অণুগল্প-- অন্নপূর্ণা
মালবিকা মজুমদার
বনেদিয়ানার কিছু অবশিষ্ট থাকলে, তা একমাত্র এই পূর্ব পুরুষদের আমলের বিশালাকার বাড়িটা ।জমিদারির ঐতিহ্য বহন করে ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বেশির ভাগ অংশই যত্নের অভাবে ভেঙে পড়ছে । জায়গায় জায়গায় আগাছা,…
অণুগল্প-- অন্নপূর্ণা
মালবিকা মজুমদার
বনেদিয়ানার কিছু অবশিষ্ট থাকলে, তা একমাত্র এই পূর্ব পুরুষদের আমলের বিশালাকার বাড়িটা ।জমিদারির ঐতিহ্য বহন করে ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বেশির ভাগ অংশই যত্নের অভাবে ভেঙে পড়ছে । জায়গায় জায়গায় আগাছা,আর বিগত স্মৃতি আঁকড়ে নিঃশ্বাস নিয়ে চলছে।
দেওয়াল এর কঙ্কাল সার ইটের বুক চিরে দখল নিচ্ছে বটের শক্ত শেকড়। এই বাড়িতে এখন তিনটে মানুষের বাস। মিত্র ভিলার নেম প্লেটটা সদর দরজায় একটা পাশ ভেঙে কোন রকমে অস্তিত্ব রাখছে। সজল মিত্র অত্যন্ত সদাশয় ব্যক্তি । বিলেতের পাশ করা ডাক্তার । তবে কথায় বলে না , ভালো মানুষের ই ভাতের অভাব হয়। এদের না দেখলে কথাটা যে কতটা সত্যি ! তা সন্দেহ থেকে যেতো । গ্রামের মানুষের কতো উপকার এই মানুষটি দিনের পর দিন করে গেছেন, বিনামূল্যে চিকিৎসা ঔষধ পথ্য সব ই দিয়েছেন । জমানো কলসির জল ক্রমাগত কমতে কমতে তলানিতে পৌছেছে। একমাত্র মেয়ে অন্নপূর্ণার সামান্য বেসরকারি স্কুলের চাকরি সংসারের একমাত্র আর্থিক সম্বল ছিলো।
এই মৃদুভাষী শান্ত অন্নপূর্ণা বা অপা র জীবনটা হয়তো এমনটা না হতে পারতো , অলখ্যে বসে বিধাতা পুরুষ , সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ওর কপালেও লিখে ছিলেন । কিন্তু বিধি বাম হলে কোন শক্তি তা কীভাবে প্রতিরোধ করবে ? ওর জীবনে থেকে সুখের সমীকরণ মুছে দিয়েছিল ও নিজেই। তাই সব কথা তার নিজেকে ই রোজ বলে । রাতের অন্ধকার নামলে অপা আগের মতো ছাদের ঘরে এসে বসে । নিজের অতীতের হিসেবের খাতা খুলে বসেও কিছুই মেলাতে পারে না। আজ হঠাত্ স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় দীর্ঘ পনেরো বছর পর রাজর্ষিদা কে দেখতে পেয়ে সে যেন একটু বেশিই ভেঙে পড়েছে । অপার সাথে কলেজে পড়তো রাজর্ষি, মাত্র দুই বছরের সিনিয়র । কলেজে বার কয়েক দুজনের সাক্ষাৎ হলেও কথা বিশেষ কিছু হয়নি । তবে ওদের দুজনের মধ্যে কী একটা আত্মার টান ছিলো দুজন আজ ও বুঝে উঠতে পারেনি । একটা চিঠি লিখেই রাজর্ষি তার সব কথা জানিয়েছিলো । কিন্তু অপা সে কী করে বলবে তাকেই সে ভালোবাসে । তাকে দেখার জন্য কতবার সে কলেজের ক্যান্টিনে দূর থেকে তাকিয়ে থেকেছে । তাকে দেখার জন্য কতবার অকারণে ছাদের থেকে ওদের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকেছে। কিন্তু কী করে তার মা বাবাকে ছেড়ে সুখের সংসার সাজাবে ! অপা , কোনদিন সে চিঠির উওর দেয়নি । তার মনের গোপন কুঠুরিতে সবটুকু রাখা ছিল। অপা একদিন স্কুল থেকে আসতেই তার মা অপাকে বলল-- ... অপার জন্য বিয়ের সম্বন্ধের কথা বলতে , রাজর্ষির বাড়ি থেকে তার বাবা এসেছিলেন । অপা কে দেওয়া চিঠির উওর না পেয়ে, তার বাড়ির দরজায় পর্যন্ত সুখ এসে ছিলো .... সে অত্যন্ত অনাদরে তাকে ফিরিয়ে দেয় । আর কোন দিন তাদের দেখা হয়নি। অপার সামনে পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে ।বাড়িতে সে একমাত্র পরিবারের আর্থিক সম্বল । সে কি করে তার মা বাবাকে ছেড়ে যাবে ? ওনাদের কে দেখবে ? সে অনেক ভেবে কূল কিনারা না পেয়ে, বারণ করে দিলো । এ ঘটনার কিছুদিন পরেই অপার বাবা হার্ট অ্যটাক এ সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পরেন । অপা ভাবে সে ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছে । এভাবেই দিন থেকে রাত ও রাত থেকে দিন ,ঘড়ির কাটা ঘুরে যায় । জীবন বয়ে চলে নদীর স্রোতের মতো । অপার ও বয়স বাড়তে থাকে । মা বাবা কারো জীবনে চিরকাল থাকে না । সময়ের নিয়ম মেনে বার্ধক্যের হাত ধরে একলা অপা কে ফেলে চলে যান তাঁরা , না ফেরার দেশে।
কেমন অন্য এক অনুভূতিতে ' অপা' আজ একটু আনমনা, ঋতু টা যে ভালোবাসার বসন্ত , চারিদিকে প্রকৃতি রঙে রঙে সেজে উঠছে। অথচ তার জীবন থেকে সব রঙ যেন শেষ হয়ে গিয়েছে । বসন্তের পলাশ শিমূলের লাল রঙ আকাশের পূর্ণচন্দ্রে পূর্ণিমার জ্যোস্নালোকে আরো অপূর্ব লাগছিল।
এভাবেই তার দিন গতানুগতিক দিন কাটছিল।
হটাৎ সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে যখন রাজর্ষি কে দেখে আর পারেনি । নিজের হাতে যাকে সে ভালোবাসে নিজের থেকে বেশি ভালোবেসেছিল দুজনের স্বপ্ন কে খুন করেছে সে । অপা তার বন্ধুর কাছে জেনেছিল, তার জন্য রাজর্ষি ও কোন সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা পড়েনি। সামনে দেখতেই সব কথাই বুকের ভেতরে তোলপাড় করতে লাগলো । রাজর্ষি র তার দিকে চোখ তুলে তাকাতে, অপার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো।
নাহ্, কেউ কোন কথা বললো না ।
তবে চোখের ভাষায় দুজন দুজনের মনের কথা মোড়ে নিয়েছিল।
সেদিন সারাটা রাত অপা ঘুমোতে পারেনি ।
আবার ঠিক তার পরের দিন স্কুল থেকে অপা বাড়িতে ফিরছে । হঠাৎ, পিছন থেকে খুব পরিচিত কণ্ঠস্বর ....
"অপা...কেমন আছো ? ওর মুখে অপা . নামটা শুনতেই যেন সে আজো শত আঘাতে ও বেঁচে আছে ।
ফিরে তাকাতেই ..... দুচোখের জলের ধারা কোন বাধা মানে না ।
রাজর্ষি, ..ও যেন . মনে মনে জানাতো 'অপা' তাকেই ভালোবাসে ,....
ওদের দুজনের এই হাইপার একটিভ রিলেশন সকলের বোঝার কথা নয় ।
যারা কিছু পাওয়ার নেই জেনেও শুধু সারাটা জীবন ভালোবেসে যায় তারাই বুঝবে।
রাজর্ষি ... অপার হাতটা ধরে সোজা বাড়িতে নিয়ে গেলো।
মাকে ডেকে বলল... সব ব্যবস্থা করতে হবে ।
কালই সে শুভ কাজটি করবে।
এই ভাবেই সেদিনের গোধুলির আলোতে অপার জীবন থেকে সব অন্ধকার চিরদিনের মতো বিদায় নিলো। অপা আবার বসন্তকে নতুন করে ফিরে পেল।