা।
বিভাস স্মিত হাসিতে ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিল সমস্ত পরিস্থিতিই অনুকূলে।
দরজায় দু’টো টোকা। বিউটির চেনা আওয়াজ দরজা খুলতে সময় নিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড।
ঘরে ঢুকেই বিভাস লাফিয়ে পড়ল সোজা বিছানায়। তার সারা দিনের ক্লান্তি যেন এখানে এলে কোথায় মিলিয়ে যায়। বাড়িতে যে টুকু সময় কাটে, সরমার সন্দেহের চোখের শিকার হয় সে।
আচমকা চোখ গেল বিউটির দিকে। আজ ওর বড় শান্ত সাজ। হাল্কা নীল রঙের একটা শাড়ি। কপালে একটা ছোট কালো টিপ ব্যাস।
"কিরে টিউবটা নেবা এবার।’ পরম তৃপ্তির হাসি নিয়ে অনুরোধ জানাল বিভাস।
******************************
সাবিত্রী মাসির এই বাড়ীটি চারিদিক দিয়ে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। বিউটির ঘরের দরজাতেও সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। বিবস্ত্র বিভাস কিছুই বুঝতে পারছে না। কোনরকমে নিজেকে আবৃত করে উঠে দাঁড়ালো। পুলিশের হাতে বিভাসের গ্রেফতারির পরোয়ানা। পুলিশ ধরে নিয়ে গেল জাল ওষুধ চক্রের অন্যতম কাণ্ডারী বিভাস ঘোষালকে।
বিভাসের মুঠোফোন হাতে পাওয়ার পর বিউটির কিছু মেসেজ চোখে পড়ে। মেসেজ পড়ে ও জানতে পারে বিভাস ওষুধ জাল করার মত কুখ্যাত অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। দেশের মানুষের শরীরে জীবনদায়ী ওষুধের নামে বিষ ঢেলে দিচ্ছে বিভাস। সারাজীবন দেশ শব্দটিকে অবজ্ঞা করলেও বিভাসের অপরাধ জানার পর মায়ের বলা ছোটবেলার দেশপ্রেমের গল্পগুলি চোখের সামনে প্রকট হয়ে ওঠে বিউটির। যতই হোক, ওর শরীরে সৈনিক পিতার রক্ত বয়ে চলেছে। সাবিত্রী মাসির সহায়তায় পুলিশকে সব জানায়। পুলিশও অনেকদিন ধরে এই কুখ্যাত অপরাধীকে ধরার চেষ্টা করছিল। আজ সফল।
আইন বিভাসের কি বিচার করবে জানে না বিউটি। কিন্তু ওর নজরে বিভাস আজ মৃত। কিশোরী অবস্থায় গ্রহণ করা স্বামীর মৃত্যুতে তাই বৈধব্য বেশ ধারণ করেছে বিউটি।
(Copyright protected)