শিরোনাম —সমুখে শান্তি পারাবার লেখা —দোলা ভট্টাচার্য তারিখ - 18.11.2020
মানুষের জীবনের ঘটনা অনেক সময় গল্পকথাকেও হার মানিয়ে যায়। সেরকমই একটা ঘটনার কথা বলছি আজ। আমার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে প্রথম দেখি বাসবীদিকে। গায়ের রংটা বেশ …
শিরোনাম —সমুখে শান্তি পারাবার
লেখা —দোলা ভট্টাচার্য
তারিখ - 18.11.2020
মানুষের জীবনের ঘটনা অনেক সময় গল্পকথাকেও হার মানিয়ে যায়। সেরকমই একটা ঘটনার কথা বলছি আজ। আমার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে প্রথম দেখি বাসবীদিকে। গায়ের রংটা বেশ কালো। সিঁথিতে সিঁদুর, হাতে শাঁখা নোয়া ।কালো হলেও মুখশ্রী কিন্তু খারাপ নয়। তবে একেবারেই নিরক্ষর। ঘড়ি টা পর্যন্ত দেখতে জানে না। বাসবী দি আমাদের প্রতিবেশী। নিজের বাপেরবাড়ি তে আশ্রিতা।
আমার শ্বাশুড়ির কাছে শুনেছিলাম, বাসবীদির বিয়ে হয়েছিল যার সাথে, সে নাকি খুব ভালো চাকরি করে। রেলের বুকিং ক্লার্ক। আমি অবাক। তাহলে? বাসবীদির এই অবস্থা কেন? কোথায় ওর বর! নিয়ে যায় না কেন নিজের কাছে! শ্বাশুড়ির কাছে পুরো ঘটনার কথা শুনে আমি স্তম্ভিত।
তখনকার প্রথা অনুযায়ী পাত্র - পাত্রীর দেখা হত একেবারে বিয়ের মন্ডপে। সেই রীতি মেনেই বাসবীদিকে বিয়ে করতে আসে তার বর অভয় । কিন্তু নতুন বৌ কে দেখে একেবারেই পছন্দ হয়নি অভয়ের । কিন্তু নতুন বৌ এর ছোট বোনটিকে বেশ মনে ধরে যায়। ছোট বোন সুবালা, সেও লেখাপড়া কিছুই জানে না, তবে ভারি চটপটে এবং ছটফটে। দেখতে বাসবীদির মতই। গায়ের রংটা শুধু একটু কটা। বাসবীদি খুব শান্ত স্বভাবের। আর সুবালা ছিল ছেনালপনায় ওস্তাদ। ব্যাস, বর মশাই তাতেই কাৎ। চিটে গুড়ে পিঁপড়ের মতো আটকে গেলেন। বিয়েটা বাসবীদির হলো ঠিকই, কিন্তু তার স্বামী তাকে গ্রহণ করল না। নিজের স্ত্রী র সঙ্গ থেকে শালীর সঙ্গ সেই মানুষটার কাছে বেশি প্রিয় যে। বাসবীদির শ্বশুরবাড়ির লোকজন কিন্তু বাসবীদিকেই পছন্দ করতেন, সুবালাকে নয়। বাসবীদির শ্বাশুড়ি বার বার বলেছেন, "তোমার বোনকে শাসন কর। বাড়িতে মাকে, দাদাদের জানাও।" নিজের যা হয় হোক, বোনটা যে কষ্ট পাবে, সেই ভেবে বাসবীদি বোনকে কিছুই বলে নি। এমনকি বাসবীদির বাপেরবাড়ির লোকজন সকলেই জানত বাড়ির ছোট মেয়ের প্রতি বড় জামাইএর দূর্বলতার কথা। প্রচ্ছন্ন ভাবে মদত দিয়ে গেছে তারা। সেটা বুঝতে পেরেই বাসবীদিও চুপ করেই ছিল। তবে অত্যাচার সহ্য করেও শ্বশুরবাড়ির মাটি কামড়ে পড়ে ছিল। প্রথম সন্তান সম্ভাবনায় খুশি হবার বদলে বরমশাই বললেন, "ওই আপদ কিন্তু রাখা যাবে না। ওকে বিদায় করতে হবে।" আসলে বাচ্চা টা থাকলে একটা দায়িত্ব থেকে যাবে। সেটা বহন করতে অভয় অনিচ্ছুক। বাসবীদিও অনড়। "এই বাচ্চা আমি নষ্ট করব না"। সুতরাং অন্য পথ নিতে হয়। কোনো ওষুধ খাইয়ে সেই বাচ্চা নষ্ট করে দেওয়া হয়। বছর ঘুরলে বাসবীদি আবার অন্তঃসত্ত্বা। নিজের স্ত্রীকে পছন্দ না হলেও তার শরীরটাকে কিন্তু যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করতে ছাড়েনি অভয়।
বার বার বলা সত্ত্বেও শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে যাবে না বাসবীদি। মারধর, গালাগালি কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। কোনোভাবেই বাসবীদি কে বাড়ি থেকে তাড়াতে না পেরে আস্তে আস্তে মরিয়া হয়ে উঠছিল অভয়। এবার সে অন্য পন্থা অবলম্বন করল। চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী কে কাছে টেনে আদর করে বলল, "দ্যাখো, এতদিন ধরে যা ভুল করেছি তার আর রিপিট চাই না। যে আসছে তাকে নিয়ে সুস্থ ভাবে বাঁচতে চাই। কাল তোমাকে তোমার বাপেরবাড়ি তে রেখে আসব। বাচ্চা টা ওখানেই হোক। তারপর মা বাচ্চা দুজনকেই নিয়ে আসব"। একটু ভালবাসার ছোঁয়ায় গলে গেল বাসবীদি। শ্বাশুড়িও খুব খুশি। আমার ছেলেটার বোধহয় এবার একটু সুবুদ্ধি হয়েছে।
পরদিন ভোরবেলায় বেরোলো ওরা দুজন। শ্বাশুড়ি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দুগ্গা দুগ্গা বলে রওনা করিয়ে দিলেন ওদের।
ট্রেন থেকে নেমে রেল লাইন ক্রশ করে লোক চলাচলের রাস্তায় পড়লে, সামনেই রিক্সা স্ট্যান্ড। সেদিকেই যাচ্ছিল ওরা। কিন্তু যাওয়া হলো না। রেললাইন পেরোতে গিয়েই ঘটনাটা ঘটে গেল। প্রচন্ড এক ধাক্কায় রেললাইনের ওপর ছিটকে পড়ল বাসবীদি। তীব্র যন্ত্রণায় জ্ঞান হারানোর আগে বাসবীদি অবাক হয়ে তাকাল অভয়ের দিকে। তার মুখে তখন খেলা করছে ক্রুর হাসির পৈশাচিক উল্লাস।
নার্সিংহোমে যমে মানুষে টানাটানি চলছে যখন বাসবীদি কে নিয়ে, ঠিক সেই সময়ে কালীঘাটের মন্দিরে বিয়ে হচ্ছে অভয় আর সুবালার। সেই থেকেই বাসবীদি বাপেরবাড়িতেই আছে। সুস্থ হয়ে একবার দেখা করতে চেয়েছিল সুবালা আর অভয়ের সাথে। অভয়ের পৈতৃক বাড়ি তে ঠাঁই হয়নি সুবালার। তাঁরা এই বিয়েটাকে মর্যাদা দিতে পারেন নি। বাসবীদিকেও দেখা করতে দেয় নি ওদের সাথে, বাসবীদির মা। বলেছিলেন, "নিজে তো সংসারটাকে ধরে রাখতে পারলি না। এখন ছোট বোনটাকে একটু শান্তি তে থিতু হতে দে" ।
পাড়া প্রতিবেশীরা প্রশ্ন করে বাসবীদির মাকে, "এটা কি করলে গো পাল গিন্নী! মেয়েটার এবার কি হবে ? জামাই কে কিছু বলতে পারলে না!এক বৌ বর্তমান থাকতে আর একটা বিয়ে করে নিল। এটা তো বেআইনি। "
" কি করব বলো? হতভাগীর কপালে যা আছে, সেটাই হয়েছে। জামাই এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলে সুবালাকেও যদি বাপেরবাড়ি তে তুলে দিয়ে যায়, তাহলে কি হবে। তার থেকে ও থাক আমাদের কাছে। আমরাই ওকে দেখেশুনে রাখব"।প্রতিবেশী গিন্নী অবাক।" তা বললে কি চলে! ওকে তাহলে কাজকর্ম কিছু শিখতে হবে, নিজের পেটের ভাত টা যাতে যোগাড় করে নিতে পারে "।
" তা কেন! মাথার ওপর বড় দাদারা থাকতে ওর ভাতের অভাব হতে যাবে কোন দুঃখে। কোনো কাজ করতে হবে না আমার মেয়েকে "।
আমার বড় জা একবার চেষ্টা করেছিলেন, বাসবীদি কে যদি ডিভোর্স টা পাইয়ে দেওয়া যায়। তাতে দুটো টাকা হাতে আসে মানুষটার। বাসবীদির বাপেরবাড়ির লোকজন এসে শাসিয়ে গিয়েছিল বড় জা কে," আমাদের বাড়ির মেয়ে, আমরা তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব। এসব হঠকারিতার সিদ্ধান্ত তুমি নিতে পার না। সুবালার সংসার টা যদি ভেঙে যায় এতে! কি হবে বুঝতে পারছো তুমি ? একজনের জায়গায় দুজনে এসে আমাদের ঘাড়ে পড়বে।"
আশ্রিতা হয়ে বেঁচে থাকার জ্বালা হাড়ে হাড়ে টের পায় বাসবীদি। মা চোখ বোজার পর অশান্তি আরো চরমে ওঠে। ভাইদের বৌরা দুবেলা দু মুঠো ভাত দিয়েও খোঁটা দেয়। বাড়ির বাথরুম তাকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। কারণ, সে নাকি বাথরুম নোংরা করে রাখে। তার নোংরা কোন বৌটা পরিস্কার করবে! ভোর চারটে তে উঠে রাস্তার ড্রেনে তাকে প্রাতকৃত্য সারতে হয়। হা ভগবান! আপন বাপেরবাড