Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

সৃষ্টি সাহিত্য যাপন।
#গল্প_ চলি'রে। ভাল থাকিস।#By_ সমীরন রায়।
আজ আমার গন্তব্য কাশ্মীরের শ্রীনগর। কিন্তু পিঠে একটা মস্তবড় ব্যাগ নিয়ে প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে ছুটে এসেও ট্রেনটা ফস্কালো। পরের ট্রেন পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর। মার্…

 


সৃষ্টি সাহিত্য যাপন।


#গল্প_ চলি'রে। ভাল থাকিস।

#By_ সমীরন রায়।


আজ আমার গন্তব্য কাশ্মীরের শ্রীনগর। কিন্তু পিঠে একটা মস্তবড় ব্যাগ নিয়ে প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে ছুটে এসেও ট্রেনটা ফস্কালো। পরের ট্রেন পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর। মার্চের অল্পচড়া রোদে 'তারকেশ্বর' লেখা প্লাটফর্মের বোর্ডের তলায় দাঁড়িয়ে মনেএলো দু'বছর আগের সেই দিনটা। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে, সেদিনও ঠিক এখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর "ক্লাস ফোর থেকে ভালোলাগা ও ক্লাস ইলেভেনে একই ক্লাসে আবার দেখা হওয়া"  - মেয়েটা দাঁড়িয়ে ছিল ওইখানে, একদম আমার মুখমুখি।

অনেক কিছু বলেছিল ও। আসলে, প্রেম নিবেদনের শুরুতেই যদি অন্যপক্ষের অসম্মতি সূচক 'না' শব্দগুলো যেমন, " তুই বুঝতে পারছিসনা.....এটা সম্ভব না.....এটা হয়না.....চলি'রে.....ভালো থাকিস"  ..... এগুলো যদি একবার কানে ঢুকে যায়, তবে অন্য শব্দগুলো কানে না ঢুকে কানের পাশ দিয়ে বাউন্সারের মতো দ্রুত পাশ হয়েযায়। শুধু ওই টুকরো শব্দগুলো কানদিয়ে ঢুকে একদম মনের মধ্যে জবর দখল করে বসে। অনেক চেষ্টা করেছি তাড়ানোর। পারিনি। এখন ওই শব্দগুলোই আমাকে তাড়িয়ে এলাকা ছাড়া করে ছাড়ছে সুদূর কাশ্মীরে। ভারতের শেষ সীমানায়।


-------------------- বাইশ বছর পর--------------------


এখন আমি একজন সফল বিজ্নেস ম্যান। কাশ্মীর আমায় ফেরায়নি। এখানের শ্বেত-শুভ্র তুষারের মাঝে লুকিয়ে থাকা ভাগ্যদেবী আমায় বঞ্চিত করেনি, নিজের আশীর্বাদের ঝাঁপিটা ঢেলে দিয়েছেন আমার ভাগ্যে। শ্রীনগর, কাটরা, সোনমার্গ, কার্গিল ও লে্হ ... মোট ছ'টা হোটেল। এছাড়া অমৃতস্বরে একটি ও দিল্লীতে একটি হোটেলের মালিক আমি। কাল আবার তিনদিনের জন্য দিল্লীতে যাবো। আরো একটা হোটেল ফাইনাল করতে।


তিনদিন পর সকাল আটটায় ফিরলাম শ্রীনগরে আমার প্রথম 'হোটেল কাম অফিস'-টায়। গেটদিয়ে ঢোকার সময় দেখলাম একটা গ্রুপ চেক্ আউট্ করছে। একঝলক দেখে মনেহল বাঙালি গ্রুপ।

সোজা ঢুকলাম আমার কেবিনে। একবার রেজি্স্টার আর অন্য এন্ট্রি বুক গুলোয় চোখ বুলিয়ে নিলাম। না, শ্রীনগরের সব ঠিক আছে। বাকি জায়গা গুলোর খোঁজ নেওয়ার জন্য ফোনটা টেনে নিলাম। যদিও আমার সব হোটেলের সব কম্পিউটার জুড়ে আছে আমার ফোনে। আমি প্রত্যেক হোটেলের প্রতি মুহূর্তের হিসাব-নিকাশ যেকোন স্থানে বসে নজর রাখতে পারি।

মোবাইলটা দু'বার রিং হতেই হাতের ঘড়িটা দেখলাম। ঠিক দুপুর এক'টা, অথাৎ মায়ের ফোন। দশবছর আগে বাড়িতে ল্যান্ড ফোন নিয়ে ছিলাম। মা এই দশ বছর দুপুর এক'টায় ফোন করে। খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়। আরো অনেক কিছু বলে। তার মধ্যে রোজ শুনে মুখস্ত হয়ে যাওয়া কিছু কথা যেমন --- "সময়ে খাসনা বলে রোগা হয়ে যাচ্ছিস........বিয়েটাও করলিনা.......আমি চোখ বুজলে কে দেখবে....... কবে বাড়ি আসবি.....।।।।".        সামনের মাসে যাবার চেষ্টা করব বলে বিদায় চেয়ে ফোনটা একেবারে বন্ধ করেদিলাম। দিল্লির নতুন ডি্ড-টা নিয়ে বসলাম।


দুপুর দু'টোর সময় রিসে্পশন থেকে ভায়া হয়ে ফোনটা এল। ওপ্রান্তে দাদা। দাদা বললো " তোর ফোনের সুইচ্ অফ। দুলাল তো আমাদের এজেন্সিতে গেছে কাশ্মীর। ওদের লাদা্খ ট্যুর আছে। আজই শ্রীনগর থাকে সোনমার্গ গেছে। ওদের একটা প্রবলেম হয়েছে। একটু ম্যানেজ করে দে।

-- ঠিক আছে,আমি দেখছি বলে ফোনটা রেখে দিলাম। নিজের ফোনটা অন্ করে সোনমার্গে ফোন করলাম। যেটা জানলাম তার সারমর্ম এই--- লাদা্খের যে গ্রুপ টা আজ শ্রীনগরের এই হোটেল থেকে গেছে ওখানে, তারা হোটেলে ই্ন করার পর  'জিরো-পয়েন্ট' গিয়েছিল লোকাল স্ট্যান্ডের গাড়িতে। সেখানে বরফে পা স্লিপকরে একজনের পা ভেঙেছে। তার পা'য়ে এখন প্লাস্টার।-- হোটেলে থাকলে আমার সাথে কথা বলাও। বললাম আমি।

-- ওকে স্যার।

লাইনটা ধরেই ছিলাম। কিছুক্ষন পর ম্যানেজারের গলা পেলাম..... 'দুলাল বাবু কথা বলুন সমীরন স্যার শ্রীনগর থেকে লাইনে আছেন'

-- হ্যালো। আমি দুলাল বোস । আপনার দাদার বন্ধু। একটু হেল্প করুন। একটু ধরুন, রিয়া কথা বলবে।

-- দিন।

-- নমস্কার দাদা। আমি রিয়া। দীপক দত্তের ওয়া্ইফ। আমার হ্যাজবেন্ডের-ই পা ভেঙেছে। আপনি কি আমাদের একটু আগে রিটার্নের ব্যাবস্থা করে দিতে পারেন ? আসলে ওরা বুঝতে পারছেনা। আমাদের আর ট্যুর করাটা সম্ভব নয়। হ্যালো.......হ্যালো...............

আরো অনেক কিছু বলছিল। কিন্তু আমার বুকের বাঁ'দিকে একটা পুরোনো ব্যাথা আবার জেগে গিয়ে আমার পুরো শরীরটা অবশ করেদিল। কয়েক মিনিট নিজেকে সময় দিয়ে সোনমার্গে জানিয়ে দিলাম " আমি নিজেই যাচ্ছি'


সোনমার্গ পৌঁছে দুলাল বাবুদের সাথে আলোচনায় বসলাম। আমি পরশু বাড়ি যাবো শুনে দীপক বাবুই প্রস্তাব দিলেন যে, ও আর রিয়া ফিরে যাবে আমার সাথে। আর দীপক বাবুর মা,বাবা ও ওর ভাইয়ের ফ্যামিলি এমনকি দীপক বাবুর পনেরো বছরের ছেলেও ট্যুরটা শেষ করবে বাকিদের সঙ্গে। একটু টানাটানির পর এই প্রস্তাবটাই ফাইনাল হল।


বিকেল চার'টেয় কোলকাতায় বিমান নামার আগেই খবরটা পেয়েগেছি যে, বিরোধী দের ডাকা দু'ঘন্টার প্রতীকি 'চাক্কা-বন্ধ' কিভাবে যেন কয়েক শত' দোকান ও গাড়ি পোড়ার ও বেশ কয়েকটি এলাকায় কা্র্ফু-র কারণ হয়েছে। বিশু'ই খবরটা দিয়েছিল। গাড়ি নিয়ে ওরই আসার কথাছিল। আমি বারণ কিরেছি আসতে।


এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখি বিশু দাঁড়িয়ে। বললো, হাওড়া আর হুগলীতে এখনো কিছু জায়গায় কা্র্ফু চলছে। ট্রেনটা চালু হয়েছে দুপুর থেকে। ইমার্জেন্সি স্টিকার সাঁটা কিছু ট্যাক্সি ছিল গেটের কাছে। তারই একটায় বিশু মালপত্র নিয়ে তুলল।


তারকেশ্বর প্লাটফর্মে যখন নামলাম প্রায় সন্ধ্যা। বিশু মালপত্র গুলো প্লাটফর্মের শেষের দিকে আলো জ্বলা এক জায়গায় জড়ো করে দীপক বাবুকে ধরে আস্তে আস্তে প্লাটফর্মের ঠিক বাইরেই গাড়ি রাখার গ্যারেজের দিকে চললো।


আমি রিয়ার মাথার উপরে 'তারকেশ্বর' লেখা বোর্ডটা দেখছিলাম। রংচটা পুরনো বোর্ডটার উপরে আবার নতুন হলুদ-কালো রংকরে 'তারকেশ্বর' লেখাটা প্লাটফর্মের তেরছা আলোয় মনেহয় যেন দাঁত বেরকরে হাসছে। ওই হাসিটাই দেখছিলাম, কানে এল -

-- কি দেখছিস অমন হাঁ করে ? যেন কতদিন দেখিসনি।

-- হ্যাঁ রে অনেক দিন পর। চব্বিশ বছর পর। 

চব্বিশ বছর আগে তুই দাঁড়িয়ে ছিলিস এখানে, ঠিক এখন যেখানে আমি দাঁড়িয়ে। আর আমি ছিলাম এই বোর্ডটার তলায়, ঠিক যেখানে এখন তুই দাঁড়িয়ে আছিস।

-- এই চব্বিশ বছরে তুই অনেক পাল্টে গেছিস। অনেক মোটা হয়েছিস। চোখে চশমা............


হয়তো অনেক কিছুই আরো বলছিল রিয়া। আমার কানে কিছুই ঢুকছিলনা। আমি তখন চব্বিশ বছর আগের পুরনো একটা ছবি দেখছি। তবে এবার দেখছি আয়নায় উল্টো ভাবে।


বিশুকে আসতে দেখলাম। বিশু কাছে এলে আমি বললাম  "এদের ভালভাবে পৌঁছে দিস। তারপর গাড়ি গ্যারেজ করে দিবি। আমার ব্যাগটা নিয়ে যা। আমি একা চলে যাবো" 

রিয়া বললো -- আমাদের বাড়ি চল। মা খুব খুশি হবে।


আমি অনেক কিছুই বলতে চাইছিলাম। কিন্তু কিছুই বলতে পারছিলামনা। তখন আমার ভেতরের সব কথা, সব শব্দগুলো যেন একসাথে বাইরে আসার জন্য নিজেদের মধ্যেই লড়াই করছে।

হটাৎ আমি যেন স্পষ্ট দেখলাম আমার ভিতর থেকে কয়েকটা মাত্র শব্দ সবাইকে ডিঙিয়ে বাইরে এসে বেরিয়ে সোজা গিয়ে পড়লো 'তারকেশ্বর' লেখা বোর্ডটার তলায় দাঁড়ানো মধ্য-চল্লিশের রিয়া দত্তর বুকের বাঁ'দিকটায়।

শব্দগুলো ....."চলি'রে। ভালো থাকিস।