Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

লিটল ম্যাগাজিনঃঅন্তর বাহির,ম্যাগাজিন কী ও কেন'?

ঋত্বিক ত্রিপাঠী
দুই
আত্মজিজ্ঞাসা
আর্থিক দিক থেকে দুর্বল, বিজ্ঞাপনহীন প্রচারবিমুখ বিনয়ী সম্পাদকের পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিন হতে পারে না যদি না তার বানান সচেতনতা থাকে, যদি না সে নতুন কিছু ভাবতে পারে। সর্বোপরি, লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদ…


ঋত্বিক ত্রিপাঠী
দুই
আত্মজিজ্ঞাসা
আর্থিক দিক থেকে দুর্বল, বিজ্ঞাপনহীন প্রচারবিমুখ বিনয়ী সম্পাদকের পত্রিকা লিটল ম্যাগাজিন হতে পারে না যদি না তার বানান সচেতনতা থাকে, যদি না সে নতুন কিছু ভাবতে পারে। সর্বোপরি, লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক কবি লেখক সবাইকে হতে হবে কর্মী। লিটল ম্যাগাজিনে অনেকেই লেখেন। তাঁদের অনেকেরই লিটল 'ম্যাগাজিন কী ও কেন' জানা নেই। ফলে আত্মবিশ্বাসের অভাব। প্রচারবিমুখ বলে আত্মগোপন করেন। সাহিত্যের জন্য সমাজের জন্য লিটল ম্যাগাজিনের কর্মী পরিচয় দিয়ে পথে নামেন না। লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে চান না। সম্পাদক নিজে যদি জ্ঞানশূন্য হন তবে সুবিধেবাদী লোকজনরা পত্রিকায় ভিড় করে। গরীব মানুষ শুধু অর্থে গরীব হন না। মূলত মানসিক কারণেই গরীব হন। যে পত্রিকা অনিয়মিত কিংবা বন্ধ হতে বসেছে, তার মূল সমস্যা অর্থসংকট নয়। কারণ বিষয়, বানান ও লেখার মান ভালো--এমন লিটল ম্যাগাজিনের পাঠক সংখ্যা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। বাড়তে থাকে লেখক, শুভানুধ্যায়ীর সংখ্যা। সে ক্ষেত্রে আর্থিক সমস্যা জন্ম নেয় না। তাছাড়া পত্রিকা যদি নির্দিষ্ট তারিখের পরে প্রকাশ পায়, তবে আগেই-বা হবে না কেন! পত্রিকা যদি বন্ধ হয়ে যেতে পারে তাকে চালিয়েও রাখা যায়। আসলে পুরোটাই নির্ভর করছে সম্পাদক ও সম্পাদকবন্ধুদের আন্তরিকতার ওপর। সন্তান জন্ম দিয়ে সন্তানের প্রাণকে রক্ষা করব না!
#
দীর্ঘ ৪০/৫০ বছর পত্রিকা চলছে। সুতরাং লিটল ম্যাগাজিন হিসাবে তার স্বীকৃতি ও সফলতা প্রতিষ্ঠা পেল--এমনটাও নয়। কুঁয়োয় ব্যাঙ হয়ে দীর্ঘ আয়ু লাভে বিশেষ লাভ কারুরই হয় না। দেখা দরকার, নতুন রক্তপ্রবাহ হচ্ছে কি না! নতুন লেখক উঠে আসছে কি না! নইলে শুধু টিকে থাকার জন্য টিকে থাকা! সারা পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে প্রায় ১০ হাজার ছোটোপত্রিকা। তার অধিকাংশই মুদ্রিত। কাগজনির্ভর। গাছ থেকে কাগজ। গাছ মানে প্রাণবায়ু, অক্সিজেন। ফুল, ফল, পাতা,ছায়া। তাই, যদি কোনও পত্রিকাগোষ্ঠী মনে করেন যে তাঁদের পক্ষে আর নতুন কিছু সম্ভব নয়, পত্রিকা বন্ধ করা সেক্ষেত্রে পরিবেশ রক্ষার কাজে লাগে। জগৎ সংসার প্রসঙ্গে এই যে গভীর ভাবনা, এও শেখায় লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন।
#
নিজস্ব চরিত্র নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, লিটল ম্যাগাজিনের প্রধান শর্তই হল তাকে হতে হবে বিশেষ। প্রতিটি সংখ্যাই যেন হয় বিশেষ সংখ্যা। বিশেষ সংখ্যা মানে সবসময় শুধুমাত্র একটি বিষয়ের ওপর জোর--তা নয়। কখনও বিষয়, কখনও ভাষা, কখনও লেখা কখনও লেখক নির্বাচনে কিংবা উপস্থাপনে হতেই হবে বিশেষ। নইলে কিছু লেখা ছেপে মলাটবন্দি করে বাড়িতে এনে জমানো আর মেলা থেকে জামা পরানো পুতুল কিনে আনা এক। সংগৃহীত লেখা ও মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করলে না হয় পত্রিকা না হয় লিটল ম্যাগাজিন। চাই তার প্রচার প্রসার।  নিজের মতো, সাধ্যমতো প্রচার না থাকলে কীভাবে পাঠক সন্ধান পাবেন! নীরব কবিত্বের মানে নেই। লেখকদের লেখাকে যদি না উপযুক্তভাবে পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারি তবে কেন আমি সম্পাদনায় এলাম! এই আত্মজিজ্ঞাসা আমাকে  লিটল ম্যাগাজিন দেয়। কিছু বিশিষ্ট পাঠক, মননশীল ব্যক্তির পাশাপাশি সংরক্ষণাগারে পত্রিকা পাঠাতেই হয়। সেই খরচও পত্রিকার খরচের অভিন্ন অংশ। অনেক পত্রিকাগোষ্ঠী তার লেখকদের লেখককপিই দেয় না। তারা লিটল ম্যাগাজিনের তালিকায় ভুল করে ঢুকে পড়ে নানান ঝামেলা বাধায়। অনেকে ৫০০ কবির কবিতা ছেপে ছক কষেন। ২০০ জনও যদি কিনে নেন, তাহলে খরচ উঠে যায়। অনেকে পুরস্কার ঘোষণা করে লেখা চেয়ে বিজ্ঞাপন দেন। এঁরা সংজ্ঞাহীন। এঁদের জীবন ও ভাবনায় লিটল ম্যাগাজিনের কোনও বোধই নেই। পথ কারুর একার নয়। একই পথে সৎ ও অসৎ হেঁটে বেড়ান।
#
লিটল ম্যাগাজিনের চরিত্র বজায় রেখে যদি কোনও পত্রিকার আর্থিকভাবে শ্রীবৃদ্ধি ঘটে তবে তো অন্যদের কাছে পথপ্রদর্শক  হয়ে উঠবে ওই পত্রিকা। কোনও কোনও পত্রিকার নিজস্ব দপ্তর রয়েছে মার্কেট কমপ্লেক্স-এ। রয়েছে বেতনযুক্ত কর্মী। আর্থিক স্বচ্ছল বহু পত্রিকাই কালজয়ী লিটল ম্যাগাজিন।  বাংলা সাহিত্যে যুক্ত করেছে নতুন সাহিত্য ধারা। আর্থিক স্বচ্ছলতা অপরাধ নয়।
#
অন্যদিকে  দুঃখের এই যে, সারাবছর  নানা কারণে হাহুতাশ করেন এমন বহু সম্পাদকের না আছে অনুশীলন না আছে পাঠগ্রহণের ইচ্ছা। না আছে নতুন সাহিত্যচর্চার গতিপ্রকৃতি লক্ষ করার আগ্রহ, না আছে বানান সচেতনতা। তাঁদের জানা নেই কী ছাপছি, কেন ছাপছি, কাদের জন্য ছাপছি! ফলস্বরূপ এঁরা একসময় হতাশার অন্ধকারে ডুবে যান ও অন্য সকলকে গালাগাল দিতে থাকেন। নিঃসঙ্গতাকে আশ্রয় করেন।
অনেককেই দেখি এই লিটল ম্যাগাজিন জগতে পাওয়া না-পাওয়ার হিসেব কষেন। নিজের অক্ষমতাকে আড়াল করতে অন্যকে ঈর্ষা করেন, ঈর্ষার জন্য রাত জাগেন, শরীর খারাপ করেন। ফলে কাজের মধ্যে আনন্দ নেই। মুখগোমড়া। বাঁকা চোখ। অকারণ উদ্বেগ ও কূটকচাল। আসলে নিজেকে 'একজন' ভাবছেন তিনি। সমগ্রের একজন ভাবতে পারছেন না। বস্তুত এ জগতে পাওয়ার আনন্দের চেয়ে হারাবার আনন্দই বেশি। এই জ্ঞান যাঁর যত দেরিতে আসবে তিনি ততই পুড়ে মরবেন। মান ও আক্ষেপের আগুন থেকে বাঁচতে শেখায় লিটল ম্যাগাজিন।
#
আসলে আমরা বিভিন্ন নামে পত্রিকা করি। যার সমষ্টির নাম লিটল ম্যাগাজিন। সুতরাং সমগ্রের অবিচ্ছিন্ন অংশ : আমি।
অন্যের উন্নতিতে আমারই উন্নতি। আমি বহু 'আমি'-র মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাই বলেই তো বারবার লিটল ম্যাগাজিন শব্দটি উচ্চারণ করি। উচ্চারণ স্বরতন্ত্রে নয়, হৃদয়তন্ত্রে। হৃদয়মন্ত্রে।
#
একটি লিটল ম্যাগাজিনকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠে পাঠকগোষ্ঠী ও লেখকগোষ্ঠী।  এতে পত্রিকাকে সঠিক ভাবে চেনা যায়। লেখকদেরও মেজাজ ধরতে পারা যায়। নতুন বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন লেখকদের আবির্ভাব। অনেকের ভুল ধারণা আছে--প্রতিষ্ঠিত লেখকরা লিটল ম্যাগাজিনে কেন! এমন প্রশ্নও শোনা যায়।  বিষয়ের প্রয়োজনেই লেখকসূচি আসবে। সেখানে বড় কাগজের লেখক বলে তাঁকে সরিয়ে রাখা একপ্রকার কুসংস্কার। কুসংস্কার মুক্ত মন গড়ে তুলতে লিটল ম্যাগাজিন সাহায্য করে। সমাজমনস্কতা লিটল ম্যাগাজিনের বিশেষ চারিত্রিক গুণ।
#
ফুল ঠিক বাজারের বস্তু উপাদান নয়। অবশ্য ইদানিং বাজারে ফুল বিক্রি হয়। এতে ফুল ফুলই থাকে। তার গন্ধ সৌন্দর্য কিছুমাত্র হ্রাস পায় না। মেজাজ ও রুচি বজায় রেখে লিটল ম্যাগাজিনের বাণিজ্যিক হওয়াটাই বরং শ্রেয়। অভাবী প্রাণও তো প্রাণ। সে প্রাণেরও তো মূল্য আছে। তাই তারও তো চাই তার মতো বাণিজ্যিক স্বভাব। অল্প প্রাণ অল্প পুঁজিরই বরং চাই বেশি করে সচেতনতা।  সচেতনতার অন্য নাম বাণিজ্যিকতা হলেও দোষের কিছু নয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে বাণিজ্যের অর্থনীতি তাকে গ্রাস করছে কি না! তাকে তার মূল কাজ থেকে সরিয়ে দিচ্ছে কি না! তার রুচিনির্ভর বাণিজ্য না থাকলে বরং তার বিকাশ ঘটবে না। লিটল ম্যাগাজিন সবার জন্য নয়, বিশেষ বিশেষ মননশীল পাঠকের --এই কথা ঠিক, তবে এই বিশেষকেও তো খুঁজতে হবে! পুরো দায় পাঠকের ওপর চাপালে ভুল হবে। দীর্ঘ আয়ু ও নিত্য নতুন বিষয় উপস্থাপনের জন্য যে পরিকল্পনা--তাতে অর্থনীতি তো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবেই। একে অস্বীকার করার উপায় নেই।
#
এটা ঠিক পাড়ার ক্রিকেটের ক্যাপ্টেন তিনিই হন যাঁর ব্যাটবল আছে। প্রথম পর্যায়ে একজন সম্পাদক নিজে থেকেই সম্পাদক। তারপর ক্রমশ চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি যদি না তাঁর দিগন্ত বাড়াতে পারেন তবে সারাজীবন পাড়ার ক্রিকেটই খেলতে হয়। একটু একটু  করে তাঁকে জানতেই হবে লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন। নইলে সমগ্রের বোধ জন্মাবে কী করে! অনেকেই অনেক কবিতা লেখেন, অথচ দুঃস্থ অসহায় কবি লেখকের পাশে দাঁড়ান না। লিটল ম্যাগাজিনেই লিখে চলেছেন গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতা অথচ লিটল ম্যাগাজিনের সুখদুঃখের সঙ্গে তাঁর কোনও যোগ নেই। তিনি যেন বসন্তের কোকিল। নিজের  লেখাটি লিখব ও লেখা ছাপার জন্য যাঁর যাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়, রাখব--তার বাইরে যাব না। এঁদের জীবন ও লেখার আশ্চর্য এক ব্যাকরণ। এঁদের কাছে প্রতিটি দিনই এক। এঁদের লেখকসত্তা ও ব্যক্তিসত্তার মধ্যে হাজারো অমিল।
#
লেখক ও ব্যক্তিসত্তার মধ্যেকার দ্বন্দ্বময় দূরত্ব কমিয়ে দিতে সক্ষম একমাত্র লিটল ম্যাগাজিন।
_____________________
.........  চলবে