বঙ্গ আমার, জননী আমার
অমৃতা মুখার্জী
"আরে হল তোমার? উফ আর হলুদ শাড়ি খুঁজতে হবে না, চল, যা পাচ্ছ পরে নাও!" রোহিত তাড়া দিল।
ইমন দিশাহারা হয়ে শাড়ির কুঁচি ম্যানেজ করছিল। মেয়েদের নাজেহাল করার জন্য এই একটি অস্ত্র ভগবান বাংলার ব…
বঙ্গ আমার, জননী আমার
অমৃতা মুখার্জী
"আরে হল তোমার? উফ আর হলুদ শাড়ি খুঁজতে হবে না, চল, যা পাচ্ছ পরে নাও!" রোহিত তাড়া দিল।
ইমন দিশাহারা হয়ে শাড়ির কুঁচি ম্যানেজ করছিল। মেয়েদের নাজেহাল করার জন্য এই একটি অস্ত্র ভগবান বাংলার বুকে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন পাগলি আঁচল সামলাও। আজ দূর্গাপুজার অষ্টমী । সকাল থেকে অবিরাম বরফ পড়ছে। এই জগাখিচুড়ী হলুদ শাড়ি আর জগঝম্প ঝোলা দুলের সাথে হাঁটু পর্যন্ত চামড়ার বুট পরে সে যখন পুজোবাড়িতে ল্যান্ড করবে কেমন দেখাবে ভাবতেই ভীষণ খিলখিল করে হাসি পেয়ে গেল।
রোহিত আবার হুংকার দিল। "আরে এই ছাতার বরফ উইন্ডস্ক্রীন থেকে কাচিয়ে তুলতে জান বেড়িয়ে যাচ্ছে, আর তুমি হাসছ? এর পর দেরি করলে কিন্তু আর অঞ্জলি দিতে পারবে না, আমি কিন্তু অনেক কায়দা করে উপোস করেছি। কুইক, কুইক।"
মিড ওয়েস্ট আমেরিকার এই ছোট্ট শহরে একটাই পুজো। তাও আবার ধাপধাড়া গোবিন্দ পুরে চল্লিশ মাইল দূরে একটা হলে। হরেকেষ্ট ইস্কনের চীপ হল, কাজেই নিরামিষ ভোগ। বাঙ্গালীর অষ্টুমী পাঁঠা ছাড়া? আরে রাম রাম। কত ভুজুং দিয়ে যে রোহিত কে রাজী করাতে হয়েছে ইমনকে। পুজোর দিনে পাঁঠা হয়নি বলে কেউ বাড়ি বসে থাকে?
কনকনে ঠান্ডা জমিয়ে দিচ্ছে পা দুটো। তাদের শস্তা গাড়ির হীটার গরম হতে হতে তারা হয়তো পুজো বাড়িতে পৌঁছে যাবে। আকাশ মেঘলা হলে কি হয়! চারিদিক ভেসে যাচ্ছে রংভাসি ফল কালারের বন্যায়। কমলা, মরচে, বাদামী, হলুদ,বাসন্তী আর টুকটুকে লাল। গাছ গুলো যেন প্রাণ ভরে দোলের আবীর মেখেছে। ও আমার রঙের আলো পাতায় পাতায় ডালে ডালে। রবিঠাকুর যেন ইমন কে মাফ করেন। কথা একটু পাল্টে সে গুনগুন করতে লাগল। কলকাতা থেকে কত হাজার মাইল দূরে, বন্ধুরা নেই, বাবা মা নেই, ঢাকের আওয়াজ নেই, তারা দুটি হারানো পাখি, তবু তো পুজো! গায়ে নতুন হলুদ শাড়ির কোরা গন্ধ। পাশে বর বাবাজীর গায়ে মিসফিট, নন ম্যাচিং গোলাপি কুর্তা। এত্ত সুখ পাওয়া যায় এই ছোট্ট জীবনে? বোলো দুগগা মাঈকি!
পুজো বাড়িতে ঢুকতেই সবাই হা হা করে উঠল। "আরে তোমরা ইয়ং ছেলে মেয়েরা কোথায় আগে এসে হেল্প করবে তা না। আমরা বুড়োরা চাঁদ মালা ঝোলাচ্ছি।"
ঢাকার পোলা নাসিম ফিসফিস করে রোহিত কে আশ্বস্ত করল " দুলা ভাই ! কুন সমস্যা নাঈ, আমার ওয়াইফ এক বাক্স ইলিশ ভুনা অলরেডী দিসে আপনার লগে, গাড়ির ট্রাঙ্কে আসে, ভুগের খিচুড়ি পাওয়া মাত্র আপনি বার হয়ে আসবেন, ইলিশ সহ খিচুড়ি খাইবেন, নিরামিষের কুন সীন নাঈ"। রাধা, বিমলা, শ্রেয়ারা এসে ইমন কে টানতে টানতে নিয়ে গেল। তরকারি কাটতে হবে। বাচ্চারা রঙ্গীন প্রজাপতির মত পুজোর জামা পরে হলে হুটোপাটি করছে। দ্যাখ না দ্যাখ মাইক্রো ফোনে ধাঁই কুড় কুড় করে ঢাক বেজে উঠল। অমনি পুরুত সোমক দা ঘন্টি নেড়ে সিরিয়াসলি ভুল উচ্চারণে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। মহিলারা সুরেলা কন্ঠে উলু দিচ্ছেন, ধুনোর ধোঁয়া, কাঁসর, মা দুগগার ঘাম তেল মাখা মুখ খানি। পুজো জমে গেল মুহুর্তে।
অঞ্জলির জায়গাটা যখন এল যশো দেহি, জয়ং দেহি, পুত্রং দেহি, ইমন একটু গলা তুলে কন্যাং দেহি বলে ধুয়া দিল। কয়েক জন বয়স্কা মহিলার দল ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। আহা তাতে কাঁচকলা বয়েই গেল। এই সুদূর প্রবাসেও বাঙ্গালীর দলাদলি আর রেষারেষি দো ধারি তরোয়ালের মত পুজোতে বেড়িয়ে পড়ে।
একদল প্রবীন প্রবীনারা যারা পঞ্চাশের দশকে পুজা শুরু করেছিলেন, তারা লাগাম আঁকড়ে ধরে কর্তাগিরি ফলাতে চান।
আর নব্য যাদবপুরিয়া আর সাউথপয়েন্ট বাহিনী ছাড়ব না ভাই ছাড়ব না বলে অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এর মাঝে ইমনের মত উটকো দু এক জন আছে যারা ভুলেও বলেনা যে শান্তিনিকেতনে নীলিমা দির কাছে গান শিখেছে।
এই গর্বে বুক ফুলানো স্বঘোষিত শিয়াল দের স্বপ্রতিষ্ঠিত বাঁশবনে রাজা বা রানী হবার কথা সে অতি বড় দু:স্বপ্নেও কল্পনা করে না।
সে দূরে থাকে।
রোহিত সাবধান করেছে অনেক বার।
"এই সব ফালতু বাঙ্গালীবাজি তে জড়িয়ে পড়বেনা। এত মেহনত করে এত সুন্দর একটা দেশে এত ভাল কাজের সুযোগ পেয়েছ। এই উইকেন্ডের পোস্ত ঘেটো কালচার অনেক বড় বড় লোকের সর্বনাশ করেছে।"
প্রসাদ খেতে খেতে জটলা আড্ডা হচ্ছিল। এরপর কালচারাল অনুষ্ঠান। কয়েক জন অবাঙ্গালী পরিবার ও এসেছেন। রোহিত দিল্লীর ছেলে বলে তাদের সাথে জমে বেশি। মি যোশি আর কে নারায়ন খুব আপ্লুত হলেন। রবীন্দ্রনাথ ট্রান্সলেশনের মাধ্যমে গুলে খেয়েছেন। বাঙ্গালীদের কালচার কিভাবে একশ গুন বেশি অন্য দের চেয়ে সে ব্যপারে কথা চলছিল। নারায়ণ সাহেব বললেন
"আরে না না। ইউ আর ফরগেটিং ভিভেকানন্দ জী। ইন আওয়ার সাউথ উই আর বিগ ফ্যান অব হিম। হোয়াট এন আমেজিং পারসোনালিটি , হোয়াট আ স্পীচ।"
একটু পরে স্টেজে আলো জ্বলে উঠল। ইমনদের অবাক করে একজন বাঙালী মহিলা ভয়ংকর জরি বসানো পিঠ খোলা বেগুনী লেহঙ্গা পরে আনাউন্স করতে এলেন। মাখো মাখো আদুরে ন্যাকামি খচিত গলায় মোচড়ানো ইংলিশে জানালেন দুটি মেয়ে এখন অ সাম "ড্যান্স" করে দেখাবে। সবাই নড়েচড়ে বসলো। সব্বাই কে অবাক করে দুটি পাখির ছানার মত রোগা মেয়ে নাভি বার করা পেট কাটা ঘাগরা আর বিসদৃশ কাঁচুলি পরে মা দুর্গার সামনে তান্ডব নৃত্যের সাথে কোমর দুলিয়ে নাচতে লাগল ছাঁইয়া ছাঁইয়া দিল, ছাঁইয়া । তাদের অঙ্গভঙ্গী দেখে মল্লিকা শেরোয়াত খাটের তলায় লুকিয়ে পড়তে পারে। কে নারায়ণের মুখটা হল দেখার মত। হা এর মধ্যে মাছির বদলে জেব্রা ঢুকে ইসিলি বেরোবে। সকলে হতভম্ব হয়ে পুজোর দিনে বাঙ্গালীর কালচার দেখছিল। পিছনে "ড্যান্স" শিক্ষিকা আর উৎসাহী বাবা মায়েরা উত্তেজনায় চেয়ারে উঠে পড়ে সিটি মারতে লাগলেন, পারলে তারাও স্টেজে উঠে পড়েন।
ইমন লজ্জায় মাথা নীচু করে বসেছিল। যোশি জী বিড়বিড় করছিলেন। "ইয়ে কুছ যাদা হি হো গ্যয়া! হামারে টেম্পল মে হামলোগ শক্ত মানা করকে রাকখা হ্যায়! জয় মাতা দী কে সামনে কোওঈ ফিল্মী গানা নেহী চলেগা!"
পুরো প্রোগ্রাম না দেখেই রোহিত উঠে পড়ল। সবার সাথে কোলাকুলি করে বেড়িয়ে এল ওরা। নাসিম জোর করে ইলিশ মাছের ডিব্বা দিয়ে দিল। "বাসায় গিয়া পান্তা ভাতের লগে খাইবেন দুলাভাই"।
দারুন চাঁদের আলো ধুয়ে দিচ্ছিল বরফে ঢাকা প্রান্তর। গাড়ী হু হু করে চলছিল রাত জাগা পাখির মত। ইমন কে অবাক করে রষকষ হীন রোহিত হ্ঠাৎ খালি গলায় গান ধরল "আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।"।
ইমনের বুক টা কেমন মুচড়ে উঠল।
একটু পরে সেও গলা মেলালো "আমারে যে জাগতে হবে, কি জানি সে আসবে কবে? যাবনা এই মাতাল সমীরণে!"
মা দুগগা মুচকি হাসলেন। তার পুজা সম্পূর্ণ হোল।
♥♥♥♥♥♥
All characters are fictitious and imaginary , any similarity with any living or dead person, time, or place is purely co incidental.
© Amrita Mukherjee