Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#বনলতার_চিঠি#সৃষ্টি সাহিত্য যাপন#শম্পা_শম্পি_চক্রবর্তী #বড়_গল্প 
প্রথম
---"টি ভি চ্যানেল গুলোতে সকাল থেকেই একই খবর দেখিয়ে চলেছে দেখেছিস মিলি? ওদের কী সত্যি কোন কাজ নেই । কে একজন বেশ্যা মারা গেছে তাঁকে নিয়ে আলোচনায় বসেছে।সারা দ…

 



#বনলতার_চিঠি

#সৃষ্টি সাহিত্য যাপন

#শম্পা_শম্পি_চক্রবর্তী 

#বড়_গল্প 


প্রথম


---"টি ভি চ্যানেল গুলোতে সকাল থেকেই একই খবর দেখিয়ে চলেছে দেখেছিস মিলি? ওদের কী সত্যি কোন কাজ নেই । কে একজন বেশ্যা মারা গেছে তাঁকে নিয়ে আলোচনায় বসেছে।সারা দেশে আরো কত কী ঘটে চলেছে সে সব খবর রাখে না এই মিডিয়ার লোকগুলো । 

যত্তসব আজেবাজে খবর।"

বালিগঞ্জ গোলপার্ক এলাকায় মস্তবড় আধুনিক ধাঁচের বাড়িটির চারতলার ওপরে বিশালাকার ড্রয়িংরুমের এক প্রান্তে রাখা অত্যাধুনিক সোফা কামবেডের ওপর বসে মিলি একটা ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় মনোযোগ সহকারে কিছু পড়ছিল হঠাত্ সুদেষ্ণার বলে যাওয়া কথাগুলি কানে যেতেই পত্রিকা থেকে চোখ না তুলেই বলে উঠল ---" সবাই কে খারাপ মনে করো কেন মা ? সবাই কী আর নিজে থেকে এই পেশা বেছে নেন? অনেকেই আছেন যাঁরা ভালোবাসার লোকের কাছে ঠকে গিয়ে এই পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন ।"

অনতি দূরেই সাবেকি আমলের চেয়ারটায় বসে টিভির চ্যানেলগুলি একের পর এক পরিবর্তন করতে থাকে সুদেষ্ণা । কোন একটি খবর যদি দু তিনটি চ্যানেলে ক্রমাগত সম্প্রচার হতে থাকে তখনি সুদেষ্ণার মাথাটা গরম হয়ে যায় তা মিলির অজানা নয়। তবে এর পিছনে আসল কারণটা কিন্তু অন্য। সেটি বাবার গত চারমাস ধরে রোজ রাত করে বাড়ি ফেরা এবং তাতেই মায়ের মাথা গরম হতে শুরু করে দ্রুত । এবং সব রাগ সেই মুহূর্তে গিয়ে পড়ে টিভি চ্যানেলে প্রদর্শিত একঘেয়ে খবরা খবরের ওপর যদি মা সেই সময় টিভি দেখে। নয়তো তাঁর ওপর বা বাড়ির সব সময়ের কাজের লোক লক্ষণদার ওপর। 

--" আচ্ছা মা তোমার এতো বিরক্তি কিসের ? তুমি বরং হিন্দি চ্যানেলগুলো দেখ না। আজ একজন বেশ্যা মারা গেল কী কাল কোন শিল্পী মারা গেল তাঁকে নিয়ে যদি বাংলা চ্যানেল গুলোয় আলোচনা হয় তা হোক্ না। তুমি অন্য কিছু দেখো। পুনরায় ইংরেজি পত্রিকা থেকে মাথা না তুলেই কথাগুলি মিলি বলে উঠতেই সুদেষ্ণা ঘটাং করে রিমোর্টের বোতামে চাপ দিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিল। তারপর বেশ আক্ষেপর সুরে বলে উঠল--

---" বিশ্বাস কর আমার আর এই মিথ্যে দিয়ে গড়া সংসার করতে ভালো লাগে না মিলি। তোর বাবা দিনের পর দিন আমাকে ঠকিয়ে যাচ্ছে তা কী আমি বুঝি না? এই চার মাস কী তাঁর বেশি সময় ধরে প্রত্যেক দিন রাত করে বাড়ি ফিরছে তাঁর কারণ কী আমি বুঝি না? ওই বনলতা নামে মহিলাটির পাল্লায় পড়েছে বলে । আসলে ওসব মহিলা ওরাও তো এক প্রকারের বেশ্যা । অতো বড় ডাক্তার কে ফুসলিয়ে অর্থ উপার্জন করাই তো ওদের কাজ।"

--" কী হয়েছে মা তোমার? এতো আজেবাজে বকছো? আর যে মহিলা সম্পর্কে তুমি কিছুই জান না তাঁকে এভাবে একটা নামের আখ্যা দিতে তুমি কখনোই পারো না মা।" পত্রিকাটি সশব্দে বন্ধ করে স্টাডি টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে কথাগুলি বলে ওঠে মিলি। 

---" কী আবার হবে ? রাত নটা বাজলো এখনো তোর বাবা হসপিটাল থেকে ফিরলো না সে খেয়াল আছে তোর? আজ তো বলেছিল ওর কোন ওটি (অপারেশন থিয়েটার) নেই তবে কিসের জন্য দেরি এতো ? আমি কী কিছুই বুঝি না? তোর বাবা মনে করে কী? আসলে তো ওই বনলতা। ও ই তোর বাবার মাথাটা চিবিয়ে খাচ্ছে। আমার জীবন থেকে তোর বাবাকে কেড়ে নেবে রে ওই সর্বনাশী বনলতা"। সুদেষ্ণার কন্ঠস্বরে তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে ব্যাকুলতা ফুটে উঠল।

মায়ের এই বাবাকে বনলতা নামে এক মহিলার নাম কে কেন্দ্র করে সন্দেহ করার ব্যাপারেটা আজ কিছুদিন যাবত কিছুতেই সমর্থন করতে পারে না মিলি। যখনই কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হোক না কেন শেষ পর্যন্ত বনলতা নামটা মা টেনে আনবেই। বাইশ বছরের ঝকঝকে, স্মার্ট, সুন্দরী সৌগত আর সুদেষ্ণার একমাত্র মেয়ে মিলি এতে যারপরনাই বিরক্তও হয় । সেও যে বাবা আর মায়ের মাঝে বনলতা নামটা সহ্য করতে পারেনা তা সে সুদেষ্ণা কে বুঝিয়েও বোঝাতে পারেনা। 

মিলি সোফা থেকে দ্রুত উঠে পরে। 

তারপর সুদেষ্ণার দিকে এগিয়ে যায় । সুদেষ্ণার গলাটা ভালো করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে ওঠে-

---" মা তুমি মিছিমিছি বাবাকে সন্দেহ করো । বাবা অতো বড় একজন ডাক্তার সর্বোপরি ভালো মানুষ। । সে কখনো এমন কোন কাজ করবে না যাতে তোমার সম্মান ক্ষুন্ন হয় । মা তুমি তোমার মনকে তা জিজ্ঞেস করে দেখ তো। বাবাকে তুমি উঠতে বসতে বনলতা নামটা নিয়ে কতো খোঁচা দাও বা দিয়ে যাচ্ছ প্রত্যহ তাতেও তো বাবা কোন প্রতিবাদ করেনি। নীরবে শুনে যায় তোমার অকথ্য গালিগালাজ । আচ্ছা মা তুমি ছাড়া আদৌ কারো উপস্থিতি বাবার জীবনে পূর্বে ঘটেছিল তাঁর কী কোন প্রমাণ তুমি কখনো পেয়েছ? শুধু সন্দেহের বশে বাবাকে কথার পর কথার আঘাতে জর্জরিত করে চলেছ প্রতিদিন । তা কী ঠিক হচ্ছে? আমি আমার বাবাকে বিশ্বাস করি মা। বাবা কখনো কোন অন্যায় কাজ করতে পারে না।"

সুদেষ্ণা ভালো করেই জানে কোন সময়ে মিলি তাঁর বাবার নিন্দা সহ্য করতে পারে না । 

তাই কথা আর বাড়ায় না শুধু স্মিত হাসি হেসে বলে ওঠে --" তুই তোর ঘরে যা মিলি । 

আমাকে একটু একা থাকতে দে।"

মিলি সুদেষ্ণার গালে টপ করে একটা চুমু খেয়ে নেয় ।তারপর বলে ওঠে--

--" আমার লক্ষ্মী মা তুমি বাবাকে ভুল বুঝো না ।" মিলির মুখে পুনরায় একই কথা শুনে সুদেষ্ণার মুখটা অদ্ভুত রকমের কঠিন হয়ে উঠলো।মিলি হয়তো আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তাঁর আগেই কঠোর কন্ঠস্বরে সুদেষ্ণা বলে ওঠে--

--" তুমি নিজের ঘরে যাও। এই একটা টাইম আমাকে একটু একা থাকতে দাও। আর তোমার বাবা কী রকম মানুষ ? সে সম্পর্কে তোমার থেকে জানার কোন প্রয়োজন নেই আমার । জেনে রাখো বনলতা আছে এবং তাঁর জন্যই তোমার বাবা রাত করে রোজ বাড়ি ফেরেন ।"

মিলি আর কথা বাড়ানোর চেষ্টা করলো না। কারণ তাতে লাভ ও নেই। মা নিজের চিন্তা ধারাতে সব সময়ই অটল। তা সে যত ভুল চিন্তাধারাই হোক না কেন? মায়ের কঠিন মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে নিজের ঘরে দিকে চলে গেল মিলি।,,,,,,,

বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেছে।

মিলি দক্ষিণ দেওয়ালে আটকানো পুরনো আমলের দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালো।

রাত প্রায় সাড়ে বারোটা । পাশের ঘর থেকে টিভির তারস্বরে শব্দ ভেসে আসছে। মিলির বুঝতে অসুবিধা হয় না মা এখন আর নিজের মধ্যে থাকবেনা। বাবার উদ্দেশ্যে বনলতা নামে অজানা অচেনা মহিলাটিকে জড়িয়ে অকথ্য গালিগালাজ করতেই থাকবে । অবশ্য মা কে এ ব্যাপারে পুরোপুরি দোষও দেওয়া যায় না তা মিলি বোঝে? কারণ আর কিছুই নয় হঠাত্ একদিন বাবার অ্যাটাচির কাগজপত্র গোছ করতে গিয়ে পাওয়া একটি পনেরো ষোলো বছরের কিশোরীর ছবি তাতে লেখা মেয়েটির নাম বনলতা দেখে ফেলে মা। তারপর বাবাকে কতবার জিজ্ঞেস করেছে ছবিটি সম্পর্কে --"বনলতা কে? তাঁর কিশোরী বয়সের ছবি কেন তোমার অ্যাটাচিতে থাকে সৌগত? কেন বলতে চাইছনা ওই মেয়েটির সঙ্গে তোমার বর্তমানে কোন সম্পর্ক হয়েছে কী না?" কিন্তু এর একটিরও উত্তর দেয়নি বাবা মা কে। তারজন্য কী কম অশান্তি ভোগ করতে হয়েছে বা হয় বাবাকে ? কিন্তু তাঁর প্রতিবাদ কোনদিনই করেনি বাবা। বরং কোন না কোন কথার ছলে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাবার চেষ্টা করে চলে। তাতে সমস্যার সমাধান তো হয় না বেড়ে চলে বাবা আর মায়ের সম্পর্কের দূরত্ব ---"কিন্তু কেন কেন বাবা মা কে জানাতে চায় না বনলতার পরিচয় । যদি সত্যিই বনলতা বলে বাবার জীবনে কেউ পূর্বে এসেও থাকে হঠাত্ যদি তাঁর সঙ্গে এতোবছর বাদে নতুন করে কোন যোগাযোগ বাবার হয়েই থাকে কোন ভাবে তাতে কী? সেখানে মা কে অকপটে সব জানিয়ে দেওয়াই তো বাবার ক্ষেত্রে বুদ্ধি মানের কাজ। তবে কেন বাবা বলতে চায়না ? তবে কী মায়ের সন্দেহই ঠিক। বাবার রাত করে বাড়ি ফেরা বা সকাল সকাল হাসপাতালে যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে পরা সবটাই বনলতার জন্য ?" ধুর এসব সে কী ভাবছে তাঁর বাবাকে নিয়ে?

বাইরে গাড়ির হর্নের শব্দে চিন্তায় ছেদ পরল মিলির। আন্দাজ করতে অসুবিধা হল না যে বাবা বাড়ি ফিরেছে। দেওয়াল ঘরি সময় ঘোষনা করলো রাত একটা। 

তৎক্ষণাৎ অজানা ভয় মনকে ছুঁয়ে গেল মিলির ---

--" এবার নিশ্চিত বাবার সঙ্গে মায়ের তুমুল ঝগড়া শুরু হবে। বাবার এতো রাত করে বাড়ি ফেরার কারণ বনলতার সঙ্গে সময় কাটানো এবং ফস্টিনষ্টি করা । তা অকথ্য গালিগালাজ করে মা বুঝিয়ে দেবে বাবাকে। আর বাবা নীরব থেকে যাবে প্রত্যেক রাতের মতো আজ রাতেও।"


দ্বিতীয় 


না সে রাতে সৌগত আর সুদেষ্ণার মধ্যে কোন অশান্তি বা ঝগড়া কিছুই হয়নি যা মিলিকে বিচলিত করতে পারে। কারণটা আর কিছুই নয় সৌগত বাড়িতে ঢুকে নিচের তলায় নিজের চেম্বাররুমে সোজা ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। আর সুদেষ্ণা তাই দেখে রাগে গজগজ করতে করতে ড্রয়িংরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সোফাতেই শুয়ে পরেছিল । মিলির এসব দেখে সেই মুহূর্তে আর বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে এবার ডিভোর্সই একমাত্র মা আর বাবার জীবনের সমাধান এনে দেবে। আর সে মেয়ে হয়ে বাবা মায়ের সম্পর্ককে ভেঙে যেতে দেখবে নীরবে।তা কোন ভাবেই জোড়া লাগাতে পারবেনা কারণ তা তাঁর দুঃসাধ্য । কিন্তু তাঁর বাবা আর মায়ের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার জন্য দায়ী কে থাকবে? দায়ী একমাত্র ওই বনলতা নামটা যাঁকে মা কোনদিন দেখা তো দূরে থাক শুধু বাবার অ্যাটাচিতে বনলতার একটা কিশোরী বয়সের ছবি দেখাকে কেন্দ্র করে বাবাকে সন্দেহ করে আসছে দীর্ঘ চার মাস ধরে। মায়ের ধারণা হয়ে গেছে বর্তমানে বনলতা নামে মহিলা যাঁর সঙ্গে বহু বছর আগে বাবার সম্পর্ক ছিল এবং মাঝে সেই সম্পর্ক কোন কারণে না থাকলেও নতুন করে তাঁর সঙ্গে কোন ভাবে বাবার যোগাযোগ হয়েছে এবং আজ ওই বনলতা নামটির জন্যই সৌগত সেন ও সুদেষ্ণা সেনের দীর্ঘ চব্বিশ বছরের বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে বসেছে । সে মেয়ে হয়ে মুখবুঁজে সহ্য করছে। না না কিছুতেই না।

যে করেই হোক বাবা মায়ের সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া থেকে তাঁকে আটকাতে হবে।কাল সকাল হলেই বাবাকে সে নিজে জিজ্ঞেস করবে ---"বাবা বনলতা কে ?তোমার সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক? । রোজ তুমি রাত করে বাড়ি ফেরো তা কী ওনার জন্যই?",,,,,,,,,,,,,

পরের দিন সকাল থাকতেই মিলি সোজাসুজি চলে গিয়েছিল সৌগতর নিচের তলায় চেম্বাররুমে। কিন্তু চেম্বার রুম ফাঁকা। সৌগতকে দেখতে পেল না কোথাও।বৃদ্ধ চাকর লক্ষণ কে ডেকে জিজ্ঞেস করে ""---বাবা কোথায় লক্ষণ দা ?" লক্ষণ তৎক্ষণাৎ বলেে ওঠে --" বাবু তো ভোর থাকতেই শ্মশানে চলে গেছে গো দিদিমণি । কে নাকী মারা গেছে ফোন এসেছিল খুব ভোরে বাবুর হাসপাতাল থেকে। তারপরই নিজে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন। আমাকে যাবার সময় শুধু বলে গেলেন--" তোর মেমসাহেব কে কিছু বলিস না আমি ফিরে এসে তাঁকে সব জানাবো শুধু দিদিমণি যদি আমার কথা জিজ্ঞেস করে তাঁকে বলবি চেম্বাররুমের টেবিলে একটা চিঠি রাখা আছে সেটি পড়ে দেখতে।"

---" বাবা শ্মশানে গেছে? কিন্তু কেন? হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছিল? কিন্তু কোন পেশেন্ট যদি মারাও যায় বাবা কেন শ্মশানে যাবে?" এরূপ নানা প্রশ্ন যখন মিলির মনটাকে অশান্ত করে তুলতে থাকে ঠিক তখনি লক্ষণের বলে যাওয়া আরো একটি কথা মনে পরে গেল । বাবা না কী চেম্বার রুমের টেবিলে একটি চিঠি রেখে গেছে?

যা তাঁকে পড়তেও বলে গেছে?"

মিলির আর তর সইল না। পুনরায় সৌগতর চেম্বার রুমে ঢুকে এগিয়ে যায় কাঠের সুদৃশ্য টেবিলটার দিকে। 


তৃতীয় 


ছোট বয়সে এই ঘরে মিলির ছিল অবাধ বিচরণ । সৌগতর স্টেথোটা নিয়ে ডাক্তার ডাক্তার খেলত এই চেম্বার রুমেরই টেবিলটাতে বসে। আর তাঁর একমাত্র বাধ্য পেশেন্ট ছিল সৌগত। মেয়ের আবদারে কখনো তাঁকে জিভবার করে মরে যেতে হত এই টেবিলটাতেই মাথা রেখে কখনো আবার পেটের যন্ত্রণা হচ্ছে এমনতর অভিনয়ও করতে হত সুযোগ্য পেশেন্ট হিসেবে ।সে সব কথা ভাবলে মিলির আজও খুব হাসি পায়। ধীরে ধীরে টেবিলের ওপর পেপার ওয়েট চাপা দেওয়া দু ভাঁজ করা চিঠিটা হাতে তুলে নিল মিলি। তারপর একটা চেয়ার টেনে বসে চোখের সামনে মেলে ধরল দীর্ঘ চিঠিখানি। যা ছোটদাদা সৌগতকে ছোটবোন বনলতার নিদারুণ কষ্টেমাখা মাস চারেক আগে লেখা চিঠি। গোটা গোটা অক্ষরে পরিচ্ছন্ন হাতের লেখায় লেখা দীর্ঘ সে চিঠি যা পড়তে পড়তে চোখের দুটো কোণ দিয়ে মিলির বেরিয়ে এসেছিল লবণাক্ত ধারা। অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এসেছিল কয়েকটি শব্দ "---- আমায় ক্ষমা করো পিসিমনি। না জেনে না বুঝে ক্ষণিকের জন্য হলেও আমি তোমার আর বাবার সম্পর্কে কালিমা লেপে দিয়েছি----"

পরম পূজনীয় 

ছোড়দা,

আমি তোর আদরের ঘেঁটু, আর সকলের কাছে যে বনলতা। মা লীনা দেবী আর বাবা রমেন সেনের বড়ো আদরের লতা। সেই আমি তোর অভাগী ছোট বোন। হ্যাঁ অভাগীই বলছি এই কারণে সৌভাগ্য তোরা আমার গড়ে দিতে চেয়েছিলিস সুন্দর করে কিন্তু আমি সে সৌভাগ্য গ্রহণ করতে পারিনি। পারিনি ডাক্তার রমেন সেনের আর দুই সন্তানের মতো তাঁর সম্মান রাখতে। তাঁর কারণ আমি যে একজন কে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ভালোবাসা তো কোন অর্থ, প্রতিপত্তি দেখে না । বোঝেনা কিসে সম্মান হানি হতে পারে আর কিসেই বা সম্মান অটুট থাকতে পারে ? ভালোবাসা তো ভালোবাসাই। তাই হয়তো বাবার সম্মান প্রতিপত্তি কোন কিছুরই তোয়াক্কা না করে ভালোবেসে ফেলেছিলাম বাড়ির একান্ত বিশ্বস্ত ড্রাইভার নিরঞ্জনদা কে। যে ছিল আমার চাইতে ষোলো বছরের বড় । তাতে কী ভালোবাসা কী আর বয়স দেখে? তোরা দুই দাদা আর বাবা আমার নিত্যদিন স্কুল আর টিউশনে যাবার সুবিধার্থে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলি। আর পরম বিশ্বাসে নিরঞ্জনদা কে করেছিলি আমার গাড়ির চালক। ভাবতেও পারিসনি একদিন এই নিরঞ্জনের হাত ধরেই আমি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারি। আসলে আমি খুব বোকা খুব বোকা । পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলাম নিরঞ্জনদা কে। কারণ ওর হাবভাব, সুদর্শন চেহারা , ওর মধুর ব্যবহার সব সব কিছু তোদের যেমন আকৃষ্ট করেছিল আমাকেও আকৃষ্ট করেছিল। ওর উপস্থিতি ওর সঙ্গ আমার ষোলো বছরের সদ্য তরুণী শরীরটায় জাগিয়ে তুলত অজানা শিহরণ। হয়তো সেটা ওই বয়সেরই দোষ ছিল। নিরঞ্জনের পরিপক্ক মন তা ঠিক বুঝে ফেলেছিল যে আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। ও সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতেও বেশি দেরি করলো না। আমি যাকে ভালোবাসা ভেবে ভ্রম করেছিলাম ও সেটারই সুযোগ নিল খুব দ্রুত। আমাকে ভালোবাসার অভিনয়ে বেঁধে ফেলল । পরম বিশ্বাসে কত কতদিন তোদের অজান্তেই স্কুল কামাই করে ওর সাথে চলে যেতাম বারাকপুরের গঙ্গার ঘাটে ওর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবো বলে। দুজনে বসে পরতাম ছায়াঘেরা স্থান দেখে। আমি বলে যেতাম আর ও শুনে যেত চুপ করে। 

একদিন এর ব্যতিক্রম ঘটল। 

ও বলল --" আমার সাথে আমার বাসায় যাবে বনলতা?"আমি বিশ্বাস করলাম ওকে। 

বললাম--" হ্যাঁ যাবো। আর যাবো নাই বা কেন নিরঞ্জনদা? আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি । তা কী তুমি বোঝো না? আর সেই তুমি আমাকে তোমার বাসায় নিয়ে যেতে চাইছ আর আমি যাবো না?" তখনও বুঝিনি ওর দুষ্ট অভিসন্ধির কথা। পরম বিশ্বাসে ওর বাসায় গেলাম একদিন দুপুরের দিকে। জায়গাটা কোথায় ঠিক জানতাম না। অবশ্য সে বয়সে সব কিছু আমার জানার বা চেনার কথাও নয় । হবে হয়তো কোলকাতার কাছাকাছি । এলাকাটা ঘন বসতিপূর্ণ । বেশির ভাগই টালির চালের ঘর। তাঁরই মধ্যে একটি নিরঞ্জনের ঘর। দরজার তালা খুলে নিরঞ্জন আমাকে বসতে দিয়েছিল একটা পুরনো কাঠের চৌকির ওপর। ঘরের পলেস্তারা খসা স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালে সেই প্রথম দেখেছিলাম সিনেমার অচেনা নায়িকাদের অর্ধ নগ্ন ছবি। কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছিল। মনে হয়েছিল যাঁকে আমি এতো ভালোবাসি তাঁর রুচি বোধের সঙ্গে আমার রুচি বোধের তো অনেক ফারাক। আমি ভুল মানুষ কে ভালোবাসলাম না তো? সেই মুহূর্তে চোখ বুঁজিয়ে আমি আমার ঘরের মানচিত্র কল্পনা করেছিলাম । যাঁর দেওয়াল জুড়ে শুধু রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল । কিন্তু তবুও ভালোবেসে ছিলাম নিরঞ্জনকে। মনের সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূরে সরিয়ে দিয়ে। ভেবেছিলাম থাক না দেওয়ালে আটকানো কিছু ছবি। ওগুলো ছবি বই তো অন্যকিছু নয়। ভালোবেসে যখন ফেলেছি অত প্রশ্নের দরকার কী? এবং সেই দিনই নিজের পরিণতির কথা না ভেবেই আমার ষোড়শী শরীরটা ওর দৈহিক লালাসা চরিতার্থে সারা দিয়েছিল সেচ্ছায়। লাভ করেছিলাম পরম সুখ। সেই ক্ষণিকের সুখের আশাতেই হোক বা ওকে ভালোবেসে ছিলাম সেই টানেই হোক সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই স্কুল কামাই করে চলে যেতাম ওর টালির চালের ঘরটিতে। শারীরিক ভাবে মিলিত হতে আমার ছিল না কোন দ্বিধা বা কোন সংশয় । কারণ আমি যে নিরঞ্জন কে বিশ্বাস করতাম ছোড়দা। আর সেই বিশ্বাস যে আমার কয়েক দিনের মধ্যেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে তা ভাবতেই পারিনি ।।।।।।।।।।


চতুর্থ 


দু একদিন ধরেই দেখছিলাম শরীরটা আমার ভালো যাচ্ছিল না। তোরাও সেটা খেয়াল করেছিলি আজও আমার মনে আছে । একদিন খুব বমিও করেছিলাম । মা বাধ্য হয়ে বাবাকে বলেছিল ডাক্তারকাকুকে কল করতে আমার জন্য। কেমন যেন অজানা ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠেছিল সেই মুহূর্তে । মনে হয়েছিল নিরঞ্জনের সঙ্গে শারীরিক ভাবে দীর্ঘ দিন মিলনে আবদ্ধ হওয়ার ফল স্বরূপ আমার শরীরে এরূপ অবস্থা নয় তো? তবে কী করা যায়? ডাক্তার কাকু এলে তো সব প্রকাশ হয়ে যেতে পারে ? উপায় কী? তবে কী নিরঞ্জন কে সব জানাবো? ও যদি সঙ্গে করে কোন ডাক্তারের কাছে আমাকে নিয়ে যায় তাহলে হয় তো এরূপ অবস্থা থেকে আমি মুক্ত হতে পারি। যেই ভাবা সেই কাজ। নাছোড় মা কে বোঝালাম স্কুলে ফুচকা খেয়েছি তাই শরীরের এমন অবস্থা । মা বিশ্বাসও করলেন সহজে আর আমি ও নিশ্চিন্তের নিশ্বাস ফেলে ছিলাম ক্ষণিকের জন্য । এর পরের দিন যথারীতি নিরঞ্জনদাকে নিজের শরীরের অবস্থার কথা বলতেই লক্ষ্য করেছিলাম নিরঞ্জনের চোখে মুখে কেমন যেন বিরক্তির ছায়া। । আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম--" কী হল তুমি বিরক্ত হলে কেন নিরঞ্জনদা?"

নিরঞ্জন নিজেকে সামলে নিয়েছিল । তারপর নিচু কন্ঠস্বরে বলেছিল--" তোমার এই অবস্থার কথা কেউ জানে ? মানে ডাক্তার দেখিয়েছ?"

আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে ছিলাম--" না"। 

নিরঞ্জন আর কথা বাড়ায় নি। হয়তো আমার ষোড়শী মন যেটা বোঝেনি ওর মত পরিণত বয়সের পুরুষের বোঝা হয়ে গিয়েছিল সহজে। এরপর নিরঞ্জনই নিয়ে গিয়েছিল একজন মহিলা ডাক্তারের কাছে। আমার অপরিণত বয়স দেখে ডাক্তার মহিলাটি বেশ অবাক হন। আমাকে দীর্ঘ সময় চেককাপ করে উনি আমার সামনেই নিরঞ্জন কে প্রশ্ন করেন--

--' মেয়েটি তো মা হতে চলেছে নিরঞ্জন । তা ওর সাথে কে এমন কাজ করলো? বয়সটাও তো মা হওয়ার উপযুক্ত নয় ওর। তবে কী রেপ কেস? "দেখে ছিলাম নিরঞ্জন কে কাঁচুমাচু মুখ করে চুপ করে বসে থাকতে ডাক্তার মহিলার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে । ডাক্তার মহিলা আর কথা বাড়ান নি। হয়তো বুঝেছিলেন আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী কে? কিন্তু আমার অবাক লেগেছিল আমি মা হতে চলেছি এই শব্দটা আমার যতটা মনে আনন্দের সঞ্চার করেছিল সেই মুহূর্তে কিন্তু নিরঞ্জনের তো তা করেনি। কিন্তু কেন?" 

কারণটা বুঝে ছিলাম আরো দুদিন বাদে। 

আমি যে মা হতে চলেছি আমার গর্ভে রয়েছে একটি শিশু তা বার বার ভাবতে গিয়েই আমার ষোড়শী মনে আনন্দের প্লাবন বয়ে যাচ্ছিল। চিৎকার করে মায়ের গলা জড়িয়ে বলতে ইচ্ছেও করেছিল ---" মা আমি মা হতে চলেছি। "

কিন্তু না সেদিন মা কে বলতে পারিনি আমার কথা তাঁর কারণ নিরঞ্জনই। ও ই ডাক্তার মহিলাকে দেখিয়ে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে আমাকে বলেছিল --" বনলতা তুমি যে আমার সন্তানের মা হতে চলেছ তা বাড়িতে কারো কে এখন বোলোনা। আমিই তোমার মা বাবাকে বলবো আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তাঁর আগে তোমাকে আমার সঙ্গে একটা জায়গায় নিয়ে যাবো। কোথায় যেতে হবে তা এখন কিছু বলবো না। তুমি বাড়িতেও কিছু জানিও না। শুধু নিজের কিছু পোশাক আর কিছু টাকাপয়সা, পারলে সোনাদানা নিয়ে নিও।" নিরঞ্জনের কথায় মাথা হেলিয়ে সায় ও দিয়েছিলাম। কোন প্রশ্ন না করে। দুদিন বাদে পরম বিশ্বাসে নিরঞ্জনের হাত ধরে পা বাড়িয়েছিলাম অজানা পথে। সেদিন আর গাড়ি করে নয় । স্কুলের ব্যাগে নিরঞ্জনের কথামতো দু চারটি জামা আর মায়ের আলমারির লকার থেকে কিছু খুচরো সোনার গহনা নিয়ে পারি দিয়েছিলাম । মাকে জানিয়েছিলাম গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেছে। নিরঞ্জন দা আমাকে ট্যাক্সি করে পৌঁছে দেবে। তখনও জানিনা আর আমার সঙ্গে মায়ের কোন দিনই কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে কেন জানিনা মনে কিছু সময়ের জন্য এ প্রশ্ন ও জেগেছিল--" আমি ঠিক করছি তো?" পরক্ষণেই উত্তর এসেছিল ---"নিরঞ্জনদাকে আমি ভালোবাসি । 

সে ভালোবাসার কাছে সবই তুচ্ছ । 

---"ভালোবাসা শব্দটা যে কতো মিথ্যা তা বুঝলাম যখন নিরঞ্জন একটি ট্যাক্সি করে কলকাতার নামকরা পতিতাপল্লীর গলির মুখে ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করাতে বলেছিল। আমি অবশ্য পতিতাপল্লী কাকে বলে তা তখনও জানতাম না । কিন্তু ট্যাক্সি যখন নিরঞ্জনের দেখানো পথে একটি গলির মুখে দাঁড়াল তখনই কেমন যেন বুকের ভেতরটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠেছিল । কারণ গলির মুখে চোখে ,মুখে ,ঠোঁটে রঙ মাখা মেয়েগুলো কে দেখে সেই মুহূর্তে আমার চেনা পরিবেশে দেখা মহিলা বা মেয়েদের সঙ্গে মেলাতে পারিনি। কেমন যেন অস্বস্তি হয়েছিল ওদের দেখে । হায়রে তখনও বুঝিনি আমি ও কয়েকদিন বাদে চোখে মুখে রঙ মেখে দাঁড়িয়ে থাকবো ঠিক ওদের মতো খদ্দের পাওয়ার আশায়। ।

ট্যাক্সি চালককে টাকা মিটিয়ে দিয়ে নিরঞ্জন বলে উঠেছিল--" এই চল্ ভেতরে তোকে রেখে আমাকে আবার অন্য ধান্দায় যেতে হবে"। চমকে উঠেছিলাম নিরঞ্জনের বলে যাওয়া কথাগুলি কানে প্রবেশ করতেই। --" এ কেমন সুরে নিরঞ্জন দা আমার সাথে কথা বলছে? যাঁকে ভালোবেসে আসছি এতোদিন ধরে সেই চেনা নিরঞ্জনদা তো আমাকে কোনদিন তুই সম্বোধন করেনি। যাঁর সুন্দর , মিষ্টি ব্যবহার আমাকে কেন আমাদের বারাকপুরের বাড়ির সকলকে মুগ্ধ করতো সেই নিরঞ্জনদা এমন অদ্ভুত সুরে কথা বলতে পারে ভেবে খুব অবাক হয়েছিলাম সেই মুহূর্তে । আমার অবাক হওয়ার কারণ হয় তো নিরঞ্জন বুঝেছিল তাই হয়তো নিজেকে নিমেষে সংযত করে নিয়ে বলে উঠেছিল--" এখানে আমার মাসী থাকে তোমাকে তাঁর কাছে নিয়ে এলাম। সে তোমাকে দেখতে চেয়েছিল। আমার একটু কাজের তাড়া আছে তাই বলছিলাম তোমাকে রেখেই আমাকে কাজটা সেরে আসতে আসতে হবে । " আমি নীরব থেকে গেলাম কী উত্তর দেবো ভেবে পেলাম না। তবে অদ্ভুত ভাবে লক্ষ্য করলাম গলির মুখে অশ্লীল বেশভূষার মেয়েগুলির প্রায় সকলেই নিরঞ্জনকে চেনে। নানা রকম ভঙ্গিমায় তাঁরা নিরঞ্জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টাও করছিল। নিরঞ্জনও হাসি মুখে তাঁদের কারো গাল টিপে দিচ্ছে তো কারো কোমড়ে আলতো করে হাত ছুঁয়ে দিচ্ছিল। এবার কেন জানিনা আমার মনের ভেতরটা ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে । আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন আমাকে জানান দেয়--" এ টা ভালো জায়গা নয়। আর নিরঞ্জনও ভালো নয়।"অবশ্য আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যে ভুল ইঙ্গিত দেয়নি তা কিছুক্ষণ বাদেই প্রমাণ পেলাম যখন একজন মধ্য বয়সি মহিলার সামনে এনে নিরঞ্জন আমাকে দাঁড় করালো।

ছোট্ট চারচৌকো ঘর।নানা দেবদেবীর ছবি আঁটা দেওয়াল। ঘরের এক ধারে একটি গোল টেবিল তার ওপর রাখা তিন চারটি কাঁচের বোতল আর গেলাস।মহিলা ঘরের মাঝ বরাবর রাখা একটি দড়ির খাটিয়াতে বসে বিড়ি টানছিল। নিরঞ্জনের সঙ্গে আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই বিড়িটাতে শেষটান দিয়ে এক ঝলক আমার দিকে তাকিয়ে নিল তারপর নিরঞ্জনকে উদ্দেশ্যে করে বলে উঠল---" ও নিরঞ্জন এর কত মাস হলো রে পেট হয়েছে তা কী তুই জানিস বেটা? তুই ও পারিস। ফ্রেস মাল কোনদিনও দিলি না আমাদের এখানে"। 

---" আঃ মাসী নিজে না চেখে অন্যকে কী করে খেতে দি? মিষ্টি না ঝাল বুঝতে হবে না ? তবে মাসী তুমি এর পেটেরটা খালাস করে দিলে একেবারে ফ্রেস মাল পেয়ে যাবে । খদ্দের লুফে নেবে। দেখছো না একেবারে কচি আনারকলি"। হয়তো ওরা আরো কথা বলেছিল। কিন্তু আমার কানে পৌঁছয়নি।ওদের ভাষা , ওদের কথাগুলি শুনতে শুনতে আমার হঠাত্ মাথাটা ঘুরে গেল। পায়ের তলার মাটি দুলতে থাকল । দুচোখে নেমে এল ঘন অন্ধকার ।আমি দাঁড়াবার শক্তি হারালাম। হয়তো দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকার ফল আর নিরঞ্জনের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়ে জ্ঞান শূন্য হয়ে পরলাম। কিছু সময় বাদে যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন জানলাম আমাকে কুড়ি হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়ে নিরঞ্জন চলে গেছে এবং যাবার সময় আমার ব্যাগ থেকে মায়ের খুচরো গয়না আর শপাঁচেক টাকা যা আমি বড় আশা করে নিয়ে এসেছিলাম নিজেই নিরঞ্জনের হাতে তুলে দেবো ওর প্রয়োজনে তাও নিয়ে চলে গেছে। শুধু আমাকে রেখে গেছে কালো অন্ধকার দুনিয়ায়। যেখানে চিৎকার করলেও কেউ আলো নিয়ে এসে পথ দেখাবে না আমাকে। হারিয়ে গেলাম আমি ছোড়দা হারিয়ে গেলাম। তোর ঘেঁটু, বাবার আদরের লতা , চুমকিরানীতে পরিণত হল ।কিছুদিন বাদে পেটের বাচ্চাটাকেও নিরঞ্জনের ভাষায় খালাস করে দিয়ে আমাকে ওরা গড়ে তুলল একেবারে আনকোরা ঝাঁ চকচকে একটা বেশ্যা । আমার চিৎকার আমার কান্না সবই সীমাবদ্ধ থেকে গেল পতিতাপল্লীর আনাচে কানাচে । 


অন্তিম 


এরপর কেটে যেতে লাগল দিন,মাস,বছর। পেটে আরো দুবার বাচ্চাও এলো । কিন্তু তাও খালাস করে দেওয়া হল। এর মধ্যেই একদিন শুনলাম নিরঞ্জন না কী গাড়ি চালাতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে মারা গেছে। খবরটা শুনে একটা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলাম। সেই সঙ্গে মনে মনে ঈশ্বরকে প্রণামও জানিয়ে ছিলাম এই কারণে যে পৃথিবী কিছুটা হলেও পাপ মুক্ত হল। 

আরো কয়েক বছর কেটে গেল । 

মাঝে মধ্যেই ঘুসঘুসে জ্বর হতো। 

আর শরীর জুড়ে ব্যথা।

ডাক্তারবাবু বললেন--"হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে পরীক্ষা নিরীক্ষার দরকার । ঠিক ভালো মনে হচ্ছে না। " হলাম ভর্তি । আর যে হাসপাতালে হলাম তখনও জানতাম না সেটা তোরই গড়ে তোলা হাসপাতাল ছোড়দা। কোন এক নার্সের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে প্রথম জেনেছিলাম হাসপাতালটা তৈরি করেছেন ডাক্তার সৌগত সেন। চমকে উঠেছিলাম নামটা শুনে । মনে হয়েছিল এ আমার ছোড়দাদা সৌগত নয় তো? আর যদি হয় তাহলে আমাকে যদি চিনতে পারে ? তাহলে তো ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নেবে। কে কবে কোন দিন এক বেশ্যাকে নিজের পরিবারের আপনজন মনে করেছে যে, ছোড়দাও মনে করবে? " পরক্ষণেই মনে হয়েছিল একই নাম অনেকেরই তো হতে পারে। এ আমার ছোড়দা তো নাও হতে পারে। কিন্তু না আমার চিন্তা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল । আমার চিকিত্সার ভার যখন ডাক্তার সৌগত সেনের হাতেই পরলো তখন তাঁকে দেখলাম । আমাকে দেখতে এসে কেমন যেন অবাক দুটি চোখ মেলে তাকিয়েছিল আমার দিকে। আমিও তাই। দুজনের চোখ অজান্তেই ভরে উঠেছিল জলে। হঠাত্ আমাকে প্রশ্ন করে উঠেছিল--" আপনি কী বনলতা ?" এবার আমি নিশ্চিত হলাম ডাক্তার বাবুটি আসলে তুইই । আমার ছোড়দা । কেন জানিনা ধরা দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ও দিলাম না । বললাম --" না আমি চুমকি"। কিন্তু তুই বিশ্বাস করিসনি। তোর চোখমুখ খুঁজেছিল আমার মধ্যে ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়া ছোট্ট বোনটাকে । তা বুঝতে অসুবিধা হয় নি আমার। শুধু ভাবলাম অন্য উপায়ে তোর কাছে না হয় ধরা দি। যে জীবনের কথা ছোটবোন হয়ে দাদাকে মুখে বলতে পারবো না তা লিখেই জানাবো। তাই লিখতে শুরু করলাম তোকে এই চিঠি । জীবনের যতটুকু কথা আমার আছে যা ছিল তোদের সম্পূর্ণ অজানা তাই আমি লিখলাম। যা বড়ো লজ্জার । এবং চিঠিখানি পাঠিয়ে দিলাম নার্সটির মারফত তোর কাছে।আমি জানি আমি পালিয়ে যাওয়ার পর তোদের কাছে আমি মৃত বলে পরিগণিত হয়েছি। হয়তো মনেই রাখিস নি এই বোনটা কে । তবু পারলে এই বোনটাকে ক্ষমা করেদিস ছোড়দা ।।

ইতি তোর ঘেঁটু।

কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলো মিলি হাতে ধরা চিঠিটা নিয়ে । 

---"আজ যে বনলতা নামটাকে কেন্দ্র করে তাঁর মা আর বাবার মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে সহস্র গুন, যাঁর নামটা মনে করে বাবার সামনেই মা করেছে অকথ্য গালিগালাজ । সেই বনলতা আর কেউ নয় সে সম্পর্কে বাবার আপন বোন । কিন্তু কেন বাবা এতোদিন মুখ ফুটে তা বলেনি তাঁর ছোটবোন বনলতার কথা ? কেন এমন অন্যায় করলো বাবা। জীবনের ভুল সিদ্ধান্তে যে মেয়েটির জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছিল তাঁর পরিচয় আমাদের কাছে দিতে কী বাবা ভয় পেয়েছিল না কী লজ্জা ? "

--"মিলি তোর বাবা ভোর থাকতেই শ্মশানে গেছে তা কী তুই জানতিস? কে মারা গেল যে তোর বাবা ভোর থাকতেই বেরিয়ে গেল?" সুদেষ্ণার কন্ঠস্বরে সম্বিত ফিরে পেল মিলি। চেয়ার ছেড়ে উঠে ধীরে ধীরে সুদেষ্ণার দিকে এগিয়ে গেল । হাতে ধরা চিঠিটা সুদেষ্ণার হাতে দিয়ে দ্রুত চেম্বার রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

বেশ বেলার দিকে সৌগত ফিরে এলো। 

সৌগত কে গাড়ি গ্যারেজ করে অন্দরমহলের দিকে আসতে দেখেই মিলি ছুটে গেল । সৌগতর বুকে এক প্রকার ঝাঁপিয়ে পরেই কান্না ভেজা কন্ঠস্বরে বলে উঠলো --" বাবা তুমি কেন কেন এমন করলে? তোমার অসহায় ছোট বোনটার পরিচয় লুকিয়ে রেখে আমার কাছে মায়ের কাছে সবার সবার কাছে তুমি কতো ছোট হয়েছ সেই সঙ্গে তাঁকেও ছোট করেছ প্রতি মুহূর্তে ? কিন্তু কেন বাবা? পিসিমনি তো সেচ্ছায় এই পথ বেছে নেয়নি। তাঁর ভালোবাসার লোক যদি তাঁর জীবন তছনছ করে দেয় তাতে কী সে দোষী? তুমি চলো বাবা চলো। আজ আমি তাঁকে নিয়ে আসবো আমাদের কাছে। সব দুঃখ তাঁর ভুলিয়ে দেবো আমাদের ভালোবাসা দিয়ে । চলো বাবা চলো। " সৌগত ধীরে ধীরে মিলির মাথায় দুবার হাত বোলাল। তারপর শান্ত কন্ঠস্বরে বলে উঠলো--

--" সে যে ধরা দিতে চায়নিরে মা কারো কাছে। তাই তাঁর চাওয়াটাকে সম্মান করে তোদের কাছে তাঁর সম্পর্কে কিছু বলিনি। তবে আজ সে , সব ধরা, ছোঁয়া ,চাওয়া ,পাওয়ার উর্দ্ধে আমাদের ছেড়ে অনেক অনেক দূরে চলে গেছে। যেখানে নতুন কোন নিরঞ্জন তাঁর আর কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। কোন কালিমা তাঁর পবিত্র শরীরটাকে ছুঁতে পারবে না। যেখানে সে পরম শান্তিতে থাকবে। সেখানে সেই অমৃতলোকে সে চলে গেছে"। কেমন যেন অদ্ভুত শোনাল সৌগতর কন্ঠস্বর । মিলি ভয় পেল। 

ভয়ার্ত কন্ঠস্বরে মিলি বলে উঠলো--

--" বাবা তুমি এসব কী বলছো?"

--" সে আর নেই মিলি। ব্লাড ক্যান্সার নিয়ে আমার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। হয়তো শেষবেলা পরম প্রিয় ছোড়দার কাছে এসে মরবে বলেই এসেছিল পাগলি মেয়েটা মাস কয়েকের অতিথি হয়ে। গতকাল রাতেই অবস্থা খুব খারাপ ছিল তাই আমার আসতে দেরি হয়ে গিয়েছিল । কেন জানি না রক্তের টান ছেড়ে আসতে মন সায় দিচ্ছিল না। তবু আসলাম তোদের কাছে ফিরে । আজ ভোরেই হাসপাতালের মেট্রন খবরটা দিলেন। আমার বড় আদরের ছোট বোন ঘেঁটুটা আর নেই। "

গলাটা বুঁজে এলো সৌগতর । কাঁপা কন্ঠস্বরে আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু পারলোনা।

একটা একটা করে লবণাক্ত ফোঁটা গন্ড বেয়ে নেমে এসে বুকের ওপর জামার খানিকটা অংশ ভিজিয়ে দিতে লাগল।। বাবার জামার বুক পকেটে রাখা একটা কিছু যেন বাবার চোখের লবণাক্ত জলে ভিজে যাচ্ছে তা মিলির দৃষ্টি এড়াল না। দ্রুত সৌগতর বুক পকেট থেকে বার করল মিলি একটা মলিন হয়ে যাওয়া সাদা কালো ছবি। যাতে এক চোদ্দ পনেরো বছরের কিশোরী প্রাণ খুলে হাসছে। তাতে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা বনলতা।

মিলির বুঝতে আর অসুবিধা হল না কিশোরীটি কে ? 

#সমাপ্ত