Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

#বিভাগ--গল্প #এক অন্য প্রেমের গল্প#কলমে--সীমা রাহা
ডাক্তার অভিরূপ মুখার্জি, নাম করা সাইক্রিয়াটিস্ট।কলকাতা শহরের বড় বড় হসপিটাল গুলিতে তিনি প্রতিদিন চেম্বার করেন।সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ি ঢুকতে রাত নটা বেজে যায়। সারাদিন যন্…

 


#বিভাগ--গল্প 

#এক অন্য প্রেমের গল্প

#কলমে--সীমা রাহা


ডাক্তার অভিরূপ মুখার্জি, নাম করা সাইক্রিয়াটিস্ট।কলকাতা শহরের বড় বড় হসপিটাল গুলিতে তিনি প্রতিদিন চেম্বার করেন।সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ি ঢুকতে রাত নটা বেজে যায়। সারাদিন যন্ত্রের মতো খালি ছুটে যান,এক হসপিটাল থেকে আর এক হসপিটালে, এক নার্সিং হোম থেকে আর এক নার্সিং হোমে। সারাদিন নিজেকে ব্যস্ত রাখেন জীবনের কষ্ট, দুঃখ গুলিকে দূরে সরিয়ে রাখতে,

অন্যের মানসিক কষ্ট লাঘবের মাধ্যমে। তার একমাত্র ছেলে আঠারো বছর বয়সে একটি পথ দুর্ঘটনায় মারা যায়। তার স্ত্রী নন্দা সেই খবর পেয়ে শোক নিতে না পেরে একপ্রকার ট্রমার মধ্যে চলে যান। তিনি কথা বলা, প্রাত্যহিক কাজকর্ম সবই বন্ধ করে দেন। কিছুদিনের মধ্যেই খুব বেশী অসুস্থ হয়ে পরায় তাকে হসপিটালে ভর্তি করা হলে সমস্ত রকম পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বাবুরা জানান নন্দাদেবীর মস্তিষ্কে অ্যানিউরিজম ধরা পরেছে।এই রোগে ধমনীতে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। অপরেশন ছাড়া এই রোগ থেকে মুক্তির আর কোন 

সম্ভাবনা প্রায় নেই। অপরেশন হয়, কিন্তু নন্দা দেবী আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না। তিনি আজ পাঁচ বছর যাবৎ চলচ্চক্তিহীন হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী। মস্তিষ্কের ভাবনা চিন্তার ক্ষমতাও তার লোপ পেয়েছে। শুধুমাত্র একটা জীবন্ত মৃতদেহ হয়ে তিনি ডাক্তার অভিরূপ মুখার্জির বিরাট তিনমহলা বাড়ির একটি ঘরের এক কোণের খাটে জীবন্মৃত অবস্থায় পরে থাকেন।রোজ বাড়ি ফিরে ডঃ মুখার্জি তার পাশে বসে কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, কোনো কোনো দিন তার হাতটা ধরে তাদের পুরনো দিনের দু-চারটে স্মৃতি আওড়ান, কিন্তু কোনো কিছুই নন্দা দেবীর মধ্যে কোনো হেলদোল আনে না।

ডাঃ মুখার্জি দুই পাত্র সুরা পান করে রাতে শুতে যান, আজকাল সুরা পান না করলে তার চোখে আর ঘুম আসে না। সব হারানোর স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।


একদিন চেম্বার সেরে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ির পেছনে বসে তার তন্দ্রা মতো এসে গিয়েছিল। হঠাৎ গাড়ি ব্রেক কষে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে পরাতে তিনি সিটের উপর হুমড়ি খেয়ে পরেন। ক্রোধিত হয়ে তিনি ড্রাইভার শ্যামলালকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে জানায় একটি মেয়ে হঠাৎ হাইওয়েতে রাস্তায় নেমে গাড়ির সামনে এসে পরায় এই বিপত্তি।শ্যামলাল তাড়াতাড়ি করে নেমে গিয়ে দেখে মেয়েটি গাড়ির সামনে উবু হয়ে বসে। তার কথা শুনে ডাঃ মুখার্জিও গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটিকে ডাকতে থাকেন।মেয়েটি কোনো সাড়া দেয়না। তিনি তাকে হাত ধরে তুলে রাস্তার ধারে নিয়ে আসেন। কোথায় লেগেছে জিজ্ঞেস করলেও মেয়েটি কিছুই শুনছে না এমন ভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি বোঝেন, মেয়েটি স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তিনি মেয়েটিকে গাড়িতে তুলে পাশ্ববর্তী তার পরিচিত হসপিটালে ভর্তি করে তার কি কি সমস্যা আছে ভালো করে দেখে তাকে জানাতে বলে বাড়ি ফিরে আসেন। পরের দিন হসপিটাল থেকে জানানো হয় মেয়েটি শারীরিক দিক থেকে একেবারেই ঠিক আছে, কিন্তু তার সমস্যা মানসিক। সে একেবারেই মানসিক ভারসাম্যহীন। কোনো কথার জবাব দেওয়া বা কথা বুঝতেও সে অক্ষম। ডাঃ মুখার্জি সেইদিনই যান মেয়েটিকে দেখতে। মেয়েটি আপাত নিরীহ, কোনো রকম মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে উগ্রতা তার মধ্যে নেই। শুধু তার চোখ দুটো ভীষণ রকম স্থির। সামনে খাবার দিলে সে খেয়ে নেয়, টেনে শুইয়ে দিলে সে ঘুমিয়ে যায়। মেয়েটির চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্বভার তিনি নিজের হাতে নেন। রোজ নিয়ম করে দুইবেলা এসে দেখা, ওষুধে কেমন সাড়া মিলছে পরীক্ষা করা সব তিনি করতেন একদম নিয়ম মেনে। মেয়েটিকে সারিয়ে তোলা তার কাছে যেন একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।


ধীরে ধীরে তিনি উপলব্ধি করেন মেয়েটির মধ্যে একটু একটু করে পরিবর্তন আসছে। তিনি যখন তাকে কাউন্সেলিং করেন তিনি টের পান সে একটু একটু করে তার কথায় রেসপন্স করছে, মাথা নেড়ে, চোখ ঘুরিয়ে। তিনি উপলব্ধি করেন মেয়েটিকে হসপিটালে ফেলে রাখলে তার পক্ষে সেরে ওঠা সময়সাপেক্ষ হয়ে যাবে। তাকে সুস্থ করতে চাই ঘরোয়া পরিবেশ। তাই তিনি মেয়েটিকে নিজের বাড়ি নিয়ে আসেন। রোজ কাজে বেরনোর আগে এবং রাতে বাড়ি ফিরে তিনি নিয়ম করে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতেন। একদিন তিনি তার চিকিৎসার একটি ধরণ মেয়েটির উপর প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিলেন। সেইদিন বাড়ি ফিরে তিনি মেয়েটির ঘরে ঢুকে দেখেন সে জানলার ধারে বসে। তিনি এক পলক দেখে নিয়েই দরজার সামনে যেন হঠাৎ পরে গেলেন এমন ভান করে যন্ত্রনায় ছটফটের অভিনয় করতে থাকেন। তিনি মেয়েটির মধ্যে কি পরিবর্তন আসে সেটি দেখার জন্যই এমন কাজ করলেন। মেয়েটি মধ্যে চঞ্চলতার আভাস তিনি লক্ষ্য করলেন। তিনি বার বার বলতে থাকলেন " আমাকে তোলো, জল দাও।" মেয়েটি ধীরে ধীরে তার পাশে এসে তাকে ধরে তুলল। তিনি খাটে নিয়ে শুইয়ে দিতে বললে মেয়েটি তাই করল। ডাঃ মুখার্জি খুশী হলেন তার চিকিৎসা পদ্ধতিতে মেয়েটি সাড়া দিচ্ছে দেখে। এইভাবে নানান আঙ্গিকে, এক একদিন এক একভাবে চিকিৎসার ধরণ প্রয়োগের দ্বারা তিনি মেয়েটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরানর চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। প্রায় মাস তিনেকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় মেয়েটি অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠল।


এখন সে কথায় সাড়া দেয়।গুণগুণ করে গান করে,টুকটাক কাজ করে। তাকে দেখার জন্য সারাদিনের যে আয়াটি রাখা হয়েছে তার কাছে, তার থেকে ডাঃ মুখার্জি কাজ থেকে ফিরে রোজ সব খবর নেন।

একদিন তিনি মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলেন "তোমার নাম কি? "সে জানায় সাময়িকা। তারপর তিনি তার থেকে সব কথা শোনেন,তার অতীত জীবনের। তার বাবা, মা ও সে একদিন গাড়িতে ঘুরতে বেরিয়েছিল।সে গাড়ি থেকে নেমে আইসক্রিম কিনতে যায়। কিনে ফিরে আসতে গিয়ে দেখে একটা বড় বারো চাকার লরি রাস্তার মোড়ে টার্ন নিতে গিয়ে তাদের গাড়িটিকে একবারে দুমড়ে মুচড়ে পিষে দিল। তার বাবা মা কে সে নিজের চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখেছে। সেইখান থেকে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে সে ছুটতে শুরু করেছিল অজানা, অচেনা রাস্তা ধরে। তারপর তার কাছে সবই অজানা হয়ে যায়, সে মন থেকে কোথাও হারিয়ে যায়, তার আর কিছুই মনে নেই। ডাঃ মুখার্জি তাকে বাড়ি ফিরতে চায় কিনা জিজ্ঞেস করলে সে জানায় মা বাবা ছাড়া খুব আপন তার আর কেউ নেই যার কাছে সে যেতে পারে। দূর সম্পর্কের কিছু আত্মীয় আছে, তার ধারণা তারা কোনোভাবেই তার দায়িত্ব নেবে না, আর সে নিজেও যেতে চায়না তাদের কাছে।

ডাঃ মুখার্জি জানান " আচ্ছা, তোমার যতোদিন ভালো লাগে তুমি এই খানেই থাকো। মেয়েটির প্রতি তার নিজেরও কেমন জানি একটা মায়া পরে গেছে।

একদিন রাতে বাড়ি ফিরে ডাঃ মুখার্জি শোনেন সাময়িকা একটি সুন্দর ভাটিয়ালি গান গাইছে.... "আমার মন যে কান্দে রে......."। তার অপূর্ব কণ্ঠশৈলী একেবারে মরমে মনের গভীরে প্রবেশ করে যেন। তারপর থেকে প্রায়ই বাড়ি ফেরার পর তিনি সাময়িকার গান না শুনে শুতে যেতেন না। সাময়িকা তার সুরার পাত্র সরিয়ে রাখে, বলে যেচে কেউ রোজ বিষ পান করে? ডঃ মুখার্জি ভাবেন এই ছোট মেয়েটির প্রতি তার যে মানসিক আকর্ষন তা কতোটা যুক্তিসঙ্গত? একদিন সাময়িকা তাকে ঘুরতে নিয়ে যেতে বললে তিনি গঙ্গার পাড়ে তাকে নিয়ে যান। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আলো নদীর বুকে এক মায়াবী পরিবেশ রচনা করেছিল। সাময়িকার জেদের কাছে হার মেনে তিনি নৌকাবিহারেও রাজি হন। মাঝ নদীতে নৌকা হাওয়ার দাপটে টলমল হলে তিনি সাময়িকা কে বলেন বুড়ো বয়সে আমাকে এবার জলে ডুবে মরতে হবে দেখছি। সাময়িকা ভীষণ রাগান্বিত হয়ে তার বুকে মুখ গুঁজে একেবারে কেঁদে ভাসায়,আর সমানে বলতে থাকে " আমার সব ভালোবাসার মানুষদের ভগবান তার কাছে ডেকে নেন।ছিনিয়ে নেন আমার থেকে। তোমাকেও নিয়ে নিলে আমি আর বাঁচতে পারব না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।" ডাঃ মুখার্জি সাময়িকাকে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে বলেন " আমি কোথায় যাবো তোমায় ছেড়ে, এই পঞ্চাশ বছরের বুড়োকে দেখে রাখার একটা লোকও তো চাই। কিন্তু ভেবে দেখেছ কি আমি কিন্তু বয়সে তোমার থেকে অনেক বড়, কি পাবে তুমি আমার থেকে? আর আমার অসুস্থ স্ত্রী নন্দা কে তো তুমি দেখেছ।সে থাকতে আমি তোমাকে হয়তো কোনোদিনই বিবাহ করতে পারব না সামাজিক ভাবে।পারবে আমার জীবনে শুধু ভালো বন্ধু হয়ে থাকতে?" সাময়িকা তার বুকে মুখ রেখে বলে "ভালবাসার কোনো বয়স হয়না। আর তোমার থেকে বৈবাহিক বন্ধনের নিরাপত্তাও আমি যাঞ্চা করি না।শুধু মনের দেওয়া নেওয়ার বন্ধনেই আবদ্ধ থাকতে চাই।আমার বয়স ছাব্বিশ আর তোমার পঞ্চাশ, তাতে কি আসে যায়? তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছ। আমি আজ আবার যদি স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেয়ে থাকি তাও তোমারই অবদান। আমার ভালো থাকার চাবিকাঠি তুমি। প্লিস, হারিয়ে যেও না আমার জীবন থেকে।আবার আমায় অনাথ করে দিও না।" ডাঃ মুখার্জি তার এই ছোট্ট অসমবয়সী অবুঝ প্রেমিকার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে তাকে বুকে টেনে নেন। দুই অসমবয়সী সর্বহারা প্রেমিক যুগল পরস্পরের কাঁধে মাথা রেখে আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন খুঁজতে থাকে।

সাময়িকার গান সেই গোধূলি লগনে ভেসে বেড়াতে থাকে নদীর বুকে......দূর থেকে দূরান্তে....... 


"তোরা কে যাস রে 

ভাটির গাঙ বাইয়া

আমার ভাইধন রে কইয়ো

নাইওর নিতো বইলা

তোরা কে যাস,কে যাস?"