Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

উপন্যাস 'চন্দ্র গোধূলি '

#ধারাবাহিক উপন্যাস #
      ★★ চন্দ্র গোধূলি ★★
           ।।  তাপস  কুমার দত্ত ।।


অস্ত রাঙা সূর্য ক্লান্ত আবেশে ধীরে ধীরে মহাকাশের অসীম কোলে আশ্রয় নিলো।
 বেদনা মাখা বসন্তের চাঁদ ছড়িয়ে দিলাে তার স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার ছটা। একে একে


#ধারাবাহিক উপন্যাস #
      ★★ চন্দ্র গোধূলি ★★
           ।।  তাপস  কুমার দত্ত ।।


অস্ত রাঙা সূর্য ক্লান্ত আবেশে ধীরে ধীরে মহাকাশের অসীম কোলে আশ্রয় নিলো।
 বেদনা মাখা বসন্তের চাঁদ ছড়িয়ে দিলাে তার স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নার ছটা। একে একে
অসংখ্য তারা আকাশের বুকে ফুটিয়ে তুলল আবেগ ভরা রোশনাই।

গোধূলির রাঙা সূর্য কখন যে জ্যোৎস্নার অপূর্ব রােশনাই-এ ভরিয়ে তুলেছে,চন্দ্রের চেতনা হয়নি।

চন্দ্র এগিয়ে চলল সদ্য আশ্রয় নেওয়া গৃহস্বামীর বাড়ী। চন্দ্র ছােট ছােট ছেলেদের
পড়তে বসার কথা বলে এসেছে। টিউটর হিসাবে এই প্রথম হাতে খড়ি চন্দ্রের।
হয়ত ছেলেরা পড়তে বসে গেছে।

জ্যোৎস্নার আলোতে ঘড়িটা দেখার চেষ্টা করল  চন্দ্র। চাঁদের আলোতে  ঝিকমিক
করে উঠল ঘড়িটা। পৌনে ছ টা বাজে।
চন্দ্র উঠে দাঁড়াল। দুরে মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি শোনা যায়। দমকা হাওয়ায় সারি
সারি তাল গাছের শুকনাে পাতাগুলাে মর্মর শব্দে বেজে উঠতে লাগল। বাদুড়ের
চনমনে পাখাগুলাে পৃথিবীর বুক বিদীর্ন করে বেরিয়ে গেল।

দূর থেকে দেখা গেল গৃহস্বামীর উঠানে মিটিমিটি করছে লণ্ঠনের আলোগুলো।
ক্রমে চন্দ্র এসে পৌঁছায় ওদের কাছে। ছোট ছেলে মেয়েরা গুন গুন শব্দে ভরিয়ে তুলেছে প্রাঙ্গন।


অন্ধকার উঠানে পা তুলতেই প্রশ্ন এলো—

-কে?

মাস্টার মশাই না? চন্দ্র মাথাটা সামান্য নীচু করে উত্তর দিলে।
-হ্যাঁ।
-চলাে মুখে কিছু দেবে, বলে গৃহস্বামীর স্ত্রী। চন্দ্র কাকীমা বলেই ডাকে।

-না- কাকিমা থাক। খেতে ইচ্ছে করছে না। কাকীমার স্থির চোখের শুভ্র দৃষ্টি
নমেষে কোথাও উধাও হয়ে গেল। ছােট ছােট মিষ্টি সুরের মাঝে কাকীমা কি যে,
-এরপর দু'বছর কেটে গেছে। দারিদ্রের চরম আঘাত নেমে এসেছে চন্দ্রের ওপর।
 চাকরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে লাগল বারবার। কিন্তু হতাশা ছাড়া কিছুই পেল না চন্দ্র।


-হঠাৎ সেই সময় খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে চোখ ঠেকে যায় চন্দ্রের। নেই
মামার চেয়ে কানা মামাই ভালাে। ভেবে একটি ছােট মেয়েকে পড়ানাের ভার নেয়
চন্দ্র। মাত্র হাজার টাকার বিনিময়ে। দেখতে দেখতে অনেক দিন কেটে গেল এই
মুকুন্দরাম পুরে।

চন্দ্রের  প্রেমিকার কথা মনে পড়ল। না-গােধূলিকে তা কোনদিন জোর
করেনি। চন্দ্র মন প্রাণ দিয়ে শুধু চেয়েছিল, কিন্তু চন্দ্রকে গােধূলি কোনাে দিনই
পছন্দ করেনি। ধীরে ধীরে চন্দ্র কলেজ ছেড়েছে।....হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে।
কাজের খোঁজে। তারপর থেকেই এখানে....।

-মাস্টার মনি। ও মাস্টার মনি, মুনাই এসে তাড়া দেয়। খাবে এসাে। নীচ
থেকে বৌদির ডাক শােনা গেল।

-মুনাই মাস্টার মনিকে তাড়াতাড়ি নীচে নিয়ে এসাে।

ওপরের বারান্দা থেকে নীচের বৈঠকে পা দেওয়ার পর বুঝতে পারলাে, অন্য
দিনের থেকে আজ ব্যস্ততার অন্ত নেই।

সকাল বেলায় ছাদের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাে চন্দ্র।তখন সুখেন মাঝীকে
একটা বড়সড় রুই মাছ নিয়ে ঢুকতে দেখেছে এ ঘরে। এখন ছাদের পশ্চিম পাশের
ঘরটিতে ঝাড়পােছ করতে দেখেছে কাজের লােক দয়ালকে। ঘরটি ওর রুমের
ঠিক পাশেই।
রৌদ্রে বড়ি শুকনাে করতে দেওয়া হয়েছে। ঘি-এর বােতলে তাপ দেওয়া হচ্ছে। চন্দ্র মুনাইকে জিজ্ঞেস করে—
 বললেন কিছুই শুনতে পেলনা চন্দ্র।
রথীনদা অনেক কষ্টে গৃহশিক্ষকের কাজটা জোগাড় করে দিয়েছিলো।কাকীমার
তিনছেলে, ছেলে বউ, দেওর, ছােট ছােট ছেলেমেয়ে নিয়ে মােট আঠারো
জন পরিবারের সদস্য। উমা কাকীমা স্নেহ মায়া মমতায় ভরিয়ে যেন সংসারে স্বর্গ
নামিয়ে এনেছেন।

চন্দ্রের নিজের মায়ের কথা মনে পড়ল। হঠাৎ চন্দ্রের চোখে জল ভরে এলাে।
মাস্টার মশাই, আমার হয়েছে। কী হয়েছে? বলে চন্দ্র।
-আমার ইতিহাস পড়া হয়েছে। চন্দ্র ওকে হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকলাে।
-বলাে।
ছোট ছেলেটি বলে চলল,

সিরাজ ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। পলাশির প্রান্তরে পরাজিত
হয়েছে সিরাজ। মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায়। ছােট ছেলেটির করুণ মুখখানি
সিরাজের দুঃখে ব্যথিত হয়েছে বুঝতে পারলো চন্দ্র। চন্দ্রের রথীনদার কথাটা মনে
পড়ল।
-নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখিস। অন্যের বিশ্বাসকে পদলিত করিস না। তাহলে
কোন দিনই এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বিশ্বাসের আশ্রয় পাবি না। চন্দ্রের বাবার কথা
মনে পড়ে। বাবা অসহায় করুন মুখখানি করুন ভাবে বলেছিলেন—

-আমার সাধ্য নেই চন্দ্র, তােমাকে উচ্চ শিক্ষা দেওয়ার। যাতে তুমি নিজে পারো সেই চেষ্টা করো।

বি.এস.সি.-তে ভর্তি হওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে। পুরাতন পঙ্কিলতাকে
দূরে সরিয়ে এগিয়ে চলার পথে ব্রতী হলাে চন্দ্র।

বিধিবাম হলাে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ছাড়তে হলাে উমা কাকীমার
স্নেহের ছায়া।
 -কেউ কি আসছে তােমাদের বাড়ীতে ?

-আজ পিসিমনি আসছে কোলকাতা থেকে। পড়াশুনাে শেষ করে। তাই
এত সব আয়ােজন।
এ বাড়ীতে প্রথম থেকে জেনে এসেছে চন্দ্র, সদস্য সংখ্যা বারো। কিন্তু দেখেছে
এগারাে। বারাে তাহলে উনিই।
আর পরিচয় বলতে যা বােঝায় মুনাই, মুনাই- এর মা ঊর্ষাবৌদি এবং উনার
স্বামী মহেন্দ্রবাবু, এবং ছােট ভাই শরৎ আর দয়াময়ী দেবী। বাকি লোক কলকাতা
শহরে থাকে। শরৎ বড্ড বেশি ফাজিল। চন্দ্রের ওকে খুব ভালােলাগে। এতক্ষন
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাে চন্দ্র। বৌদির ডাকে চেতনা হয়।
-আরে এসাে। কতক্ষন আর ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। এসাে এসাে বসে
পড়। বুঝতে পেরেছি তুমি অবাক হচ্ছো। এইসব কান্ড কারখানা দেখে। তােমার
দাদার আদুরে বোন কোলকাতা থেকে পড়াশুনা শেষ করে আসছে।
নাও এবার খাওয়া শুরু করাে। চন্দ্রের মনে পড়ল উমা কাকীমার কথা। ঠিক
এইভাবে উমা কাকীমা স্নেহ করতেন। আদর করে খাওয়াতেন। চোখে হঠাৎ জল ছলছল
করতে লাগল।
ঊষাবৌদি ওখান থেকে সরে গেল। মাছ খেতে ভাল লাগে না চন্দ্রের। একটু
আলুমােলা, ডাল, আর সজনে ডাঁটা দিয়ে খাওয়া শেষ করে উঠে যায় চন্দ্র।

-তুমি মাছটাই ছুঁলে না চন্দ্র ? জিজ্ঞাসা করে বৌদি।
তােমার মাছ খেতে ইচ্ছে করে না?
-না, উত্তর দেয় চন্দ্র।
চন্দ্র হাত মুখ ধুয়ে উপরে চলে আসার সময় বলে -মুনাই তুমি খাওয়া শেষ করে
ওপরে পড়তে এসাে।
চন্দ্র ওপরে গিয়ে বসেছে তক্তবােসের ওপর। সেই সময় গাড়ির শব্দ ভেসে এলো।
কান পেতে শুনতে লাগল চন্দ্র। ঊষাবৌদি শ্বাশুড়ি দয়াময়ী দেবীকে ডাকছেন।

-আপনার মেয়ে এসে পড়েছে। দয়াময়ী দেবী সারা দিন ঠাকুর ঘর নিয়েই ব্যস্ত
থাকেন। পরিবারের সমস্ত দায় দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নিয়েছেন। ।

বাড়ির পেছন থেকে শরৎ-এর চিৎকার শুনতে পেল চন্দ্র। এবার একটা
জমকালাে বুড়াে থেকে গোধূলিকে বিদায় করে দেব।

চন্দ্র ওই নামটা শােনামাত্রই ধড়ফড় করে উঠে বসল বিছানার ওপর।

একি সেই গােধূলির বাড়ি? না, না সে হবে কেন? মনে মনে ভাবতে লাগল
চন্দ্র।

-সেই গােধুলিকে তো মন থেকে বিসর্জন দিয়েছে।
সত্যিই যদি সেই গােধূলি হয় তাহলে সে চিনতে পারবে কি?
-আয়নার সামনে দাঁড়ালে চন্দ্র। মুখে একরাশ খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শীর্ণ চেহারা।না—
- মনে হয় আমায় চিনতে পারবে না। নিশ্চিন্ত মনে আবার তত্তবােসের ওপর
বসে পড়ল।
প্রায় বেলা দুটো বাজতে চলল। এখনও মুনাই এলােনা। হয়ত আজ আসবে না পড়তে।

 নতুন পিসিমণি এসেছে তাই, মনে মনে ভাবতে লাগল চন্দ্র। আনন্দ তাে
ওদেরই।
বাজার থেকে ঘুরে এলে ভাল হয়। সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। বারান্দার পিছনের
সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে নিঃশব্দে নীচে নেমে এলাে চন্দ্র।
পথে চলতে শুরু করল। এলােমেলাে পায়ে ঘুরতে ঘুরতে শিব মন্দিরের কাছে
এসে পড়ে। অনেকক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর মন্দিরের চূড়োটার দিকে
লক্ষ্য করে চন্দ্র। ধীরে ধীরে মন্দিরের ঘন্টা ধ্বনির শব্দ শােনা যায়। মাথা নামিয়ে
প্রণাম জানালো পৃথিবীর আরাধ্য দেবতাকে। হঠাৎ গােলমালের শব্দে চন্দ্র মুখ
ঘােরায়। মন্দিরের সামনে একটি বড় মিষ্টির দোকান। সারি সারি মিষ্টান্ন সাজানো —
.............চলবে