মহালয়ার একাল সেকাল ***********************সুতপা চৌধুরী
আজ মহালয়ার প্রভাত! ছোটবেলায় মহালয়ার আগের রাতেই সব প্রস্তুতি সেরে রাখা হোত। মানে রেডিওটা ঠিকঠাক আছে কি না দেখে রাখা! আমাদের বাড়িতে মা বরাবর খুব ভোরে উঠে সংসারের কাজে লেগে যেতে…
মহালয়ার একাল সেকাল
***********************সুতপা চৌধুরী
আজ মহালয়ার প্রভাত! ছোটবেলায় মহালয়ার আগের রাতেই সব প্রস্তুতি সেরে রাখা হোত। মানে রেডিওটা ঠিকঠাক আছে কি না দেখে রাখা! আমাদের বাড়িতে মা বরাবর খুব ভোরে উঠে সংসারের কাজে লেগে যেতেন! আর প্রত্যহ মাহেন্দ্রক্ষণে বাবী তানপুরার সাথে রেওয়াজ করতেন। তবে মহালয়ার ভোর ছিল ব্যতিক্রম! মা ঠাকুমা বলতেন শুদ্ধ হয়ে মহালয়া শুনতে হয়। ঠাকুমা ধূপ জ্বালিয়ে শঙ্খ বাজাতেন। বাড়িতেও যেন একটা পুজোর আবহ তৈরি হোত! সারা পাড়া একই সাথে রেডিওতে কান পেতে থাকতো দেড় ঘন্টা ধরে! কি রোমাঞ্চকর যে ছিল মহালয়ার ভোর! আজকের প্রজন্মের কাছে সেসব অবিশ্বাস্য গল্পকথা!
একটু বড় হয়ে বাবীর কাছেই শুনতাম, শ্রদ্ধেয় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র স্নান সেরে পট্টবস্ত্র পরিধান করে ধূপধূনো জ্বেলে স্টুডিওতে প্রকৃতই পুজোর আবহে চন্ডীপাঠ শুরু করতেন! বাকি শিল্পীরাও সমান নিষ্ঠায় 'মহিষাসুরমর্দিনী' অনুষ্ঠান করতেন!
বাবীকে দেখেছি নিষ্ঠাভরে স্বর্গত পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতেন! মহালয়ার দিন দেবীপক্ষের সূচনায় মৃন্ময়ী মায়ের চক্ষুদান সম্পন্ন হয়! ঠাকুমা গল্পের ছলে বলতেন, মা দুর্গাকে কোন দেবতা কোন অস্ত্র দান করেছিলেন মহিষাসুরকে বধ করার জন্য !
মহালয়া থেকে দেবীপক্ষের সূচনা...মা বলতেন, আজ থেকে এমন কোনও কাজ কোরো না যাতে গুরুজনেরা তোমাদের তিরস্কার করতে বাধ্য হন! কারুর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে নেই, মা দুর্গা কূপিতা হন! ব্যস, মায়ের কথাই বেদবাক্য ছিল, যা আজও মেনে চলি, নিজের আত্মজকেও বলেছি তার শৈশবে,বাল্যকৈশোরে!
এখন দেবীপক্ষে কারণে অকারণে দৃষ্টি ঝাপসা হয়, খাঁ খাঁ করা মেয়েবেলাকে স্মরণ ক'রে,...যা একদা ভালোবাসায় পরিপূর্ণ নিটোল এক সুখী গৃহকোণ ছিল! বড় তাড়াতাড়ি শেষ হল জীবনের সে অধ্যায়!
ঠাকুমার সাথে খালি পায়ে বাগানের শিশির মেখে শিউলি ফুল কুড়োতাম,জবা টগর আর দূর্বা তুলতাম বাড়ির পুজোর জন্য! আজও দুচোখ বন্ধ করে শিশিরে পা ভেজানোর সুখ অনুভবে পাই!
আমার কাছে মহালয়া মানেই শ্রী বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কন্ঠের চন্ডীপাঠ ! দূরদর্শনের অনুষ্ঠান আজ পযর্ন্ত দেখিনি,দেখার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে হয়নি! তবে আজ যুগ পাল্টেছে,সেইসাথে ধ্যান ধারণা বিশ্বাসও বদলে গেছে! তাই দূরদর্শনের প্রয়াসকে সাধুবাদ জানাই। কারণ যে কোন আলেখ্যর দৃশ্যরূপে বাচ্চাদের আগহ বেশি থাকে! তাই যেভাবেই হোক তাদের মধ্যে নিজেদের ঐতিহ্য কে সঞ্চালিত করাই প্রধান ও প্রথম কাজ! সেক্ষেত্রে দূরদর্শনের এই প্রয়াস সফল!
মহালয়া নিয়ে আমার উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে আমার আত্মজ মজা পায়, বলে' মা তুমি কখনও বড় হবে না?'... কি করে বোঝাই আমরাই সম্ভবত শেষ প্রজন্ম যারা যৎসামান্য উপকরণেও আনন্দে ভাসি আজও! আমাদের সেই সময়টা যেন আমাদের আলোমাখা সরল বিশ্বাসের ভোর আর আমার আত্মজন সমেত লহমায় অজানা ঠিকানায় মুখ লুকোলো! শুধু মহালয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র মহাশয়ের উদাত্ত কন্ঠের স্তোত্রপাঠের হাত ধরে ফিরে পাই আরবার আমার হারিয়ে যাওয়া স্বজনের সান্নিধ্য ! মুঠোয় ভরি হারানো সময়কে!
রচনাকাল
মহালয়া।৩১শে ভাদ্র ১৪২৭