ছোট গল্প।বৈচিত্র্য ভরা সংসার।অনিতা দাশগুপ্ত।প্রমোটর রাজ শুরু হওয়ার প্রথম দিকেই তৈরী হয়েছিল পৌষালীদের এই পাঁচ তলার আবাসনটি। প্রথম দিকে যখন ওরা এসেছিল মানিকতলারওদের চার পুরুষের ভিটে থেকে আলাদা হয়ে তখনএখানকার অনেক আবাসিক ই আসে ন…
ছোট গল্প।
বৈচিত্র্য ভরা সংসার।
অনিতা দাশগুপ্ত।
প্রমোটর রাজ শুরু হওয়ার প্রথম দিকেই তৈরী হয়েছিল পৌষালীদের এই পাঁচ তলার আবাসন
টি। প্রথম দিকে যখন ওরা এসেছিল মানিকতলার
ওদের চার পুরুষের ভিটে থেকে আলাদা হয়ে তখন
এখানকার অনেক আবাসিক ই আসে নি। বেশ ফাঁকায় ফাঁকায় শহরতলীর মোটামুটি এই ফ্ল্যাট
বাড়িতে থাকতে বেশ ভালো ই লাগতো। শুধু একটা
জিনিস ই ওর অসহ্য লাগত, চারতলার একটা ফ্ল্যাটে সন্ধ্যা হওয়ার পর থেকেই মদের মজলিস
বসা। যদিও কিছু বলার নেই ফ্ল্যাটের মালিক ই আসর জমাতেন। তিনতলায় ওদের ফ্ল্যাটে রাগিনী
কে নিয়ে থাকতে ওর বেশ ভয় ই লাগে এখন। রাগিনী র এখন উঠতি বয়স। বয়সজনিত চাপল্য ও ছুকছুকানী ওর একটু বেশি ই আছে। সন্ধ্যা হলেই ওর ছাদে যাওয়ার বাই ওঠে। নতুন কিনে দেওয়া মোবাইলে বন্ধু দের ফোন করা ওর একটা
নেশা। ছাতে অনেকক্ষণ থাকা টা পৌষালী র একদম পছন্দ নয়। ও বাঁধাও দেয় কিন্তু অবাধ্য মেয়ে ওর কথা কে গ্রাহ্যের মধ্যে ই আনে
না। ওর সবথেকে রাগ হয় ঘরের মানুষ টার
ওপর। মেয়ে কে একটু ও কিছু বলতো না। ওর এই
অবাধ্য চপলতা মানুষ টা দেখে ও দেখতো না।
নীতিশের এই রকম স্বভাব বরাবরের।এই স্বভাবের জন্য প্রথম জীবনে পৌষালিকেও কম অপদস্থ হতে হয় নি। অনেক বড়ো বিপদ তাকে
ছুঁতে পারেনি শুধু তার বুদ্ধির জোরে। বিপদের রূপ
নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসেছিল ওর ই দূর সম্পর্কীয় অর্থবান ভাসুর। সেদিন ও কিন্তু নীতিশের কোনো রকম হেলদোল ছিল না। বারবার
ওদের বাড়িতে অনেক উপহার নিয়ে আসা মানুষ টার আসল উদ্দেশ্য ও ধরতে পারলে ও নীতিশ সব
জেনে ও কেমন না জানা একটা ভাব করে থাকত।পৌষালীর মনে হত বোধহয় বড়োলোক দাদাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নিজের বৌ কে এগিয়ে দিচ্ছে। সেটা মনে করে অনেক মান অভিমান ও হয়েছিল
ওদের মধ্যে। কিন্তু পরে বুঝেছিল লোভী মানুষ নীতিশ নয়। যৌথ পরিবারে পৌষালীর বিয়ে হয়েছিল। ন্যায় অন্যায় অনেক কিছুর মধ্যে দিয়ে
ওর জীবন কেটেছে। স্পষ্টবাদী স্বভাবের জন্য সংসারের অনেক অন্যায়ের বিরোধীতা ও করেছে।
কিন্তু এইসব ক্ষেত্রে ও নীতিশ কে ও পাশে পায় নি।
এমনকি ওর বিরুদ্ধে যখন অনেক অবিচার ওর জা ও শাশুড়ি করেছে তখন ও পৌষালীর কষ্ট ও
দুঃখ ওকে বিচলিত করত না। বাড়ীর কারোর ব্যাপারে কিছু বলতে গেলে ও বলত," তোমাদের
ঝামেলা তোমরা মিটিয়ে নাও। আমাকে এসবের
মধ্যে জড়িয়ো না। ' বারবার ওর এই নির্লিপ্ততা তে
পৌষালী মানসিক ভাবে আরও দৃঢ় হয়ে গিয়েছিল।
ভেবেছিল ওর লড়াই টা ওকেই লড়তে হবে। রাগিনী বড়ো হবার পর পারিবারিক অশান্তি বেড়েই চলেছিল। তবে নীতিশের একমাত্র দূর্বলতা
ছিল ওদের মেয়ে রাগিনী। তাই ওর বেড়ে ওঠার
জন্য একটা সুন্দর পরিবেশের প্রয়োজনেই শহরতলিতে এই ফ্ল্যাট টা কেনার কথা যখন পৌষালী বলে তখন ও না করে নি। কিন্তু মেয়ের
প্রতি ভালোবাসা এতটাই বেশি যে মেয়ের শত অন্যায় ও লক্ষ্য করে না।
পৌষালী অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল আগের সব কথা গুলো মনে করে। তার পর খেয়াল হল
অনেক ক্ষন হলো রাগিনী ছাতে গেছে। এখনও
ফিরল না কেন ভাবতে ভাবতে ই দরজাটা বন্ধ করে
ও সিঁড়ি বেয়ে ছাতে চলল। যেতে গিয়ে চারতলায় রায়
বাবুর ফ্ল্যাট থেকে অনেকগুলো গলার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ায়। দরজা টা খোলাই ছিল। ওর
মনে হল রাগিনী কোনো এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হয়ে কলিং বেল
বাজিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। একটু পরে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে রাগিনী বেরিয়ে এসে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলে," মা এই অ্যান্টি আমাকে
ওনাদের বাড়ি নিয়ে এসেছেন আমার সঙ্গে গল্প
করবেন বলে।' এতক্ষনে ঐ মহিলা বলেন, "হাঁ , দিদি
ছাতে গিয়ে রাগিনী র সঙ্গে আলাপ হল। তাই নিয়ে
আসলাম ঘরে গল্প করার জন্য। ও অবশ্য অনেকক্ষণ থেকে যাব যাব করছিল। আমি ই উঠতে দিচ্ছিলাম না। আপনি ও বসুন না, একটু আলাপ করা যাক।' পৌষালী ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য একটু বসে। বলে," আপনারা এখানে এসে থাকেন না কেন? বেশ তো সাজানো গোছানো ফ্ল্যাট আপনাদের' । ব্রততী (ভদ্রমহিলার নাম)
বলে," না না এটা আমার ফ্ল্যাট নয়। দাদার ফ্ল্যাট।
শোভাবাজারে দাদার বাড়ি আছে। ওরা ওখানে ই
থাকে। এখানে আসে মাঝে মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প
গুজব করতে।' এরমধ্যে ব্রততীর দাদা সহাস্যে ঘরে
ঢুকে ওদের সঙ্গে আলাপ করে। বলে," মামনি কে তো প্রতিদিনই ছাতে যেতে দেখি। আজ ব্রততী এসেছে বলে ওকে ডেকে নিয়ে আসতে বললাম।
ভারী মিষ্টি মেয়ে আপনার।' নৃপেন রায়ের চাউনি
টা একদম ভালো লাগে না পৌষালীর। একটু বসেই
পৌষালী রাগিনী কে নিয়ে চলে আসে ওখান থেকে।
ঘরে ঢুকেই প্রচন্ড বকুনি দেয় রাগিনী কে।
বলে," ওদের ঘরে কেন গিয়েছিলি?' " অ্যান্টি তো আমাকে বারবার যেতে বলছিল, তাই গিয়েছিলাম।' "কেউ যেতে বললেই তার ঘরে চলে যেতে হবে? আমি বলেছিলাম না ওরা খুব একটা ভালো লোক নয়?"
" ওদের বাড়িতে কোনো মেয়ে থাকে না আর ঐ অ্যাঙ্কেল সব বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা মারে, ড্রিঙ্কস করে বলে তোমার ওদের পছন্দ নয়। কিন্তু দেখলে
তো উনি কত ভালো, কী সুন্দর করে কথা বলছিলেন। তুমি সবাই কে শুধু খারাপ দেখ।'
একসঙ্গে অনেক গুলো কথা মায়ের দিকে না
তাকিয়ে বলে যাচ্ছিল রাগিনী। ও দেখে ও নি
ওর মায়ের মুখের প্রতিক্রিয়া। পৌষালী প্রচন্ড রেগে
চিৎকার করে বলে উঠলো, " তুই আমাকে মানুষ
চেনাবি? আমি তোর মা। কতটুকু চিনিস মানুষ দের? জগত টা কে আমি অনেক ভালো করে
দেখেছি। একটা বাচ্চা মেয়ে তুই। তোর পক্ষে সহজ
নয় মানুষ চেনা।
তাই আমি যখন বলেছি ওরা ভালো নয়, ওরা
সত্যিই ভালো নয়। তুমি আর ওদের বাড়ি যাবে না।'
ওদের কথার মাঝে ই নিতীশ ঘরের দরজা বাইরে
থেকে খুলে ঘরে ঢুকেছে। মা মেয়ের কথার মধ্যে না
থেকে ও ফ্রেশ হবার জন্য বাথরুমে ঢুকে যায়। তারপর নির্বিকার চিত্তে বলে, " পৌষালী চা দাও।'
অবাক হয়ে পৌষালী বলে," তুমি কিছু জানতে চাইবে না আমি কেন এতো চিৎকার করছি?'
" শুনলাম তো রাগিনী কার বাড়ি গিয়েছিল । '
" তুমি জানো কার বাড়ি? ঐ রায় বাবুর বাড়ি। তুমি কী ফ্ল্যাটের কারোর কাছে কিছু শোন নি? '
" কোন রায় বাবু? আমি তো কিছু জানিনা।'
" সব জান। ন্যাকামো করছো। সব সময় তোমার এই গা ছাড়া ভাব আমার অসহ্য লাগে। মেয়ে বড়ো
হচ্ছে এটা খেয়াল রেখ। আর জেগে জেগে ঘুমিয়ে থেকো না। একটু চোখ কান খোলা রাখো বুঝলে।'
বলে রাগে গজগজ করতে করতে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল চা করতে।
নিতীশ টিভি চালিয়ে সেই রকম ই নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থেকে নিউজ দেখতে থাকল। একটু পরে চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে আবার রায়বাবুর
রাগিনী প্রতি নজর টা যে ওর ভালো লাগে নি সেটা ভালো করে নিতীশ কে বোঝাবার চেষ্টা করছিল। অনেকক্ষণ পর একটা কথাই নিতীশ বলে, ও তাই
নাকি? দেখ তুমি কী করতে পারি। আমি তো বাড়ীতে থাকি না । ' ওর নিস্পৃহতায় আরও রেগে যায় পৌষালী। ভাবে মেয়ের পুরো দায়িত্ব টা হয়তো
ওকেই নিতে হবে।
কিন্তু বাড়ীর পুরুষ মানুষদের এই নিস্পৃহ ভাব তে কোন ভাবেই সংসারের পক্ষে ভালো হয় না
সেটা বোঝা গেল কিছু দিনের মধ্যেই। ওদের বাড়িতে রাতে যে
চিৎকার চেঁচামেচি হয়েছে সেটা পাশের
ফ্ল্যাটের মাসীমার ঠিকই কানে গিয়েছিল। পৌষালী
সেই ভাবে কারোর ফ্ল্যাটে যাতায়াত করে না। ছাতে
কাপড় শুকাতে দেয়ার সময় যা দেখা সাক্ষাৎ হয়।
পাসের ফ্ল্যাটের নীতি মাসীমা বোধহয় সেই রকম সুযোগ খুঁজছিলেন। ছাতে দুদিন পরে তাই ওর সঙ্গে দেখা হতেই ঐ দিনের রাতের ব্যাপার টা জানাতে চাইলেন। সব শুনে পৌষালী কে বললেন,
" দেখ কিছু মনে কোরো না, সাবধান তোমাকেই হতে হবে। তোমার বর টা কে তো দেখছি এতো
দিন। কেমন যেন একটা। সবকিছু দেখে ও কেমন
একটা না দেখার ভান করে থাকে। সেদিন দোতলায় মিত্রর বাবুর নাতি বল ছুড়ে সিড়ির জানলার কাঁচ ভেঙে দিল ওনার সামনে ই। সেই নিয়ে সবাই মিত্র বাবু কে কত কথা বললো, উনি
কিন্তু কিছু না বলে পাস কাটিয়ে চলে গেলেন। ফ্ল্যাটের সবাই কিন্তু ওনার ওপর খুব অসন্তুষ্ট হয়ে
আছেন। তোমাকে মেয়ের মত দেখি তাই বললাম।'
" না মাসীমা আমি কিছু মনে করিনি। আমার ঘরের
মানুষ টা ঐরকম ই।'
" কিন্তু ঘরের পুরুষ যদি কোনো ব্যাপারে কিছু না বলে খারাপ মানুষেরা এর অনেক সুযোগ নেয়। আর একটা কথা তুমি তোমার মেয়ে কে বলে দিও
ও যেন কোনো দিন ওদের ফ্ল্যাটে না যায়। কার মনে
কী আছে কিছু বলা যায়? আর ওনার বোন বলে যাকে পরিচয় দিয়েছে সে সত্যিই ওর বোন কি না কে জানে। ওনার বৌ কে তো কোনদিন আসতে দেখলাম না। পয়সা থাকলে কী হবে রায় বাবুর স্বভাব চরিত্র যে ভালো নয় সেটা সবাই জানে। কিসের ব্যাবসা করে কে জানে'।
ছাত থেকে ফিরে এসে অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে পৌষালী। নীতি মাসিমার ওপর রাগ
হচ্ছিল কান পেতে ওদের সেদিনের সব কথা শুনেছিল বলে। কিন্তু এটাও মনে হচ্ছিল রায় বাবুদের বিষয়ে ওকে সতর্ক করে ভালো ই করেছেন উনি। পৌষালীকে এই ব্যাপারে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
রায় অ্যাঙ্কেল কে কিন্তু একটু ও খারাপ লাগে নি রাগিনীর। কি সুন্দর ভাবে কথা বলছিলেন। মা যাবার আগে তো কত কিছু খাবার ও উনি আর ঐ
অ্যান্টি টা ওকে খাইয়েছে। রাগিনীর পড়াশোনার কথা ও কত জিজ্ঞেস করছিলেন। ও অংক ভালোবাসে শুনে তো বললেন ওনার ছেলে ও পিওর সায়েন্স নিয়ে পড়ছে। পড়াশোনা তে ও খুব ভালো ।শুনে রাগিনী র খুব ভালো লেগেছে। ও এখন নাইনে পড়ে। ঐ রকম একজন ভালো ছাত্রর
সঙ্গে যদি আলাপ হয় তাহলে সব দিক দিয়েই ওর ভালো হবে। ঐ অ্যান্টি টা তো ছেলেটার ফটো টা ও
দেখার। কী সুন্দর দেখতে। এরসঙ্গে যেমন করেই হোক একবার আলাপ করতে হবে এটাই ও ঠিক করে রেখেছিল। ঐ দিনের দুদিন পর সেদিন ওর
মা বাড়ী ছিল না সেই দিন ঐ ছেলেটা এসেছিল।
ওর নাম মৈনাক। যে রকম দেখতে সুন্দর সেই রকম কথাবার্তা। ছাতে ওর সঙ্গে আলাপ হবার পর
মৈনাক ওদের বাড়িতে ও এসেছিল। মা না থাকলেও ওর বাবা বাড়িতে ছিল। ওর বাবা খুব ভালো ভাবে মৈনাকের সাথে কথা বলে। মৈনাকের ব্যাপারে ও মা কে কোনো কথা বলে নি। আর ওর বাবাও বলে নি। মোবাইল নাম্বার দিয়ে ছিল ও। তার পর থেকে প্রতি দিন ও মৈনাকের সাথে অনেক কথা হয় রাগিনীর । ওর বাবা জানে মৈনাকের ফোন আসে । জানে না শুধু ওর মা। মা জানতে
পারলে তুমুল অশান্তি করবে। বাবা কে নিয়ে ওর
কোনো চিন্তা নেই। বাবা কোনো ব্যাপারে থাকে না।
এটা ওর একটা বড়ো লাভ।
রাগিনীর ফোনের নেশা টা যখন বাড়ছিল ঠিক সেই সময় পৌষালীর মায়ের অসুস্থতার কারণে ওকে একটু বেশি সময় ধরে মায়ের বাড়ি গিয়ে থাকতে হতো। ওর দাদা বৌদির কাছে মা থাকলেও সেই সময় ওরা কিছু দিনের জন্য দিল্লি তে গিয়েছিল ওদের ছেলের কাছে। বাড়িতে ওদের মা কে দেখাশুনা করবার জন্য একজন মহিলা আছে ঠিকই। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থতার জন্য পৌষালী কে মায়ের কাছে প্রতিদিন ই প্রায় আসতে হচ্ছে। এখানে আসলেও ওর বাড়িতে ই মন টা পড়ে থাকে। রাগিনী কে যদি ও অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ও আসে। স্কুল থেকে এসে ঠিক মতো খেয়ে নেওয়ার কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়। সেই একই সঙ্গে ছাতে বেশি না যাওয়ার ও গেলেও
রায় বাবু দের কারোর সঙ্গে ই ওকে মিশতে পইপই
করে নিষেধ করে আসে পৌষালী। নিতীশ কে এই কদিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বলেছে ও।
যদিও জানে লাভ খুব একটা হবে না। কিন্তু তবুও
মনে হয় তাহলে অন্তত মেয়ে কে একলা বাড়িতে থাকতে তো হবে না। এরমধ্যে ও মনটা খচখচ করতে ই থাকে। তাই মত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি ফিরে যেতে চায়। কিন্তু রাস্তায় সময় ও তো লাগে অনেক টা।
মায়ের অনুপস্থিতির সুযোগ টা ভালো ভাবে
নেয় রাগিনী। মৈনাক এখন ওর চোখে একটা নেশা
ধরিয়ে দিয়েছে। সব সময় ওর কথাই মনে হয়। এরমধ্যে তিন দিন ওদের ফ্ল্যাটে এসে অনেকক্ষণ ধরে গল্প করেছে ওর সঙ্গে। বাড়িতে ওর বাবা ছিল
তখন। কিন্তু মৈনাক আসলেই ওর বাবা বসবার ঘর
থেকে উঠে শোবার ঘরে চলে যায়। একদিন তো
মৈনাক বলে ফেলে," তোমার বাবা খুব কুল না? ' তারপর হেসে আস্তে করে বলেছিল, এটা অবশ্যই
আমাদের জন্য ভালো।' রাগিনীর চোখে তখন কৈশোরের প্রেম রঙ লেগেছে। মৈনাকের কথা টা
বেশ ভালো লাগে। ওর মুখ লজ্জায় কিছু টা লাল
হয়ে যায়। এইভাবেই দুই এক সপ্তাহ যায়। মৈনাক
এখন ওদের ঘরে আসতে না পারলেও নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে রাগিনীর সাথে অনেকক্ষণ ধরে সময়
কাটায়। ওর বাবা বাড়িতে এসে যায় বেশিরভাগ দিনই। কিন্তু ছাতে এতক্ষণ ও কী করছে সেটা জিজ্ঞেস ই করে না। যদিও ফ্ল্যাটের দুই একটা কাকীমা একটু বাঁকা চোখে ই ওদের দেখে। কিন্তু
এরা কেউই মায়ের বন্ধু না ভেবে ও নিশ্চিন্ত বোধ
করে। কিন্তু ওর দিদার শরীর ঠিক হয়ে যাবার পর
ওর মায়ের বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ হবার পর ই
কিভাবে যেন সব কথা মা জানতে পারে। এবার আর শুধু বকুনি নয়। ওর মায়ের হাতে অনেক মার
খেতে হয় ওকে। তারপর বলে," তোর জন্য তো ফ্ল্যাটে আমার থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মায়ের
কোনো কথাই কী তুই শুনবি না? আজ থেকে তোর
ঘর থেকে বেরোনো ই বন্ধ। আমি ওদের বাড়ির কারোর সঙ্গে তোকে মিশতে বারন করেছিলাম। আর ঐ বাড়ির কোন ছেলেকে তুই বাড়ি তে এনেছিস। আবার তার সঙ্গে প্রত্যেকদিন ছাতে হা হা হি হি করেছো। এইসব কথা বলে আবার রাগিনী র গিলে থাপ্পর মারতে থাকে পৌষালী। রাগে ওর সারা শরীর কাঁপতে থাকে। রাগিনী অনেকক্ষণ সোফায় বসে কাঁদে । তারপর নিজের ঘরে চলে যায়। রাগিনী র পর নীতিশের ওপর প্রায় ঝাপিয়ে পড়ে পৌষালী। " তুমি এসব কিছুই জানতে না বল?'
" কী জানবো? তুমি এতো মারলে কেন মেয়েকে?'
" তোমার লজ্জা করছে না একথা বলতে? ঘরে ঐ
নোংরা লোকটার ছেলে এসে তোমার সামনে তোমার মেয়ের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে আর তুমি ঘরে
থেকে ন্যাকামো করছো? '
" গল্প করেছে তো আমার সামনেই। তাতে কী হয়েছে?
ফ্ল্যাটের লোকেরা যাচ্ছেতাই বলছে। মিত্রর বৌদি তো ঠারেঠরে আমাকে এটাই বললো তোমার মেয়ে কে তোমার সামনে কেউ নিয়ে গেলে ও তুমি না দেখার ভান করে থাকবে। তোমরা দুজনে আমাকে পাগল করে দেবে। শোন , আজ থেকে আমি কোথাও যাব না । রাগিনী স্কুলে তো বাসে করে যায়। কিন্তু টিউশন গুলো তে আমি নিয়ে যাব, নিয়ে আসব। তোমার মতো তার বাবা তার কপালে তে কী আছে ভগবান জানে। ঐ অবাধ্য মেয়ে কে আমি কত গার্ড করে রাখবো ?
মায়ের ওপর রাগ করে সেই রাতে খাবার ই খেল না রাগিনী। শুধু এই কথা টাই মনে হতে থাকে সে কী এমন করেছে তে ওর মা ওর গায়ে
হাত তুললো। রাগ অভিমান সারা রাত ওকে কুড়ে
কুড়ে গেল। অনেক রাতে মা ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চিত হয়ে ও ফোন করে মৈনাক কে সব কথা জানায়।সব শুনে মৈনাক বলে," তোমার মা তোমার
গায়ে হাত তুললো? আর তুমি কিছু বললে না?'
" আমি কী বলবো? রেগে গেলে মায়ের সঙ্গে কথা
বলার সাহস আমার থাকে না। তাছাড়া মেয়েরা মা
বাবার মুখের ওপর কথা খুব কম বলে।'
" তুমি কালকে আমার সঙ্গে দেখা কর যে কোন ভাবে।'
" সম্ভব নয়। স্কুল বাসে মা তুলে দেবে আবার আসার সময় নিয়ে ও আসবে।'
" তাহলে টিউটোরিয়ালে যাবার সময়। আমি গাড়ী নিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।'
" না ,তাও হবার নয়। মা ওখানে ও আমাকে নিয়ে যাবে, নিয়ে আসবে।'
" তাহলে অপেক্ষা কর। দেখি আমি কী করতে পারি। '
" আমার জন্য তুমি এতো ভেবে না । তোমার সামনে বোর্ড এর পরীক্ষা ।'
"দূর আমার সব কিছু তো তোমার ওপর নির্ভর করছে।'
" কী যে বলো না। ঠিক আছে আমার সব কিছু তোমাকে আমি জানাব।'
পৌষালী মেয়ে কে সেদিন থেকে আর চোখের আড়াল করতে না। ভয়ে ও দুশ্চিন্তা তে ওর শরীর
খারাপ হতে থাকে। দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেছে
নীতি মাসিমার কথা শুনে। ছাতে উনি সেদিন বলছিলেন রায় বাবু নাকি মেয়ে পাচারের সঙ্গে যুক্ত
আছে। যদিও হাতে নাতে ধরা উনি পড়েন নি কোনদিন। ভেবে ভেবে ওর রাতে ও ঘুম হয় না আজকাল। মোবাইলে কথা বলা ও রাগিনী র প্রায়
বন্ধ করে দিয়েছে পৌষালী। খুব দরকার হলে ওর
সামনে রাগিনী ফোন করে স্কুলের বন্ধুদের। পৌষালী এইসব কিছুর জন্য নীতিশ কে ই দায়ী করে। ছেলে টা ঠিক নীতিশের স্বভাব বুঝতে পেরেই রাগিনী র দিকে হাত বাড়িয়েছে। এতো কিছু
হবার পর ও কোন হেলদোল নীতিশের মধ্যে ও লক্ষ্য করে নি। শুধু বলে," তুমি ফালতু এতো চিন্তা করে শরীর খারাপ করছো। ' উত্তরে পৌষালী বলে,
" তোমার মতো লোকের সঙ্গে বিয়ে হলে এর থেকে
বেশী কি বা হতে পারে? আজ আমাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী তুমি। তোমার আস্কারা পেয়েছিল বলেই এতো টা বাড় বেড়েছে তোমার মেয়ের। দেখ আমার কপালে আরও কী আছে।'
পৌষালীর কথা গুলো নীতিশের মনে কোন দাগ ই কাটলো না। ও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।
এই ভাবেই বেশ কয়েকটা মাস গেল। পৌষালী এখন কিছু টা নিশ্চিন্ত। এর মধ্যে রাগিনী কিন্তু রাতে মোবাইলে মৈনাকের সাথে কথা বলা চালিয়ে গেছে আর প্রত্যেক দিন কল লিস্ট থেকে মৈনাকের কলগুলো ডিলিট করে গেছে । তার ফলে ওর মায়ের মনে কোনো সন্দেহই জাগে নি । বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট যথারীতি আশানুরূপ হয় নি। তার জন্য ও আবার অনেক কথা শুনতে হয়েছে
ওকে ওর মায়ের কাছে। কিন্তু মৈনাকের সাথে ও তে আর কোনো ভাবেই যোগাযোগ করতে পারছ
না সেই ব্যাপারে আর কোনো চিন্তা ওর মায়ের
মধ্যে নেই। তাই এখন শুধু ওর পড়াশোনা নিয়ে ই ওর মা বেশি ভাগ কথা বলে থাকে।
দিন টা ছিল শুক্রবার। পৌষালীর সকাল থেকে আজ অনেক কাজ। ২২ ফেব্রুয়ারি মানে
কালকে শনিবারে রাগিনীর জন্মদিন। বাড়িতে আত্নীয় স্বজন সকলের বন্ধু বান্ধব আসবে কালকে। দুপুরে খাবার আয়োজন করেছে ও। রান্নার মাসি সরলার সঙ্গে কালকের জন্য কিছু আইটেম আজ ই করে রাখতে চাইছে। তাই নীতিশ কে অফিস যাবার সময় রাগিনী কে বাসে উঠিয়ে দিতে বলে ও । সেই সঙ্গে বারবার বলে দিয়েছে ওর বাস ছাড়ার পর যেন নীতিশ অফিসে যায়। ওরা
এরপর একসাথে দুজনে বেরিয়ে যায়।
রাস্তায় বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডের কাছে এসে রাগিনী ওর জন্য অপেক্ষা না করে নীতিশ কে চলে যেতে
বলে। কারন ওর বাস টা আসতে বেশ দেরী করছিল। নীতিশ ও চলে যায়। পৌষালীর কথা ওর
মনে ই আসে না। নীতিশ চলে যাবার পর মৈনাক গাড়ি নিয়ে আসে। ওরা দুজনে গাড়ীতে করে
রওনা দেয়। রাগিনী এতো দিন পরে মৈনাক কে
দেখে প্রচন্ড খুশি থাকলেও এই প্রথম কোনো ছেলের সঙ্গে এইভাবে বেরিয়ে আসতে একটু ভয়
ভয় ও করছিল। মৈনাক বলেছিল ওকে যে প্রথম
যেদিন ওরা বেড়াতে যাবে সেদিন আগে ই রাগিনী কে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু রাগিনী দেখে শহর ছেড়ে গাড়ী টা হাইওয়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। ও তখন ই মৈনাক কে জিজ্ঞেস করে , " আমরা কোথায় যাচ্ছি? তুমি তো তোমাদের বাড়িতে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে যাবে বলেছিলে।' মৈনাক বলে, " সত্যি তুমি না একদম
বাচ্চা মেয়ে। আগে চল আমরা একটু মজা করে নি। তারপর তো মা, বাবা। কবে থেকে এই দিনটার
অপেক্ষা করছি।'
এবার রাগিনীর বেশ ভয় করতে থাকে। তাছাড়া মৈনাক খুব বাজে ভাবে ওর দিকে তাকাচ্ছে বারবার । সেই সঙ্গে মাঝে মাঝেই ওর গায়ে হাত দিচ্ছে। একবার তো ওর বুকের মধ্যে ও হাত দিয়েছে। রাগিনী আপত্তি জানিয়ে যতবার ওর কাছ
থেকে সরে আসছে ও একহাত দিয়ে ওকে আবার
কাছে টেনে নিচ্ছে । ভয়ে এবার রাগিনীর বুক কাঁপতে থাকে। ও সন্দেহ করতে আরম্ভ করে ও
ভুল মানুষের সঙ্গে এসেছে এবং খুব বিপদের মধ্যে
পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু ও ওর মায়ের মতো ই বুদ্ধিমতী। নিজের মনের ভাব টা প্রকাশ করে না।
শেষে মৈনাকের গাড়ী এসে দাঁড়ায় একটা হোটেলের কাছে ।ওরা নামবার সাথে সাথেই আরও
দুটো ছেলে আসে মৈনাকের কাছে। কীসব যেন
কথা হয় ওদের মধ্যে। দু একটা কথা ওর কানে আসে। ও শুনতে পায় একজন বলছে," ভালো ই তো মাল তুলেছিস। বেশ ভালো ই ফূর্তি করা যাবে।
তবে তুই এনেছিস। তুই আগে। তারপর আমরা। '
কথা গুলো শুনে ভয়ে ওর সারা শরীর কাঁপতে থাকে। কিন্তু ওর উপস্থিত বুদ্ধির জোরে ও ওদের
ওখান থেকে একটু পিছিয়ে আসে এটা দেখতে যে
ওর পালিয়ে যাবার রাস্তা আছে কিনা। এই সময়ে
একটা পুলিশ ভ্যান ও দেখতে পায়। ও রাস্তায় গিয়ে
ওটা কে দাড় করাবার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে মৈনাকের এক বন্ধুর সেটা চোখে পড়াতে সে জোর করে টানতে টানতে ওকে নিয়ে যেতে থাকে। পুলিশ
ভ্যান থেকে একজন পুলিশের সেটা নজরে পড়ে। ওরা দৌড়ে আসে। কিন্তু কাউকে দেখতে পায়না।
তখন হোটেল টার খানা তল্লাশি করে মৈনাকের সম্পূর্ণ দল টা কে এবং এই সব কাজে সাহায্য করার জন্য হোটেলের মালিক কে হওড়ার থানায়
নিয়ে যায়। রাগিনী কে উদ্ধার করে ওকেও থানায়
নিয়ে আসা হয়।
রাগিনীর ফেরার সময় পৌষালী সময় মতো
বাসস্টপে আসে। আজ সারাদিন ওর মন টা বড়ো কু ডাক দিয়েছে। দূর থেকে ওদের স্কুল বাস টা দেখে কিছুটা শান্তি হয় পৌষালীর। কিন্তু তার পর ও কে নামতে না দেখে অবাক হয়ে যায়। ওখানে পৌষালীর যেসব বন্ধুরা নামে তাদের কাছে জানতে পারে রাগিনী আজ স্কুলেই যায় নি। শুনে ওর শরীর
এতো খারাপ করতে থাকে যে মনে হয় এক্ষুনি ওর
হার্ট ফেল হবে। তাড়াতাড়ি বাসস্ট্যান্ডের একটা বেঞ্চিতে বসে পরে ও। ওর শরীরের অবস্থা দেখে দু একজন জড়ো হয়। তাদের মধ্যে একজন ওর চোখে মুখে জল ছিটায় এবং একটু জল ও খাওয়ায়। ঠিক সেই সময় হাওড়ার থানা থেকে
ফোন আসে ওর মোবাইলে। সব শুনে ওর ধড়ে
প্রাণ আসে। মনে হয় যাক এই যাত্রায় মেয়ে টা তাহলে বেঁচে গেল। রাগিনী কে পৌঁছে দেয়ার জন্য
ওদের বাড়িতে পুলিশ কে আসতে না দিয়ে নিজে একটা ওলা বুক করে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে ওখানে
পৌঁছে যায়। করনীয় যা ছিল সব হয়ে গেলে সপাটে
থাপ্পর মারে প্রথমে রাগিনীর গালে তারপর মৈনাকের গালে।
পৌষালী ঘটনা টা কে চাপা দিতে চাইলে ও ফ্ল্যাটে কথা টা জানাজানি হয়ে যায় কোনো ভাবে।
অনেকে অনেক রকম কথা বলতে থাকে। রাগিনীর
সত্যি ই কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা এই সম্পর্কে ও
সবাই প্রশ্ন করতে থাকে। পৌষালী যত টা সম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে ই ওদের উত্তর দেয়। বাড়ী ফেরার পর রাগিনী কে কিন্তু ও কিছু ই বলে নি।
বরং ওর উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ করে মেয়েকে সহায় দিয়ে যায় পৌষালী। কিন্তু নিজের বিছানা
টা ও আলাদা করে নিয়েছে। স্বামী হবার ও বাবা হবার যোগ্যতা যে নীতিশের নেই সেটা বুঝিয়ে দেবার সময় এসে গেছে। এই সাংঘাতিক বিপদের জন্য যে
নীতিশ নিজে দায়ী এই বোধটা নীতিশের ও হয়েছে। অনেক বড়ো বিপদের মুখে পড়ে নিজের
ত্রুটি গুলো দেখতে শুরু করেছে নীতিশ। তাই সেই
গুলো শোধরানোর নিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ও।
এই ঘটনার কিছু দিন পর রায় বাবু তার
ফ্ল্যাট টা কে বিক্রি করে দিতে একরকম বাধ্য হয়।
পৌষালীদের আবাসনে একটা নিশ্চিন্ততা ফিরে
এসেছে সবার মনে। পৌষালীদের নিয়ে আলাপ আলোচনা ও এখন সেরকম হয় না । রাগিনীর এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা জন্মেছে। পৌষালী এখন ওর মা থেকে বন্ধু হিসেবে ই বেশী পাশে থাকার চেষ্টা করে।
_______সমাপ্ত_____