#বড়গল্প#শিরোনাম_কাকে_লক্ষ্মী_বলে?#কলমে_সুদেষ্ণা_রায়
১তৃষার বিয়েটা ভেঙেই গেল। শান্ত, ভদ্র, উচ্চশিক্ষিত মেয়ে। অবস্থাপন্ন বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।পাত্র নির্মল সুচাকুরে। তৃষা র সাথে তার গত পাঁচ বছরের মেল…
#বড়গল্প
#শিরোনাম_কাকে_লক্ষ্মী_বলে?
#কলমে_সুদেষ্ণা_রায়
১
তৃষার বিয়েটা ভেঙেই গেল। শান্ত, ভদ্র, উচ্চশিক্ষিত মেয়ে। অবস্থাপন্ন বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।পাত্র নির্মল সুচাকুরে। তৃষা র সাথে তার গত পাঁচ বছরের মেলামেশা, ভালবাসা। হবু শাশুড়িমা রঞ্জনাদেবী বেশ পছন্দ করেন তৃষাকে। নির্মলের সাথে সম্পর্কের কথা জানার পর, নিজে পাঁজি দেখে বিয়ের দিন স্থির করেছেন। বিধবা রঞ্জনাদেবী আর ছেলে নির্মলের ছোট সংসারে ঝামেলাও কিছু নেই। নেই পণ সংক্রান্ত কোন সমস্যাও।
তারপরও বিয়েটা ভেঙে গেল।
ভেঙে দিলেন রঞ্জনাদেবী নিজেই। একদিন ফোনে তৃষার বাবা সুবোধবাবুকে তিনি জানিয়ে দিলেন;;
" কিছু মনে করবেন না সুবোধ বাবু। আমার ঐ একটাই ছেলে। তার বিয়ে দিয়ে আমি ঘরে লক্ষ্মী আনতে চেয়েছিলাম। কোন পোড়া মুখের প্যাঁচাকে তো আমি বরণ করে এনে আমার ছেলের জীবনটা নষ্ট করতে পারি না। তাই এই বিয়ের আলোচনা এখানেই বরং,...."
"পোড়া মুখের প্যাঁচা"? সেটা আবার কে? তৃষা পরমা সুন্দরী, স্মার্ট, আধুনিকা, কলেজ ইউনিভার্সিটির অনেক ছেলেরই হার্টথ্রব সে। তাহলে?
২
এই "তাহলে"র উত্তর আছে তৃষার অসামান্য রূপের মধ্যেই। তৃষার মুগ্ধ প্রেমিক দের মধ্যে একজন ছিল ইউনিভার্সিটির বখাটে ছাত্র, দুর্বার। কী ভালই না সে বাসে তৃষাকে! বুক ঠুকে বন্ধুদের বলে; " তৃষার জন্য একটা কেন, দশটা জীবন দিতে পারি আমি। দেখে নিস সময় হলে।"
তা দেখা গেল বৈকি। প্রচণ্ড দামী একটা হীরের আংটি (কত দামী জিজ্ঞেস করে আবার লজ্জা দেবেন না, হবে কয়েক লাখ অথবা কয়েক কোটি) নিয়ে রীতিমতো বিদেশী কায়দায় হাঁটুমুড়ে তৃষাকে একদিন প্রোপোজ করল সে। এই প্রোপোজালের ধরণ দেখে প্রথমে তো হেসে গড়িয়ে পড়ল তৃষা।
"দুর্বার, সত্যি বলছি, তোর এলেম আছে। তোর নাটকের এই ট্যালেণ্ট টা একটু কালটিভেট কর না। উপকার পাবি। পাগল যতসব।"
"আমি পাগল এখনো হই নি তৃষা। কিন্তু হয়ে যাব, বিশ্বাস কর, যদি তোকে না পাই।"
এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেল তৃষা। " দেখ দুর্বার, আমি কোন শপিং মলে সাজিয়ে রাখা ব্র্যণ্ডেড পোশাক নই, যে তোর পছন্দ হলেই তুই টাকার জোরে আমায় পেয়ে যাবি। আমি মানুষ। আমার নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ আছে। আমি অন্য একজনকে ভালবাসি। খুব শীগগির তাকেই বিয়ে করব। তুই তোর পাগলামি বন্ধ কর।" কথা কটা বলে আর সেখানে দাঁড়ায় না তৃষা। একটু বেশীই ব্যস্ততার সাথে ইউনিভার্সিটির গেট দিয়ে বেরিয়ে যায় সে। বড্ড দেরী হয়ে গেছে। আজ নির্মলের জন্মদিন। সারপ্রাইজ গিফ্ট কিনতে হবে ওর জন্য।
হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময়, একবার পিছন ফিরে তাকালে তৃষা দেখতে পেত, দূর্বারের চোখদুটো হিংস্র শ্বাপদের মত জ্বলছে।
৩
দেখতে দেখতে এম এ পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল তৃষার। তার মনের আকাশে এখন আনন্দ ই আনন্দ। এগিয়ে আসছে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটা, যেদিন নির্মলের সাথে তার প্রণয় পরিণয়ে পূর্ণতা পাবে। বিয়ের তখন আর দিন কুড়ি বাকি, হঠাৎ একদিন দুর্বারের ফোন;;
" তৃষা, আজ একবার ইউনিভার্সিটি আয়। আমার বিয়ের প্রোপোজাল তো ছুঁড়ে ফেলে দিলি। তোর বিয়ের উপহার টা অন্তত নিয়ে যা।"
" সেকীরে! এখন কীভাবে যাব? তুই আসছিস তো আমার বিয়েতে। তখন উপহার দিস।"
" না রে তৃষা, তোর বিয়েতে আমি কলকাতায় থাকব না। বাবার ব্যবসার একটা কাজ নিয়ে দিল্লী যাব। তুই প্লিজ একবার আয়। আর কখনো তোর কাছে কিছু চাইব না। এই শেষ অনুরোধটা রাখ আমার।"
হেসে ফেলল তৃষা।
" এই ভরদুপুরেই নেশা করে বসে আছিস নাকি রে? দেবদাসের মত ডায়লগ ঝাড়ছিস!! ড্রামাবাজ কোথাকার। তুই আয় ইউনিভার্সিটির গেটে। আমি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আসছি।"
খানিকটা উড়ে উড়ে, খানিকটা নেচে নেচে, সাজগোজ সারল তৃষা। এই আকাশনীল জারদৌসীটা নির্মলের বড্ড প্রিয়। এটাই পরা যাক। ফেরার সময় নির্মলের অফিসে গিয়ে, ওকে একটু চমকে দেওয়া যাবে। ধুত্তেরি, কী মুশকিল! সব কাজেই যে কেন নির্মলকে মনে পড়ে ছাই!! লজ্জায় রাঙিয়ে নিজে নিজেই জিভ কাটল তৃষা।
৪
ইউনিভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে ছিল দুর্বার। হাঁপাতে হাঁপাতে সেখানে এসে দাঁড়াল তৃষা।স্বপ্ননীল শাড়ি, ম্যাচিং গয়না, মুখে আগামী খুশীর আবেশ; দুর্বার চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল কিছুক্ষণের জন্য। তার ঘোর কাটল তৃষার ডাকে।
" ওরে, কী উপহার দিবি দে তাড়াতাড়ি। হাঁ করে কী দেখছিস?"
"তোকেই দেখছি তৃষা। কী সুন্দর তুই! হীরে, পান্না দিয়ে সাজাতে চেয়েছিলাম রে তোকে। তুইই নিলি না। খুব দেমাক যে তোর রূপের। দেবদাস বলেছিলি না আমায়? আরে, দেবদাস তো বোকা রে। পার্বতীর কপালে একটা ছিপের বাড়ি মেরে, চাঁদের গায়ে কলঙ্ক আঁকতে চেয়েছিল শুধু। আমি কিন্তু অত বোকা নই। আমি পুরো চাঁদ টাকেই জ্বালিয়ে দেব।"
দুর্বারের কথার ভঙ্গিতে কেঁপে উঠল তৃষা। দুর্বার পায়ের কাছ থেকে ওটা কী তুলে নিচ্ছে? কী..কী করতে চাইছে দুর্বার? বেশী ভাবতে পারল না তৃষা। খানিকটা জ্বলন্ত আগুন দূর্বারের হাত থেকে ছুটে এসে ঝলসে দিল তার মুখটা। উফ্ কী যন্ত্রণা! চারপাশটা কেমন আবছা হয়ে এল তৃষার....।
তীব্র সালফিউরিক অ্যাসিড। জিনিসটা ইউনিভার্সিটির ল্যাবে নিতান্ত দুর্লভ নয়।বিশেষত যেখানে, দুর্বারের পকেটে আছে টাকার বাণ্ডিল, আর ল্যাব-ক্লার্কের লোভ এবং কর্তব্যবোধ দুটো একে অপরের ব্যস্তানুপাতিক।
দশদিন হাসপাতালে কাটিয়ে, কোন রকমে প্রাণটা বাঁচিয়ে, কুঁচকে যাওয়া মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরল তৃষা। হাসপাতালের বেডে শুয়ে অসহ্য জ্বালাপোড়ার মধ্যেও সে ভেবেছে, " নির্মল আমাকে ভালবাসে। ও নিশ্চয়ই অপেক্ষা করবে আমার জন্য।" বারবার প্রশ্ন করেছে, " নির্মল বা মামণি, কেউ আসছে না কেন মা আমায় দেখতে?" হ্যাঁ রঞ্জনাদেবী কে মামণি সম্বোধন করে তৃষা। হায় রে, মুখ যার পোড়া, তার আবার মামণি! তার আবার ভালবাসা! কালপ্যাঁচার আবার সংসার করার সখ!!
অতঃপর , একদিন "শুভদিনে", "শুভক্ষণে" , এল রঞ্জনাদেবীর ফোন। মুখ পোড়া মেয়েকে ঘরের লক্ষ্মী করতে অপারগ তিনি।
বিয়েটা তাই ভেঙেই গেল তৃষার।
৫
ভেঙে, গুড়িয়ে গেছিল তৃষা। যতটা না দুঃখে, তার থেকে বেশী অপমানে চুরমার হয়ে গিয়েছিল তার মনটা। বারবার তার মনে হচ্ছিল, মানুষের স্নেহ, ভালবাসা, প্রেম, সব অনুভূতি গুলোই মেকী? মেয়েদের বাইরের রূপটাই সব? কোন কদর নেই শিক্ষার, রুচির, ব্যবহারের, অন্তরের সৌন্দর্যের? যন্ত্রণায় পাগল হয়ে একদিন তৃষা জ্বালিয়ে দিতে গেছিল নিজের সব মার্কশিট আর সার্টিফিকেট গুলো। মূল্যহীন কাগজ ওগুলো। জ্বলে পুড়ে যাক, যেভাবে জ্বলে গেছে তার রূপ। সুবোধবাবু বাধা না দিলে হয়ত মহা সর্বনাশ হয়ে যেত সেদিন। বাবার কাছেই নতুন করে লড়াই করার প্রেরণা পেল তৃষা।বেশ, তবে তাই হোক। এই সার্টিফিকেট গুলোই হোক তৃষার সমাজকে উত্তর দেওয়ার অস্ত্র।
চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল তৃষা। অনেক কাজ বাকি। কাঁদার সময় কোথায় তার!
শুরু হল নতুন জীবন। একদিকে চলল ত্বক বিশেষজ্ঞের তত্বাবধানে মুখের চিকিৎসা, অন্যদিকে চলল ডব্লিউ বি সি এস্ পরীক্ষার কঠিন প্রস্তুতি।
ইতিমধ্যে, ধূমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল নির্মলের। রঞ্জনাদেবী খুঁজে পেতে সুন্দরী, সুশীলা, লক্ষ্মীমন্ত বৌ নিয়ে এলেন ঘরে। পরিতৃপ্ত তিনি।
৬
পাঁচ বছর পরের কথা।
তৃষা এখন বর্ধমান জেলার জেলাশাসক পদে কর্মরত। নির্দিষ্ট সময়, কৃতিত্বের সাথেই ডব্লিউ বি সি এস পরীক্ষায় পাশ করেছে সে। সেই সঙ্গে দীর্ঘ চিকিৎসায় মুখের অবস্থাও আগের থেকে অনেকটাই ভাল। আগের মত অপরূপ সুন্দরী না হলেও,, অতটা ভয়ঙ্কর ও আর দেখায় না তাকে।
আজ লক্ষ্মীপুজো। নিজের বাংলোর কাছে, একটি জাগ্রত মন্দিরে পুজো দিতে এসেছে তৃষা। মন্দিরের গেটের কাছে এক আলুথালু, উন্মাদিনীকে দেখে চমকে গেল তৃষা। মুখটা বড্ড চেনাচেনা লাগছে।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল তৃষা।
" একী? মামণি? তুমি এখানে কেন?"
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল পাগলিনী। তারপর বিড়বিড় করে অসংলগ্ন ভাবে বলে উঠল, " তুমি...তুমি...কে? তুমি...লক্ষ্মী? ওরা ফেলে গেল।আমাকে...ফেলে...গেল। তুমি...তুমি জান, লক্ষ্মী...কাকে...বলে?"
হায়রে নিয়তি!! যে সুন্দরী , লক্ষ্মীমন্ত বৌমাকে বরণ করে ঘরে তুলেছিলেন রঞ্জনাদেবী, সেই "সুশীলা, লক্ষ্মীর প্রতিমা বৌমা" বিয়ের বছর খানেক পরেই তার স্বামী টিকে বগলদাবা করে চলে গেছে নিজেদের অন্য ফ্ল্যাটে। মামণির সাধের ছেলেও আর খোঁজটুকুও নেয় না মায়ের। এককালের দাপুটে মামণির এখন পথই ঘর, আর ভিক্ষান্নই খাদ্য। পথে পথে ঘুরতে ঘুরতেই হয়ত কোনভাবে এতদূর বর্ধমানে চলে এসেছেন। নিজের জীবনের এই চরম বিপর্যয় দেখেই হয়ত বৃদ্ধার মনে জেগে উঠেছে প্রশ্ন,, " কে লক্ষ্মী? লক্ষ্মী কাকে বলে?" কিন্তু, বড় দেরী হয়ে গেছে এখন।
মামণির অবস্থা দেখে তৃষার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। বৃদ্ধাকে হাত ধরে তুলতে তুলতে সে বলল,, " চল মামণি, আজ থেকে তুমি আমার কাছে থাকবে। তুমি তো সব ভুলে গেছ। তাই তোমার মনে নেই, তোমার একটা মেয়েও আছে। সেই মেয়ের কাছেই এখন থেকে সসম্মানে থাকবে তুমি। আর আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব, লক্ষ্মী কাকে বলে।
সমাপ্ত