ছোট গল্প
'টুকরো টুকরো আমি'
সুদীপ্তা চক্রবর্ত্তী।
০৩|০৫|২০২০
ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলতেই তিতির্ষা দেখে দুটো বাজে! চোখের জলটা গড়িয়ে শুকিয়ে গেছে, রয়ে গেছে একটা অস্পষ্ট দাগ! চোখটা জ্বালা করছে এবার শুয়ে পড়তে হবে! ল্যাপটপটা বন্ধ ক…
ছোট গল্প
'টুকরো টুকরো আমি'
সুদীপ্তা চক্রবর্ত্তী।
০৩|০৫|২০২০
ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলতেই তিতির্ষা দেখে দুটো বাজে! চোখের জলটা গড়িয়ে শুকিয়ে গেছে, রয়ে গেছে একটা অস্পষ্ট দাগ! চোখটা জ্বালা করছে এবার শুয়ে পড়তে হবে! ল্যাপটপটা বন্ধ করতে করতেই তিতির্ষার মনে পড়লো কিছু খাওয়া হয় নি আজ ডিনারে। এখন অর্ডার করলে হয়তো পাবে, কিন্তু সেটুকুও করতে ইচ্ছে করছে না। সত্যিই কি ভীষণ অগোছালো, এলোমেলো হয়ে গেছে ও! অফিসের কাজটুকু করতেই হবে না হলে খাওয়া জুটবে না, তাই সেটুকু বাদ দিয়ে যেন আর কিছুই করতে ইচ্ছে করে না ওর। অথচ ও তো এরকম ছিলো না!!!!
আরে ঝড় উঠেছে, জানলার পাল্লাগুলো পড়ছে ধপাস ধপাস করে! বৃষ্টি শুরু হতেই একান্ত অনিচ্ছায় উঠে বন্ধ করে সেগুলোকে! এটা কি ও, নাকি অন্য কেউ? কেন এই রূপান্তর!
ব্রিলিয়ান্ট তিতির্ষার মসৃণভাবে এগিয়ে চলা জীবন, প্রথম ব্রেক কষল তানিস্কের আগমনে। মাঝে মাঝে দুকলম লিখত তিতির্ষা, তানিস্কও তাই! সেরকমই একটা গ্রুপের গেট্টু তে প্রথম দেখা। এক একটা রবিবার এভাবে সময় কাটাতে বেশ লাগত তখন। পড়াশুনায় ব্যাতিব্যস্ত জীবন থেকে মুক্তি মিলেছে, সদ্য চাকরি পেয়ে। দুটো ছুটির দিন, হাতে যথেষ্ট টাকা, অথচ খরচ করার জায়গা নেই। উশৃঙ্খল জীবনটাকে ছোট থেকেই ঘৃণা করে ও! মনে আছে তানিস্কের বলা চারটে লাইন ওর দিকে তাকাতে বাধ্য করেছিল তিতির্ষাকে! খুব সাধারণ চারটে লাইন কিন্তু এখনো মনে আছে!
তুমি মাথা দিয়ে মন খোঁজ
মনের ঠিকানা নেই।
হৃদয়ের দ্বার খোলো বন্ধু
মনের আনাগোনা সেখানেই।।
সেই শুরু প্রথমে ফোন, তারপর মন দেওয়া নেওয়া। তিতির্ষার বাবা মায়ের ডিভোর্সের কারনে হস্টেলে বড়ো হওয়া তিতির্ষার কারো প্রতি তেমন টান ছিলো না। তানিস্কের বাবা নেই মা গ্রামে যৌথ পরিবারে থাকতেন। ওরা ঠিক করে লিভ ইন রিলেশনশিপে থাকবে! তানিস্ক বিয়েই করতে চেয়েছিল রাজী হয়নি তিতির্ষা।
আরে আগে কিছুদিন একসঙ্গে থেকে দেখি দুজনে দুজনকে টলারেট করতে পারছি কিনা, যদি পারি, তবে ভেবে দেখব নাহলে টা টা।
দেখ তিতির্ষা, শুধুমাত্র মজা করব এই চিন্তা থেকে একসাথে থাকব ভাবলে কিন্তু হবে না, দায়িত্ব নিতে হবে। আর ঘাড়ে পড়লে তবেই দায়িত্ববোধ তৈরি হয় মানুষের মধ্যে, কারন যে কোন সম্পর্কের মুল কথা হলো দায়িত্ব।কোনও কাজ যে মানুষটা করবে বলে ঠিক আছে, পাশের লোকটা যেন সেই কাজের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকে। আমি করতে পারিনি, ও তো করে নিতেই পারত এই ভাবনা কে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া বলে, যেটা কিন্তু সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার একটা বড়ো কারন। অসুবিধা থাকলে সেটা অপর জনকে জানিয়ে দিতে হবে।
দেখ তানিস্ক আমি তোর মতো অতো ভাবতে পারি না। এতো ভাবিস কেন তুই?
ভাবতেই হয় রে, না ভাবলে কোন কিছুই সৃষ্টি হয় না, সে কবিতাই হোক্ বা অমলেট!
ডিমের অমলেট নিয়ে আবার কি ভাবব?
ভাববি কতো রকম ভাবে বানানো যায়? জানিস তো আগে চোখের আরাম, তারপর পেটের আরাম। তিতির্ষা, এই যে আমরা একসঙ্গে থাকব ভাবছি, সেটা যেন পজিটিভ হয়। মানে বিয়ে করব এই ভাবনার যদি জোর না থাকে, কোনওদিন বিয়ে করতে পারব না আমরা, কারন লক্ষ্য স্থির না করলে সেখানে পৌছানো যায় না।
তিতির্ষার মাথায় এতো কিচ্ছু ঢোকেনি সেদিন, বোধহয় ঢোকাতে চায়নি বলেই! একটু বেশি বোঝে এবং জ্ঞানদাতা বলে মনে হয়েছিল তানিস্ককে। আজ বোঝে তিতির্ষা, তখন যদি তানিস্কের কথাগুলো একটু মন দিয়ে শুনতো, ভাবতো তাহলে হয়তো আজ এই ভয়ঙ্কর একাকিত্ব ওর সঙ্গী হতো না! এখন ওর খাওয়া ঘুম, কোন কিছুরই ঠিক নেই। রোবটের মতো অফিস আর বাড়ি! আগে তানিস্কের গায়ে পা তুলে না শুলে ঘুম আসত না, আর এখন ওষুধ ছাড়া ঘুম আসে না! কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না, এক লাইন কবিতা আসে না, কিরকম যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেছে সবকিছু। অথচ তানিস্ক যতদিন ছিলো ওর গোছানো স্বভাব, নিয়মানুবর্তিতা তিতির্ষার বাড়াবাড়ি মনে হতো! আজ বোঝে নিজে ভালো থাকার জন্য কিছু নিয়মের বাঁধন খুব প্রয়োজন। খুব চেষ্টা করেছিল তানিস্ক, তিতির্ষাকে বোঝাতে, সত্যিই সে ভালোবেসেছিল তিতির্ষা কে! ভালো তো তিতির্ষাও বেসেছিল তানিস্ককে, খুব ভালোবেসেছিল! কিন্তু আজ বোঝে ওর 'আমি কম কিসে' নামক ইগোর তলায় চাপা পড়ে গেছিল ভালোবাসা!
আজ হঠাৎ করেই তানিস্কের প্রোফাইলে ঢুকেছিল তিতির্ষা। স্ক্রল করে করে দেখছিল ওর, ওদের ছবিগুলো। তানিস্ক কোনোদিন ওকে ব্লক করেনি। ও প্রথমে আনফলো করেছিলো পরে উইড্র করে নিয়েছিল। তানিস্কের বউ বাচ্চা নিয়ে হাসি হাসি মুখে কতো ছবি! বউকে কোলে নিয়ে ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে একটা অসাধারণ ছবি ওর কভার পিকচার!!
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, বাজ পড়ছে! চিৎকার করে কেঁদে চলেছে তিতির্ষা! দমকা হাওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে ওর আওয়াজ, ঠিক যেমন হারিয়ে গেছে ওর....
আজ, ফার্নিচারের খাঁজে খাঁজে আটকে থাকা টুকরো টুকরো আমি, তুমিগুলোকে জড়ো করতে করতে জীব আর জড়ের পার্থক্যটাই জড়িয়ে গেছে মনে হয়! আসলে মানুষের দাম বুঝতে পারা, আর তাকে পেলে যে দাম দিয়েই কাছে রাখতে হয়, নাহলে সে হারিয়ে যায়, এটা ওকে কেউ কখনো শেখায়নি! খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে আজ তানিস্কের সঙ্গে, কিন্তু ও জানে ডায়াল করলেও কলটা......
