"সামান্য ক্ষতি"- পটলার বাইশে শ্রাবণ #সুস্মিতা
পটলা তখন দশ এগারো বছরের স্কুল পালানো ছেলে। মাত্র কদিন আগেই ওর চিররুগ্ন বাপ বস্তির লোকেদের কাঁধে চেপে স্বর্গে চলে গিয়েছে। হাড় জিরজিরে মা'টা পাড়ার সাত বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের ক…
"সামান্য ক্ষতি"- পটলার বাইশে শ্রাবণ
#সুস্মিতা
পটলা তখন দশ এগারো বছরের স্কুল পালানো ছেলে। মাত্র কদিন আগেই ওর চিররুগ্ন বাপ বস্তির লোকেদের কাঁধে চেপে স্বর্গে চলে গিয়েছে। হাড় জিরজিরে মা'টা পাড়ার সাত বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে মা-বেটার সংসার চালায়। সংসার আর কি? বস্তির ঘর ভাড়া আর দুবেলা দু মুঠো কিছু দিয়ে পেট ভরানো। যদিও পটলার মা ওই অবস্থাতেও পটলাকে একজন শিক্ষিত মানুষ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখত। বড্ড কষ্ট করত মা'টা। রাত্রিবেলা রাস্তার লাইট থেকে হুকিং করে টেনে আনা আলোতে পটলাকে একটু পড়তে বসানোর কি কষ্টকর চেষ্টা ছিল মায়ের।
আর নিজে মা... সারাদিনের ঝিয়ের কাজ করা মা'টা রাতের বেলা কেমন যেন অচেনা মানুষ হয়ে যেত। তখন মা তার ভাঙা ট্রাঙ্ক থেকে বের করত এক দাড়িওয়ালা বুড়োর ছবিসহ একটা বই। মা ওই বইটা থেকে এক একদিন একেকটা কবিতা পড়ত, কখনও গুনগুন করে গান গাইত... গাইতে গাইতে কাঁদত। মাকে তখন এই চেনা বস্তির কোনও মানুষ মনে হ'তনা। মা যেন তখন অনেক দূর দেশের কেউ...যেন বা স্বর্গের দেবী। সরস্বতী পুজোর দিনে দেখা দেবীমূর্তির মুখ আর মায়ের মুখটা তখন কেমন মিলেমিশে এক হয়ে যেত।
*
সেদিনটাও ছিল ভরা শ্রাবণের এক দিন। ঘুম থেকে উঠেই পটলার মা বলেছিল-"জানিস পটল আজ বাইশে শ্রাবণ।" কেন যে বলেছিল, কে জানে। চার পাঁচদিন ধরে কি বৃষ্টি আর বৃষ্টি। পটলদের বস্তির ঘরের টিনের ছাদের বেশ কয়েক জায়গায় ফুটো হয়ে গিয়েছে। ঘরের একদিকে পটলারা মা বেটা মিলে যত পেরেছে হাঁড়ি, কড়াই, বাটি, গেলাস পেতে রেখেছে। ফুটো ছাদ থেকে জল পড়ে সেগুলো যেই ভরে যাচ্ছে ওরা পালা করে সেই জল বাইরে ফেলে আসছে। ঘরের বাইরের অবস্থাও শোচনীয়। জমা জল বাড়তে বাড়তে প্রায় হাঁটুছুঁই। বৃষ্টি আর কমেনা...
জল মাথায় করে কাজে যেতে যেতে তিনদিনের দিন পটলার মা পড়ল জ্বরে। তার শরীর আর চলেনা...
পাড়ার ডাকসাইটে বড়লোকবাড়ি ছিল তখন লাহাবাড়ি। পটলার মা সেবাড়িতে দুবেলা কাজে যেত। ঘরমোছা, বাসন মাজা সব তার দায়িত্ব। আগের রাতে পটলার মা জ্বরের ঘোরে প্রায় বেহুঁশ হয়ে কাটিয়েছে। ছেলেমানুষ পটলাই তখন মায়ের কপালে জলপট্টি দিয়েছে। সকালে মা আর কাজে যায় কি করে। বৃষ্টিও ধরার নাম নেই। মাথার ওপরের ছাদটা যেন এবার পুরোটাই ভেঙে পড়বে। পটলার বড্ড ভয় করে, ও তো জানেনা ছাদ মেরামতের পয়সা মা'র কাছে আছে কিনা...
ঘরের এককোণে মুখ শুকিয়ে বসেছিল পটলা। আজ বাড়িতে ভাত রান্না হবেনা। মার গায়ে জ্বর। নিতাইকাকার মেয়ে বাসন্তীদি এসে ঠিক তখনই খবর দিলো- "লাহাবাড়ির গিন্নীমা টেলিফোন করেছে, ডাকছে পটলার মাকে।"
এই বস্তিতে একমাত্র নিতাইকাকার ঘরেই তখন টেলিফোন ছিল। বস্তির সকলেরই দরকারি ফোন আসত বাসন্তীদিদের ঘরে।
*
মা তো কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে, উঠতেই পারছেনা। অতএব পটলা নিজেই চলল লাহাদিদার সঙ্গে কথা বলতে। ও বাবা, টেলিফোন কানে তুলতেই ওদিক থেকে দিদার কি রাগী গম্ভীর গলার আওয়াজ। পটলাকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উনি শুরু করে দিলেন- "দেখো বাছা আমাকে কোনও অজুহাত শুনিও না, সামনেই আমার বাড়িতে শুভ কাজের অনুষ্ঠান, আজও বিকেলে বাড়িতে ক'জন অতিথি আসবে, যেমন করে পারো এসে আমার ঘরবাড়ি মুছে বাসন মেজে দিয়ে যাও বাপু।" দিদার কণ্ঠস্বরে ভীত পটলা তবুও সেদিন সাহস সঞ্চয় করে বলতে চেষ্টা করেছিল- "ও দিদা আমি পটলা, মায়ের তো খুব শরীর খারাপ আর আমাদের ঘরটারও খুব খারাপ অবস্থা গো, ছাদ ভেঙে ..."
পটলার পুরো কথা শোনার ধৈর্য ছিলনা লাহাদিদার। মুখ ঝামটা দিয়ে তিনি বলে উঠেছিলেন- "দেখ বাপু তোদের নাকিকান্না শোনার সময় এখন আমার নেই। তোর মা কাজে আসতে না পারলে আমাকে নতুন লোক দেখে নিতে হবে, বলে দিস মাকে। আর তোদের ওই ঘরের ছাদ ফুটো...সে তো প্রত্যেক বছরের ব্যাপার রে, সে আর এমন কি...আমার ছেলের বিয়ে তো আর প্রতি বছর হবেনা।" কথা শেষ করেই টেলিফোনটা ঝনাৎ করে রেখে দিয়েছিল দিদা।
বড্ড অসহায় বোধ করেছিল সেদিন সেই দশ বছরের ছেলেটা। "কি হবে এখন? মায়ের এই কাজটা যদি চলে যায়? ওদের ঘরের ফুটো ছাদটা তাহলে এবছরেও সারানো হবেনা?"
*
ধীর পায়ে ঘরে ফিরে এসেছিল পটলা। মা জিজ্ঞেস করেছিল -"কি বলল রে দিদা? তুই তাকে বলেছিস তো আমার জ্বরের কথা?"
একটাও উত্তর দেয়নি পটলা...একটাও কথা বলেনি। শুধু মা যখন বারবার একই কথা জিজ্ঞেস করছিল...তখন আর থাকতে না পেরে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে খুব কেঁদেছিল সে।
পটলার কান্না দেখে মাও হঠাৎ কেমন চুপ করে গিয়েছিল। মা'টা যে ওইরকমই। খানিকক্ষণ পরে পটলার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মা বলেছিল- "ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে বইটা একটু নিয়ে আয় তো পটল...ওই যে ওই রবিঠাকুরের বইটা।"
রবি ঠাকুরকে পটলা অতশত চেনেনা। সেই দাড়িওয়ালা বুড়োর ছবিশুদ্ধ বইটা মায়ের হাতে দিতেই মা সেদিন একটা কবিতা পড়ে শুনিয়ছিল। কবিতার নাম- "সামান্য ক্ষতি"
কবিতা টবিতা মাথায় ঢোকে না পটলার। শুধু সেদিন কেন কে জানে ওই কবিতাটা শুনতে শুনতে কাশীর রাজাকে খুব ভালোবেসে ফেলল পটলা। সে দেশের রানি গরীবের বাড়ি পুড়িয়ে আগুন জ্বালিয়ে সখীদের সঙ্গে আনন্দে মেতে উঠেছিল।
উফ, রাজামশাইটা কত ভালো। দুষ্টু রানিকে ভিখারি বানিয়ে বের করে দিলো রাজবাড়ি থেকে। ঠিক একবছর সময় দিলো তাকে ভিক্ষা করে টাকা জোগাড় করে ওই গরীব লোকেদের আবার বাড়ি বানিয়ে দেওয়ার জন্য, তবেই তো রানি গরীবের কষ্টটা বুঝবে। সত্যি এইরকম না হলে রাজা? গরীবের কষ্ট না বুঝলে সে সত্যিকারের বড় রাজা হবে কি করে?
লাহাদিদারা কত বড়লোক, কিন্তু পটলাদের বস্তির ঘরের ছাদ উড়ে গেলে, ফুটো হয়ে গেলে কেমন কষ্ট হয়, কতটা ক্ষতি হয়...ওরা কেউ বোঝেনা...
"সামান্য ক্ষতি" কবিতাটা মনের মধ্যে গেঁথে গেল পটলার...
*
তারপরে কত বছর পেরিয়ে গিয়েছে। পৃথিবীটা যে কত্ত পাল্টে গিয়েছে। পটলার মা মরে গিয়েছে সেই কবে, লাহাদিদাও আর বেঁচে নেই। ওদের পুরোনো বাড়িটার জায়গায় এখন একটা বড় ফ্ল্যাটবাড়ি।
অনেক হোমড়াচোমরা লোকজন থাকে ওই বিল্ডিংয়ে। পটলা ওই বিল্ডিংয়ের সাতজনের গাড়ি ধোয়ার কাজ করে আজকাল।
এইভাবেই চলছিল। করোনা ভাইরাস এসে পৃথিবীটাকে আরও ওলটপালট করে দিলো। সেই মার্চ মাসের শেষ থেকে শুরু হয়ে গেল লকডাউন। বাড়ি থেকে কেউ আর নি