গল্প #ভয়
#ঝুম_দত্ত
মাত্র তেরো বছর বয়সে রমলার বিয়ে হয়। অভাবের সংসারের বড়ো মেয়ে রমলা। বাবা মা ভাই বোন মিলিয়ে নটা পেট। বি আই কোম্পানির চাকরি টা ধুঁকছে বাবার, আজ আছে কাল নেই। এমন সময়ে সম্বন্ধটা এসে যাওয়ায় আর না করেন নি রমলার বা…
গল্প #ভয়
#ঝুম_দত্ত
মাত্র তেরো বছর বয়সে রমলার বিয়ে হয়। অভাবের সংসারের বড়ো মেয়ে রমলা। বাবা মা ভাই বোন মিলিয়ে নটা পেট। বি আই কোম্পানির চাকরি টা ধুঁকছে বাবার, আজ আছে কাল নেই। এমন সময়ে সম্বন্ধটা এসে যাওয়ায় আর না করেন নি রমলার বাবা - মা। ছেলে সরকারি চাকুরে, দেখতে শুনতে ও মন্দ না। মেয়েটা খেয়ে পড়ে বাঁচুক।
কিন্তু যার কপাল পোড়া সে আর কি করে সুখের মুখ দেখে! অমলেশ মানে রমলার বর সরকারি চাকরি করলেও মাইনের প্রায় অর্ধেক পাঠিয়ে দিতে হোতো গ্রামের বাড়িতে। কারন অমলেশ তখন তার পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। দেশে ছোটো ছোটো ভাই বোন, মা বাবা তার ও। সময় টা সত্তরের দশক। নকশাল মুভমেন্ট মাথা চারা দিয়ে উঠেছে তখন। কলকাতার নামি কলেজের বহু মেধাবী ছাত্র ইচ্ছাকৃত ভাবে অথবা অনিচ্ছুক ভাবে জরিয়ে পরেছে আন্দোলনে। পুলিশ যখন তখন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে ইয়ং ছেলেদের। ওদিকে বিয়ের দুমাসের মাথায় রমলা প্রেগনেন্ট হয়ে পরে। অভাবের সংসারে নিত্য দিন লেগে ই থাকত অশান্তি। রমলা চাইত দুটো পয়সা বাঁচিয়ে ওদের ভবিষ্যত সন্তানের জন্য রাখতে, অমলেশ ভুল বুঝতো ওকে। ভাবতো রমলা বুঝি পছন্দ করে না ওর দেশে টাকা পাঠানোর ব্যাপারটা। টানাপোড়েন এর মধ্যে ই জন্ম নিল ওদের সন্তান। সংসার খরচ যারপরনাই বারল। কিন্তু দেশ থেকে আরো টাকা পাঠানোর চাপ আসতে লাগলো। একদিন অশান্তি চরমে উঠল।
অমলেশ সব কিছু ভুলতে নাম লেখালো গিয়ে নকশাল আন্দোলন এ। সকালে বেড়িয়ে যেতো ফিরত রাত করে। রমলার সাথে বিশেষ কথাবার্তা হোতো না। অভিমান চেপে রমলাও ছেলে কে বুকে আগলে বাঁচতে শিখছে এখন। এমনি করে কাটছিল দিন। অমলেশের বাড়ি ফেরার সময় আরও কমতে থাকে দিন দিন। এরপর হঠাৎ ই একদিন অমলেশ যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল কোথায়। আড়াই বছরের শিশু পুত্র কে নিয়ে অথৈ জলে পরল রমলা।কোথায় যাবে এখন সে? বাপের বাড়ি যাওয়ার পথ নেই ওখানে অভাব যে বড়ো। পাড়ার দাদা ও অমলেশের অফিস কলিগদের সাহায্যে কিছু দিন কাটলো। কিন্তু কেউ কোনো খবর দিতে পারল না অমলেশের। বাতাসে গুজব রটল অমলেশ কে আজ এখানে কাল ওখানে দেখা গেছে। শুনলেই রমলা পাগলের মতো ছুটে যেতো তাদের কাছে। কিন্তু কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারতো না অমলেশের ঠিকানা।
একদিন মাঝরাতে বাড়ি তে পুলিশ এলো। ঘর তছনছ করে কি সব খুঁজলো ওরা।ছেলেকে বুকে জড়িয়ে খাটের তলায় লুকিয়ে কাঁপতে থাকল রমলা।
বেশ কিছু দিন পর খবর এলো আলিপুর জেলে বন্দি অমলেশ। খবর পেয়ে সন্তান কোলে ছুটে গেল রমলা। কি চেহারা হয়েছে অমলেশের। শুকিয়ে দড়ি একদম। চোখের তলায় কালি। পুলিশ ওর উপর যে অত্যাচার চালিয়েছে তার প্রমাণ স্পষ্ট।
পুলিশ সুপার রমলা কে ডেকে জানিয়ে দিল অমলেশ "মিসা"এক্ট এর আসামী। সেই সময় শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর তৈরি এই মিসা আটকে যারা বন্দী হোতো, তাদের কে দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে এনকাউন্টার করা হোতো। সব শুনে প্রথমে কান্নায় ভেঙে পড়ে রমলা। কিছুই কি করার নেই। পুলিশ সুপারের হাতে পায়ে ধরে রমলা। রেগুলার জেলে দেখা করে অমলেশ আর পুলিশ সুপার এর সাথে।
এরপর একদিন হঠাৎ করেই ছাড়া পেয়ে যায় অমলেশ। কারনটা সবার অজানা। অমলেশ যখনই রমলা কে জিজ্ঞেস করেছে রমলা বলেছে যে, পুলিশ সুপার কে রমলা বলেছিল "আপনার বোনের সাথে যদি এমন ঘটনা ঘটত আপনি কি করতেন দাদা?" কথাটা শোনার পর ই পুলিশ সুপার একদিন ডেকে রমলা কে বলে যে, অমলেশের নাম টা মিসা এক্ট থেকে কেটে দিয়েছেন উনি।
ফিরে এসে অমলেশ অন্য মানুষ হয়ে যায়। মন দিয়ে সংসার করে, নিয়মিত অফিস যায়। কিন্তু জেলের টর্চারে তার শরীর ভেঙে পড়েছে। রমলার সাথে তার স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক আর গড়ে ওঠে না কখনো।
রমলার অতৃপ্ত শরীর মাঝে মাঝে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। যা কিনা তার মানসিক স্বাস্থ্য কে আঘাত করে। ওদের ছেলের তখন পাঁচ বছর বয়স। রমলা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। শুধু চিৎকার করে বলতে থাকে "উফ্ কি অন্ধকার! ভয় ভয়।"
অমলেশ চিকিৎসার কোনো ত্রুটি রাখে না। নিয়মিত ডাক্তার দেখানো, অফিস কামাই করে রান্নাবান্না সব করে। শুধু পারে না রমলাকে শারীরিক সুখ দিতে।
এমনি করেই ওদের সন্তান একদিন বড়ো হয়। রমলা মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পরত। অমলেশ আবার তাকে সুস্থ করে তুলতে। এরপর এক শিক্ষিত পরিবারের সুশিক্ষিতা মেয়ের সাথে বিয়ে হয় ওদের ছেলের। ফুলসজ্জার রাতে রমলার ছেলে পুত্রবধূকে গল্প শোনায় কি ভাবে ওর মা ওর বাবাকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে এনেছে।
সুখ-দুঃখ নিয়ে সংসার চলতে থাকে তার আপন নিয়মে। হঠাৎ করে একদিন রমলাদের বাড়ি তে এসে উপস্থিত সেই পুলিশ সুপার। অমলেশ ও রমলা দুজনেই বেজায় খুশি। নতুন বৌকে পরিচয় করিয়ে দেয় ওরা। ছেলে অফিসে গেছে তাই অমলেশ গেলো মিষ্টি আনতে। বৌমা কে চা করতে বলে বসার ঘরে গিয়ে বসল পুলিশ সুপার আর রমলা। ছেলের বৌ ঋতু চায়ের ট্রে হাতে ড্রয়িং রুমে ঢুকতে গিয়ে থমকে গেলো। পুলিশ সুপার রমলার হাত টা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলছে, "তোমার ভয় কি এখনো কাটলো না রমলা? কেউ কিচ্ছু টি জানবে না কোনোদিন।"
শিক্ষিতা ঋতু এই টুকু বোঝে যে এ ছোঁয়া ভাইবোনের ছোঁয়া নয়।বুদ্ধিমতি ঋতু জানে এই গোপন কথাটা তার নিজের মধ্যেই রাখতে হবে সারা জীবন। স্বামী কেও বলতে পারবে না কোনোদিন। থাক না এটুকু কলঙ্ক। মানুষটা তো জীবনে কম কষ্ট সহ্য করে নি।
সমাপ্ত