সিনেমার নামে কী এসে যায় ?
অচিন্ত্য নন্দী
ছবির নাম মেঘে ঢাকা তারা। মুক্তি পেয়েছে ষাটের দশকে। ছবিটির পরিচালক ভারতীয়
চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী ঋত্বিককুমারঘটক। 'দাদা, আমি বাঁচাবাে- ছবির এই সংলাপটিতে যেন ভারতীয়
ভাবনার শৈল্পীক সিন…
সিনেমার নামে কী এসে যায় ?
অচিন্ত্য নন্দী
ছবির নাম মেঘে ঢাকা তারা। মুক্তি পেয়েছে ষাটের দশকে। ছবিটির পরিচালক ভারতীয়
চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী ঋত্বিককুমারঘটক। 'দাদা, আমি বাঁচাবাে- ছবির এই সংলাপটিতে যেন ভারতীয়
ভাবনার শৈল্পীক সিনেমাও বাঁচার আর্তি জানায়। এই সময়ের বাঙালি দর্শক ছবিটিকে হৃদয়ে গ্রহণ
করেছিলেন। তারপরও প্রায় পাঁচ দশক জুড়ে ছবিটি প্রদর্শিত ও আলােচিত হচ্ছে। ফলে ছবিটির এক
দর্শকসমাজ গড়ে উঠেছে, যা হয়ত কিছুটা নষ্টালজিয়াআক্রান্ত। ছয় দশক পরে আরাে একটি চলচ্চিত্রের
নাম মেঘে ঢাকা তারা! ছবিটি দেখার আগে এই বার্তা দর্শকসমাজের অন্তরাত্মায় কাঁপন ধরাতে পারে।
কী জানিই হেরিটেজ সিনেমাটি থেকে ইট খসে পড়বে না তো? ছবিটি দেখার পরে সিনেমা অবশ্য দর্শকি
কিছুটা স্বস্তি পান। কারণ, অত্যন্ত উন্নত মানের ছবি এই দ্বিতীয় মেঘে ঢাকা তারায়
স্বয়ংঋত্বিক কুমার ঘটকের জীবনালেখ্য ছায়া ফেলেছে।
ছবির নাম সাত পাকেবাঁধা। সুচিত্রা, সৌমিত্র অভিনীত এই ছবিটিতে আভিনয়ের জন্য মাস্কো
চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছিলেন সুচিত্রা সেন। কিন্তুপুরস্কারের থেকেও বড় কথা,
ছবিটি দর্শক মনে গেঁথে আছে আজও। তাহলে কেন সম্পূর্ণ অন্য গল্প, অন্য ভাবনা নিয়ে টি ভি.
সিরিয়ালে সাতপাকে বাঁধা' ? টি.ভি. সিরিয়ালও তাে একতার্থে সিনেমা। 'এ্যান্টনি ফিরিঙ্গি প্রায় পাঁচ
দশক আগে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ছবি যা দর্শক মনে প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন, এখনও যে ভাল লাগার রেশ
কাটেনি। সেই এ্যান্টনী ফিরিঙ্গির সূত্র ধরে সম্প্রতি তৈরী হয়েছে জাতিস্মর নামের একটি উন্নত মানের
ছবি। এই ছবিটিতে পূর্বতনছবিটির অনেকদৃশ্যও গানের পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে যাকে অনুকরণ বলা
যাবে না, বরং বলতেই হয় এক একটি শৈল্পিক
প্রয়ােগ। এই ছবিটিতে কিন্তু নামের ব্যাপারে নির্মাতারা
বেশ পাশ কাটিয়ে গেছেন এবং নাম রেখেছেন "জাতিশ্মর। অত্যন্ত বিষয় ভিত্তিক এই নামকরণ।
ছবিটির নাম যদি হত' এ্যান্টনি ফিরিঙ্গী? দর্শক যেমন পুরনাে দিনের গানে আপ্লুত হন, ঠিক একইভাবে
কোন কোন পুরনাে সিনেমাতেও নষ্টালজিক হয়ে পড়েন। সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবনার একটি ছবির নামকরণ
যদি পুর্বের কোন ভাল লাগা ছবির নামেই হয় তাহলে কিন্তু দুটো ছবির মধ্যে তুলনার প্রশ্ন ও
এসে পড়ে
এবং প্রথম ছবিটির দর্শক আহত হতেই পারেন। এতে যেন একটা প্রজন্মের আবেগকেও অন্বীকার করা হয়। উত্তম-সুচিত্রাজুটির প্রায় প্রত্যেকটি ছবিই তাে প্রজন্মের পর প্রজন্মদর্শকমনে গেঁথে আছে।
যদি দ্বিতীয় বার কোন ভিন্ন আঙ্গিক ও ভাবনার ছবির নাম হয় শাপমােচন বা অগ্নীপরীক্ষা ? তাহলে
কোন কোন দর্শক মনে কী বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, তা তাে সহজেই অনুমেয়। আর সিনেমার মতন একটি
মাধ্যমের ক্ষেত্রে-যেখানে দেখা হয় লেখকের সম্মতি ছাড়া যেন কাহিনী নির্বাচন না হয় বা অন্য ভাষার
চলচ্চিত্রের থেকে যেন সরাসরি অনুকরণ নাा হয় অথবা ছবিটি যেন কোন গােষ্ঠীর ভাবাবেগে আঘাত না
করে।
মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলাছবির নাম সিটি লাইটস'। এই নামের চার্লি চ্যাপলিনের
যাতিক, যা বাঙালি দর্শক মনেও স্থান করে নিয়েছে। তাহলে কেন এই পুনরাবৃত্তি?
কোন বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের বিপনির নাম যদি হয় 'সিটি লাইটস তাহলে অবশ্য বলার কিছু থাকে না,
কারণ ক্ষেত্র দুটি পৃথক। সম্পূর্ণ ভিন্ন ভাবনার ও চলনের কোন কোন ছবির নাম যদি পুনরায় রাখা হয়
বাই সাইকল থিপ' অযান্ত্রিক' বা রসােমন?এই সব ক্লাসিক ছবিগুলির নাম তাে বিভিন্ন চলচ্চিত্র
বিষয়ক লেখায়, সেমিনারে বারবার উঠে আসে। তখন কিন্তু কোন ছবিটির কথাবলা হচ্ছে, প্রথমটির না ্বিতীয়টির- তা নিয়ে সাধারণ পাঠক বা শ্রোতা মহলে কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা দিতেই পারে। সিনেমার
দর্শক সমাজও এই নাম বিভ্রাটের শিকার হতে পারেন।
কই, সাম্প্রতিক কোন উপন্যাসের নাম তাে তিতাস একটি নদীর নাম পুতুলনাচের ইতিকথা
বা আনা কারেনিনা রাখা হয় না। 'লাস্ট সাপার'-এই ক্যাপশনের কথা উঠলে তাে লিওনার্দো দা
ভিঞ্চির আঁকা বিখ্যাত ছবিটির কথাই মনে পড়ে। তাহলে কেন সিনেমার নাম নির্বাচনে এই দায়সারা
ভাব। বাংলা শব্দভান্ডারে কি টান পড়ে গেল ? নাকি অন্য কোন কারণে এই পুনরাবৃত্তি।
পথের পাঁচালি ছবির অপুচরিত্রেরঅভিনেতার আদলে তৈরী উন্নতমানের ছবিটির নাম অপুর
পাঁচালি। এতেও নামে নামে সংঘর্ষ ঘটেনি। কিন্তু মদি কখনও এমন হয় যে একটি ডান্স আর
র ছবির নাম পথের পাঁচালি! তাহলে ?
তাহলে কি চলচ্চিত্রের নামে কিছুই আসবে যাবে না?