Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

বিজয়ার মিষ্টিমুখে বাত্য নারকেল নাড়ু ও আনন্দ নাড়ু

অরুণ কুমার সাউ/ তমলুক: কৈলাশের পথে পাড়ি দিয়েছেন মা দুর্গা। আবার এক বছরের অপেক্ষা। মন কিছুটা ভারাক্রান্ত হলেও মহিলারা মেতে উঠেন সিঁদুর খেলায়। সিঁদুর খেলার পর বাড়ির বড়দের প্রণাম, কোলাকুলি আর মিষ্টিমুখ…এটাই বাঙালির বিজয়া। একটা সম…



অরুণ কুমার সাউ/ তমলুক: কৈলাশের পথে পাড়ি দিয়েছেন মা দুর্গা। আবার এক বছরের অপেক্ষা। মন কিছুটা ভারাক্রান্ত হলেও মহিলারা মেতে উঠেন সিঁদুর খেলায়। সিঁদুর খেলার পর বাড়ির বড়দের প্রণাম, কোলাকুলি আর মিষ্টিমুখ…এটাই বাঙালির বিজয়া। একটা সময় ছিল শুভ বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানানো হতো হাতে গড়া নাড়ু ও মিষ্টিতেই। বিজয়া দশমীর জন্য দু-তিন দিন আগে থেকেই বাড়ির মা ঠাকুমারা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন নাড়ু ও ঘরোয়া মিষ্টি বানানোর জন্য। কিছু কিছু বাড়িতে পুজোর আগে থেকেই চলত নাড়ু তৈরির  কাজ। আজ থেকে দুই দশক আগেও পর্যন্ত বাংলার ঘরে ঘরে বিজয়ার মিষ্টি বাড়িতেই বানানো হতো। বাড়ির সব মহিলারা একসঙ্গে বসে বানাতেন নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, আনন্দ নাড়ু, মোয়া । সেই সাথে থাকতো মুগের ডাল বা ছোলার ডাল বাটার বরফি, কুচো গজা, নিমকি, মালপো, নারকেলের বরফি, ছাঁচে ফেলে সন্দেশ ইত্যাদি। বছরের পর বছর ধরে এই রীতি চলে আসছে।


এখন বাড়ির তৈরি মিষ্টি উধাও। বাঙালি মিষ্টির পরিবর্তে প্লেটে এসেছে ভিন প্রদেশের বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি ,সন্দেশ, শন পাপড়ি সঙ্গে ঝুড়ি ভাজা।মিষ্টিমুখে এখন বাজার চলতি হরেক মিষ্টি জায়গা করে করে নেওয়ায় নারকেল নাড়ুর ঐতিহ্য বর্তমানে ম্লান হয়েছে। পুজোর আগে থেকেই বাড়িতে চলত নাড়ু তৈরি। বাড়ির সব মহিলারা একসঙ্গে বসে বানাতেন নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, আনন্দ নাড়ু,  ইত্যাদি। নারকেলের বরফি, ছাঁচে ফেলে সন্দেশ এসবও ছিল। এখন ঝামেলার ভয়ে অনেকেই এসব মিষ্টি তৈরি এড়িয়ে যেতে চান। আর নারকেল নাড়ু এখন বাজারেও কিনতে পাওয়া যায়। তবে তার দামও যথেষ্ট বেশি। যদিও বাজারে তৈরি নাড়ু আর বাড়ির বানানো মিষ্টির মধ্যে ঢের ফারাক রয়েছে।


এখন নারকেল নাড়ু ও আনন্দ নাড়ু সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা যাক। ‘নাড়ু' শব্দটি এসেছে ‘লাড্ডুক' শব্দ থেকে। লাড্ডুক> লাড্ডুঅ> লাড়ু> নাড়ু। তবে সেকালের অনেক মা ঠাকুমার কাছে নাড়ু ‘লাড়ু' হিসেবেই পরিচিত ছিল। প্রয়োজন মত গুড় ও কোরানো নারকেল  একসঙ্গে করে জ্বাল দিতে হবে। জ্বাল দিয়ে যখন দুটো উপকরণই একসঙ্গে পাক হয়ে যাবে তখন তাতে প্রয়োজন মত এলাচ গুঁড়ো, দুধ, বাদাম গুঁড়ো মিশিয়ে ছোট আকারের যে লাড্ডু তৈরি করা হয় তাকে নাড়ু বলে। এক্ষেত্রে প্রধান উপকরণ যেহেতু নারকেলের কোরা তাই নারকেল নাড়ু হিসেবেই পরিচিত। তবে ‘আনন্দ নাড়ু'র মান কিছুটা উন্নত। আনন্দ নাড়ু মিষ্টান্নটিকে অনেক ক্ষেত্রে নাড়ু হিসেবে না ধরে মিঠাই হিসেবে ধরা হয়। এটি প্রাচীন মিষ্টান্ন। তবে কিছুটা বিলুপ্তের পথে। গ্রামীন এলাকাগুলোতে অভিজাত পারিবারিক উৎসবে কিন্তু আজও আনন্দ নাড়ুর প্রচলন থাকলেও বিজয়া উৎসবে একেবারে ব্যবহার হয় না বললেই চলে। নারকেল কুরিয়ে, ভিজে আতপ চাল, কলা ,তিল  আখের গুড় একসঙ্গে মিশিয়ে এক ধরনের মণ্ড তৈরি করা হয়। এই মন্ড ‘ন্যাড়াই' নামে পরিচিত। পরে হাতে গোল গোল করে ছোট ছোট বোঁদের মতো তৈরি করে বারকোসে সাজানো হয়। তারপর সেগুলিকে ঘিয়ে ভেজে চিনি বা গুড়ের রসে পাক দিয়ে সেগুলিকে গোল আকারে বেঁধে নাড়ু তৈরি করা হতো। এই নাড়ু ‘আনন্দ নাড়ু’ নামে পরিচিত। অভিজত অনেক পরিবারে আজও এ মিষ্টান্ন উৎসব উপলক্ষে বা বিজয়া উৎসবে সামান্য হলেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে এই পরিমাণটা আজ অতি সামান্য। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এই নাড়ুকে আজ ভুলতে বসেছে। একসময় পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে এই আনন্দ নাড়ু তৈরি করতে হতো। পরিবারের আনন্দ সংবাদ নিয়ে অন্য বাড়িতে যাওয়ার সময় অবশ্যই আনন্দ নাড়ু সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। বাড়িতে কোন শুভ অনুষ্ঠান অর্থাৎ বিবাহ, অন্নপ্রাশন ইত্যাদি হলে ময়রা ডেকে এনে ব্যাপক পরিমাণে এই আনন্দ নাড়ু তৈরি করা হতো। আনন্দ নাড়ু তৈরি হওয়ার পর একটা মাটির হাঁড়িতে করে রেখে দেওয়া হত। এটাই ছিল পারিবারিক নিয়ম। শুভ কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই হাঁড়িতে হাত দেওয়া হতো না। এসব এখন স্মৃতিপটে আঁকা।


বিজয়া দশমীতে  মিষ্টিমুখ আর অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে এক সময়ে যে রেওয়াজ ছিল তা আজ বিলুপ্তির পথে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাঙালির বাড়িতে হাতে তৈরি মিষ্টি পদ হিসেবে নাড়ুর চাহিদা অনেকটা কমেছে। আধুনিকতার সাথে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছে না বাড়ির তৈরি নাড়ু। নিজে হাতে কিছু করলে তার মধ্যে যে আন্তরিকতাটুকু থাকে, তা কী আর বাইরে মেলে!