পিতৃদিবস
অনামিকা_মন্ডল_সেনগুপ্ত
সকাল বেলা উঠে হাঁটা সোহিনীর অনেক দিনের অভ্যাস। এই দূর বিদেশে এসেও সেই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয় না। আমেরিকার বিখ্যাত এক ইউভার্সিটির পাশেই সোহিনীর আবাসন।তার সংলগ্ন পার্কটাতে হাঁটার পরে রোজ কিছুক্ষণ…
পিতৃদিবস
অনামিকা_মন্ডল_সেনগুপ্ত
সকাল বেলা উঠে হাঁটা সোহিনীর অনেক দিনের অভ্যাস। এই দূর বিদেশে এসেও সেই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয় না। আমেরিকার বিখ্যাত এক ইউভার্সিটির পাশেই সোহিনীর আবাসন।তার সংলগ্ন পার্কটাতে হাঁটার পরে রোজ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে সে। এই সময়টাতে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় অধ্যাপিকা নয়,বরং সে যেন এক মনযোগী শিক্ষার্থী, আর প্রকৃতি তার শিক্ষক। যে অকৃপণ হাতে রোজ সোহিনীকে একটু একটু করে শিক্ষা দিয়ে পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চের উপযুক্ত করে তুলছেন। তাই এই সময় মধ্যচল্লিশের সোহিনী মনে মনে যেন ষোড়শী কিশোরী। দিনের মধ্যে এই সময়টা ভারী ভালো লাগে ওর। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। হাঁটার পরে বেঞ্চে বসে সোহিনীর মনে হলো, কাল রাতে ফোন করে ওর বান্ধবী ও সহকর্মী অ্যালিস বলেছিলো, ওকে আজ সকাল সকাল ফোন করে ডেকে দিতে। অ্যালিসের বেলা করে ওঠার অভ্যাস। অনেক সময় অ্যালামেও ঘুম না, তাই সোহিনীকে এই অনুরোধটা করেছিল অ্যালিস। আজ ওদের ফাদার্স ডে। আজ সকালে সকালই অ্যালিস যাবে ওর বাবার সাথে দেখা করতে । দুবার রিং হয়ে কেটে গিয়ে, তিনবারের বার ফোনটা ধরে অ্যালিস। সামান্য কথোপকথনের পরে সোহিনীকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা কেটে দেয় সে। ফোনটা ট্রাকস্যুটের পকেটে ভরতে ভরতে সোহিনীর মনে হলো এখন তো ভারতেও ফাদার্স ডে, মাদার্স ডে পালনের হিড়িক উঠেছে। ফেসবুক, ইন্ট্রাগ্রাম সব জায়গায়ই সবাই নিজেদের বাবা, মায়ের ছবি পোস্ট করে। অথচ, সে নিজে এখনও এই দিনগুলোকে ওদের দিন ভাবে কেন ? কি জানি? এতো আধুনিক সে, অথচ এখনও এইসব দিনগুলোকে কেন যেন মনের থেকে ঠিক আপন করতে পারে না। সত্যিই কি বাবা, মাকে কেবল একটা দিন দিয়ে আটকে রাখা যায়! তারা তো দূরে থেকেও সন্তানের জীবনের সাথে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে থাকেন। সন্তানের মননে তাদের অবাধ বিচরণ। তবে সোহিনী নিজে বিশ্বাস না করলেও, বাবা, মাকে ঘিরে এই উৎসবটা খারাপ লাগে না ওর। এই সুযোগে সব পুরোনো বন্ধুদের বাবা, মায়ের ছবি দেখা যায় । তাদের খবরও পাওয়া যায়। কতো পরিবর্তন হয়ে গেছে তাদের চেহারার, অথচ সন্তানের প্রতি তাদের স্নেহ, ভালোবাসা, উদ্বেগ একই রকম রয়েছে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে উদাস হয়ে যায় সোহিনী। ফিরে যায় তিরিশ বছরেরও আগের দিনগুলোতে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলো সে। তার বাবা আর দুই জ্যাঠাদের একান্নবর্তী পরিবারে তখনও আধুনিকতার আলো সেভাবে ঢোকেনি। রক্ষণশীল, পুরুষতান্ত্রিক পরিবারে ছেলে আর মেয়ের ফারাক ছিলো প্রচুর। তার নিজের ও জেঠতুতো ভাই বা দাদারা যে ভালোবাসা পেত, সেটা কোনদিনই পায়নি ওরা। মানে সোহিনী আর ওর দিদি বা বোনেরা। সবসময়ই ওদের বলা হতো মেয়েরা কোনরকমে একটু পড়াশোনা করলেই চলবে। কারণ ওরা বিয়ের পরে পরের বাড়ী চলে যাবে, সেখানে সংসার সামলানোটাই প্রধান কাজ হবে। তাই সোহিনী ছাড়া ওর সব দিদি বা বোনেদেরই লেখাপড়ার থেকে ঘরসংসারের কাজ বেশী শেখানো হতো। ব্যতিক্রম ছিল কেবল সোহিনী। তবে সত্যিই কি সোহিনী ব্যতিক্রম ছিলো? না ওর বাবা ব্যতিক্রমী ছিলেন বলে ও আজ ব্যতিক্রমী হতে পেরেছে! বাবার কথা মনে হতে সোহিনীর মন চলে যায় হাজার হাজার মাইল দূরে থাকা ওদের পুরোনো সাবেকি বাড়ীটাতে। যেই বাড়ীটাকে আজও আঁকড়ে ধরে রয়েছেন ওর বাবা, মা। কিছুতেই ওনারা পারেননি ছেলেমেয়েদের সাথে তাদের ঝকঝকে ফ্ল্যাট বাড়ীতে যেতে। 'পৈত্রিক ভিটের টানই আলাদা', বলে রয়ে গেছেন ওদের পুরোনো বাড়ীটাতে। আবাক হয়ে ভাবে সে। কী করে একটা মানুষের ভেতরে সাবেকিয়ানা আর আধুনিকতার এমন মিশেল থাকতে পারে!
একে একে মনে ওর পড়ে যায় সব কথা। একমাত্র মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনদিনই কোন কার্পণ্য করেননি সোহিনীর বাবা বরং একটু বেশিই নজর দিয়েছিলেন। বাবার অনুশাসনেই খুব ভোরে উঠে পড়তে বসতে হতো সোহিনীকে । ওর বাবা বলতেন, 'সকাল বেলায় মাথা পরিস্কার থাকে। তখন পড়া ভালো মনে থাকবে।' তখনো সব কথার অতো যুক্তি দিয়ে বিচার করার বুদ্ধি ছিলো না সোহিনীর। তবে আজ বোঝে সকালবেলা অনেকটা সময় বাবা ফাঁকা থাকতেন। তাই হয়তো উনি চাইতেন মেয়ে ওনার সামনে বসে পড়াশোনা করুক। মেধাবী সোহিনীকে পড়াশোনার বাইরে কোন রকম ঘরের কাজ করতে দেখলেই উনি খুব রেগে যেতেন। মৃদুভাষী সোহিনীর বাবার কেবলমাত্র এই একটি ব্যাপারই সোহিনীর মা বা বাড়ীর অন্যদের সাথে মতানৈক্য ঘটতো। সেই নিয়ে বাড়ীর অন্যদের কাছের থেকেও অনেক বাঁকা কথা শুনতে হতো সোহিনীকে আর ওর বাবাকে। কিন্তু উনি এগুলোকে পাত্তাই দিতেন না। সোহিনীর বেশ মনে পড়ে, একজন অংকের শিক্ষক আসতেন ওকে আর ওর দাদাদের অংক শেখাতে। সোহিনী বরাবরই অংকে ভালো ছিলো। তাই দাদাদের দু ক্লাশ উঁচুর অংকও ও অনায়াসে করে দিতে পারতো। কিন্তু একদিন সে অংকে ভুল করে। তখন সোহিনীর দাদা বলে,' মেয়েদের দ্বারা অংক হয় না। সেই মাথা মেয়েদের নেই। তুই শুধু শুধুই অংকের পিছনে সময় নষ্ট করছিস। তার থেকে বরং ঘরের কাজে মন দে।' ছোট্ট সোহিনী দাদার কথায় খুব আঘাত পেয়েছিল। তারপর বাবা ঘরে ফিরলে বাবাকে, দাদার বলা কথাগুলো বলে মনটা হালকা করেছিল। প্রথমে কথাগুলো শুনে সোহিনীর বাবা চুপ করে থাকেন। তারপর মেয়েকে বৈদিক যুগের বিদুষী নারী, গার্গী, মৈত্রী, খনাদের কথা গল্পের ছলে বলেন। গল্প বলেন আধুনিক যুগের নারী, মানব কম্পিউটার শকুন্তলা দেবীর কথা। যিনি ৬১,৬২৯,৪৭৫ এর কিউব রুটও অনায়াস দক্ষতায় সলভ করতে পারতেন। তারপর বলেছিলেন, 'মেয়েরা সব-ই পারে মা। দরকার শুধু একটু ধৈর্য্য আর অধ্যাবসায়।' পরের দিন থেকে উনি তিন কিলোমিটার দূরে ওই শিক্ষকের বাড়ীতে সোহিনীকে নিয়ে যেতেন আলাদা করে অংক শেখানোর জন্য। বাবা এবং ওই শিক্ষকের মিলিত প্রচেষ্টায় কবে থেকে যেন সোহিনী পড়াশোনাকেই জীবনের ধ্যান,জ্ঞান করে ফেলে।
আজ যেন সোহিনীকে পুরোনো কথায় পেয়েছে। বেশ মনে পড়ে ওর, বি.এস.সিতে দারুণ রেজাল্ট করার পরে সোহিনীর বড় জ্যাঠা ওর জন্য বিয়ের সমন্ধ আনেন। কিন্তু সোহিনীর বাবা এই প্রথম, জীবনে দাদার অবাধ্য হন। ওনার আনা বিয়ের প্রস্তাবকে নাকচ করে সোহিনীকে, উচ্চ শিক্ষার জন্য উনি পাঠিয়ে দেন দিল্লীর জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজও যে সে, বিয়ে না করে নিজের পড়াশোনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে, তার জন্য সবাই বিরূপ মন্তব্য করলেও সোহিনীর বাবা কোনদিন মেয়েকে কিছু বলেন নি। সব সময় বলেছেন, ' নিজের