বিষয় : ছোটগল্প
শিরোনাম : এক বৈশাখী সন্ধ্যায়
কলমে : মৌমিতা ভট্টাচার্য্য
তারিখ :11. 05. 2020
সুশোভনবাবু মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে ঘোষণা করলেন, আমাদের প্রগতি সংঘের পক্ষ থেকে কবিগুরুর জন্মদিবসে শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি পারমিতা স্যান্যালের ক…
বিষয় : ছোটগল্প
শিরোনাম : এক বৈশাখী সন্ধ্যায়
কলমে : মৌমিতা ভট্টাচার্য্য
তারিখ :11. 05. 2020
সুশোভনবাবু মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে ঘোষণা করলেন, আমাদের প্রগতি সংঘের পক্ষ থেকে কবিগুরুর জন্মদিবসে শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি পারমিতা স্যান্যালের কন্ঠে গাওয়া একটি গান।
সৃজন কিছুক্ষণ ভাবতে থাকে এই নামটা লিস্টে তো ছিল না তো, ইনি আবার কে? কাল রাতে সুশোভনকাকার সাথে সংঘের সব সদস্যরাই ফাইনাল মিটিংয়ে ছিল, অনুষ্ঠানসূচী খুবই বিবেচনার সাথে সাজিয়ে নেওয়া হয়েছে, তবে শেষ মুহুর্তে এই ভাবে কাউকে মঞ্চে ডাকা কেন?
চিন্তার তার ছিঁড়ে কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে থাকে সৃজন ;উজ্জ্বল বর্ণ, ছিপছিপে গড়নে লালপাড় সাদা শাড়ি, ডান হাতে একটা সোনার বালা, বাম হাতে ঘড়ি, গলায় হালকা সোনার চেন, চুলে হাতখোঁপা করে জড়ানো জুঁইয়ের মালা ;চোখ দুটিতে অপার স্নিগ্ধতা। মঞ্চের মাঝে এসে বসে পারমিতা, হারমোনিয়াম বাজিয়ে ধীর কন্ঠে শুরু করে "কি গাব আমি, কি শোনাব আজি আনন্দধামে"।সকলেই বিস্মিত, গান শেষে করতালিতে ভরিয়ে দেয় মুগ্ধ শ্রোতারা। সকলকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে মঞ্চ ছেড়ে নেমে আসে পারমিতা। মুগ্ধতার ঘোর লেগে থাকে সৃজনের চোখে, চমক ভাঙে বিনয়ের ডাকে,
-কি রে লিস্টটা দে, অনুষ্ঠান শেষ, যা কিছু নিয়ে আসা হয়েছিল লিস্ট দেখে মিলিয়ে নিই চল।
-বিনয়, কে রে এই পারমিতা স্যান্যাল?
-এই যে গান গেয়ে গেল?
-হুম..
-ও তো সুশোভনদার ভাইঝি।
-কই আগে দেখিনি তো।
-সে আমিও দেখিনি, কি সুন্দর গান গাইল বল?
-হ্যাঁ রে..
-চল সব ঠিক করে দেখে নিই।
-হ্যাঁ চল।
অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরতে সৃজনের অনেকটা রাত হয়ে গেল। সারাটা রাস্তা সৃজন মনে মনে গুনগুন করেছে "কেমনে গলাব হৃদয় প্রাণ তোমার মধুর প্রেমে" ; কি অপূর্ব কন্ঠ, গান গাইবার কি অপরূপ ভঙ্গিমা, যেন মনে হচ্ছিল স্বয়ং কবিগুরুকে সামনে বসিয়ে তাঁর চরণে অর্ঘ্য নিবেদন করছে।
বাড়ি ফিরতে কণিকাদেবী বলেন,
-কী রে অনুষ্ঠান কেমন হল?
-খুব সুন্দর মা, তোমায় এত করে যেতে বলে গেলাম ;তুমি গেলে না কেন?
-তুই তো জানিস বাবা আমি এই সব অনুষ্ঠানে যাই না, আমার ভালো লাগে না।
-মা তোমার ওই এক কথা, ভালো লাগে না, তোমার যে কি করে রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান ভালো লাগে না আমিও বুঝতে পারি না, আমার তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান শুনলেই মনে কেমন ঘোর লেগে যায় ;শুধু তোমার মুখেই শুনলাম তুমি গান ভালোবাসো না।
-সবাই কি সব ভালোবাসতে পারে রে বাবা?ফ্রেশ হয়ে আয়, খেয়ে নিই দুজনে, অনেক রাত হল।
-মা, সত্যিই তুমি গান ভালোবাস না?
-না রে বাবা, ভালোবাসি না, পছন্দও করি না।
-মা...
-আয় বাবা খেতে আয়, কাল সকালেই তো অফিস।
-হুম, আসছি।
সৃজন ঘোষাল, বছর দুই হল সরকারী ব্যাংকে চাকরী পেয়েছে, পড়াশোনায় বরাবরই ভালো। চাকরী পাওয়ার আগেই বাবাকে হারিয়েছে। মা, ছেলের সংসার, দিন কেটে যায় গল্প- কথায়। কণিকাদেবী এবার ছেলের বিয়ের কথা ভাবছেন, তবে যে দুজায়গায় ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়েছিলেন ওনার ঠিক মনে ধরেনি। সৃজনের এই নিয়ে অত মাথা ব্যাথা নেই, মায়ের ওপর তার সব ভরসা, মা ওর জন্য সঠিক সিদ্ধান্তই নেবে।
কণিকাদেবী সংসারী মানুষ, সারাজীবন সংসারে মন দিয়েছেন, খুব একটা বাড়ির বাইরে বের হন না। স্বামী এতকাল সব সামলে দিয়েছেন, এখন বাইরের সবকিছু ছেলের দায়িত্বে। শুধু একটা ভালো সম্বন্ধ দেখে ছেলেটার বিয়ে দিতে পারলে ওনার কর্তব্য লাঘব হয়।
সপ্তাহখানেক পর অফিস যাওয়ার পথে সৃজন চমকে তাকায়, বাসস্টপে দাঁড়িয়ে পারমিতা না? হ্যাঁ সেই তো, এ মুখ একবার দেখলে ভোলা যায় না। হালকা সবুজ চুড়িদারে কি লাবণ্যময়ী লাগছে! দেখলে মনটা স্নিগ্ধ হয়ে যায়। তবে ও বাসস্টপে কেন? ও কি বাড়ি ফিরে যাচ্ছে? সৃজন এগিয়ে যায় পারমিতার সামনে।
-নমস্কার, আমি সৃজন ঘোষাল, প্রগতি সংঘের সদস্য। ওই যে সেদিন আমাদের সংঘের অনুষ্ঠানে আপনি গান করলেন।
-নমস্কার। আমি সেদিন আপনাকে দেখেছি।
-তাই! আপনি কি অপূর্ব গান করেন।
-ধন্যবাদ।
-আপনি কি বাড়ি চলে যাচ্ছেন?
-মানে?
-না মানে আপনি তো সুশোভনকাকার ভাইঝি? তাই বলছিলাম কাকার বাড়ি কি বেড়ানোর দিন শেষ হয়ে গেল?
-না, এখনও কিছুদিন থাকবো। গান শিখতে যাচ্ছি। বাস এসে গেছে। আসছি, নমস্কার।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, নমস্কার।
পারমিতা চলে যেতে সৃজনের ইচ্ছা হল নিজের গালে নিজেই একটা চড় লাগায়, শুধু রাস্তার মাঝে বিষয়টা বড় হাস্যকর হবে বলে থেমে গেল নিজেই। মনে মনে বলতে থাকে, মা ঠিকই বলে আমি সত্যিই বোধ হয় কোনওদিন বড় হব না, ওই বাসটা করেই তো আমায় অফিস যেতে হবে। তবে আমি বাসে না উঠে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম কেন? একে তো অফিসের দেরি হবে এবার, তার ওপর জানা হল না কোথায় গান শিখতে যাচ্ছে? অন্তত ফোন নাম্বারটুকুও যদি চাইতাম। না না, এই ভাবে ফোন নাম্বার চাইলে হয়তো আর কথাই বলতো না। তবে আর কি, এবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করি। না তবে একেবারে বোকা আমি নই, এটুকু তো জেনেছি এখন কিছুদিন অন্তত এখানে থাকবে।
সুশোভনবাবু আর সীমাদেবী নিঃসন্তান দম্পতি। পারমিতা তাদের বাড়িতে আশায় দুজনে ভীষন খুশি। যতদিন মেয়েটা থাকে অন্তত বাড়িতে মনে হয় প্রাণ আছে। যদিও পারমিতা খুবই শান্ত স্বভাবের মেয়ে ; আগে যদি বা উচ্ছ্বল ছিল, এখন তো আরও শান্ত হয়ে গেছে। গানই তো ওর একমাত্র সাধনা, ওই নিয়েই বেঁচে আছে মেয়েটা। ভগবান মেয়েটাকে রূপে, গুনে ভরিয়ে দিয়েছেন, শুধু মেয়েটার কপালে একটু সুখ সইলো না।
সৃজন অপেক্ষা করতে থাকে পরের বুধবারের, নিশ্চয়ই আবার দেখা হবে দুজনের। এক সপ্তাহ পার হতে যে এত সময় লাগে তা আগে কখনও বুঝিনি।
বহু অপেক্ষার পর আজ সেই বুধবার। সৃজনের অফিস যাওয়ার একটু বেশিই তাড়া আজ। যদিও বিষয়টা মায়ের চোখ এড়িয়ে যায় না, মা বলেন - কি রে আজ কি অফিস তাড়াতাড়ি যেতে হবে?
-না মানে হ্যাঁ ওই কয়েকদিন বাস সময়ে না পেয়ে একটু দেরি হয়ে যাচ্ছে।
-আচ্ছা, সাবধানে যাস বাবা।
-হ্যাঁ মা, আসছি।
সৃজন প্রায় ছুটতে ছুটতে বাসস্টপে আসে। দূর থেকেই দেখে পারমিতা নেই। চলার গতি কমে যায়, এতটা হতাশ লাগে! কত আগে এসেও ও চলে গেল? চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সৃজন। কিছু পরে চোখে পড়ে হালকা গোলাপী রঙের চুড়িদারে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে পারমিতা। সৃজনের সারা শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। কাছে আসতেই সৃজন বলে বসে, - আমি ভাবলাম আপনি বোধহয় চলে গেছেন।
-কেন ভাবলেন?
কি বলবে ভেবে পায় না সৃজন, সত্যি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিশ্চয়ই কিছু ভুল বলে বসেছে।
-না মানে ভাবছিলাম আপনি বোধহয় গান শিখতে চলে গেছেন। জানেন আপনি যে দিকে গান শিখতে যান আমার অফিসও তো ওই দিক দিয়েই, তবুও আগের দিন আপনার বাসে উঠলাম না, আর আমার অফিস যেতেও দেরি হল।
-আমি তো আপনাকে বাসে উঠতে বারণ করিনি।
সৃজন খুব ভালোই বুঝতে পারছে ও ভীষন অগোছালো কথা বলতে শুরু করেছে।
-না বলেননি, আমিই ভুলে গিয়েছিলাম ।
-কি?
-বাসে উঠতে।
-সৃজনবাবু আপনি কি বলছেন আমি একটুও বুঝতে পারছি না, বাস আসছে, আমি চলি, নমস্কার।
-আমি যাব তো, সেটাই বলছিলাম।
এবার ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে যায় পারমিতার। ভিড় বাস। দুজনে কোনও রকমে একটা জায়গায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যায়। সৃজন বলে বসে, - পরের সপ্তাহ থেকে আমার বাইকটা নিয়ে আসব? আপনি কোথায় গান শিখতে যান আমি পৌঁছে দেব?
-না। ধন্যবাদ।
-রেগে গেলেন কেন? দেখুন না কি ভিড় বাস।
- আমি পরনির্ভরশীল হতে চাই না সৃজনবাবু।
-ও সরি, আমি শুধু একটু সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।
-প্রয়োজন হবে না, ধন্যবাদ।
এবার চুপ করে যায় সৃজন। সত্যি বড় ভুল বকে চলেছে ও। পারমিতা বলে, আমি নামব, চললাম। সৃজনের মনে হয় পুরো বাসটাই ফাঁকা হয়ে গেল। মুখে কোনও রকমে বলে, আসুন।
তবে কি সৃজন সত্যিই প্রেমে পড়ল! না উচিত নয়। পারমিতা গান ছাড়া কিছু বোঝে না, আর কণিকাদেবী গান একেবারেই পছন্দ করেন না। এ সম্পর্ক অসম্ভব। কিন্তু এক মুহুর্তও কেন পারমিতাকে ভুলতে পারে না সৃজন!!
আবার অপেক্ষা শুরু হয় বুধবারের। সময় আর এগোতে চায় না। কে বলেছিল চব্বিশ ঘণ্টা ধরে পৃথিবীটাকে ঘুরতে, বারো ঘন্টা ঘুরলে কি পৃথিবীর খুব ক্ষতি হয়ে যেত?
অবশেষে আসে সেই কাঙ্খিত বুধবার। সৃজন প্রতিজ্ঞা করতে করতে যায়, আজ আর কিছু ভুল বলবো না। বরং জানতে চাইব পারমিতার বাড়ি কোথায়? পড়াশোনা কি নিয়ে? কোন্ বছর Graduation complete করেছে? ভবিষ্যতে কি করতে চায়? প্রশ্নগুলো প্রায় মুখস্ত করতে করতে বাসস্টপে এসে পৌঁছায় সৃজন। মুখস্ত তো শেষ, সুযোগ পেলে এবার সব প্রশ্নগুলো একসাথে বলে ফেলতে পারবে, তবুও পারমিতার দেখা নেই। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত লাগে ভীষন। এক সময় ধীর পায়ে বাসের দিকে এগোতে থাকে সৃজন।
সারাদিন কাজে মন বসে না। টাকার হিসাব মেলাতে গিয়ে আজ সৃজন যে কত ভুল করল! শেষে কল্লোলদা বলেই বসলেন, সৃজন কি আজ যোগ বিয়োগ ভুলে গেলে?
বাড়িতে ফিরে বড় অস্থির লাগে, পারমিতার শরীর ঠিক আছে তো? বহুবার ফোনটা হাতে নিয়েও রেখে দেয় সৃজন। শেষে আর থাকতে না পেরে ফোনটা করেই ফেলে।
-হ্যালো..
-হ্যাঁ সুশোভনকাকা, কেমন আছ?
-কি রে সৃজন তুই? ভালো আছি।
সুশোভনবাবুর পাশেই বসে একটা ম্যাগাজিনে চোখ বোলাচ্ছিল পারমিতা, চমকে ওঠে।
-হ্যাঁ এমনিই ফোন করেছিলাম। তোমার বাড়ির সবাই ভালো আছে?
-বাড়ির সবাই বলতে তোর কাকিমা তো, হ্যাঁ ভালো আছে।তুই ভালো আছিস তো?
-হ্যাঁ ঠিক আছি। আচ্ছা রাখছি গো।
-হ্যাঁ রাখ।
ফোনটা রেখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে সুশোভনবাবু বলেন, সৃজনের আবার হল কি? হঠাৎ ফোন করে খোঁজ নিচ্ছে, তুমি কেমন আছ? আমি কেমন আছি!
সীমাদেবী হেসে বলেন, ছেলেটা খুব ভালো গো, সেই ছোট থেকেই দেখছি তো; যেমন পড়াশোনায় ভালো, তেমনি ভদ্র।
শুধু হাসে না পারমিতা, সৃজনের ফোন করার কারণ ও খুব ভালোই বুঝেছে। সুশোভনবাবুর দিকে ফিরে বলে, কাকা আমার ফোনটা খুব নেট প্রবলেম করছে, তোমার ফোনটা একটু দেবে?
-হ্যাঁ এই তো নে।
ফোনটা হাতে নিয়ে সৃজনের নাম্বারটা মুখস্ত করে নেয় পারমিতা। কিছুক্ষণ পর ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে বলে, কাকিমনি খেতে তো একটু দেরি আছে, আমি একটু ঘরে যাই?
-হ্যাঁ মা, যা। আমি খাবার সময় তোকে ডাকব।
ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয় পারমিতা। নিজের ফোন থেকে ফোন করে সৃজনকে।
Unknown number, সৃজনের বিরক্ত লাগে ফোন ধরতে। রিং শেষ হয়ে আসার মুহুর্তে ফোনটা রিসিভ করে,
-হ্যালো..
-হ্যালো, সৃজনবাবু বলছেন?
-হ্যাঁ, আপনি?
-আমি পারমিতা বলছি।
সৃজনের হাত থেকে ফোন প্রায় পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা। সামলে নিয়ে বলে,
-আপনি? ফোন নাম্বার কি করে পেলেন?
-কাকার ফোন থেকে নিলাম। কাকাকে ফোন করেছিলেন কেন? আজ যাইনি বলে?
-হ্যাঁ মানে না মানে আসেননি কেন?
-আজ স্যার ছুটি দিয়েছিলেন।
-ও, জানেন আমি কতক্ষণ অপেক্ষা করেছি!
পারমিতা শক্ত করে নেয় নিজেকে। কঠিন গলায় বলে,
-আমিও জানতে চাই কেন অপেক্ষা করেছেন?
আর লুকোতে পারে না সৃজন, বলে বসে,
-আমি আপনাকে ভালোবাসি।
কিছুক্ষণ উভয় প্রান্তই নীরব। নীরবতা ভাঙে পারমিতা,
-এটা আমার ফোন নাম্বার। আপনাকে আমি বিশ্বাস করি, আমি জানি আপনি আমার কোনও ক্ষতি করবেন না। যদি সম্ভব হয় রবিবার বিকাল পাঁচটায় বাইক নিয়ে বাসস্টপে আসতে পারবেন? নিয়ে যেতে পারবেন অন্য কোনও জায়গায়? আপনার সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই।
সৃজন প্রায় লাফিয়ে ওঠে, - হ্যাঁ পারব, কোনও অসুবিধা নেই।
-আচ্ছা, রাখলাম। আমায় আর ফোন করবেন না। রবিবার দেখা হবে। শুভ রাত্রি।
পারমিতা কেটে দেয় ফোনটা। সৃজন কিভাবে আনন্দটা ধরে রাখবে ভেবে পায় না। কি সাহসী মেয়ে! নিজেই ওর সাথে দেখা করতে চাইলো! মনে হতে থাকে, পৃথিবীটা খুব সুন্দর। কেন যে এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষগুলো রাগ করে, হিংসা করে ;সত্যি মানুষগুলো বড় বোকা। খাবার সময়ের আগেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করে সৃজন,
-ও মা, খেতে দাও। খিদে পেয়েছে সেই কখন থেকে।
-খিদে তো পাবেই, অফিস থেকে ফিরে কিছু খেলি না, টিফিন বক্স খুলে দেখি সেখানেও অর্ধেক খাবার পড়ে। হাত ধুয়ে আয়, খেতে বোস।
খেতে দিতে দিতে কণিকা দেবী বলেন,
-কি রে কিছু নিয়ে মন খারাপ ছিল? এখন মন ভালো হয়ে গেছে তাইতো?
-ও মা তুমি কি ভালো। সব বুঝতে পারো।
-কি হয়েছিল?
-ও কিছু না।
চুপ হয়ে যান কণিকাদেবী। উনি মানেন সন্তান বড় হলে তার নিজের একটা জগত তৈরি হয়।
ফোনটা রেখে পারমিতার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এসে পড়ে হাতে ধরে থাকা ফোনটার ওপর।
শনিবারের রাতটুকু প্রায় না ঘুমিয়েই কাটে সৃজনের। রবিবার সকাল থেকে নিজেকে অনেক শাসন করেছে। পারমিতা সামনে এলে সে যেন আবোল তাবোল বকতে শুরু না করে। বহুবার আয়নার সামনে রিহার্সাল দিয়েছে, কিভাবে কথা বলা উচিত। যদিও কোনওটাই ঠিক মনের মত হয়নি। খুব ইচ্ছে হয়েছে ঘড়ির কাঁটাটাকে ধরে ঘুরিয়ে দিতে।
বিকাল হতেই তৈরি হয়ে নেয় সৃজন, মাকে জানায় - মা এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।
-ফিরতে বেশি রাত করিস না।
-না মা, দেরি হবে না, আসছি।
বাসস্টপে এসে দেখে পারমিতা আগেই এসে গেছে। আজ পরেছে একটা সাদা চুড়িদার, মনে হচ্ছে যেন এক স্বপ্নপরী।
- আমি তো দেরি করিনি, আপনি কি একটু আগেই এসেছেন?
-হ্যাঁ, চলুন কোথায় নিয়ে যাবেন।
-একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে যাবেন?
-চলুন।
সৃজনের মনে হতে থাকে, জীবন এত সুন্দর! এত আনন্দও পৃথিবীর বুকে লুকিয়ে থাকে!!
রেস্টুরেন্টে পৌঁছে মুখোমুখি বসে দুজনে, পারমিতা কথা শুরু করে,
-আমার কিছু কথা আপনাকে বলার জন্য ডেকেছি।
-শুনব, তার আগে বলুন কি খাবেন?
-কিছু না।
-আচ্ছা, ঠান্ডা কিছু নিই? আমার না ভীষন তেষ্টা পেয়ে গেছে।
-নিন।
-জানেন, আমি তো ভাবতেই পারি নি আপনি আমায় ফোন করতে পারেন, বলুন।
কিছুটা সময় নিয়ে পারমিতা শুরু করে,
-সৃজনবাবু, আপনি আমায় আগেরদিন বলেছিলেন আমায় ভালোবাসেন, যদিও সেটা আমি আগেই বুঝেছিলাম, আমি শুধু আপনাকে জানাতে এসেছি, আমায় ক্ষমা করবেন। ভুলে যান সবকিছু। যতটুকু আপনাকে দেখেছি, আমার মনে হয়েছে আপনি ভীষন সহজ সরল মানুষ, জীবনের জটিলতা থেকে অনেক দূরে।
-কেন এইভাবে কথা বলছেন পারমিতা?
-বলছি কারণ আমি divorcee, তিন মাস হল আমার ডিভোর্স হয়েছে। তাই কাকা আর কাকিমনি আমায় এখানে নিয়ে চলে এসেছেন।
-ডিভোর্স??!!
-হ্যাঁ, চমকে গেলেন কেন? আমি divorcee, আর তার কারণ আমার গান। বিয়ের পাঁচ মাসের মধ্যেই আমার ডিভোর্স হয়। Graduation complete করার পর দেখাশোনা করে বিয়ে, আমার husband এর বাড়ি থেকে প্রথম কোনও সমস্যা ছিল না, বিয়ের পর খুব সুন্দর সময় কাটিয়েছি আমরা দুজন, যেমন হয় মানুষের সাধারণ জীবন। সমস্যা শুরু হয় আমার অনুষ্ঠানে গান করা নিয়ে। যেহেতু গানের জগতে আমি অনেকদিন যুক্ত, তাই আমার স্যার অনুষ্ঠানের জন্য যেতে বলেছিলেন। এই নিয়েই শুরু হয় নানান অশান্তি, এত নীচ মানসিকতার সাথে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি, আমার হারমোনিয়াম ভেঙে দেন শাশুড়ি মা। আমার বাবা সব কিছু জানতে পেরে আমায় নিয়ে আসেন, তার পর আর ফিরে যেতে দেননি। যেহেতু আমার বাবা লইয়ার তাই ডিভোর্স পেতে আমার দেরি হয় নি। সব থেকে মজার কথা আমার husband একজন শিক্ষিত মানুষ, শিক্ষিত পরিবারের সন্তান, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী।
সব কিছু শুনে কোনও ভাষা খুঁজে পায় না সৃজন। শুধু মনে হয়, আলোর পিছনের অন্ধকারটা এত নিকষ কালো কেন?
দুজনেই নীরব হয়ে বসে থাকে, পারমিতা ডাকে,
-সৃজনবাবু, এবার ফিরে চলুন। আমার কথা শেষ।
-হুম, চলুন।
আর একটাও কথা বলা হয় না সৃজনের। সাজানো পৃথিবীটা কে যেন দুহাতে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিয়ে চলে গেল।
মনে মনে হাসে পারমিতা, এরই নাম ভালোবাসা! সত্যিটা জানার পর আর বলার সাহস রইল না ভালোবাসি! ভীষন হাসি পায় পারমিতার, মনে হয় প্রাণ ভরে একবার হেসে নিই এই পৃথিবীর মুখোশ পরা মানুষগুলোকে দেখে।
বাসস্টপে পারমিতাকে নামিয়ে দেয় সৃজন। আর একটাও কথা হয়নি দুজনের। সৃজন কেবল দুর থেকে দেখেছিল পারমিতার চলে যাওয়া।
-কি রে এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি?
- কথা শেষ হয়ে গেল।
মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ঘরে চলে যায় সৃজন। কণিকাদেবীর চোখ এড়ায় না ছেলের বিষণ্ণ মুখ।
ঘণ্টা খানেক হয়ে গেল ছেলে কি করছে একলা ঘরে? ভিতরে এসে কণিকাদেবী দেখেন অন্ধকার বারান্দায় ছেলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে যান ছেলের দিকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, বাবান কবে এত বড় হয়ে গেলি বাবা, যে সব কষ্ট একা সহ্য করতে হয়, মাকেও বলা যায় না?
আর থাকতে পারে না সৃজন, মাকে জড়িয়ে ধরে জোরে কেঁদে ওঠে, সব বলতে থাকে মাকে। কণিকাদেবী স্থির হয়ে যান, ছেলেকে প্রশ্ন করেন, - divorcee বলে তোর মানতে অসুবিধা?
-না মা, ওকে আমি ভীষন ভালোবাসি, কিন্তু তুমি পারবে মানতে? আমাদের আত্মীয়রা পারবে মেনে নিতে? তার ওপর ও গান ছাড়া বাঁচবে না। তুমি তো সেটা কোনওদিনই পছন্দ করো না মা।
চুপ করে যান কণিকাদেবী, ছেলের মাথায় হাত রেখে স্থির বসে থাকেন।
বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে নেয় পারমিতা। কাকিমনিকে বলে, আজ আর কিছু খাব না, শরীরটা ঠিক নেই, মাথা ধরে আছে। আমি একটু একলা গান গাইব।
-মাথা ধরে আছে গান গাইবি? একটু শুয়ে থাক, রাতে আমি হালকা কিছু খাইয়ে দেবো।
-কাকিমনি, গান যে আমার প্রাণ ।
-তুই যাতে ভালো থাকিস তাই কর মা।
ঘরে এসে রবি ঠাকুরের ছবির সামনে হারমোনিয়াম নিয়ে বসে পারমিতা। কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে। একটা শব্দও বের হয় না, দুচোখ বেয়ে শুধু অবিরাম জলের ধারা।
রাত প্রায় ন'টা, সুশোভনবাবুর বাড়ির দরজায় বেল বেজে ওঠে, দরজা খুলে দেখেন কণিকাদেবী।
-এত রাতে বৌদি আপনি? আসুন, আসুন, ভিতরে আসুন, কিছু সমস্যা হয় নি তো?
-একটু কথা ছিল আপনাদের সাথে।
-হ্যাঁ হ্যাঁ, বসুন। কি হয়েছে?
কোনও ভূমিকা ছাড়াই কণিকাদেবী বলেন, আপনার ভাইঝি পারমিতাকে আমায় দেবেন?
আকাশ থেকে পড়েন সুশোভনবাবু আর সীমাদেবী। এ কি অদ্ভূত প্রস্তাব!
কণিকাদেবী বলতে থাকেন, আমি পারমিতার সমস্ত অতীত জানি, আমার কোনও আপত্তি নেই, শুধু আপনাদের মত প্রয়োজন।
সুশোভনবাবু কিছুই বুঝতে পারেন না কিভাবে সব জানাজানি হল! - দেখুন পারো'মার নিজের একটা মত আছে, অনেক ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে, তাছাড়া ওর মা, বাবা আছে, আমরা এই মত দেবার কে বলুন?
-নিশ্চয়ই, একবার আমায় পারমিতার কাছে নিয়ে যাবেন?
সীমাদেবী জানান, - ওর শরীরটা ঠিক নেই, ওপরের ঘরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছে। চলুন...
-এক মিনিট, বাবান বাইরে আছে, ওকে একটু ডেকে দিন দাদা।
-সেকি! সৃজন বাইরে কেন? সৃজন... সৃজন... ভেতরে এসো।
সীমা দেবী বলেন, - হাতে ওটা কি দিদি?
-আপনাদের মেয়ের উপহার।
দুজনে এগিয়ে যান পারমিতার কাছে। ঘরের দরজা খুলে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন কণিকাদেবী। সামনে ছবিতে রবি ঠাকুরের চিরপরিচিত মৃদুহাস্য মুখ, পারমিতার দুগাল বেয়ে জলের ধারা। হারমোনিয়ামে সুর বেজে চলেছে, কন্ঠে কোনও শব্দ নেই। সুরের সাথে সাথে কণিকা দেবী গেয়ে ওঠেন,
"হারিয়ে গেছে মোর বাঁশি,
আমি কোন্ সুরে ডাকি তোমারে।
পথে চেয়ে থাকা মোর দৃষ্টিখানি
শুনিতে পাও কি তাহার বাণী...
কম্পিত বক্ষের পরশ মেলে কি সজল সমীরণে।।"
হারমোনিয়াম থামিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে পারমিতা, কে ইনি!? সাদা শাড়ি, হাতে একটা মলিন তান পুরা, দুচোখে জল, আর কি সুরেলা কন্ঠ।
কণিকাদেবী এগিয়ে যান পারমিতার কাছে, উঠে দাঁড়ায় পারমিতা, তান পুরাটা পারমিতার হাতে দিয়ে বলেন, তোর হারমোনিয়ামের পাশে রাখ, একটু সারিয়ে নিস, আমার আঠারো বছরের জন্মদিনে এটা আমার বাবা আমায় দিয়েছিলেন। তার বছর খানেকের মধ্যেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের কয়েক মাস পর যেদিন আমার স্বামীর সাথে এটা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছিলাম, সেদিন শাশুড়ি মা বলেছিলেন, বিয়ে যখন করেইছো মা তখন আর বিদ্যেধরী সরস্বতী হয়ে কাজ নেই, এবার আমার ঘর আলো করে লক্ষ্মী হয়ে থাকো। কথাটা শুনে আমার স্বামী মাথাটা নীচু করে নিয়েছিলেন, আমার বুঝতে অসুবিধা হয় নি একটুও, তবে বাবার দেওয়া উপহার ফেরত দিতে পারিনি, বাবা কষ্ট পেতেন তাহলে, তাই খুব যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিলাম, আজ তোকে দিতে এলাম। আমি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি মা, সরস্বতী চাইলে লক্ষ্মী হতে পারে, কিন্তু লক্ষ্মী চাইলেই সে সরস্বতী হতে পারে না। আমার ঘরে না হয় তুই সরস্বতী হয়ে আয়। আমি সৃজনের মা।
পারমিতা আর সামলাতে পারে না নিজেকে, কণিকাদেবীর পায়ে হাত ছোঁয়াতে গিয়ে চোখের জলে ভাসায়। কণিকাদেবী বুকে টেনে নেন পারমিতাকে, কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার বত্রিশ বছরের গান না গাওয়ার যন্ত্রণা তুই মুছে দে মা।
সুশোভনবাবু, সীমাদেবীর চোখও ভরে ওঠে জলে।
সৃজন দরজার বাইরে থেকে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ডেকে ওঠে, মা....
- - - - -
