Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

শুভ দীপাবলি'র শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার ছোট্ট নিবেদন:-
গল্প_দীপ-জ্বেলে-যাই।কলমে_রীনা সাহা ।
প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে নীহাররঞ্জনের বাড়ি ফিরতে বেশ রাতই হয়ে গেল। একটা ফ্ল্যাট বাড়ির বর্জিত অংশে ছোট্ট দেড়খানা ঘরের আপাতত মালিকানা তার…

 


শুভ দীপাবলি'র শুভেচ্ছা জানিয়ে আমার ছোট্ট নিবেদন:-


গল্প_দীপ-জ্বেলে-যাই।

কলমে_রীনা সাহা ।


প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে নীহাররঞ্জনের বাড়ি ফিরতে বেশ রাতই হয়ে গেল। একটা ফ্ল্যাট বাড়ির বর্জিত অংশে ছোট্ট দেড়খানা ঘরের আপাতত মালিকানা তার। ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরটা নিয়ে কোনোমতে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে বিছানায় নিজেকে সঁপে দিল। ঘরের আলো জ্বালার দরকার হলোনা। বাইরের রাস্তায় দীপান্বিতার আলোর রোশনাইতে ঘরে আলোর জোয়ার। অমাবস্যার অন্ধকার নিশি আতসবাজির ঝলকানিতে উৎসবমুখর। 

নীহার কিছু ছোট পত্রিকায় লেখালেখি করে, আগে তার কোনো লেখাই প্রকাশকরা ছাপার যোগ্য বলে মনে করতেন না, গভীর বেদনা, নৈরাশ্যের মধ্যে এক মানসিক অবসাদে যখন বিধ্বস্ত, তখন কয়েকটি পত্রিকায় তার লেখা গল্প প্রকাশিত হওয়ায় অবস্থা একটু সামাল দেওয়া গেল। এর উপর একজন প্রকাশকের দাক্ষিণ্যে তার ভাগ্যের চাকাটা কিছুটা ফিরেছে। সে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছে, প্রকাশকের অনুরোধে আজ রাতেই শেষাংশটুকুর প্রুফ দেখে কাল প্রেসে দিতে হবে। কিন্তু মন যেন আজ তার উল্টো খাতে বইছে। পেছনের স্মৃতিগুলো তাকে বড় বেশি টানছে। নীহারের বাবা ছিলেন কালীসাধক,খুব নিষ্ঠা ভরে এই পূজো করতেন। নীহার বাবার কাছেই জেনেছিল "দীপাবলি" নামের অর্থ "প্রদীপের সমষ্টি"। অমঙ্গল বিতাড়নের জন্যই চোদ্দপ্রদীপ জ্বালা,এরদ্বারাই পূর্বপুরুষদের আলো দেখিয়ে আত্মার শুদ্ধিকরণ করে যমরাজকে সন্তুষ্ট করে আত্মার স্বর্গযাত্রার পথ সুগম করা হয়।

বাবা বলতেন "অসত্য হইতে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে জ্যোতিতে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে অমরত্বে লইয়া যাও,সর্বত্র যেন ছড়িয়ে পড়ে শান্তির বার্তা।......

" দীপাবলির আলোর রোশনাই

রাতের তারারা ডুবে যায় আলোরগভীরে"

অদৃষ্টের পরিহাসে আজ তাকে একাকীত্বের জীবন কাটাতে হচ্ছে,অথচ একদিন তার সবাই ছিল,মা ছোট বয়সে মারা গেলেও বাবা, তাকে স্বচ্ছলতার মধ্যে বড় করেছে। তারপর বি.এ. পাশ করার পর ছোট একটা চাকরিও জুটে যায়। এরপর যথাসময়ে বাবা গরীব ঘরের সুন্দরী মেয়েকে পুত্রবধূ করে আনলেন। সদ্য ফোটা চাঁপার কলির মত নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক মন্দিরাকে পেয়ে জীবনটা যেন এক রঙিন স্বপ্ন বলে মনে হয়েছিল নীহারের। কিন্তু বছর কাটলো না,সব স্বপ্ন অন্ধকারের অমানিশায় হারিয়ে গেল। বাবা চলে গেল চিরতরে, চাকরিও সেইসময়ে চলে গেল। মন্দিরার গয়না, ঘরের আসবাবপত্র বাসনপত্র সব আস্তে আস্তে বিদায় নিল। সুসময়ের সুজনরা সব কোথায় হারিয়ে গেল।উঠে আসতে হলো ভাড়াটে বাড়ির অন্ধকার একটা ঘরে। ভাড়া দিয়ে অবশিষ্ট কিছুই থাকতো না। তাই নিজেদের ভাগ্যে চলল দিনের পর দিন উপবাস। মন্দিরার কোনো প্রতিবাদ ছিল না, কিন্তু উপর্যুপরি উপবাসের ফলে তার প্রাণশক্তি ক্রমশঃ বিদ্রোহ করতে শুরু করলো, অপরূপা সুন্দরী মন্দিরার বুদ্ধিনাশ হলো, সেই চরম দুর্দিনে মন্দিরা ঘর ছাড়ল,লিখে গেল দুটি মাত্র কথা "আমি চললাম"।

নীহারের সেদিন নিজের উপরই রাগ হয়েছিল, লজ্জা হয়েছিল এই ভেবে যে পুরুষ হয়েও স্ত্রীর দায়িত্ব নিতে সে অক্ষম। তাই হয়তো মন্দিরা তাকে রেহাই দিয়ে গেল।

 অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে আজ তার অবস্থা বেশ স্বচ্ছল, কিন্তু এই স্বচ্ছলতা যার জন্য বেশি প্রয়োজন ছিল আজ সেই তো তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে,কে জানে কোথায়, কোন অবস্থায় আছে সে!

নীহার অতীতের দুঃখজাল ছিন্ন করে বাস্তবে ফিরে চোখেমুখে জল দিয়ে আলো জ্বেলে প্রুফ দেখতে বসলো। মনে পড়লো প্রকাশক মোহনবাবু বলেছেন যে বইটা নীহার কাকে উৎসর্গ করতে চায় তার নামটা যেন উল্লেখ করে দেয়। কিন্তু তার প্রিয়জন বলতে কেউ নেই,এটা তার প্রথম উপন্যাস,কার হাতে তুলে দেবে এই বই! অবচেতন মনে উঠে এলো একটা নাম "মন্দিরা"! তবে কি শেষ পর্যন্ত ঐ কুল-ত্যাগিনীকেই উৎসর্গ করবে তার এই অমূল্য সম্পদ!

 কিন্তু মন্দিরা ঘর ছেড়ে কোনো অপরাধ করেনি। মন্দিরার প্রতি তার কোনো অভিমান,অনুযোগ নেই। যে কদিন সে কাছে ছিল,লীলাচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ কিশোরী বধূটিকে সে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল। অনেক ভাবনার পর সে লিখলো--

"কল্যাণীয়াসু, শ্রীমতী মন্দিরা দেবী"।।


কদিন পরেই বইটা প্রকাশিত হলো, উপন্যাসের নাম "দীপ জ্বেলে যাই"।


 প্রেস থেকে ফিরে মোহনবাবু বইটার একটা কপি তাঁর রক্ষিতার দিকে বাড়িয়ে দিলেন, বললেন "এই নাও তোমার সাধের বই, কদিন ধরে এত তাগাদা দিয়েছো, যে আমাকে তড়িঘড়ি বইটা ছাপাতে হলো, ভদ্রলোক কি সব ছাইপাঁশ লেখে কে জানে, তোমার কথায় আমাকে অনেক টাকা ঢালতে হয় ভদ্রলোকের পেছনে, ইদানিং দেখি ঐ লেখকের প্রকাশিত হওয়া লেখা সব পত্রিকাগুলো তুমি রাখতে শুরু করেছো। কেন যে তুমি ভদ্রলোকের নাম শুনলেই গলে পড় কে জানে! আমার টাকাগুলো এখন উঠলে বাঁচি,সব না আবার ভস্মে ঘি ঢালা হয়"।

শান্ত কণ্ঠে উত্তর এলো, "তুমি চিন্তা করোনা তোমার টাকা ঠিক উঠে যাবে,কি করবো বল, একলা সময় কাটেনা,তাই ওঁনার লেখাগুলো পড়ি,ভালোই লেখেন ভদ্রলোক।

সুন্দর মলাটে বাঁধানো বইটা হাতে তুলে "উৎসর্গ" এর পৃষ্ঠাটা মেলে ধরলো নিজের চোখের সামনে, সেখানে সোনালী অক্ষরে জ্বলজ্বল করছে তার নাম।

মোহনবাবু বললেন "কি মজার ব্যাপার, তুমি ঐ লেখকের অন্ধভক্ত, নানাভাবে অর্থসাহায্য করেছো অন্তরালে থেকে আবার উনি যাকে উৎসর্গ করলেন বইটা, তার নামের সঙ্গে তোমার নামের হুবহু মিল, তুমি কি ওকে চেনো নাকি"?

মন্দিরা চোখের জল আড়াল করে বললো "আমি কেমন করে চিনবো,দুজনের কি একনাম হয়না?"।

মোহনবাবু বলেন_"আমি ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করেছিলাম__মন্দিরা দেবী কে, তার সঙ্গে কি সম্পর্ক?

প্রশ্নটা শুনে কেমন যেন এড়িয়ে গেলেন, বললেন উনি একজন আমার শুভাকাঙ্ক্ষী,অভিমানে আমার কাছ থেকে দূরে চলে গেছেন"।


বইটা নিয়ে মন্দিরা ঠাকুরের বেদীর কাছে যান।বইটা মা সরস্বতীর চরণে নিবেদন করে দুটি হাত জোড় করে, মনে মনে বলেন,"মাগো, যে দীপ একদিন আমি জ্বেলে ছিলাম, আজ তোমার আশীষে তার জীবন আলোতে ভরে গেছে। তোমার চরণে আমার হাজার প্রণতি"।।


                  । সমাপ্ত।