Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-সম্মাননা

মাছ
-------
নীলাঞ্জনা
--------------
পৃথার মনটা বড় খারাপ। আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে কালো থমথমে। তার মনের ভেতরটাও মেঘ থৈথৈ। পড়ুক না, বৃষ্টি পড়ুক না এখন অঝোর ধারায়। ভিজবে পৃথা আকুল হয়ে। আর সেই জলের ঝরোখার আড়ালে আরো ক ফোঁটা বৃষ্টি ন…


মাছ
-------
নীলাঞ্জনা
--------------
পৃথার মনটা বড় খারাপ। আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে কালো থমথমে। তার মনের ভেতরটাও মেঘ থৈথৈ। পড়ুক না, বৃষ্টি পড়ুক না এখন অঝোর ধারায়। ভিজবে পৃথা আকুল হয়ে। আর সেই জলের ঝরোখার আড়ালে আরো ক ফোঁটা বৃষ্টি না হয় ঝরবে তার দু চোখ থেকে, লুকিয়ে লুকিয়ে। লুকিয়ে তো সে রেখেছে, নিজেকে, নিজের মনকে। সকলের সামনে, যেন কিছুই হয় নি, এমনি ভাব করে ঘুরছে সে। হাসি মুখে ঘরের কাজ করছে, কুটছে, বাঁটছে, ফাই ফরমাশ খাটছে বাড়ির লোকের। কিন্তু এখন এই শুনশান দুপুরে, এঁটো বাসনের বোঝা নিয়ে পুকুর ঘাটে এসে, চুপ করে ঘাটলায় বসে আছে, জলে পা ডুবিয়ে। মেঘ গড়গড় করছে। সাঁই সাঁই করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। বৃষ্টি এল বলে। আকাশে। চোখেও।
পুকুর তো নয়, দীঘি। পদ্মদীঘি। কত লম্বা। শালুক ফুটে আছে। জল যেন কাজল কালো। আর কি ঠাণ্ডা। কোন ছোটবেলা থেকে চান করে আসছে সে এখানে। গা যেন জুড়িয়ে যায়। আর কত মাছ। বড় বড় রুই কাৎলাও আছে। তবে বাপু বেশ বদনাম আছে পুকুরটার। কত লোক মরেছে এখানে। কেউ ডুব সাঁতার দিতে গিয়ে ঝাঁঝিতে পা আটকে। আর উঠতে পারে নি। কেউ জেদ করে এপার ওপার করতে গিয়ে দম ফুরিয়ে, নাকানি চোবানি খেয়ে। আবার কেউ বা ঘড়া কলসি থান ইঁট গলায় বেঁধে ডুবেছে, শান্তি পাবে বলে। চুপ করে চেয়ে থাকে পৃথা জলের দিকে। আস্তে আস্তে নেমে যাবে নাকি অতল জলের তলায়। ঠাণ্ডা জল তার বুকের মধ্যে ঢুকে গিয়ে জুড়িয়ে দেবে যত জ্বালা পোড়া।
আনমনা হয়ে গেছিল। জলের তলায় ডুবে থাকা পায়ে একটা ঠোক্কর পড়ল। প্রথমটা খেয়াল করে নি। পরেরটা পড়তেই চটকা ভাঙ্গল। শ্যাওলায় কালচে হয়ে যাওয়া গা, ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে, ভ্যাটকা মুখে বুজকুড়ি তুলে ফক্কুরি করছে কালু। একটা বিশাল কাৎলা মাছ। ছোটবেলা থেকে চেনে মাছটাকে। যখন চান করত, সাঁতার শিখত, গায়ে গায়ে ঘুরত আর ঠুকরে দিয়ে খেলত। হিহি করে হাসত পৃথা। সেই নাম রেখেছিল, কালু। তখন অনেক ছোট ছিল। এখন বড় হয়ে গেছে। মুড়ো থেকে ল্যাজা অব্দি প্রায় তিন হাত লম্বা। আর তেমনি নধরকান্তি। মাছ কি এত বড় হয়? কে জানে। বয়েসও তো অনেক হল। এতদিন কি বাঁচে? কে জানে। এটাই কি সেটা, নাকি অন্য কেউ? কে জানে। তবে রোজ বাসন মাজার সময় এসে হাজির হয়। ওর জন্যে বাঁচিয়ে একমুঠো ডালভাত আলু দিয়ে মেখে নিয়ে আসে পৃথা রোজ। আজও এনেছিল। চেঁছেপুঁছে ঢেলে দিল। চোখের নিমেষে কপকপ করে খেয়ে নিল। তারপর জলের তলায় ডুব দিয়ে, পৃথার পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দুটোকে কুপুত কুপুত ঠোকরাতে লাগল। এটাই খেলা। জানে পৃথার ভাল লাগে। তাদের এই খেলার কথা দুনিয়ার কেউ জানে না। আরো একটা কথা কেউ জানে না। ঘাট যখন ফাঁকা থাকে, পুকুর যখন নির্জন, তারা দুটিতে গল্প করে।
:- তোর কি হয়েছে রে পিতু?
:- কি আবার হবে?
:- উঁহু, কিছু একটা হয়েছে। রোজ তোর আঙ্গুল কামড়ে দিলে, আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিস। আজ যে বড় দিলি না? চুপ করে বসে আছিস।
:- আমার মন খারাপ।
:- কেন রে। মা বকেছে কাপ ভেঙ্গেছিস বলে?
:- ধ্যুৎ।
:- তবে?
:- সম্বন্ধটা ভেঙ্গে গেল।
:- কিসের সম্বন্ধ?
:- বিয়ের।
বিরক্ত হয় পৃথা।
:- কার বিয়ে?
:- কার আবার? আমার। মুখ্যু ভুত কোথাকার।
ঝামরে ওঠে পৃথা।
:- আহা চটিস কেন। বলনা কি হয়েছে?
:- ওরা অনেক দাবী দাওয়া করেছে। আমাদের সামর্থ্যের বাইরে। হল না বিয়েটা।
:- ভাল হয়েছে। অত যাদের খাঁই, তারা লোক ভাল হবে না।
:- সৌম্যকে যে ভুলতে পারছি না। কি সুন্দর দেখতে। কি সুন্দর কথা বলে।
:- সেটা আবার কে?
:- ওই যে, যার সঙ্গে বিয়ের ঠিক হয়েছিল।
বলে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। কালু ড্যাবড্যাব করে দেখে। তারপর ভুস করে ডুবে গিয়ে, একটু দূরে ভেসে উঠে ঘাই মারে।
:- আমাকেও তো দেখতে খুব ভাল। তুইই বলিস। আমাকে বিয়ে করবি পিতু? দ্যাখ, আমার কোন দাবী দাওয়া নেই। শুধু তোকে পেলেই হবে।
:- ভ্যাট হাঁদারাম। আমি মানুষ না।
:- তুই মাছ হয়ে যা না। তারপর তোকে বিয়ে করে বাড়ি নিয়ে যাব। এই পদ্মদীঘির জলের তলায়, শালুক বনের অনেক নিচেয়। সেখানে আমরা দুটিতে মিলে সারাদিন খেলব। ঝাঁঝির বিছানায় ঘুমোব। তুই আর আমি। যাবি পিতু?
পৃথা হেসে ফেলে। তাকে হাসতে দেখে কালু ঘনিয়ে আসে তার কাছে। তার নাল শ্যাওলা মাখা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে পৃথা।
:- কি রে, হবি বউ আমার?
:- দূর হ। কাজ করতে দে?
বাসন গুলোকে ঘস ঘস করে মেজে, ধুয়ে, গোছ করে, উঠে দাঁড়ায় পৃথা। আরো খানিকটা ঘ্যান ঘ্যান করে ডুব দিল কালু। পৃথাও পেছন ফিরে ঘরের রাস্তা ধরল। খেয়াল করল না, দুটো গোল গোল চোখ তার সরু কোমরটার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। কি সরু, তারপরে কি চওড়া, ঠিক যেন মাছ।
খুব জোরে বাজ পড়ল কোথাও। আর মুষলধারে বৃষ্টি এল। রাত গভীর। সবাই ঘুমোচ্ছে। শুধু ঘুম নেই পৃথার এ পোড়া চোখে। সৌম্যর ছবিটাকে দেখতে দেখতে বৃষ্টি নামে পৃথার।
:- কেমন মানুষ গো তুমি। অত পছন্দ হয়েছিল আমাকে। শুধু কটা টাকা পয়সার জন্যে পেছিয়ে গেলে? আর আমি যে তোমায় সবটুকু দিয়ে বসে আছি, আমার কথা ভাবলেও না একটু।
অভিমানে ঠোঁট ফুলে ওঠে পৃথার।
:- বেশ তো। কি পেলে না, জানতেও পারবে না তুমি। থাকো তোমার টাকা পয়সা নিয়ে।
কেমন পাগল পাগল লাগে পৃথার। উঠে বসে, এক এক করে খুলে ফেলে শাড়ী, সায়া, ব্লাউজ। ডিম লাইটের আলোয়, হাত আয়নাটায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে নিজেকে। সে কি সুন্দরী নয়। এমন বুক কোমর পাছা, আছে কটা মেয়ের? এমন নাক চোখ মুখ, এমন চুল? এমন গায়ের রং? আয়নাটা বড় ছোট। পুরোটা দেখতে পাচ্ছে না ভাল করে। কোথায় গেলে পাবে? ঠিক। পদ্মদীঘির জলে। সেখানেই দেখবে সে নিজেকে। বিদ্যুৎ এর আলোয়। পুরোটা। এক সঙ্গে। এক্ষুনি।
হুঁড়কো খুলে নিঃসাড়ে বেরিয়ে আসে পৃথা। তারপরে সেই পাগলিনী নগ্নিকা ছুটতে ছুটতে হাজির হয় ঘাটে। জলে তখন খই ফুটছে। আকাশ চমকাচ্ছে ঘন ঘন। সব তো ঝাপসা। দেখতে পাচ্ছে কই। আস্তে আস্তে বুক জলে নামে পৃথা। তাও তো দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু তাকে আজ জানতেই হবে, কেমন দেখতে তাকে। আকুলি বিকুলি করে খুঁজতে থাকে পৃথা।
:- কালু, কালু, একবার আয়। একবার আমাকে দেখে বল, আমায় কেমন দেখতে।
ভুস করে ভেসে ওঠে কালু। তারপর গোল হয়ে তাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে।
:- তোকে খুব ভাল দেখতে রে পিতু। ঠিক মাছের মত। আমাকে বিয়ে করবি? সেই কোন ছোটবেলা থেকে তোকে পাগলের মত ভালবাসি। তুই মাছ হয়ে যা, তুই মাছ হয়ে যা পিতু।
বলতে বলতে কালু তার ভ্যাটকা মত ঠোঁটে ঠোকরাতে থাকে পৃথার বুক, পেট, নাভি, যোনী। আবেশে থরথর করে কেঁপে ওঠে পৃথা। একটু একটু করে তার চুল খসে যায়, খসে যায় চোখের পল্লব। পাদুটি জুড়ে গিয়ে পাখনা হয়ে যায়। মসৃণ চামড়া ঢেকে যায় আঁশে। তার দীঘল চোখের পাতা দুটি খসে যায়। সব শেষে গোলগোল ড্যাবড্যাবে চোখে চেয়ে, ভ্যাটকা ঠোঁটে বুজকুড়ি তুলে বলে পৃথা,
:- দেখ কালু, আমি মাছ হয়ে গেছি।
:- আয় পিতু, আমরা বাড়ি যাই।
দুজনেই তলিয়ে যায় অতল জলের তলায়। ঝাঁঝির বিছানায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে।
বুলবুলি ঘাটের রানাটা ধরে পা দাপাচ্ছিল জলে। সাঁতার শেখার চেষ্টা করছিল একা একা। গরমের দুপুর। কেউ কোত্থাও নেই। এই সুযোগ। হঠাৎ তার গায়ে দু দিক থেকে ধাক্কা মারল কেউ। খুব চমকে গেছিল প্রথমটা। তারপর দেখে সেই কাৎলা মাছ দুটো। ফাঁকা পেলেই খেলে এসে তার সঙ্গে, কথা বলে।
:- কি চাইরে?
:- তোকে খুব পছন্দ আমাদের। আমাদের মেয়ে হবি?