#সন্ধ্যাতারা, চামচিকে আর আমার কৈশোর#ব্যক্তিগত গদ্য #সুস্মিতা
চামচিকের গায়েও যে লেখা ছিল আমার কৈশোরের গল্প, আমি নিজেও জানতাম না...
কত বছর পরে...উঁহু, কত যুগ পরে একটা চামচিকে দেখলাম।গতকাল সন্ধ্যায় ঢুকে পরেছিল ঘরের ভিতর।প্রাণীটিকে…
#সন্ধ্যাতারা, চামচিকে আর আমার কৈশোর
#ব্যক্তিগত গদ্য
#সুস্মিতা
চামচিকের গায়েও যে লেখা ছিল আমার কৈশোরের গল্প, আমি নিজেও জানতাম না...
কত বছর পরে...উঁহু, কত যুগ পরে একটা চামচিকে দেখলাম।গতকাল সন্ধ্যায় ঢুকে পরেছিল ঘরের ভিতর।প্রাণীটিকে দেখে কত কথাই যে হুড়মুড় করে মনে পড়ে গেল...
মনে পড়ে গেল বহু যুগ আগে পেছনে ফেলে আসা আমার কৈশোরকে...
আমার স্মৃতিতে কৈশোর আর গোধূলিবেলা কেমন যেন হাত ধরাধরি করে থাকে। 'গোধূলি'- বিকেল আর সন্ধ্যার মাঝামাঝি সে এক অলীক মুহূর্ত।আকাশের রং তখন মায়াবী আলোয় ভরা, আমরা তাকে বলতাম "কনে দেখা আলো।"
আমি তখন কোনোদিন হয়ত কৈশোরের একবুক অকারণ মনখারাপ নিয়ে ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি...আবার কখনও আমাদের উত্তর কলকাতার পাড়ার দিগন্ত ছোঁয়া খেলার মাঠে একদল বন্ধুর সঙ্গে।
কোনও বাড়ির রেডিও থেকে শোনা যাচ্ছে ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী...কখনও বা মনকেমনকরা আধুনিক বাংলা গান। সেসব গান শুনে বুকের ভেতরটা যে কেমন করত।ফেরিওয়ালার "বেলফুল" ডাকের সাথে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ত মিষ্টি সুবাস।
সন্ধ্যা নেমে আসার সঙ্গেসঙ্গে বাতাসে ভেসে আসত কাঁসর ঘন্টার শব্দ। ঘরে ঘরে সন্ধ্যাপ্ৰদীপ দেওয়ার পালা।তুলসীতলায় মাথায় ঘোমটা টেনে মা যখন প্রণাম করত, প্রদীপের আলোয় মায়ের মুখখানা ঠিক বিজয়া দশমীর দিনের দুর্গা ঠাকুরের মতো মনে হত। কি অদ্ভুত একটা কান্না পেত মায়ের সেই পবিত্র সুন্দর মুখটা দেখে।এক একদিন ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতাম মাকে ।সদ্য গা-ধোওয়া মায়ের গা থেকে তখন টের পেতাম সেই 'মা মা গন্ধটা'। কত কিছু যে মিশে থাকত সেই গন্ধে...সারাদিন রান্নাঘরে ব্যস্ত মায়ের শাড়ির আঁচলে মশলার ঘ্রাণ কিম্বা বিকেলে মাখা সাবান...জানিনা...
ক্রমশ সূর্য্যের আলো নিভে আসছে।দিগন্তরেখাকে পেছনে রেখে ঘরে ফেরা পাখির ডানা আকাশের বুকে ছবি আঁকছে। আমরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম আকাশের দিকে। ধীরেধীরে জ্বলে উঠছে একটা দুটো করে নক্ষত্রের আলোকবিন্দু...যেন বাদশাজাদির নীল মখমলি ওড়নায় শুরু হ'ল সলমা জরির কাজ । বন্ধুরা মিলে একটা খেলা খেলতাম সেই সময়ে- "কে ক'টা তারা গুনতে পারে?"
আকাশের বুকে ফুটে ওঠা তারা আর ঘরে ফেরা পাখির ডানায় লেখা থাকত আমাদেরও বাড়ি ফেরার 'সময়'। এবার ঘরে ঢুকতে হবে। এইসব কিছুর সঙ্গে বোধহয় খেয়ালও করতাম না যে চরাচর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একঝাঁক চামচিকে বা আরও কত কীট পতঙ্গ ।ঝিঁঝিঁ পোকার গান কবে আর আলাদা করে শুনেছি।
ঘরে ঢুকেই হাত পা ধুয়ে পড়তে বসতে হবে। এই ছিল আমাদের সেই সময়ের নিয়ম।
এক একদিন কোন ফাঁকফোকর দিয়ে একটা দুটো চামচিকে ঘরে ঢুকে পড়ত। কি যে ভয় পেতাম।বৈদ্যুতিক পাখার ঝাপটা লেগে সেই ভয়াবহ চামচিকে যে কার গায়ে এসে পড়বে- এই ভয়ে ভাইবোনদের হুলুস্থুল কাণ্ড। বড়রা কেউ এসে আলো নিভিয়ে, দরজা-জানালা খুলে সেই চামচিকেকে বাড়ির বাইরে বের করতেন, সে এক পর্ব বটে আমাদের মেয়েবেলার।
এতগুলো বছর পরে গতকাল সন্ধ্যায় একটা চামচিকে আমার ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। প্রাণীটি এসেছিল যেন আমার স্মৃতির মনিকোঠায় কড়া নাড়বে বলে...ওর ডানাতেও যে লেখা হয়েছিল আমার কৈশোরের গল্প...আমি নিজেও জানতাম না।
সুস্মিতা
******