Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

ছোট গল্প --একটি আত্মহত্যার নেপথ্যে কলমে--রমা মোহান্ত। **।       *******     ******"***** সবে রেডিওতে সন্ধ্যা স্থানীয় খবর শেষ হয়েছে ।গেটে একটা স্কুটার থামার শব্দ,  তারপরেই কলিং বেল। দরজা খুলে যাকে দেখলাম তাকে পরিচিত মনে হলো না।…


ছোট গল্প --একটি আত্মহত্যার নেপথ্যে
কলমে--রমা মোহান্ত।
**।       *******     ******"*****
সবে রেডিওতে সন্ধ্যা স্থানীয় খবর শেষ হয়েছে ।গেটে একটা স্কুটার থামার শব্দ, 
তারপরেই কলিং বেল। দরজা খুলে যাকে দেখলাম তাকে পরিচিত মনে হলো না। প্রশ্ন করলাম,"কাকে চাই?"
-"কৌশিক বাবু আছেন ?"
‌-"আমি ,ভেতরে আসুন ।"
‌ ভদ্রলোক বসার ঘরে ঢুকে এদিক ওদিক একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বয়স চল্লিশের নিচেই হবে । সাধারণ আর পাঁচটা লোকের মতই চেহারা ।পরনে নতুন আধময়লা ধুতি ও চাদর। গালে অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়ি ।হাতে কম্বলের আসন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তার অশৌচ অবস্থা চলছে। আমার ঘরের সোফাসেটে বসতে সংকুচিত হচ্ছেন অনুমান করে ভেতর থেকে একটা কাঠের চেয়ার এনে দিয়ে বললাম ," বসুন।" ভদ্রলোক আসন পেতে চেয়ারে বসলেন, এবং এতক্ষণে নমস্কার জানালেন । বেশ বুঝতে পারছিলাম উনি অপরিচয়ের কুন্ঠা কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে পারছেন না। সুযোগ দেবার জন্য আমিও কোন প্রশ্ন না করে নমস্কারান্তে তার সামনে সোফায় বসলাম । মাথাটা একটু নিচু করে রেখেই উনি বললেন," আমার নাম দেবাশীষ রায় । সরোজ রায় আমার বাবা ।উনি আপনার কাছে, মানে আপনাদের পত্রিকা অফিসে মাঝে মাঝে আসতেন মনে করতে পারবেন বোধহয় ? উনি..!"দেবাশীষ থেমে গেল।
‌ এবার আমার চমকে ওঠার পালা । সরোজ বাবু মারা গেছেন ? মাসখানেক বোধ হয় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। মানে এদিকে আসেন নি । ওঁর হাই প্রেসার ছিল জানতাম ।গলায় সহানুভূতি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বললাম,"হঠাৎ করে হলো বোধহয়? কবে হলো? স্ট্রোক নাকি ?"কথা শেষ করার পর একটু থেমে ভদ্রলোক নতমুখে বললেন,"না,মানে.. আত্মহত্যা!"আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। ভদ্রলোকও স্থির। ঘাড়টা একদিকে হেলানো বসে রইলেন। আমি বুঝে উঠতে পারলাম না কি বলবো কি বলা উচিত এক্ষেত্রে। তবু কিছু তো বলতেই হবে। মুখ দিয়ে অসংলগ্ন ভাবে বেরিয়ে গেল, "আশ্চর্য! খুবই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কি যে বলব! ওনাকে দেখতে, মানে উনি খুবই নিরীহ নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন। এমন একটা কাজ এই বয়সে কেন যে করলেন ভাবা যায় না। আপনাকে কি যে বলব বুঝতে পারছি না।"দেবাশীষ এর মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন খানিকটা ।হতেই হয় ।দুর্ঘটনার পর মানুষের প্রতিরোধক্ষমতা ভেতর থেকেই গড়ে ওঠে বোধ হয় ।নিচু কণ্ঠে বললেন,"আপনি বাবাকে চিনতেন, দুঃসংবাদটা আপনাকে বিচলিত করেছে ।এ সংবাদ হঠাৎ করে দিতে হলো বলে আমাকে ক্ষমা করবেন। একথা আপনাকে না জানিয়ে আমার উপায় ছিল না।" কিন্তু কেন? আমার মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠলেও সেটা প্রকাশ না করে বললাম,"হ্যাঁ এটা আমার কাছেও ভীষন দুঃসংবাদ।আমি সরোজ বাবুকে বোধহয় মাস ছয়েকের উপর জানি ।খুব শান্ত চুপচাপ প্রকৃতির মানুষ ছিলেন ।আমাদের নব দিগন্ত পত্রিকা অফিসে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমি এই সাহিত্য পত্রিকার সহ-সম্পাদক ,সেইজন্যই একটা লেখা নিয়ে প্রথম এসেছিলেন। তারপর মাঝে মাঝেই আসতেন। আমাদের সাহিত্যের আসরের সদস্য দের মধ্যে  নানা আলোচনা হয়। মন দিয়ে শুনতেন। খুব একটা মত প্রকাশ করতেন না তবে খুব আগ্রহী ছিলেন সাহিত্যের প্রতি। আমার সঙ্গে একটা রিলেশান মানে ওই বন্ধুত্ব র মত গড়ে উঠেছিল ।শেষের দিকে বোধ হয় মাসখানেক আসেননি। ভেবেছিলাম হয়তো শরীর ভালো নেই ,তাই..! তা হঠাৎ এরকম ব্যাপার কল্পনাও করা যায় না ।আগে আপনারা কিছু বুঝতে পারেননি? -মানে কোন পরিবর্তন?"
--"নাহ্, একেবারেই অকল্পনীয়। বাবা বরাবরই শান্ত প্রকৃতির মানুষ কথা কম বলতেন। চাকরি সূত্রে পশ্চিম বাংলার বাইরে বাইরে থেকেছেন মাকে নিয়ে। বদলির চাকরি ছিল বলতে পারেন প্রবাসী বাঙালি যাকে বলে তাই। রিটায়ার্ড করার পরে যাদবপুরের  পৈতৃক বাড়িতে আসেন ।আমি চাকরি সূত্রে স্ত্রী সহ তখন ওই বাড়িতেই থাকি । রিটায়ার্ড করে এসে খুব উৎসাহ নিয়ে বাড়িঘর রিকনস্ট্রাকশন করান। আমার স্ত্রী তখন সন্তান সম্ভবা। আমাদের ছেলে হয়। মা বাবা তখন দুজনেই নাতি মানুষ করা, বাগান, বাড়িঘর এইসব নিয়ে সদা সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। বছর তিনেক খুব ভালো কাটার পর হঠাৎ মা মারা যান। আর তারপরেই বাবা যেন কেমন জীবন সম্বন্ধে নিরুৎসাহী হয়ে পড়েন। হাই প্রেসার ছিলই। বেশ খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েন কিছুদিনের জন্য ।তারপর সুস্থ হলেও আগের মত স্বাভাবিক আর হন না। সর্বদা নিজের ঘরে নিজের মধ্যেই গুটিয়ে থাকতেন ।আমরা মানে আমি আমার স্ত্রী ভাবতাম মায়ের মৃত্যুর শকটা উনি সামলে উঠতে পারছেন না। ধীরে ধীরে সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। এরপরে লক্ষ্য করলাম লেখাপড়া নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকছেন। বইপত্র পড়ার নেশা বরাবরই ছিল ।সেটা আরো বেড়ে যাওয়ায় ভেবেছিলাম ওটা অবলম্বন করেই বাবা ভালো থাকবেন।বইপত্র আমি এনে দিতাম, উনি ও কিনতেন। আপনাদের পত্রিকা ওঁর কাছেই প্রথম দেখেছি। পরে আপনাদের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগের ব্যাপারটাও জেনেছিলাম। লেখালেখিও করছেন দেখতাম, কিন্তু কি লিখছেন সেইসব জানতে চাওয়ার মত আমার সময় হয়নি । একা মানুষ চাকরি ,সংসার সামলে আর সময় কোথায় বলুন?"
‌দেবাশীষের বিবৃতির অনেক টাই আমার জানা। কারণ এসব, কথা প্রসঙ্গে সরোজ বাবুর কাছ থেকেই জেনে ছিলাম।  নিকট আত্মীয় তাঁর তেমন কেউ ছিলনা মনে হয়।দীর্ঘ দিন প্রবাসী থাকার কারণে তাঁর কাছের বা ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব ও এখানে কেউ ছিল না। খানিকটা তাঁর নিজের স্বভাবের জন্যও বোধহয়। কারণ খুব একটা মিশুকে মানুষ ছিলেন না তিনি ।
‌তিনি নিজেই বলতেন ,"এই বয়সে  নতুন করে পরিচিত হলেও বন্ধু যাকে বলে ,তা আর হয়না কৌশিক বাবু ।এই লেখাপড়া নিয়ে আমি তাই ভালোই থাকি । সাহিত্য ই আমার জীবনের বড়ো অবলম্বন। একটু লেখালেখি করি, চেষ্টা করি ওই আর কি ! আমার এই লেখাটা দেখবেন, যদি সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে থাকে ,যদি আপনাদের পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ...??"দুটি লেখা তিনি আমাকে দিয়েছিলেন ।একটি প্রেমের গল্প । তাতে ঘটনা থাকলেও আঙ্গিক পরিপাট্য বা ভাষাশৈলির উত্তরণ তেমন ভাবে হয়নি ।পুরনো ধ্যান-ধারণা ভাবনা-চিন্তার লেখা। আজকাল আর এই ধরনের গল্প  প্রকাশিত হয় না। আর একটি প্রবন্ধ, তাতেও , রাজনীতি ,দুর্নীতি ,সমাজ, আদর্শবাদ ইত্যাদি নিয়ে লিখেছিলেন  ।বক্তব্য স্পষ্ট বা বলিষ্ঠ নয়, এধরনের লেখা আমাদের পত্রিকায় প্রকাশের যোগ্য নয়। আমি জানতাম আমি চাইলে ও সম্পাদকের অনুমোদন পাওয়া সম্ভব নয় । কিন্তু এসব কথা বয়স্ক ভদ্রলোক কে বলা যায়না ।মায়া হয়েছিল তার আগ্রহ দেখে ।সে জন্য উৎসাহ দেখিয়ে বলেছিলাম," বেশ ভালো হয়েছে ।এগুলো আমার কাছে থাক । সময়মতো দেখা যাবে। আপনি আরো লিখুন ।আরো জোরালো করুন বক্তব্যকে । সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা নিয়ে, জীবন নিয়ে ,লিখুন। আপনি নিশ্চয়ই পারবেন । আপনার লেখার চেষ্টা যখন আছে, ...ইত্যাদি ।এসব কথা সরোজ বাবুর ছেলেকে বলা যায় না । বিশেষ করে এই সময়েই। বললাম ,"উনি ভালই লিখতেন ,হাত ছিল ।আমাকে দিয়েছিলেন দুটি লেখা ,তবে আমাদের ছোট পত্রিকা তো অপেক্ষা করতে হয় সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করা সম্ভব হয়না ।আমি ওঁকে বলেছিলাম আরো লিখতে । আমার বিশ্বাস ছিল উনি নিশ্চয়ই সাহিত্যের ক্ষেত্রে সফলতা পাবেন। এটা কি করলেন উনি !! কবে কি হলো ,কী ভাবে উনি এই সিদ্ধান্ত নিলেন কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। দেবাশীষ বললো ," কাল ঘাট ,মানে দশ দিন। বাবার রাতে ঘুমের ওষুধ না খেলে ঘুম হত না ।নিজেই আনতেন পরিচিত দোকান থেকে। কবে থেকে যেন এনে এনে বেশি জমা করেছিলেন।সেদিন সকালে আমার স্ত্রী বাবাকে বেড-টী  দিতে গিয়ে তাঁর আর ঘুম ভাঙাতে পারেনি। সুইসাইড-নোটে লিখেছেন, নিজের জীবন নিয়ে তিনি ক্লান্ত বলে এই কাজ করছেন ।আমাদের ডাক্তার বললেন ,এটা একটা মানসিক রোগের প্রতিক্রিয়া ।বাবা যে মনে মনে এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন ,আমরা বুঝতেই পারিনি। মা থাকলে হয়তো....!!"  দেবাশীষের গলা ধরে এলো ।দুইহাতে মুখ ঢাকা পড়ল তার ।কিছুক্ষণ দুজনে নীরবে বসে থাকলাম ।একটু পরে সহজ হবার জন্য বললাম ," একটু বসুন। আমি চা নিয়ে আসি। একটু গরম চা খেলে আপনার হয়তো একটু ভালো লাগবে। আপনার উপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে...!" উঠে দাঁড়িয়ে দেবাশীষ বাধা দিলেন ,"না না, আমাকে আরো দু চার জায়গায় যেতে হবে ।আমাদের আত্মীয় স্বজন কাছে তেমন কেউ নেই ।নিজেকেই  সব করতে হবে তো ,হাতে সময়ও বেশি নেই ।আমি আপনাকে এটা দিতে এসেছিলাম ।বাবার ঘরে শ্রাদ্ধের জিনিসপত্র রাখতে গিয়ে খাট-বিছানা সরাতে যাই ,আমার স্ত্রী তখন আপনার নাম ঠিকানা লেখা এই খামটা পায় ।এটা বাবা আপনার জন্য রেখে গেছেন । হয়তো কোন লেখা ।তার শেষ ইচ্ছা মনে করে এটা দিতে এসেছিলাম ।"
‌একটা লম্বা খাম দেবাশীষ আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে ।  -"এর যে মুখ বন্ধ ,আপনি খুলে পড়েন নি ?"
‌আমি প্রশ্ন করি ।দেবাশীষ বলে, আপনাকে দিয়েছেন । আপনার নাম লেখা,বন্ধ খাম। আপনি ওঁর বন্ধু স্থানীয়, আমার খোলাটা উচিত নয় বোধে খুলিনি।আপনি ই আগে দেখুন ।আপনি সময়মতো পড়বেন। আমি এখন যাই ।কাজ মিটে গেলে পরে একদিন আসব ।তখন না হয় বলবেন ।বাবা -ই যখন চলে গেছেন, তখন আর ...! আচ্ছা নমস্কার ।" দেবাশীষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় তাড়াতাড়ি । হয়তো বাবার শেষ কাজ সু-সম্পন্ন করার কর্তব্যের তাগিদে ,অথবা বাবার উপর প্রবল অভিমানের ধাক্কা সামলাতে ।আমি দুখানা পাতার একখানি চিঠি পেলাম। যেখানে আমাকে লিখেছেন সরোজ বাবু ,
‌প্রিয় কৌশিক বাবু, 
‌আপনার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আমি চলে যাচ্ছি ।এভাবে যেতে হবে কখনো ভাবিনি। গিয়েও যে কোথায় পৌঁছাব, পৌঁছাবার সত্যি আদৌ কোন স্থানে আছে কিনা, কিছুই জানিনা। যারা স্বাভাবিকভাবে যান, তাঁরা কি কোথাও পৌঁছান ? নাকি প্রদীপ জ্বলতে জ্বলতে তেলটুকুই শুধু নিঃশেষ হয়ে যায়? আবার কোন কোন ক্ষেত্রে তেল থাকার সময়ও হঠাৎ করে নিভিয়ে দেয় কে? যেভাবেই হোক একদিন জীবনের শেষ হয়। প্রদীপ নিভে যাওয়ার পর অতি সামান্য একটু ধোঁয়ার রেস আর হালকা পোড়া গন্ধ বাতাসে মিলিয়ে যায়। মানুষের জীবনের শেষেও কি সেই একই ঘটনা? আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না ?  আমি এই নিয়ে অনেক ভেবেছি ।অনেক ভেবেছি, জানবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু  সঠিক উত্তর বা যুক্তি গ্ৰাহ্য উত্তর কিছুই পাইনি। যা পেয়েছি সব ভাষা ভাষা মনকে ছুঁয়ে গেছে ,কিন্তু হাতের মুঠোয় যুক্তিগ্রাহ্য কোন উত্তর পাইনি। কি জানি কেন মৃত্যু সম্বন্ধে একটা প্রশ্ন আমার মনে বরাবরই ছিল, বিশেষ করে সেটা আরও উদগ্ৰ হয়ে উঠলো আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর ।প্রায় 40 বছর একত্রে জীবন কাটানো অতিপরিচিত প্রিয় মানুষটা হঠাৎ করে বিনা নোটিশে কোথায় যে হারিয়ে গেল ! তাঁর জীবনের পরিণতি দেখলাম চোখের উপরে কিন্তু তথাকথিত আত্মার কোন নাগাল পেলাম না । আত্মা যদি সত্যিই থেকে থাকে, তবে সেই অতি মমতাময়ী মানুষ টি মুহূর্তের মধ্যে আমাদের সবার মায়া কাটিয়ে কোথায় চলে গেল ? অনেক চেষ্টা করেছি ঘুমে জাগরনে একান্তে তাকে একটিবার মাত্র অনুভব করতে। অনেক ডেকেছি তাঁকে, অনুরোধ করছি তার অস্তিত্বের সত্যটা মুহূর্তের জন্য হলেও আমার মনে প্রবাহিত করতে। কিন্তু আজ দু বছরে তাতে কোনো সফলতা আসেনি। তারপর আজ আমিও যাব যখন শেষ হয়ে  তখন কি আমার সেই প্রশ্নের উত্তর পাবো ? নাকি প্রশ্নের কোনো অবকাশ ই থাকবে না? বেঁচে থাকার মধ্যে শুধুই নানা প্রশ্ন আর প্রশ্ন! অনেক প্রশ্নেরই যুক্তিগ্রাহ্য উত্তর পাওয়া যায় না। যেমন এই মুহুর্তে দুটি প্রশ্ন বড় হয়ে সামনে দাঁড়াচ্ছে  আমার । এক ,সেটা হচ্ছে আমি কি জন্য , সংসারের কোন প্রয়োজনে বেঁচে আছি ? আর অন্যটি আমার সংসার আর আপনাদের কাছে, আমি কেন ইচ্ছাকৃতভাবে আত্মহত্যার মতো বাজে একটি কাজ বেছে নিলাম ? এই দুটি প্রশ্নই আমার কাছে সবচেয়ে বড় তার উত্তর খুজে খুজে আমি ক্লান্ত !ছ'বছর আমি অবসর নিয়েছি। আমার  একমাত্র পুত্র তার স্ত্রী পুত্র নিয়ে সুখী স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে ।তাদের জীবনে আমার অস্তিত্বের কিই বা এমন প্রয়োজন আছে ? এমন নয় যে তাদের কাছে আমি লাঞ্ছিত বা অবহেলিত ! ঠিকমতো বোঝানো যায় হয়তো এই বলে যে আমার ও আমার 35 বছর বয়স্ক পুত্র ও পুত্রবধূর সাথে আমার সম্বন্ধটা সুজন, কিন্তু নির্লিপ্ততার মধ্যেই পর্যবেশিত হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক ।সন্তানরা মা-বাবা থেকে উদ্ভূত ।আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ সেজন্য তাদের ঘিরে প্রবাহিত হয়। তাদের অবর্তমানে সংসার ভেঙে যায় ।মা-বাবার কাছে তারা চাঁদ সূর্য। কিন্তু সেই সন্তানদের পরিণত বয়সে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে, পূর্ব পুরুষের প্রয়োজন কতটুকু ? শুষ্ক পাতা ঝরে যায় ,গাছের কোন ক্ষতি না করেই তো ?গাছটাকে পরিপুষ্ট করে নব পত্রদল । নতুন শষ্য লাগান    হয় ভবিষ্যতের জন্য। এই প্রকৃতির নিয়ম ।মানুষের বেলায় দূরত্ব বাড়ে। তাই প্রয়োজনের , অনুভবের এসবের মৃত্যু হয় ।তার পরও বেঁচে থাকা ? শুধু ই থাকা। আমিও নতুন করে আর কিছুই দিতে পারিনা আমার পুত্রকে, এই প্রজন্মকে ।বুঝতে পারি কারো প্রয়োজন নেই । কায়িক পরিশ্রম করতে শরীর সঙ্গ দেয় না। যৎসামান্য করতে গেল বাধাই পাই ।হয়তো আমার কষ্ট হবে বলে , অথবা লোকে কি বলবে বলে  আমি তো হাই প্রেশারের রুগী ? যতদিন আমার স্ত্রী ছিলেন আমার সব দায়িত্ব ছিল তাঁর প্রতি ,যাবতীয়  করণীয় কর্তব্যের,মানসিক সাপোর্টে র । তাঁকে সর্বক্ষেত্রে প্রতিপালিত করার অঙ্গীকার করেইতো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলাম? সে বন্ধন আজ দুবছর হয় তিনিই ছিন্ন করেছেন। আমি এখন নির্দায়, নির্ভার।
‌ একটি অতি প্রিয় স্নেহের স্থান আমার আছে অবশ্য, সেটি আমার পাঁচ বছরের পৌত্র । কচিকাঁচা নবীন অঙ্কুরিত কিশলয় সে ,আমার পাঁচ বছরের নাতি ।তাকে সযত্নে সরস পুষ্টিতে আগামী দিনের মহীরুহ করার একটা দায়িত্ব আমারও থাকা উচিত ,এটা অস্বীকার করতে আমি পারিনা ।কারণ বংশপরাম্পরায় এর দায়িত্ব বহন করতে হয় এই সংস্কার আমরা আমাদের ছেলেবেলা থেকে বহন করে আসছি ।কিন্তু আজকের দিনে. সে সুযোগ কি আছে, বলুন? আজকের শিক্ষার যে নবধারা এসেছে যে দুর্বার গতি তার সেই বোঝা বহন করতে করতেই তো তারা পরিশ্রান্ত ? আমার পাঁচ বছরের নাতিটি ঠিক সাতটায় স্কুলে যায় ।ফিরে আসতে না আসতেই একটুখানি খাওয়া ও বিশ্রামের ছুটি।
‌ তারপর ই মাস্টার আসে ।মাস্টার যখন যায়, তখন তার মা তাকে আধা ঘুমে আধা জাগরনে কোলে বসিয়ে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়।এরমধ্যে বৃদ্ধ দাদুর স্থান কোথায় ?সেই বুড়োর নিজের  শৈশব থেকে সযত্নে আগলে রাখা রূপকথার থলির মুখ আর খোলা হয় না ।আগামী দিনের মহীরুহকে মাটির তলার শিকড়পদ্ধতিরএবং তার সন্ধান দেবার কর্তব্য আর সমাধা করা হয়না। সে কাজ অসমাপ্ত রেখেই আজ তাই অক্ষমতার লজ্জা নিয়ে চলে যাচ্ছি কৌশিক বাবু ।ভালো লাগছেনা, এই চারপাশের নতুন করে গড়ে ওঠা সব কিছুর নিয়ম-নীতি ।অথবা বলা ভালো রাজনীতি থেকে শুরু করে সমাজনীতি, ধর্মনীতি, ন্যায়-নীতি এই সবকিছু থেকেই নীতি টাই দেখছি যেন আলগা হয়ে খসে পড়েছে ।চারিদিকে শুধু সবকিছুকে নিয়েই যেন  উদ্বেলিত স্রোতের তাণ্ডব চলছে। সবাই সবকিছুই যেন ভেসে যাচ্ছে ।এরমধ্যে আমার নাতির মতো নিষ্পাপ ফুলের মতো শিশুরাও জন্মাচ্ছে, জন্মাবে ।তারাও কিছু না বুঝেই ঘুরপাক খাবে ।আমার বড্ড কষ্ট হয় বড্ড কষ্ট। চেষ্টা করেছিলাম নিজের বুকের, মনের অনুভবের কথা ,কষ্টের কথা সাহিত্যের রূপে যদি কয়েক জনের কাছেও পৌঁছে দিতে পারি তাই, আপনার, মানে আপনাদের পত্রিকা নব দিগন্তে হাজির হয়েছিলাম। কিন্তু ব্যর্থ অক্ষম আমি সেখানেও
‌প্রবেশের পথ পেলাম না । সেখানেও সমসাময়িককেই ধরার চেষ্টাই প্রধান সাহিত্য। আমাদের অনুভব অভিজ্ঞতা নস্টালজিয়া উপদেশের আখ্যা পায় সেসব সাহিত্য হয়ে ওঠে না ।জীবনের শেষে এসে যারা তার অন্তর শূন্যতা অন্তঃসারশূন্যতা টের পায় তার জীবন তার জীবনে সে সুসাহিত্য সৃষ্টি করবে? কিভাবে ? যখন কোন কর্মই নেই, কাউকে কিছু দেবারও নেই তখন বিশ্রাম নেওয়াই ভালো নাকি? অনেক ঘুমের ওষুধ এনেছি ।এবার ঘুমিয়ে পড়বো পরম নিশ্চিন্তে ।ঈশ্বর যদি থাকেন তিনি আপনাদের সকলের মঙ্গল করুন এই প্রার্থনা করে যাচ্ছি।
‌                  ইতি সরোজ রায়। 
‌চিঠিটা পড়া শেষ করে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম ।মাথাটা যেন ঠিকমতো কাজ করছিল না । নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। সরোজ বাবু আমার কাছে এসেছিলেন ,অথচ আমি তাকে কোন সাহায্য করতে পারিনি , তাঁকে বোঝার চেষ্টাই কি করেছি? আমাদের সময়ের বড় অভাব যে!! সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে জোরালো লেখার উপদেশ দিয়ে দায়িত্ব এরিয়ে গেছি। তার মৃত্যুর পর আজ ভাবছি  তিনি কি তাঁর শেষ বেলাতে আমাকে          শেষ প্রশ্নটা করে, শেষ   জবাবটাও তিনি ই দিয়ে গেলেন কি  ?আজকের  দিনের পেক্ষাপটে জীবন দিয়ে লেখা তার এই একমাত্র গল্প পড়ার পরেও আমরা আরো অনেক সরোজ বাবু কে তাদের একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারবো কি? আমরা আমাদের ব্যস্ততার জীবন থেকে তাদের জন্য একটু সময় একটু সহানুভূতি নিয়ে তাদের কথা শুনতে পারবো কি ? 
‌আপনারা কি বলেন ...???
‌।              +++++    সমাপ্ত ।।++++
‌***একটি আত্মহত্যার নেপথ্যে ।**(আমার গল্প )
‌******রমা মোহান্ত ।।