#গল্পের নাম -পুনর্জন্ম (ছোট গল্প )
#সংহিতা মজুমদার
গৌড়বঙ্গে হিন্দু রাজবংশের পতনের পর পাঠান সুলতানগণ রাজত্ব করেছে দীর্ঘদিন |তারপর মোগলরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এসে পাঠানদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্তহয়েছে বেশ কিছু বছর |হুমায়ুন বাদশ…
#গল্পের নাম -পুনর্জন্ম (ছোট গল্প )
#সংহিতা মজুমদার
গৌড়বঙ্গে হিন্দু রাজবংশের পতনের পর পাঠান সুলতানগণ রাজত্ব করেছে দীর্ঘদিন |
তারপর মোগলরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এসে পাঠানদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত
হয়েছে বেশ কিছু বছর |হুমায়ুন বাদশার মৃত্যুর পর তার পুত্র আকবর সিংহাসনে বসেন | তাঁর আমলে মোঘল শাসন সারা ভারতের অনেক স্থানে বিস্তৃত হয় |
সেই সময় বারোভূঁইয়া নামে প্রচলিত জমিদার শ্রেণীরা বাংলায় নিজ নিজ অঞ্চলে
নিজস্ব জমিদারি ও প্রজাগণকে নিয়ে রাজত্ব
করতো |এদের নিজস্ব দুর্গ ও সৈন্যবাহিনী ছিলো | এরা কেউ ছিলেন হিন্দু আবার কেউ ছিলেন মুসলমান | সেই সময় এইরকম এক রাজ্য বিক্রমপুরের অধীশ্বর ছিলেন সমরেশ রায় ও তার পুত্র প্রভাত রায় এবং রং পুরের অধীশ্বর ছিলেন আমন খান |
ধর্ম আলাদা হওয়া সত্ত্বেও আমন খান ও প্রভাত রায়ের মধ্যে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ বন্ধুরতো ছিলো |সেই সময় মোগল সেনাপতি মানসিংহ
পাঠানদের দমন করে এই সমস্ত জমিদারিগুলি দখল করার উদ্দেশ্যে আক্রমণ চালাতেন | এই সময় আমন খান, মানসিংহের সাথে তলোয়ার হাতে দৈরথেও
মেতে ছিলেন |কিন্তু আমন খানের প্রবল বিক্রমে ও দক্ষতায় মানসিংহকে পরাজয় স্বীকার করতে হয় |
এর কিছু বছর পর বিক্রমপুরের জমিদার
সমরেশ রায় অসুস্থ হয়ে পড়েন |তাঁর সেবা করতেন তাঁর বিধবা কন্যা স্বর্ণকান্তা, প্রভাত রায়ের একমাত্র ছোট বোন |মাত্র এগারো বছরে বিধবা হন তিনি |স্বামীর সাথে দশ দিনও ঘর করেননি | তার বিধবা হওয়ার পর থেকে তিনি বাপের বাড়িতেই থাকেন | তিনি এখন সম্পূর্ণ যুবতী |তিনি শুদ্ধাচারী,পূজা আচ্চায় নিমগ্ন থাকেন,পিতার সেবা করেন |
একদিন সমরেশ রায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে আমন খান তাঁকে দেখতে আসেন |সেই সময় দৈবত তাঁর কন্যার সঙ্গে তার দৃষ্টি বিনিময় হয় |এরপর থেকে সেই ক্ষনিকের সাক্ষাৎ আমন খানকে ব্যকুল করে দেয় | তিনি ঠিক করেন স্বর্ণকান্তাকেই তিনি বিবাহ করবেন |সেই মতো এই প্রস্তাব তিনি প্রভাত রায়কে দিলে, প্রভাত রায় তা কাটিয়ে দেন এবং বলেন ,হিন্দু ধর্মে এটা শাস্ত্রের বিরুদ্ধে, আর এই কথা আমার ভগ্নি শুনলে সে আত্মহত্যা করবে কিন্তু কিছুতেই পরধর্ম গ্রহণ করবে না |
এরপর অনেক কষ্টে প্রচুর চেষ্টার পর লুকিয়ে তিনি দেখা করেন স্বর্ণকান্তার সঙ্গে এবং বিবাহের প্রস্তাব দেন আর বলেন আমি এই বন্দিদশা থেকে তোমায় মুক্তি দিতে চাই স্বর্ণকান্তা | স্বর্ণকান্তা রাজি হন এবং তিনি আমন খানের সঙ্গে কাউকে কিছু না জানিয়েই রং পুরে চলে আসেন |
এই ঘটনা জানাজানি হবার পর সমরেশ রায় তা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যুবরণ করেন এবং প্রভাত রায় এর প্রতিশোধ নেবার জন্য প্রস্তুত হন |
ইতিমধ্যে প্রভাত রায় খবর পান আমন খান, মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন | এরপর তিনি আরো নিশ্চিত হন যে রংপুর দখল করার এটাই
সুবর্ণ সুযোগ |
প্রভাত রায় সেনাপতি বিহীন রংপুর আক্রমণ করেও যখন কিছুতেই পেরে উঠছেন না তখন তিনি জানতে পারেন যে, কোনো এক মহিলা সেনাবাহিনীর মাঝে থেকে সেনাবাহিনীকে পরিচালনা করছেন |আরো খবর পান যে এই মহিলাই তার বোন স্বর্ণকান্তা |
তিনি স্বর্ণকান্তার সাথে সাক্ষাৎ করবেন ঠিক করলেন | সেই মতো নতুন শিবির স্থাপন করে তাদের সাক্ষাৎ-এর ব্যবস্থা করা হলো l প্রভাত রায় স্বর্ণকান্তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন | অলংকার বিহীন, শুভ্রবসন পরিহিতা তার সেই লাজুক বোন এখন সম্পূর্ণ অন্য বেশে | স্বর্ণকান্তা এখন স্বর্ণবিবি, তার পরিধানে এখন রঙিন মুসলমান পোশাক |মাথায় পালক বসানো মুকুট |
স্বর্ণবিবি বললেন, তোমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তোমার জাত ধর্ম নষ্ট করবো না |
তাই দূর থেকেই আদাব জানাচ্ছি | প্রভাত রায় অবজ্ঞার সুরে বললেন, সত্যি বিচিত্রভাবে কুৎসিত সেজেছিস স্বর্ণ তুই | মনে হচ্ছে সার্কাস দেখাতে এসেছিস | সত্যিই সার্কাসই বটে, ভোলপাল্টে ভোজবাজিতে সামিল হয়েছিস |সার্কাসে যেমন ক্ষনিকেই সব পরিবর্তন হয়ে যায় তেমন তুইও এত তাড়াতাড়ি এতটা বদলে গেছিস |এই ভাবে এত সহজে তুই ধর্ম বিসর্জন দিলি কি করে? এভাবে ধর্ম বিসর্জন দিয়ে তুই মরে গেলি না কেন? স্বর্ণবিবি স্পষ্ট স্বরে উত্তর দিলেন, যে ধর্ম মেয়েদের শুধু মরতেই বলে, সে ধর্ম আমি মানি না | ধর্ম মানে এই নয় যে, ইহজগতের সমস্ত সুখ -সম্ভোগ থেকে বঞ্চিত হওয়া | সেবা করা মানে দাসী হয়ে থাকা নয় | ঠিকই বলেছো দাদা সার্কাসের একটা চরিত্রই ছিলাম আমি | সার্কাসে বাঁধা প্রাণীদের মতোই অবস্থা ছিলো আমার | মালিকের ইচ্ছাতেই জীবন আর শ্বাস | সার্কাসের মূক প্রাণীদের মতোই করে রেখে ছিলে তোমরা আমায় |তোমরা আমাকে সহজ ভাবে কোনোদিন নিঃশ্বাসও নিতে দাও নি | আমার সমস্ত স্বাধীনতাকে কেড়ে নিয়ে তোমরা আমাকে সার্কাসের মূক প্রাণীদের মতোই বানিয়ে রেখেছিলে |
প্রভাত রায় বললেন, ঐ বিশ্বাসঘাতক, তস্কর তোকে স্বাধীনতা দিয়েছে? স্বর্ণবিবি বললেন হ্যাঁ দিয়েছেন | সন্মান দিয়েছেন, স্বাধীনভাবে নিঃশ্বাস নেবার অনুমতি দিয়েছেন |নিরুপায় তোমাদের হাতের পুতুল হয়ে থাকা আমার মতো নির্জীব প্রাণীকে তিনি দিয়েছেন নতুন জন্ম | তিনি আমায় ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছেন, অস্ত্র ধরা শিখিয়েছেন | তিনি আমার মতামতের গুরুত্ব দিতেন |আমি আবার পুনর্জন্ম পেয়েছি দাদা | হ্যাঁ আমি আর তোমাদের হাতের পুতুল হয়ে সার্কাস দেখবোনা | আমি এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন | এই বলে তিনি প্রভাত রায়কে আদাব করে শিবির ত্যাগ করলন |
(এতে ঐতিনহাসিক তথ্য যৎসামান্য, সেই সময়ের মূল সত্য আদর্শটি অক্ষুন্ন রেখে আধুনিক ভাবে লেখার চেষ্টা করেছি )