ধারাবাহিক উপন্যাস: চন্দ্র গোধূলি
তাপস দত্ত
********
চন্দ্র ভেসে চলতে লাগল অশান্ত জলরাশির সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে। একটা
বড় গাছ তখনাে জলের সঙ্গে যুদ্ধ করে তখনাে দাঁড়িয়ে আছে। চন্দ্র গাছের ডালে আশ্রয় নিলে। নদীর অশান্ত স্রোতে অনেকখ…
ধারাবাহিক উপন্যাস: চন্দ্র গোধূলি
তাপস দত্ত
********
চন্দ্র ভেসে চলতে লাগল অশান্ত জলরাশির সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে। একটা
বড় গাছ তখনাে জলের সঙ্গে যুদ্ধ করে তখনাে দাঁড়িয়ে আছে। চন্দ্র গাছের ডালে আশ্রয় নিলে। নদীর অশান্ত স্রোতে অনেকখানি পথ পেরিয়ে এসেছে। প্রায় দুই দিন
পরে জল যখন নেমে গেল কতদুর জলের স্রোতে ভেসে এসেছে তা কল্পনা করতে পারল না চন্দ্র। জল নেমে যাওয়ার পর চন্দ্র স্থলভূমির ওপর দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। অনেকখানি পথ হেঁটে যাওয়ার পর চন্দ্র দুরে দেখতে পেল একটি গির্জা। সূর্য সবে পূর্বদিকে উঁকি দিতে শুরু করে। সূর্য তার অনুপম সৌন্দর্য্য দিয়ে পৃথিবীকে ধ্বংসের পর সাজিয়ে তুলতে চাইছে। গির্জায় ঘন্টার শব্দ পাওয়া গেল। অনেক দিন পেটে কিছু পড়েনি। চন্দ্র খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দেখল গির্জায় ফাদার প্রার্থনা করছেন।
চন্দ্র ধূলাে পায়ে, ক্লান্ত শ্রান্ত বেশভূষায় প্রবেশ করল গির্জাতে। যিশুকে প্রণাম করল। ফাদার কিছুক্ষন পর ওর দিকে তাকালেন।
-তুমি ক্ষুধার্ত। কিছু খেয়ে নাও। তারপর কথা হবে। বলেই উনি চলে গেলেন। কিছুক্ষন পরে ভেতর থেকে নিয়ে এলেন কিছু চিড়ে আর গুড় সঙ্গে এক গ্লাস জল।
-আমি রেভারেন্ড আপ্তে। তুমি কে? কোথা থেকে আসছ ?
-আমি বানে ভেসে আসা একজন অসহায় মানুষ।
-থাক তুমি যখন নিজে পরিচয় দিতে চাও না তাহলে থাক। তুমি এখন বিশ্রাম নাও আমি আসছি।
-আর কেউ থাকে না এখানে ফাদার ?
-থাকেন সিস্টার মারিয়া উনি এখন রােগীদের সেবাতে গেছেন। আজ প্রায় পাঁচদিন হতে চলল। এখনাে মারিয়া ফেরেন নি। আজ হয়ত ফিরবেন। চন্দ্র কতক্ষণ যে ঘুমিয়েছে মনে নেই। চারিদিকে আঁধার নেমে এসেছে।
সামনে দুটো মােমের বাতি জ্বলছে। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বাইবেল পড়ছেন একজন সুন্দরী মহিলা। কি আশ্চর্য রূপ, যেন স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য নেমে এসেছে পৃথিবীতে। ঈশ্বরের যা কিছু সুন্দর তা দিয়েই তৈরি করেছেন এই মহিলাকে।
এই মহিলা কে? মনে প্রশ্ন এলাে চন্দ্রের। ইনিই কি সিস্টার মারিয়া?কিছুক্ষণ পরে উনি মুখ তুলে দেখলেন।
-কি এখন সুস্থ বােধ করছেন তাে?
-হ্যাঁ।
-আপনি খুব চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন আমাদের। আপনি প্রায় তিন দিন জ্বরে বেহুঁশ ছিলেন।
চন্দ্র অবাক হয়ে গেল। ওর মনে হলাে যেন এই মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম। চন্দ্র একটু নড়ে চড়ে বসতেই নিজের শরীরের অবস্থা টের পেল। সর্বাঙ্গ যেন পাকা ফোঁড়ার মত ব্যথা। বিশেষ করে পা দুটো যেন লুপ্ত অঙ্গের মতাে অবশ হয়ে গেছে।
-তিন রাত আপনার সেবা করে চলেছি। সারারাত ধরে বাইবেল পড়ে ভোরের সূর্য ডেকে এনেছি। মনে মনে ভীষন ভয় হচ্ছিল।
আপনি সিস্টার মারিয়া, তাই না?
হ্যাঁ, কিতু আপনি কি করে জানলেন? আপনার সঙ্গে তো আমার দেখা
হয়নি আগে কোথাও।
-ফাদারের কাছে শুনেছি।
যাক আপনি যখন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। আপনি এখন বিশ্রাম নিন। আমি পাশের গাঁ গুলাের খবর নিয়ে আসি। ফাদার একা গিয়েছেন।
কেন কি হয়েছে? প্রশ্ন করে চন্দ্র। বন্যার প্রকোপে ঘর বাড়িতো ভেসেই গেছে, তার ওপর বন্যা নেমে যাওয়ার পর প্রচুর আন্ত্রিকের প্রকোপ বেড়েছে। প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে।
আমাকে যেতে হবে গাঁ গুলোতে। -আপনি বিশ্রাম করুন।।
-আপনি কখন আসবেন সিস্টার?
-আমি আজ ফিরে আসতে নাও পারি। হয়ত সপ্তাহ খানেক পরে ফিরে আসতে পারি।
ঔষধগুলাে ঠিক মতাে খাবেন। টেবিলের ওপর রাখা আছে।
-আমি চললাম। যেত যেতে বলল, আশে পাশের গাঁণ্ডলােতে কোনাে ডাক্তার থাকায় মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। চন্দ্র মারিয়ার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকল। ক্রমে সিস্টার মারিয়া ছােট হতে হতে মিলিয়ে গেল ওই সীমানায়। চন্দ্র একেবারে একা। চোখ পড়ল যিশুর ছবিতে কেমন যেন প্রশান্ত হাসি যিশুর মুখমন্ডলে। কে যেন বলল-তুমি যাও! ওদের সেবা করাে। তােমার সব শেষ হলেও এখান থেকে শুরু করাে। ওরা জানে তুমি মৃত। চন্দ্রের মনে হল সত্যিই তাে, নিশ্চই সুখেন জেলে গােধূলির কাছে ওর মৃত্যুর খবর পৌঁছে দিয়েছে। আচ্ছা ওরা কি খুঁজবে আমায় ? না-না ওরা আবার খুঁজতে যাবে কেন? গােধূলি সারা জীবনই ঘৃণা করে এসেছে। না আমার আর কারাের দরকারই বা কি?না হয় বাকি জীবন এখানে যিশুর সেবায় কাটিয়ে দেব। চন্দ্র মনে মনে ভাবল-না-না আমি আর বিশ্রাম করব না। গরীব অসহায়দের চিকিৎসা। করবাে। নিজে যতটা ডাক্তারি জানি তাই যছেষ্ট। আর বসে থাকা মানায় না। সিস্টার মারিয়া বলেছিলেন এখানে ডাক্তারের বড়াে অভাব। গীর্জা থেকে বেরিয়ে এলো চন্দ্র। সূর্য মধ্য গগনে কিরণ দিচ্ছে। কয়েকটা ডাক্তারি ফন্ত্র কিনতে হবে। কিন্তু টাকা কোথায় পাবে। চন্দ্র আবার গির্জার ভেতরে এলাে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর শ পাঁচেক টাকা পেল চন্দ্র। কিন্তু বাজার কতদুর,
তা জানে না চন্দ্র। গাঁয়ের একটি লােককে জিজ্ঞাসা করে।
ভাই এখান থেকে বাজার কত দুর ?
এখান থেকে কুড়ি পঁচিশ মাইল হবে।
-এটা কোন গ্রাম?
-এটা পির পঞ্জাল গ্রাম।
আচ্ছা ওই বাজারে কোনাে হাসপাতাল বা ঔষধ দোকান আছে ?
যেতে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। চন্দ্র ওই শরীরের ওপর দৌড়তে লাগল। এই অবসন্ন ক্লান্ত দেহে । মাঝে মাঝে গাঁগুলাে থেকে স্বজন হারানাের কান্নার রােল শােনা যায়। মাঝে মাঝে নির্জন নদী তটের দিকে থেকে
ভেসে আসে পচা গলা শবদেহের দুর্গন্ধময় বাতাস। মাঝে মাঝে শেয়াল শকুনের
চিৎকার শােনা যায়। তারই মাঝে এগিয়ে চলে সামনে। সামনের গাঁয়ে একটা জটলা
দেখে চন্দ্র এগিয়ে যায়। একজন মেয়ে বুক চাপড়ে কাঁদছে। চন্দ্র একজন কে জিজ্ঞাসা
করে-দাদা কি হয়েছে এখানে?
সাদা চুলগুলো এলােমেলাে করতে করতে বুড়াে বলল ওই ছেলেটাকে দেখছেন খাটিয়ার ওপর শুয়ে আছে, বন্যার সময় সাপে কেটেছে। ওর মায়ের আর কেউ নেই। ওই ছেলেটাই ওর একমাত্র ভরসা ছিলাে। তাও আবার আল্লা
কেড়ে নিল। বৃদ্ধকে জিজ্ঞাস করল চন্দ্ৰ-আচ্ছা এখান থেকে বাজার কত দূর হবে?
-বাজার আর বেশি নয়। চন্দ্র এগিয়ে চলল মাঝে মাঝে গােধূলির কথা মনে পড়ে। মনটা বিষ হয়ে পড়ে। কেন তুমি আমায় ভুল বুঝলে গােধূলি। যেদিন তুমি তােমার ভুল বুঝতে পারবে সেদিন সব শেষ হয়ে যাবে। চোখের জল ওর চিবুক ভাসতে লাগল। পথ চলতে চলতে হঠাৎ চন্দ্র লক্ষ্য করলাে, একটি শেয়াল ঝোপের মধ্যে কি
যেন একটি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
******
...........…… চলবে