গাড়িতে কাঁটা
কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়28/10/20
বছর পনের আগের ঘটনা। আমার আত্মজা ছোট থেকেই এলার্জেটিক শ্বাসকষ্টের ক্রনিক পেশেন্ট। মাঝে মাঝেই ডাক্তার পাল্টে হোমিওপ্যাথি, এলোপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক নানা বিকল্প পদ্ধতির চিকিৎসা ব্যবস্থার ডা…
গাড়িতে কাঁটা
কলমে #পম্পা বন্দ্যোপাধ্যায়
28/10/20
বছর পনের আগের ঘটনা। আমার আত্মজা ছোট থেকেই এলার্জেটিক শ্বাসকষ্টের ক্রনিক পেশেন্ট। মাঝে মাঝেই ডাক্তার পাল্টে হোমিওপ্যাথি, এলোপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক নানা বিকল্প পদ্ধতির চিকিৎসা ব্যবস্থার ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খাওয়ানো হত তখন, যদি ওর একটু শ্বাসের সুরাহা করা যায়। একবার টানা এগারোদিন সারাদিন সারারাত জেগে বসে কেশেছিল, একদম আধমরা হয়ে গেছিল সেবারে। কোথায় কোথায় যে গেছি আমরা ওর এই অসুস্থতার জন্য, সে আর কি বলব। তার মধ্যে প্রত্যেকবার যে ডাক্তার দেখত, এলার্জি টেস্ট করে একটা লিস্ট করে দিত যে কি কি ও খেতে পারবে না। ওকে সেগুলো মানাতে গিয়ে বাড়িতেও সেগুলো ঢুকত না, সে তার বড়ো ফিরিস্তি, পোনা মাছ, চিংড়ি মাছ, বেগুন, ডিম, পালং শাক, মুসুর ডাল, কাবলি ছোলা, ময়দা, ইলিশ মাছ ইত্যাদি আরো জিনিস বন্ধ ছিল।
সেবারে আয়ুর্বেদিক ডাক্তার দেখানো হল, তিনি একগাদা ওষুধ দিলেন, যেখানে ওষুধগুলো পাওয়া যাবে সেটাও বলে দিলেন। সেই জায়গাটা এজরা স্ট্রিটের একটা দোকান যেটা পোদ্দার কোর্টের কাছে। সময়টা অগাস্টের শেষের দিকে, পুজোর কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে তখন।
এদিকে কর্তামশাইয়ের বেহালা থেকে সল্টলেকের অফিসে যাতায়াত করতে হয় বলে মোটামুটি সারাদিনের ছ'ঘন্টা তাঁর বাস জার্ণিতেই কেটে যায়, সে যেতে পারবে না বলে হাত তুলে দিল। আমিও তখন অফিস করি পার্ক স্ট্রিটের কাছে, আমিই দায়িত্ব নিলাম বাড়ির গাড়িতে সারথি সমেত ' যাবো' বলে। আমি কিন্তু পোদ্দার কোর্ট জায়গাটা তখন একদমই চিনি না।
যাই হোক, সাড়ে পাঁচটায় অফিসের পরে গাড়ি নিয়ে চললাম পোদ্দার কোর্টের দিকে, আমার সারথিটি, যার নাম রাম, একটি অল্পবয়সী ছেলে। কিছুদূর গিয়ে গোলদীঘির পাশ দিয়ে গিয়ে গাড়ি লালবাজারের দিকে চলল। ওইখানে বারদুয়েক গোল গোল ঘুরে একই জায়গায় ফেরত আসার পরে পুলিশকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল যে এজরা স্ট্রিটে গাড়ি যাবে না, আমাকে গাড়ি পোদ্দার কোর্টের কাছে রেখে হেঁটে গিয়ে এজরা স্ট্রিটে বেশ ভেতরে ওই দোকান থেকে ওষুধগুলো নিতে হবে। রামকে বললাম, "তুমি দেখেশুনে পার্কিংয়ের জায়গায় গাড়িটা রাখো, আমি আসছি"।
রাস্তায় নেমে দেখি সেটা ওই জায়গার ক্রসিং, বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসগুলো চলেছে, ওয়াকিটকি নিয়ে ট্রাফিক পুলিশ সমানে কথা বলছে আর যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করে এজরা স্ট্রিটের দিকে হাঁটা লাগালাম। সেই ওষুধের দোকান একটা বড়ো বাড়ির ভেতরে ঢুকে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ছাদের ওপরে উঠে ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে বাড়িটার আরেকটা অংশে নেমে বেশ অনেকটা গিয়ে একটা বড়ো বারান্দার শেষ প্রান্তে। সমস্ত জায়গাটা অবাঙালি অধ্যুষিত। আমি গুটি গুটি হেঁটে খুঁজতে খুঁজতে সেই বাড়িটার গেটে ঢুকব হঠাৎ শুনি "একি বৌদি, আপনি এখানে!" বলে কেউ ডাকল, দেখি ঠিক গেটের মুখে একটা বড়ো ইলেকট্রিকাল এপ্লায়েন্সের দোকান থেকে আমাকে ডাকছে, আমাদের পাড়ার ঠিক আমাদের পাশের বাড়ি ও ইলেক্ট্রিকের দোকানের প্রতিবেশী দুই ভাই, ওদের মূল দোকান আর আরো দুটো দোকান আছে ওই বাড়িটাতেই। ওরা আমাকে বসতে বলল ওদের দোকানে, তারপরে ওষুধের দোকানের কথা শুনে ওরাই আমাকে দোকানটার ঠিকঠাক জায়গাটা বলে দিল।
সেই মত অপরিসর অন্ধকার কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে সেই ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে বারান্দা পেরিয়ে দোকানে ঢুকলাম, ওষুধগুলো কিনছি এমন সময় রামের ফোন, "দিদি, শিগগির আসুন, পুলিশ আমাদের গাড়িতে কাঁটা দিয়েছে"। আমি বললাম, "কেন?" রাম বলল, "গাড়ি পোদ্দার কোর্টের দোকানগুলোর সামনে রেখেছি এমন সময় ট্রাফিক সার্জেন্ট এসে আমার লাইসেন্স দেখতে চাইল, আমি ভুল করে লাইসেন্সটা বাড়িতে ফেলে এসেছি আজকে, দেখাতে পারিনি, তারপর গাড়ির ব্লু বুক দেখতে চাইল, সেটা তো দাদা গাড়িতেই রাখেন, সেটা দেখালাম, তারপরে গাড়ির চাবিটা নিয়ে গাড়িতে কাঁটা দিয়ে দিয়েছে "। আমার একদম জলে পড়ার মত মনে হল। বললাম, "তুমি গাড়ির কাছে থাক, আমি আসছি "। দোকানে যিনি ওষুধ দিচ্ছিলেন তিনি জানতে চাইলেন "কি হয়েছে দিদি", বললাম, তিনি বললেন, "এ হে, একদম কাঁচা কাজ হয়ে গেছে, পুজোর মুখে কেউ এ ভুল করে? ওদের পুজোর বাজারে এবারে আপনার অনুদান যোগ হয়ে গেল "। মনে মনে তো প্রমাদ গুনলাম। এমন একটা বিষয় যেটা আমার এক্তিয়ারেই নেই।
ওষুধ কিনে বেরোনোর মুখে ওই এলাকায় হয়ে গেল লোডশেডিং, হাতড়ে হাতড়ে নিচে নেমে প্রায় দৌড়ে দৌড়ে যখন গাড়ির কাছে পৌঁছলাম তখন সাতটা। দেখলাম একটা তিনকোণা লোহার যন্ত্র গাড়ির সামনের চাকায় ঢোকানো। সেই সার্জেন্টের সাথে গিয়ে কথা বললাম, তিনি বললেন, "বিনা লাইসেন্সের কারুর হাতে গাড়ি ছাড়ব না, আপনার হাসব্যান্ডকে বলুন তাঁর লাইসেন্স নিয়ে এসে গাড়ি নিয়ে যাক "।আমি তাঁকে আমাদের ভীষণ অন্যায় হয়েছে,ভবিষ্যতে আর কখনো হবে না, বাড়িতে ছোট বাচ্ছা একা রয়েছে ইত্যাদি অনেক কিছু বলে অনুনয় বিনয় করলাম, ভদ্রলোক অনড়, শেষে নিরুপায় আমি অগত্যা কর্তাকে ফোন করলাম, সে জানাল অন্তত ঘন্টা খানেক তো লাগবেই পৌঁছতে, সেই সময়টা আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।
আমি রামকে গাড়ির কাছে রেখে সেই সার্জেন্ট যেখানে ট্রাফিক সামলাচ্ছেন ক্রসিংয়ের মুখে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। একটু পরে সচকিত হয়ে খেয়াল করলাম যত গাড়ি যাচ্ছে, বাস যাচ্ছে ওই মোড় পেরিয়ে সবাই একবার করে আমাকে আর একবার ওই সার্জেন্টকে আপাদমস্তক দেখে চলে যাচ্ছে, ভদ্রলোকও ক্রমে সেটা লক্ষ্য করলেন, আমায় বললেন, "আপনি গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ান "। আমি ভ্রুক্ষেপ মাত্র না করে ওখানে ওঁর পাশেই দাঁড়িয়ে রইলাম।
যখন সাড়ে সাতটা বাজে হঠাৎ দেখি ভদ্রলোক ইশারায় ওঁর সঙ্গে আসতে বলে গাড়ির দিকে যাচ্ছেন, আমি ওঁর সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। উনি গাড়ির কাছে এসে আমার হাতে গাড়ির চাবিটা দিলেন, রামকে আরেক প্রস্থ বকলেন, তারপরে আমায় বললেন, "যান, চলে যান বাড়িতে, আর যেন এরকম না হয়, সবসময় চেক করে নেবেন গাড়িতে ওঠার আগে যে চালাচ্ছে তার লাইসেন্স সঙ্গে আছে কিনা, আপনার অসহায়তা দেখে ছেড়ে দিচ্ছি "। আমি তো তাঁকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়ে রামকে বললাম, "আগে এই চত্বর ছেড়ে চল "।
তারপরে কর্তাকে ফোন করলাম, সে তখন থিয়েটার রোডের কাছে, আমাকে বলল প্লানেটোরিয়ামের সামনে দাঁড়াতে। ওকে ওখান থেকে তুলতে প্রথমে জিজ্ঞেস করল, "কত দিতে হল "? আমি বলার আগে রাম উত্তরটা দিল, "একটা টাকাও না, দিদি ওই মোড়ের মাথায় গিয়ে এমন ভাবে কাঁদো কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল আর যেতে আসতে সবাই এমন করে দেখতে লাগল যে পুলিশটা একদম নিজের সম্মান বাঁচাতে গাড়িটা ছেড়ে দিল দাদা। আমাদের আগের, পরের দুটো গাড়িকে দুহাজার টাকার ফাইন আদায় করে তবে ছেড়েছে দাদা, আমার সামনে "। আমি ওকে ধমক লাগালাম, "আর তুমি যে বাড়িতে লাইসেন্স রেখে রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলে, সেটা বুঝি খুব মহৎ কাজ হয়েছে”? দেখি কত্তামশাই হা হা করে হাসছেন।