* জননী যখন দুহিতা *---মেঘে ঢাকা তারা20.10.20
কম বয়সেই পিতৃবিয়োগ হয় মঞ্জুষার। মায়ের অন্যত্র চাকুরি থাকায় যদিও সে ছোট থেকেই বাবার কাছে মানুষ,তথাপি তার কোন চাহিদাই অপূর্ণ রাখতেন না তার মা, মণীষা দেবী।সাধ্যমত সব করতেন।না চাইতেই সময় মত…
* জননী যখন দুহিতা *
---মেঘে ঢাকা তারা
20.10.20
কম বয়সেই পিতৃবিয়োগ হয় মঞ্জুষার। মায়ের অন্যত্র চাকুরি থাকায় যদিও সে ছোট থেকেই বাবার কাছে মানুষ,তথাপি তার কোন চাহিদাই অপূর্ণ রাখতেন না তার মা, মণীষা দেবী।সাধ্যমত সব করতেন।না চাইতেই সময় মত সবকিছু, এমনকি পাঠ্যবইয়ের সব খুঁটিনাটি, বিভিন্ন লেখকের লেখা রচনা বই বা সহায়িকা সবই জোগাড় করে দিতেন।হোস্টেলে বা ইউনিভার্সিটি যেতে হলে,কিংবা অসুস্থ হলে ডাক্তারখানায়, সকল স্থানেই সঙ্গে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতেন।এক কথায়,কোনোকিছুই করতে বাদ রাখতেন না তিনি।
ছেলেবেলায় মাইয়োপিয়া ছিলো মঞ্জুষার ।দূরের জিনিস ভালো দেখতে পেতো না।কিন্তু সেটাই যেন স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছিলো সে।পরে মা যেদিন ডাক্তার দেখিয়ে চশমা গড়িয়ে দিলেন,আর সেই চশমা পরে দূরের বস্তু স্পষ্ট যখন দেখতে পেতে লাগলো, মঞ্জুষার সে কি আনন্দ হলো সেদিন মনে ! মনে মনে অনেক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলো সে মাকে।আজ সে সবকথাই তার মনে আছে।তাই বৃদ্ধ বয়সে মণীষা দেবী যখন অথর্ব হয়ে গেলেন,মাকে শুধু মা নয়,তার নিজের অন্যান্য সন্তানের চোখেই দেখতে শুরু করলো মঞ্জুষা।একমাত্র মেয়ে হবার সুবাদে মাকে এখন তার নিজের কাছেই এনে রেখেছে সে।
সাধারণতঃ বৃদ্ধাবস্থায় মানুষ ছেলেমানুষের মতো হয়ে যায়।মণীষা দেবীও বাচ্চাদের মতো যখন তখন বায়না করেন,একটুতেই অভিমান করেন বা অসন্তুষ্ট হন।মাঝে মাঝে বিরক্তি লাগলেও মঞ্জুষা আবার সামলে নেয় নিজেকে এই ভেবে,মাও তো আমার আরেক সন্তান! নিজের সন্তান হাজার দোষ করলেও তো শেষে মাপ করে দিতে হয়।
সে জানে,সকলে এই ভুলটাই করে।শিশুর ভুলত্রুটি উপেক্ষা করা সহজ,কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষের তা করা সহজ নয়।সেও যে কখনো কখনো ধৈর্য্যচুত হয়নি এমনটাও নয়।আগে অনেক বকাবকি করেছে মাকে।তবে এখন আরো পরিণত হয়েছে সে।ক্রমশঃ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হতে হতে,বয়স মানুষকে অনেক সহিষ্ণু করে তোলে । শাস্ত্রে বলে,মা বাবার প্রতি বিরক্ত হয়ে কখনো "উঃ!" শব্দটি কোরো না।মঞ্জুষাও আপ্রাণ চেষ্টা করে সেটা মনে রাখার।সব সময় যে সফল হয় তা নয়,তবে চেষ্টাটা থাকে সর্বদা।
মঞ্জুষার গৃহস্থালির ছোটখাটো,টুকিটাকি জিনিস,যেমন,চামচ,বাটি,কাঁচী, ছুরি,রুমাল,ফ্রিজ থেকে ফলমূল প্রায় গায়েব হয়ে যায়।মঞ্জুষা বুঝতে পারে,এ তার মায়েরই কারবার,যদিও মায়ের কোনো অভাবই অপূর্ণ রাখা হয় না।একটু আধটু বিরক্ত হয় এই ভেবে,মা তো তাঁর প্রয়োজনীয় জিনিস চেয়ে নিলেই পারেন,কিন্তু কেন জানি না তা করেন না।শুধালে আবার স্বীকারও করতে চান না।বেশি বললে যদি কিছু মনে করেন,তাই সেই নিয়ে আর ইচ্ছে করেই উচ্চবাচ্য করে না সে।ওষুধ,জল ইত্যাদি ফেলার কারণে ঘরদোর নোংরা হলে বা,কাপ,গ্লাস,শিশি বোতল ভাঙলেও চুপ করে মেনে নেয় ।প্রথম প্রথম রাগ লাগে একটু।পরে আবার ভাবে, এটা তো তার বাচ্চাদের দ্বারাও হতে পারতো ! অগত্যা হজম করতে হয় সবকিছু।তবে মনে মনে সান্ত্বনা পায় নিজের এই সংযম শক্তির জন্য।বয়সের কারণে মণীষা দেবী আজকাল সবকিছুই ভুলে যান।অকারণে অন্যদের বিভিন্ন ছুতোয় দোষারোপ করেন।ঝি চাকরদের অহেতুক বকাবকি করেন।
মাঝে মাঝে মৃদু শাসন করতে হলেও অযথা তর্ক করা থেকে বিরত থাকতে চেষ্টা করে মঞ্জুষা।এছাড়াও সব সময় চেষ্টা করে মায়ের পছন্দ মত খাবার দাবার কিনে জমা করে রাখতে।দোকানে গেলেই মায়ের জন্য ডেয়ারী মিল্ক,কেক,ফ্রুটজুস,এছাড়াও যা চান,সবই কিনে আনে,নিজের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে সঙ্গে।মা খুব খুশি হন তাতে।
সেদিন মণীষা দেবী আব্দার করলেন তাঁকে ছবি আঁকার সামগ্রী কিনে দেবার।মঞ্জুষা জানে মা ভালো আঁকতে পারেন।হঠাৎ তাঁর সখ হয়েছে ছবি এঁকে ফেসবুকে পোস্ট করবেন।সেই মতো পরেরদিন মঞ্জুষা একটা ড্রইংবুক, এক ডজন রঙিন ডট পেন,স্কেচ পেন আর কালার বক্স এনে, মায়ের হালে তুলে দিতেই,মণীষা দেবী যেন ঠিক ছোট্ট শিশুর মতোই আহ্লাদিত হয়ে হাততালি দিয়ে উঠলেন।মনে মনে তৃপ্ত হলো মঞ্জুষা। আর খুশি হলো আজ তার এই ভূমিকা বদলে। আজ জন্মদাত্রী জননী যেন সত্যিই তার দুহিতা আর সে যেন তার - মা হতে পেরেছে!