কাটমানি
টোকন মান্না
সাব একটু সরেন।
আস্তে। গা ঠেসেঠেসে ভীড় হচ্ছে। চন্ডী হাঁসদা। কুচাগেড়িয়া বাড়ী। ট্রলীটা টেনেটেনে হাসপাতালে কাছে ঠেস দিয়ে রাখে। এমার্জেন্সিতে ধবধবে ফর্সা নার্স বসে চা খাচ্ছে। কেউ হাত গলাচ্ছে, কেউ মাথা গলাচ্ছে। কেউ…
কাটমানি
টোকন মান্না
সাব একটু সরেন।
আস্তে। গা ঠেসেঠেসে ভীড় হচ্ছে। চন্ডী হাঁসদা। কুচাগেড়িয়া বাড়ী। ট্রলীটা টেনেটেনে হাসপাতালে কাছে ঠেস দিয়ে রাখে। এমার্জেন্সিতে ধবধবে ফর্সা নার্স বসে চা খাচ্ছে। কেউ হাত গলাচ্ছে, কেউ মাথা গলাচ্ছে। কেউ মুখ গলাচ্ছে। মাঝে মাঝে নার্সরা ধমকাচে, চমকাছে, এরই মধ্যে ফোনে হাসাহাসি, চোখ নাচানাচি সবই হচ্ছে। স্টাফরা বেপাত্তা সবাই।
ওগো পেটটা মুচড়ে দিল গো।
সুবুর কর ফুলি। একটু সুবুর কর।
বাবু কি করব বলে দিন তো। মোটাসোটা লোকটা হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল।
একশ টাকা লাগবে।
এই নাও।
প্রায় আধঘণ্টা পরে এলেন। হাতে কাগজ। সরকারির প্রেসক্রিপ্সান। হবে না কেন। লাইন তো রাস্তা পর্যন্ত। ঠেলাঠেলি। গালাগালি। এমনকি লাইন টোপকে যাচ্ছে কেউ কেউ। বাপের গুষ্টি থেকে মায়ের ফুষ্টি শেষ হচ্ছে। এরই মধ্যে আগে থেকে লাইন পেয়ে ডাক্তার দেখা হয়ে মারুতিতে করে চলে যাচ্ছে। হাতে তিন শ চারশ হাতে হাতে চলছে সব।
সাব ব্যবস্থা করে দেবেন।
লাল গোল গোল চোখ। খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কাচাপাকা। মোটাসোটা গলার স্বর। - কবে আসা হচ্চে।
ওই যে ট্রলীতে আমার রোগী।
মরে যাবে। ভিতরে নিয়ে আসো।
চন্ডী রেগে ওঠে। হাত পা শক্ত হয়ে ওঠেছে। যেন মাথায় গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। মাথাটা টন করে র র করছে। ‘হারামজাদা’।
ড. বিধান ব্লকে। বেড পেতে হলে তিনশ টাকা লাগবে।
তিনশ।
হ্যাঁ। না হলে মেঝে। তিনশ টাকা কাটমানি নয় । তিনশ টাকা বেড ভাড়া।
কমসম বৃষ্টি হচ্ছে। হঠাৎ ভিজে যাচ্ছে শরীর। চন্ডীর জঙ্গলের কাঠকাটা শরীরটা লালচে ফুটফুট বুদবুদ ফুটচ্ছে। দশবছরের সংসার স্বামী স্ত্রীর মারামারি, ভালোবাসাবাসি সব যেন থেমে গেল। চণ্ডী পকেটে হাত রাখে। চারশ টাকা পড়ে আছে। কাল ভোরে শালা বীরু আসবে। তারও সংসারে অশান্তি। বেচারা কাজকাম হারা হয়েছে। মাওবাদী নামে পোস্টার পড়েছে। বউ – এর ছেঁড়া কাপড় জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। চপ মুড়ির গন্ধটা বেশ সারা শরীরে লাগছে। বউ- এর কাছে কাকি আছে। যে কাকি দিনরাত ঘচঘচ করত বউ- এর সাথে সেই এখন বিপদে পাশে। হাসপাতালে বের হবার সময় কান ছবিটা দিয়ে বলেছিল বাবু বেচে দিস। সেও ফেঁসে আছে। মন্ডু নেতার কাছে। বিশহাজার টাকা একা একা দিয়েছে। বাড়ি করে দেবে। কিন্তু গত চার বছর হচ্ছে হচ্ছে আর হয়নি। সবাই ফেঁসে আছে। গ্রামে লোক। শহরে লোক। সারা পৃথিবীর লোক। ময়লা পলিথিন থেকে পোড়া বিড়িটা বের করে কয়েকটা টান দিল। ভালো লাগছে না। আগুন নিভিয়ে পলিথিনে রেখে দিল।
কি বলল।
নার্সিং হোমে। কলকাতা যেতে হবে। শান্ত ভাবে বলে বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে মিরাজ। সবাই মশারি থেকে মুখ বের করে বলে।
খুব সিরিয়াস।
মোটা লেপটা গায়ে জড়িয়ে চলতে থাকে।
প্রায় এক মাস এখানে আছে। বাঁচবে না। ডাক্তার দেখে না। সরকারি ওষুধ খেলে কাজ দেয় না। চণ্ডী চোখ বন্ধ করে অশ্রু এসে গেল। সারা রাত ঘুম হয়নি। মশার কামড়ে। আর হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। বর্ষা থামল ভোরে।
দ্বিতীয় দিনে চন্ডীর মেয়ে জন্মালো। কিন্তু কাল থেকে রোগীর দেখা নেই। ডাক্তাররা বারবার বলছে নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে। তা খরচ হবে ষাট হাজারের মত।
এদিকে বারবার ব্লাড যাচ্ছে।
ব্যাঙ্কের যান। যদি ব্যাঙ্ক থাকে এ গ্রুপে তাহলে ভালো না হলে বাইরে নুরকে বলবে ব্যাবস্থা করে দেবে। আমার নাম বললে কমে হয়ে যাবে।
ডাক্তারবাবু আমি রক্ত দিয়েছিলাম গ্রামে।
সার্টিফিকেট আছে? ডাক্তারবাবু সকালে মত হেসে বলল।
হ্যাঁ।
ঘণ্টার মধ্যে আনতে পারবে। স্ট্যালিনের মত হেসে বলল।
না।
এখন যাও। রোগী মরে গেলে আনবে। রোগী মরে গেলে আমাদের এসে মারবে। বাপ তুলে গাল দেবে।
ডাক্তারবাবু পেছনে শালাদের লাথি দিতে হবে। খুব হাল্কা প্রেমিকার মত বলল শ্রেয়া মালিক। শ্রেয়াকে সবাই চেনে। ডাক্তার, হাসপাতালের নার্স, অফিসাররা, এমন কি রোগী, রোগীর বাড়ির লোক এবং এখানে কাটমানি বাবু ও শ্রমিকরা।
চন্ডী আলুথালু ভাবে চলতে থাকে হাসপাতালে। চারদিকে একশ দুশ টাকার খরিদ্দের। গায়ে আতুরের গন্ধ দমকা হাওয়ায় নৃত্য করছে।
কি চণ্ডী হাঁসদা বউ এখনো বের হয়নি।
না।
মরে গেছে। মেয়ে কেমন আছে।
ভালো নেই।
কে বলছে।
ডাক্তার।
তাহলে ভালো আছে। কিন্তু বউটা মরে গেছে।
বিশালদা। চলি বারিক নার্সিং হোমে।
কে বলল। কেন ডাক্তার বলল। ড্রাইভার বলল।
চন্ডী স্থির থাকতে পারেনি। দৌড়ে গেল। ওয়ার্ডে।
আমার বউকে বের করুন। না হলে। চন্ডী মাথা ঢুকতে থাকে।
তোমার বঊ-এর নাম কি?
ফুলি হাঁসদা।
দূটো নার্স ছুটে গেল ওটিতে। আবার ছুটি এলো।
ভালো আছে। একটু পরে বের হবে। কালকে ডাক্তার ছিল না। ঠিক মত সেলাই হয়নি। রক্ত চলছিল। ভালো আছে।
মিত্র ঠাকুর কে। লাশ নিয়ে যেতে হবে মর্গে।
হাঁসদাবাবু মা মেয়ে দুজনেই সুস্থ। এবারে মিষ্টি খাওয়ান। হাঁসদাবাবু আপনাদের জন্য দুহাজার টাকা মিষ্টি খেতে দেবেন। জেনারেল হলে তো পাঁচ হাজার। লালচে ঠোঁটে হাসলেন শ্রেয়া। শরীরটাও বেশ।
কোথায় পাবো ম্যাম।
ও আমরা আদরে বললাম বলে। দেখি বাচ্চা ট্রিটমেন কে করে?
চন্ডীর বউ বলল হাজার টাকা দেব ম্যাম।
ঠিক আছে এসটি জন্য করলাম।
চন্ডীর বউ হাসল। কাস্টের জন্য বেঁচে গেল।
আর বাড়ী যাবার আগে ডাক্তারের কাছে দেখা করে যাবে। ওষুধ লেখে দেবে। ভালো ডাক্তার, চেম্বার করে। হাজার টাকা ফি। আমি লাইন করে দেবো। সুপর্ণা বলল। সুপর্ণা বল আয়া। ওই যে ডাক্তারবাবু আসছেন কথা বলে নাও।
চন্ডী হাঁসদা। কপাল খুব ভালো, মরা মানুষ বাঁচিয়ে তুলেছি। ম্যামদের মিষ্টি খাইয়েছ। আর আমার চেম্বারে কিবার যাবে। ভালো ওষুধ লেখে দেব। বাচ্চা ও বাচ্চার মা ভালো থাকবে। এটা হাসপাতাল, ভালো ওষুধ লেখতে নেই। যাও জয় কালি বলে ব্যবস্থা কর গিয়ে।
চণ্ডীর বউ হাত নেড়ে ডাকল।
শুনো।
কি?
আমার হাতের পলাটা বেচে দাও। এখানে ব্যাপার হচ্ছে। বাড়ি গিয়ে বলব।
চণ্ডী বউয়ের হাত ধরে কেঁদে ফেলল।
তুমি শুধু বাড়ী চল।