Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-সম্মাননা

#শরীর
----------
নীলাঞ্জনা
-------------
মৃন্ময়ের সঙ্গে শম্পার ছিল উথাল পাথাল করা প্রেম। মাঝেমাঝে ঠাট্টা করে শম্পা বলত বউ পাগলা। তবে আদরও করত। দুজনের ছোট্ট সংসার সুখের বাতাসে পাল তুলে দিয়ে ছুটছিল তরতর করে। অন্ততঃ বছর খানেক আগে অ…


#শরীর
----------
নীলাঞ্জনা
-------------
মৃন্ময়ের সঙ্গে শম্পার ছিল উথাল পাথাল করা প্রেম। মাঝেমাঝে ঠাট্টা করে শম্পা বলত বউ পাগলা। তবে আদরও করত। দুজনের ছোট্ট সংসার সুখের বাতাসে পাল তুলে দিয়ে ছুটছিল তরতর করে। অন্ততঃ বছর খানেক আগে অব্দি।
গত এক বছর ধরে, কাজের বড্ড চাপ বেড়েছে মৃন্ময়ের। পেশায় ট্যাক্সীডার্মিস্ট। কিন্তু ট্যাক্সীডার্মিটা যেন নেশাও তার। বাড়িতেই একটা বড় ঘরে তার কাজের জায়গা। পাশেই একটা খুপরি স্টোর রুম। সেখানে গাদা করা খড়, কাঠের গুঁড়ো, আরো নানা রকম জিনিস। ঘরের মাঝখানে একটা স্টীলের টেবিল। হরেক রকমের যন্ত্রপাতি সাজান। কত রকমের স্ক্যালপেল, কাঁচি, ট্যুইজার, ছুঁচ, সাকিং মেশিন। কোথা থেকে, কোথা থেকে, লোকেরা সাপ্লাই দিয়ে যায় কত মরা পাখি, কুকুর, বেড়াল, বাঁদর। সে গুলোকে পরিষ্কার করে, তাদের নাড়ি ভুঁড়ি বের করে, সেখানে যত খড়, কাঠের গুঁড়ো ভর্তি করে মৃন্ময়। একে নাকি বলে স্টাফ করা। এই সব মরা প্রাণীদের কত তরিবত। কোনটার চামড়ায় পালিশ লাগাচ্ছে। কোনটার ডানার পালকে কেমিক্যাল ছিটোচ্ছে। তবে হয়ে গেলে, যেন ম্যাজিক। একদম যেন জ্যান্ত হয়ে যায় প্রাণী গুলো। ঈগল যেন এক্ষুনি ডানা মেলে উড়ে যাবে। প্যাঁচাটা যেন খর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইঁদুর ধরবে বলে। বাঁদর যেন হুপ করে লাফ দেবে। হাতের কাজটা বড় ভাল মৃন্ময়ের।
গুণীর কদরও আছে। দেশ বিদেশ থেকে অর্ডার আসে তার কাছে। তার সৃষ্টির ছবি ছাপা হয় দেশী বিদেশী ম্যাগাজিনে। তবে শম্পার বড় গা ঘিনঘিন করে। এই ঘরটায় ঢুকলেই কেমন একটা পচা গন্ধ লাগে নাকে। পারতপক্ষে তাই ঢুকতোও না এ ঘরে।
তবে মৃন্ময় তাকে অন্য কোন অভিযোগের সুযোগ দেয় নি। কাজের ফাঁকে ঠিক সময় বের করে নিত। তাকে নিয়ে ঘুরতে যেত এদিক ওদিক। সিনেমা, থিয়েটার, মার্কেটিং, বাইরে খাওয়া দাওয়া, কোন কিছুই বাদ ছিল না। বছরে একবার বেড়াতেও নিয়ে যেত। কত জায়গায় ঘুরেছে তারা। সিমলা, উটি, সিকিম, রাজস্থান। মোটামুটি ভাবে, তার পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে, শম্পা তার বরকে নিয়ে সুখেই ছিল।
তবে ওই গত বছর থেকে, একটু......। না না, আগের মতই যত্ন আত্তি করে শম্পার। ভালও বাসে। বরং একটু বেশিই বাসে। শুধু কাজের চাপে, তাদের ঘোরা বেড়ানটা বন্ধ হয়ে গেছে। তা আর কি করা যাবে। আগে তো কাজ। বেচারি আজকাল ভাল করে খেতে শুতেও পারে না। দিন রাত ওই কাজের টেবিলে ঘাড় গুঁজে পড়ে থাকে। এঘরেই খায়। এক পাশে একটা সোফা আছে। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে, সেখানেই শুয়ে পড়ে। শম্পার বুকের ভেতরটা কি রকম করে দেখে। মানুষটা বড় একলা হয়ে যাচ্ছে। আজকাল তাই ঘেন্না পিত্তি ভুলে, মৃন্ময়ের কাছে এসে বসে, চেয়ার নিয়ে। ওর কাজ দেখে। সঙ্গ দেয়। যখন কাঁচের বাক্সয় করে ওর তৈরী স্টাফ ডেলিভারি দিতে যায়, তখন যাবার আগে একটু হেসে, আদর করে যায় তাকে। একা বাড়িতে শম্পা তখন ঘুরে ঘুরে সংসার গুছোয়। গুনগুন করে গান করতে করতে, আনমনে কখনো বা পুরনো অ্যালবাম দেখে। কখনো সাজে।
এমনি এক ফাঁকা দুপুরে, জানলায় দাঁড়িয়ে, লোকটাকে চোখে পড়ল শম্পার। একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুগ্ধ দৃষ্টি। আড়ালে সরে এল শম্পা। তার তিরিশ বছরের জীবনে, এক মৃন্ময় ছাড়া আর কোন স্তাবক জোটেনি। না, কুচ্ছিত সে দেখতে নয়। তবে আহামরি সুন্দরীও নয়। ওই যাকে বলে সাদামাটা। আজ হঠাৎ লোকটাকে অমন করে তাকে দেখতে দেখে, তাই খুব অবাক লাগছিল। হয়ত বা একটু ভালও। কখন শোবার ঘরে এসে, আয়নায় নিজেকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল, খেয়ালই ছিল না। হুঁশ ফিরতে ভীষণ লজ্জা পেল। ধ্যাৎ! কোথাকার না কোথাকার একটা বাজে রাস্তার লোক!
এরপর থেকে মাঝেমাঝেই লোকটাকে চোখে পড়তে লাগল। বাড়িটার আশেপাশেই ছোঁক ছোঁক করে ঘোরে। বারান্দায়, জানলায়, ছাতে, যেখানে যখন যাক না কেন, ঠিক চোখে চোখ পড়ে যাবে। সেই মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকা। দেখব না দেখব না করেও একটু আধটু করে দেখে ফেলেছে, চিনে ফেলেছে লোকটাকে। বয়েস প্রায় তারই মত। বেশ লম্বা, ভাল স্বাস্থ্য, কাটা কাটা নাকমুখ, মাথায় বড় বড় চুল। আর চোখ দুটো! কি রকম নিষ্ঠুর নিষ্ঠুর দৃষ্টি। গা সিরসির করে। কেমন যেন সম্মোহিত করে ফেলে শম্পাকে। আজকাল সারাক্ষণ লোকটার কথাই ভাবে। চেয়ারে বসে, যখন কাজ দেখে মৃন্ময়ের, তখনো আনমনে কখন জানি ওই চোখ দুটোর কথা ভেবে ফেলে। তারপর লজ্জা পায় ভেতরে ভেতরে। এ তো মহা জ্বালা হল!
এমনি করতে করতে একদিন আলাপও হয়ে গেল লোকটার সঙ্গে। মৃন্ময় একদিন বেরিয়ে যাবার পর, সদর দরজা বন্ধ করতে এসেছিল শম্পা। এসে দেখল, লোকটা দরজায় দাঁড়িয়ে।
: একটু জল খাওয়াবেন? খুব তেষ্টা পেয়েছে।
কি বলবে শম্পা। জলই তো চেয়েছে। তবে বাড়িতে ঢোকাবে, এত বোকা সে নয়। কে জানে কি মতলব।
: দাঁড়ান। দিচ্ছি।
বলে ভেতরে এসে কাঁচের গেলাসে করে জল নিয়ে যায়। বোতলটাও সঙ্গে নিয়ে যায়। যেন জানে, লোকটা ঠিক আরেক গেলাস চাইবে।
: এই নিন।
লোকটা ঢকঢক করে জলটা খায়।
: আর নেবেন?
: নাহ্।
অবাক হয় শম্পা।
: এভাবে দিনের পর দিন, কারুর বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকাটা কিন্তু মোটেই শোভন নয়।
বলেই মনে মনে জিভ কামড়ায় শম্পা। তারমানে, সেও লোকটাকে লক্ষ্য করেছে, বুঝে গেল।
: বাড়ির দিকে তো তাকাই নি।
: মানে? কি দেখেন তবে?
এবারে একটা চড় মারে নিজের গালে মনে মনে।
: আপনাকে।
আচ্ছা অসভ্য লোক তো! এমন মুখের ওপরে বলে দিল।
: দেখুন, বাড়াবাড়ি করবেন না। এবারে কিন্তু আমার স্বামীকে বলতে বাধ্য হব।
: বলবেন না। আমি জানি। বলার হলে এতদিনে বলে দিতেন।
: আপনি যান এখান থেকে!
বলে রেগেমেগে দরজা বন্ধ করে দেয় শম্পা। তারপর ঘরে চলে আসে। কি অসভ্য লোক। মুখের ওপর বলে দিল, তাকে দেখে। রেগে উঠতে গিয়েও কেমন যেন ঠিক মত রাগতে পারছিল না। কি নিষ্ঠুর চোখ। আরো নিষ্ঠুর ওর হাসি। ভেতরে ভেতরে কেমন ছটপট করে ওঠে শম্পা।
পরদিন দুপুরে বারান্দায় গেছিল। লোকটা দেখতে পেয়ে এগিয়ে এল।
: খাওয়া হয়ে গেছে?
: তাতে আপনার কি?
: রাগ করছেন কেন?
: করবই তো। দিন রাত এখানে ছোঁক ছোঁক করছেন।
: কি করব? আপনাকে না দেখে থাকতে পারি না যে।
লোকটার সরল স্বীকারোক্তি। খুব একটা রাগের কথা বলতে গিয়ে, হেসে ফেলে শম্পা।
: কাজকর্ম নেই কিছু?
: এটাই কাজ।
: বিবাহিত মহিলাদের দেখা?
লোকটা এ কথায় একটু আহত হয়।
: আমি শুধু আপনাকেই দেখি, শম্পা।
: ও বাবা, নামটাও জানা হয়ে গেছে