Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-পত্রিকার-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

কাঠগোলাপ:-কলমে:- মিতালী চক্রবর্তী
ঘড়িতে আরেকবার সময় দেখে নিলো মন্দিরা। বিকেল পাঁচটা বাজতে চলেছে। মনে মনে ভাবছে, রণজয় হয়তো এতক্ষণে পৌঁছে গেছে কফিশপে। এইরকমই তো কথা হয়েছিল মন্দিরার সঙ্গে রণজয়ের। চন্দ্রানী, রণজয়, মন্দিরা, কুমারেশ…

 


কাঠগোলাপ:-

কলমে:- মিতালী চক্রবর্তী


ঘড়িতে আরেকবার সময় দেখে নিলো মন্দিরা। বিকেল পাঁচটা বাজতে চলেছে। মনে মনে ভাবছে, রণজয় হয়তো এতক্ষণে পৌঁছে গেছে কফিশপে। এইরকমই তো কথা হয়েছিল মন্দিরার সঙ্গে রণজয়ের। চন্দ্রানী, রণজয়, মন্দিরা, কুমারেশ, তমোঘ্ন, অদিতি, পিউ এই কয়েকজনের একটা নিজস্ব বন্ধুবেষ্টনী ছিল কলেজ জীবনে। তারা সকলেই ছিল অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। এর মধ্যে রণজয় আর মন্দিরার সখ্যতা ছিল জগৎ বিখ্যাত। তাদের বন্ধুবেষ্টনীর আর সকলেও জানত রণজয় আর মন্দিরার সখ্যতা কতটা গাঢ়। আজ পুরনো এই দুই বন্ধু দেখা করবে কফিশপে।

বর্তমানে মন্দিরা একটি হায়ার-সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষিকা, আর রণজয় এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী। কলেজ পাস করেই চাকরির চেষ্টায় উঠেপড়ে লাগা ছেলেটি আজ নিজের জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। অটোতে বসে এইসব পুরনো হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর স্মৃতিতে গা ভাসাচ্ছিল মন্দিরা। টনক নড়ে ফোনের আওয়াজে। রণজয়ের ফোন। ফোন রিসিভ করতেই ওই প্রান্ত থেকে ভেসে আসে সেই চির পরিচিত গলার আওয়াজ, "কই? আমি পৌঁছে গেছি তো।" 

মন্দিরার উত্তর, "আমিও প্রায় এসেই পড়েছি।" 

আজ রবিবার। রাস্তায় ভীড়, যানজট একটু কম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্দিরাও পৌঁছে গেলো। ওই তো রণজয় দাঁড়িয়ে। হাত নাড়ছে তাকে দেখে। অটোর ভাড়া মিটিয়ে পা চালালো মন্দিরা।


চেয়ার টেনে দু’জনেই বসে পড়ে কফিশপের ডানদিকের একটা টেবিলে। রণজয় অর্ডার প্লেস করে নিশ্চুপ বসে আছে। মন্দিরা একটু অবাক হয়। আরো তো কতবার সাক্ষাৎ হয়েছে তাদের, কিন্তু রণজয়কে এতটা বিমর্ষ দেখেনি কখনো। মনে মনে প্রমাদ গোনে সে। কী ভাবে কথা শুরু করবে ভাবতে ভাবতেই বেয়ারা কফি নিয়ে হাজির। কফি হাতে নিয়েও কেমন গুম হয়ে আছে রণজয়। পরিস্থিতির সংবেদনশীলতা পরিমাপ করে মন্দিরাই নিস্তব্ধতা ভাঙে, "কী রে? আমায় ডেকে এনে এখন নিজেই চুপ হয়ে আছিস?"

"না। তেমন কিছু না। তুই বল? সব ভালো?"

রণজয়ের চাপা দীর্ঘশ্বাসটা দৃষ্টি এড়ায় না মন্দিরার। মুখে শুকনো হাসি টেনে বলে, "হ্যাঁ, ভালোই তো। কিন্তু তোর মুখটা এমন বাংলার পাঁচ হয়ে আছে কেন? সব ঠিক আছে? চন্দ্রানী ভালো আছে?"

চন্দ্রানীর নাম শুনতেই একপলক মন্দিরার দিকে তাকায় রনজয়। শান্ত অথচ গম্ভীর স্বরে বলে, "চন্দ্রা তো ভালোই আছে। খারাপ আছে শুধু আমাদের সম্পর্কটা!"

কথাটা শুনে নির্বাক মন্দিরা তাকিয়ে থাকে রণজয়ের দিকে। 

************

একা ঘরে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে চন্দ্রানী। বিশ্বাস হয় না এই সেই রণজয়, যাকে বিয়ে করেছিল সে? একসময়ে চন্দ্রানী ভেসে যেত রণজয়ের ভালোবাসায়। তাদের দুজনের ভালোবাসা কি আর এই কিছুদিনের? না তো! কলেজ জীবনেই তো মন দেওয়া নেওয়া হয়ে গিয়েছিল তাদের। মন্দিরা সহ সকলেই সাক্ষী ছিল তাদের ভালোবাসার।

আর এখন? দুজনের মধ্যে শুধু একযোজন দূরত্ব। নাহ্, ভালো নেই সে এই সম্পর্কটায়। মনে হয় প্রাণহীন একটা সম্পর্কের বেড়াজালে আটকে আছে। এখানে নেই কোনো তাপ উত্তাপ, নেই কোনো টান। আছে কেবল কর্তব্যবোধ! রণজয়ের ভালোবাসার শহরেই তো হারিয়ে যেতে চাইতো চন্দ্রানী। কিন্তু এখন শুধুই খাতা ভরা অভিমান। চন্দ্রানীর কেবল মনে হয় রণজয় বদলে গেছে। ভালোবাসার ঘরে এখন বাসা বেঁধেছে টাকার লোলুপতা। ভালোবাসার নিবিড় সান্নিধ্য থাকা সত্ত্বেও নিজেকে আরো উঁচুপদে দেখার তাড়না রণজয়ের, সঙ্গে অর্থের লোভ। 

কিছু দুঃখ খুব একান্ত, খুব ব্যক্তিগত হয়। আর সেই দুঃখের কারণ যখন নিজের প্রিয় মানুষটাই হয় তখন মনের মধ্যে কেবল বাড়তে থাকে সংঘাত, আঘাত। আরো কত কী কথা চন্দ্রানীর মনের আকাশে ভেসে ভেসে আসছিলো, কিন্তু ভাবনার জাল ছিড়ে যায় কলিংবেলের আওয়াজে। দরজা খুলতেই দেখে সামনে রণজয়। ভেতরে ঢুকেই চন্দ্রানীর মুখোমুখি দাঁড়ায় সে। এক পলক চন্দ্রানীর গভীর চোখগুলোর দিকে তাকিয়েই বলে, "তোমার ভালোবাসার নেশায় আমি আজও আসক্ত চন্দ্রা। বিশ্বাস করো, তোমায় আরো বেশি সুখী করার জন্যই দিনরাত..."

বলতে বলতে একটু থেমে যায় রণজয়। চন্দ্রানীর শুকনো মুখটা দুহাতে ভরে মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকায়। বিড়বিড় করে বলে, "নিজেকে আরও প্রতিষ্ঠিত করার লোভ চেপেছিল চন্দ্রা। ভুলেই গেছি যে সংসারে শুধু টাকা থাকলেই চলে না। ভালোবাসাটাও চাই। আমায় ভুল বোঝো না। আমি অনেক দোষে দোষী। একটি বার ক্ষমা করে দাও..."

নাহ্ আর থাকতে পারে না চন্দ্রানী। অনেকদিনের ক্ষোভ, অভিমানগুলো চোখ দিয়ে নেমে আসছে ঝর্নার মতন। অস্ফুটে শুধু বলে, "আমি যেমন আছি খুব ভালো আছি জয়। কিন্তু তোমার সঙ্গে এমন বাসায় থাকবো কী করে যেখানে ভালোবাসাটাই নেই। শুধু নামের একটা সম্পর্ক রয়ে গেছে কেবল! আমার অমূল্য সম্পদ তো তুমিই।"

চুপ করে চেয়ে আছে রণজয় চন্দ্রানীর দিকে। তার চোখে তখনও নোনাজল। রণজয় শার্টের বুক পকেট থেকে বার করে একটা কাঠগোলাপ ফুল। ধীরে ধীরে পরিয়ে দেয় চন্দ্রানীর কানের পাশে। অবাক হয়ে তাকায় চন্দ্রানী। মনে পড়ে যায়, কলেজ জীবনে বিয়ে হওয়ার আগে তাকে প্রায়শই কাঠগোলাপ উপহার দিত রণজয়। হেসে বলত "লাল গোলাপ কেনার পয়সা নেই চন্দ্রা, তাই কাঠগোলাপই দিলাম।" হেসে ফেলত দুজনে। আজ এতদিন পর রণজয়ের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া একটা কাঠগোলাপ চন্দ্রানীর ভগ্ন মনে জাগিয়ে দিল প্রেমের পরশ। রণজয় অস্ফুটে বলে, "আমাদের ভালোবাসায় একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল কেবল, ভালোবাসাটা মরে যায়নি চন্দ্রা।" জল ছলছল চোখে রণজয়কে জড়িয়ে ধরে চন্দ্রানী। 


রণজয়ের মনে তখন কেবল শ্রদ্ধা। কার জন্য? মন্দিরার জন্য। বাল্যবন্ধু মন্দিরাই তো কফিশপে বসে বুঝিয়েছিল কী ভাবে নিবিড় করা যাবে এই নিষ্প্রাণ সম্পর্কটাকে। রণজয় মনে মনে বলছে, "তোর মতন একটা বন্ধু থাকলে কোনো সংসার ভাঙে না রে সখী..."

                       _____*_____

ছবি সৌজন্য:- গুগল