Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-সম্মাননা

নষ্ট বসন্তএবং অমবস্যায় চাঁদের উদয়।
ক) নষ্ট বসন্তঃ--
দেখতে শুনতে যেমনই হই আমার জীবনের প্রথম বসন্তের আবির্ভাব উনিশ বছর হতে না হতেই পাড় হাত ধরে। মানে সেই যে রবি ঠাকুরের প্রেমের কবিতা "আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি*****।মানে একই পাড়া…

 

নষ্ট বসন্ত

এবং অমবস্যায় চাঁদের উদয়।


ক) নষ্ট বসন্তঃ--


দেখতে শুনতে যেমনই হই আমার জীবনের প্রথম বসন্তের আবির্ভাব উনিশ বছর হতে না হতেই পাড় হাত ধরে। মানে সেই যে রবি ঠাকুরের প্রেমের কবিতা "আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি*****।মানে একই পাড়ার মাঝে দীঘি ।এপারে আমি ওপারে রীমা। মানে পাড়ার ডাকসাইটে মহিলা মীরা মাসীর মেয়ে রিমা।


মীরা মাসী আঠারোতে পালিয়ে পাড়ার অতীশদার সাথে লাভ ম্যারেজ করেছিলো। বছর না ঘুরতেই দুজনের  জোরদার প্রেমের ঠ্যালায় রিমার জন্ম। রিমার বয়স বছর সতেরো। তারমানে মীরা মাসী বছর পঁয়ত্রিশ হবে তার বেশী নয়। মা মেয়ে দুজনেই শ্যামলা মাজা মাজা রঙ,ধারালো নাক বড় বড় চোখ আর ছোটোখাটো চেহারা। মা মেয়ে নয় বড়জোর একই রকম চেহারার দুই বোন মনে হয়।

রীমাকে আমি 'বড় বাজার থেকে খাইয়েছি ঝালমুড়ি,

চিনা বাজার থেকে পরিয়েছি কাচের চুড়ি।'

রীমা আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছে,"তুমি পাড়ার বখা ছেলে। মা বাবা তোমার সাথে আমার বিয়ে দেবে না। আমি তো জানি তুমি কত দিলদরিয়া। বিয়ের পর কত ফুচকা খাওয়াবে!চলো আমরা আমার মা বাবার মতো পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করি।'' 

আমি রীমাকে  আশ্বস্ত করেছি,"তোমার আঠেরো বছরটা শুধু হতে দাও না। স্কুল থেকে তোমার এজ সাটটিফিকেটটা হাতিয়ে দুজনে সিধা ধাঁ। তারপর শুধু আমি তুমি ফুচকা ভেলপুরি আর ক্যাডবেরি!'


তখন বসন্ত এসে যাবো যাবো করছে। তারমানে দোল। রীমাদের বাড়ির বারান্দায় দেদার রঙ খেলার মাতন।আমি পাড়ার বখা বদ ছেলে। ওখানে অবাঞ্ছিত, বলতে গেলে নিষিদ্ধ চরিত্র।অগত্যা ওদের বাড়ির আশেপাশে, পাশের  রাস্তায় ঘুরঘুর করছি কখন রীমা বেরোবে। পকেটে খুনী লাল,সোনালী, সবুজ রঙ। পেটে সকাল থেকে বন্ধুদের খাওয়ানো দেদার ভাঙ,সিদ্ধির মালাই সরবত। বেলা নটা দশটা,এগারোটা হতে হতে দুটোও বাজতে চললো।রিমার আর দেখা নেই। এদিকে সিদ্ধি ভাঙের নেশায় আমার তখন পুরো 'দে দোল দোল"অবস্থা। কখনও আকাশে উঠে যাচছি আবার কখনও পাতাল প্রবেশ করছি সীতার style এ । "যাহা দেখি কৃষ্ণ স্ফূরে!"মেয়ে  যাকে দেখছি তাকেই রিমা মনে হচ্ছে। নেশার গন্ধ না থাকলেও মুখে অনর্গল হরি নামের মত "রিমা আমার রিমা! নেই আজ কোন ক্ষমা!" লেগে রয়েছে। 

প্রায় তিনটে বাজে । হতাশ বিহ্বল, নেশায় হাপুস নয়নে কেঁদেই যাচ্ছি মুখে 'রিমা রিমা 'বোল্ ।পুকুর ঘাটের পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরছি। এই সময় সত্যিকারের মানে রক্তমাংসের রিমা ঘাট থেকে উঠে এলো। পাটভাঙা লালপাড় সাদা শাড়ি,শ্যাম্পু করা চুল,মুখে হাতে পায়ে রঙের আভাস মাত্র নেই। নেশায় টং হয়ে থাকা আমি হারানিধি ফিরে পেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে পকেটের যত বাদুড়ে রঙ লাল সবুজ সোনালি হলুদ সব রিমার মুখে চোখে সদ্য শ্যাম্পু করা  চুলের ফাঁকে ফাঁকে মিনিট পাঁচেক ধরে মনের তুরীয় আনন্দে ঘষে ঘষে রঙ দিয়ে যাচ্ছি আর মুখে ,"রিমা রিমা রিমা আমার ব্যাকুল বসন্তের প্রতিমা। " নেশার মধ্যেই কাণের ভিতর দিয়ে একেবারে মরমে পশিলো,"আমি রিমা না। রিমার মা মীরা মাসী। এই অনাচারের যদি বিহিত না করতে পারি তবে  আমি এ পাড়ার মেয়েও না বৌও না!" 

কি হতে গিয়ে কি হলো এবং কি হতে যাচ্ছে ভেবে আমার মাথায় চড়ে বসা সিদ্ধির নেশার মধ্যেও পিলে চমকে গেল।

হলো ,সেদিন সন্ধ্যা বেলাতেই হলো। আমার জন্মের পরে পরেই মা মারা গেছেন। বাড়িতে আমি আর বাবা। বাবা পুরনো দিনের লোক,স্কুলের সংস্কৃতের পণ্ডিত মশাই। এখনও খড়ম পরে চলাফেরা করেন।অল্প বয়সে বৌ হারিয়ে স্বভাবে খিটখিটে। সৎমা পাছে আমার উপর অত্যাচার করে তাই আর বিয়ে থাওয়া করেন নি।আমার নানা নষ্টামির খবর রাখেন না এবং এখনো আমার উপর আশাও অনেক।মেয়েদেরকে কোনো অশ্রদ্ধার খবরে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। মালা মাসী সন্ধ্যাবেলায় বাবার পায়ে আবির দিয়ে নমস্কার করে উঠে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,"অমূল্যদা আশীর্বাদ করুন আজ দুপুরে হীরালালের (আমার একমাত্র নাম) হাতে আমার যে হেনস্থা হয়েছে এরকম হেনস্থা যেন এই জীবনে আর কখনো না হয়। " চোখের জলে ভাসতে ভাসতে গোটা ঘটনাটাই মীরা মাসী বর্ণনা করলো। অবশ্য একদম ঠিক ঠিকই বললো । একটুও বাড়িয়ে বা কমিয়ে না। আমার ফর্সা বাবার  মুখের রঙ টকটকে লাল হয়ে উঠলো।বাঙাল ভাষায় কথা বলতেন। মুখে শুধু বললেন,"ঠিক আছে বইন। তুমি যাও। আমি দেখতাছি।"

মীরা মাসী ঘরের বাইরে পা রাখতে না রাখতে বাবা 

খড়মজোড়া হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে বললেন,"এই জোড়া অনেক পুরানা হইতে চললো। এখনে ফিক্কা ফ্যালনের কাম। তয় ফ্যালনের আগে একটু কামে লাগাইয়াই ফেলি।" তারপরই আমাকে আগাপাশতলা খড়ম পেটা করতে করতে,"হারামজাদা! এই বয়সেই নেশাভাঙ কইরা পাড়ার মাসীরে বেইজ্জতি কর। তর নেশাভাঙ আর পাড়ার বইনের লগে পীরিতের  হালুয়া! আমি আইজ এই খড়ম তর শইলে (শরীরে) ভাইঙ্গা ছুইড়া ফেলুম।" খড়ম না ভাঙতে পারলেও বাবার মারের চোটে আমার ভাঙের নেশা কেটে গিয়েছিলো।আর পীরিতের হালুয়া?


পরের দিন বিকালে রিমাকে দেখে হাসতে হাসতে চিড়ে ভাজার প্যাকেট নিয়ে এগিয়ে গেলাম,"নাও  ডার্লিং। চিড়েভাজা খাও। চলো কাল দুজনে চৌরঙ্গীতে অনাদির মোগলাই'''''''''।"

কথা শেষ করার আগেই রিমা বলতে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়লো,"গোটা পাড়া জানে কি ভাবে মাকে রাস্তার উপর  রঙ মাখিয়ে বেইজ্জতি করেছ। মা এরপরে তোমাকে জামাই করবে? তোমাকে আদর দিয়ে কোলে বসাবে?"

আমি কোনরকমে শুধু আত্মপক্ষ সমর্থনে বোললাম,"মাইরি মাইরি রিমা ভাঙের নেশায় সিলি মিসটেক হয়ে গেছে। মানে স্পেলিং মিসটেক আর কি! RIMA আর MIRA। R আর Mসামান্য এদিক আর ওদিক!তাতে এত বড় শাস্তি?" রিমা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো,"আমার কথা ভুলে যাও। অন্য জায়গায় চান্স লাগাও।" তারপরই মুখ ঘুরিয়ে যেতে যেতে বললো," আর দেখা হলেও কথা বলতে এসো না। টাটা বাই বাই !তোমার থেকে রেহাই চাই।"


হে "প্রেমপূজারী" পাঠক !  এইইআমার প্রথম বসন্তের মানে নষ্ট বসন্তের গল্প। শরচ্চন্দ্রের দেবদাসের মতই বোলতাম,"হে পাঠক! আমার জন্য দু ফোঁটা চোখের জল ফেলিও"। কিন্তু বলা হলো না। কেন? এবারে সেই কিস্যা ।


খ) অমবস্যায় চাঁদের উদয়ঃ---

আগে লিখেছি আমার মা আমার জন্মের পরে পরেই মারা যান। আমার দাইমা মানদা মাসি আমাকে বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেন। খুব কম বয়সে তার নিজের ছেলে মারা যায় পুকুরে পড়ে গিয়ে। স্বামী রিকশা চালাতো । সে ও একদিন বাসের ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় চাপা পড়ে মারা গেলো। বড় দুঃখী মানুষ।তিনকূলে এখন আর কেউ নেই। আমাকে গুপাল গুপাল বলে ডাকে,বড় ভালোবাসে। লোকের বাড়ি বাড়ি কাজ করে খায়।আমাদের বাড়ি , পাড়ার আরো দু চারটে বাড়িতে কাজ করে। তার মধ্যে রিমাদের বাড়িও রয়েছে। আমার রিমার কাছে চোট খাওয়ার ঘটনাও জানে। দু একবার আমার হয়ে রিমার বাড়িতে সালিশিও করতে গিয়েছিল,"আমগো গুপাল পুলাপান মানুষ। তয় ঐ বিশেষ দিনে একটু ভাঙ সিদ্ধির সরবত খাইয়া মাইয়ার জায়গায় মায়ের  লগে ভুলে একটু অঙ(রঙ) তামাশা কইরা ফেলছে।তয় বিস্তর মাইর ,খড়ম পিটাও জুটছে বাপের থন।তয় এতো বালাবাসা। মনমরা অইয়া ঘুরে। বাড়িতে বইয়া কান্দে 'ইমারে(রিমারে) ছাইড়া বাঁচুম ক্যামনে।" 

মীরা মাসী বলেছে,"বুয়েচি তুমি মেয়েটাকে ফুঁসলাতে চাও। বিন্দা দূতী। তোমার এত টাকার মায়নার কাজ তো যাবেই তোমাকে পুলিশেও দেবো।"

প্রায় সাত বছর কেটে গেছে।মানদা মাসি আজকাল আর উচ্চবাচ্য করে না। আমার বয়স এখন ছাব্বিশ হতে চললো। রিমারও তেইশ।আর আগের ফ্যালশানি করা,হি হি হো হো করা সেই রিমা নেই। একটা ভার ভারিক্কি রইশ সুন্দরী ভাব এসেছে।আমি একটু দূর থেকে মুগ্ধ হয়ে দেখি আর ভালোবাসি। poor man's Hema Malini ! বুঝি আমার সব আশাই ভচ্ হয়ে গেছে।

মানদা মাসীর কাছে খবর পেতাম বহু পাত্রপক্ষ রিমাকে পছন্দ করে যায়। রিমা খুব নাক উঁচু কাউকেই আর পছন্দ হয় না। এই নিয়ে মা বাবার সাথে নিত্য অশান্তি লেগেই আছে।

সেদিন ছিল পয়লা এপ্রিল রোববার। সকাল বেলা মানদা মাসী কাজ করে গেছে। বেলা প্রায় বারোটা বাজে। মাসী ছুটতে ছুটতে এসেছে। চোখে মুখে উত্তেজনা,"গুপাল! রিমার বাড়ির থন ছুটতে ছুটতে আইতাছি। অগো বাড়িতে মাবাপের  লগে মাইয়ার খুবই ঝামেলা হইছে। আইজ সকালে ফির এক পাত্রপক্ষরে মাইয়ায় না করছে। মায় কইছে অবিয়াত মাইয়ারে আর ঘাড়ের উপর বওয়াইয়া  রাখবো না। যেইদিকে দু  চক্ষু যায় যেনো চইলা যায়।মাইয়াও তেমনই ঠ্যাটা। কইলো আইজ সন্ধ্যায় সাজন গোজন কইরা মালা লইয়া বাইরাইবো। বাড়ির থন বাইরাইযা গাধা ঘুড়া যারেই পরথম দেখবো তার গলায়ই মালা দিবো। অরা বওয়নের(বসার) ঘরে ঝগড়া করতে আছিলো আর আমি পাশের ঘরে দরজার পাশে ঘর মুছনের ভাব কইরা কাণ পাইত্যা সব হুনছি।অরা টেরই পায় নাই। তয় আমি কই কি গুপাল ঐ মাইয়ার জেদ আমি জানি। কইছে যখন সয়ম্বর কোরবো তাই ই কোরবো।তুমি এই সুযোগ ছাইড়ো না।লজ্জা ছাড়ান দিয়া সাজ সজ্জা কইরা যাও। এখন তক্ বাইরের কেউই জানে না।"

যদি সত্যি হয় এই আশায় সন্ধ্যার আগের থেকেই ওর বাড়ির উল্টোদিকে চায়ের দোকানে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অমবস্যার অন্ধকার। রাস্তার আলোয় রিমাকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে দেখলাম। খুব সেজেছে। মস্ত খোপাতে গোলাপ লাগানো রজনীগন্ধার মালা।অমবস্যায় যেন চাঁদের উদয় হলো। 

আমার পরণে ধুতি পাঞ্জাবী।যা থাকে কপালে। আমি দুরু দুরু বক্ষে আমার মানে গরীব মানুষের হেমা মালিনীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।সাত বছর পরের এ রিমা আলাদা। আগের সেই প্রগলভ ফিচেল বালিকা নেই। খোপার মালাটা খুলে আমায় পরিয়ে দিল।তারপর অপরূপ মুখে  হাসির আভাস এনে বললো,"আমি জানতাম তুমি আসবে। মানদা মাসী তোমাকে ভালবাসে। আমার বিয়ে সংক্রান্ত সব কিছুই সে কাণ খাড়া করে শোনে এবং তোমাকে পৌঁছে দেয় এ আমি

 মেয়েলি অনুভতিশক্তিতে আগেই বুঝেছিলাম। সামান্য একটা রঙ দেবার ব্যাপারকে কেন্দ্র করে সাত বছর ধরে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি ,নিজেও কষ্ট পেয়েছি।

লাভও  একটা হয়েছে। আমাদের টিনএজার ভালোবাসা যে খাটি ছিল সেটাই কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে গেলো।

চলো আগে তোমার বাবাকে দুজনে মিলে প্রণাম করি।তারপর  আমার মা বাবাকে।"

আমরা দুজন হাত ধরাধরি করে এগোলাম।