**এটি একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক দ্বৈভাষিক কথোপকথন। স্থান কাল পাত্র ও তত্ত্ব বিশেষে ভিন্ন জনশ্রুতি অনুসারে অগণিত ভিন্ন মত অনস্বীকার্য। এখানে কেবলমাত্র প্রধান দু'টি চরিত্রে'র তৎকালীন আবেগমথিত অভিব্যক্তির যৎকিঞ্চিৎ প্রস্ফুটন ঘট…
**এটি একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক দ্বৈভাষিক কথোপকথন। স্থান কাল পাত্র ও তত্ত্ব বিশেষে ভিন্ন জনশ্রুতি অনুসারে অগণিত ভিন্ন মত অনস্বীকার্য। এখানে কেবলমাত্র প্রধান দু'টি চরিত্রে'র তৎকালীন আবেগমথিত অভিব্যক্তির যৎকিঞ্চিৎ প্রস্ফুটন ঘটাবার দুরূহ প্রয়াস মাত্র।
পাঠককুলের কাছে নতশিরে ত্রুটি মার্জনা'র সশ্রদ্ধ আবেদন রইলো।**
বামাংশসম্ভূতা
শান্তনু দাস
[ স্থান- দ্বারকার সীমান্ত অমোঘ নির্জন বন। শ্রীরাধিকা'র টলমল চরণযুগল বৃন্দাবনাভিমুখে অগ্রসর। অদূরে শ্রীকৃষ্ণ তাঁহাকে অনুসরণ করিতেছেন। ]
শ্রীরাধা- হে মুরারি, কৃপাসিন্ধু, দ্বারকাধীশ হে- আমি অবগুণ্ঠনরতা, তব হর্ম্য সেবাদাসী, দ্বারকা'র মহা-নৃপাসনে তব সৌম্যকান্তি মূরতি দরশন করিয়া'ই বৃন্দাবনাভিমুখে গমনোন্মুখ হে যদুকুলপতি। এ বিজন অটবির পথে আর মোর পশ্চাদ্ধাবন করিও না। ফিরিয়া যাও, ফিরিয়া যাও হে জগৎ-পালনহার- তব অবশ্যম্ভাবী ঔচিত্য সাধনায়.....
শ্রীকৃষ্ণ- তিষ্ঠ ক্ষণকাল প্রিয়ে। এই অতিকায় পাদপতলে কুসুমবিচ্যুত চির-প্রেমাস্পদ কদম্বরেণু তব চরণকমল স্পর্শিতে আজি ব্যাকুল। পথ ক্লান্ত তুমি হে পরমানন্দরূপিণী, বসো ক্ষণকাল এইখানে.....
শ্রীরাধা- (ইষৎ হাসিয়া) ব্যাকুল? ব্যাকুল দয়ানিধি? হে মনোজ্ঞ- তুচ্ছ প্রকৃতিজ ব্যাকুলতা তব চিত্তাঙ্গন স্পর্শিতে যদি পারে, এ অভাগী তবে বঞ্চিত কি হেতু হে হৃদেশ্বর?
কায়মনোবাক্যে ধ্যানে জ্ঞানে অবচেতনে লীলায় পূজনে উজাড় করিয়া নিংড়াইয়া নিজেরে তব চরণে সঁপিয়া দিয়াও অদ্যাবধি কি হেতু তোহে লভিতে পারিলাম না হে মোর আরাধ্য?
এ কাঙালিনী'রে তাহার প্রেম তপস্যার ত্রুটি-বাখান শ্রবণ করাইতে পারো হে মধুসূদন?
শ্রীকৃষ্ণ- হে সচঞ্চলা, শান্তম্ ভবতু। তব কোমল হৃদগহনে আজি অজস্র পুঞ্জীভূত প্রশ্নরাশি'র অতৃপ্ত মন্থন, উহার দুর্নিবার তরঙ্গাভিঘাতে জর্জরিত ভঙ্গুর হৃদকমলের পরিচায়ক তব মুখচন্দ্রিকায় সঞ্জাত ব্রজবালা। তব ঈদৃক রূপ মোহে ব্যথিত করিলো হে চন্দ্রাকান্তা, যতো'না ব্যথিত করিলো তব শাণিত প্রশ্নবাণ।
সুতরাং, তব জিজ্ঞাস্য প্রশমনে আমি অভিনিবিষ্ট হইলাম হে শ্রীলক্ষী।
শ্রীরাধা- শ্রী-ল-ক্ষী-? এ নাম ধরিয়া তো পূর্বে কভু মোরে সম্বোধন করো নাই হে রাধারমণ!
একি মায়া! একি শিহরণ! দেহের সমস্ত অস্থি, মজ্জায়, রোমকূপে একি অদ্ভুত অনুভূতি!
আহ্!! কেশব...কেশব....
শ্রীকৃষ্ণ- হে শতচন্দ্রনিভাবননা, আমি স্বয়ং বিষ্ণু'র অষ্টমাবতার। এ যুগে কিয়ৎ বিশেষ কার্য
সমাধা এবং পূর্বজনমের প্রতিশ্রুতি পূরণের প্রয়োজন আমার আবির্ভাবে'র হেতু।
তুমি বৈকুণ্ঠ রাজ্ঞী নারায়ণী, তুমি কেবলমাত্র আমার প্রণয়িনী রূপে নিজেরে অবলোকন করিবার ঐচ্ছিক প্রাবল্যে পূর্ব-জন্মবিস্মৃতি'র শর্ত মানিয়া লইয়া মৃত্যুলোকে আবির্ভূতা হইয়াছ।
প্রণয়িণীরূপে যাহা চাহিয়াছিলে রাসেশ্বরী- এ জনমে সে কামনাপূর্তি'র অপেক্ষা অধিক'ই পাহিয়াছ। যুগ-যুগান্ত ব্যাপিয়া তব প্রণয়কীর্তি ত্রিলোকবিদিত ও ধন্য রহিবে, জানিও বৃন্দা।
শ্রীরাধা- আশীর্বাদ? পতিতপাবন? তব এ আশীর্বাদে প্রীত হইব কি'না, তাহা যে ভাবিয়া পাহি না।
হে ত্রিকালদর্শী, সর্ব-পরিণাম জ্ঞাতা, ভবিতব্য পূর্বজ্ঞাত হইয়াও মোরে ইচ্ছাসংবরণ ভিক্ষা দানিলে না কি হেতু হে দীনবন্ধু? না'ই দানিলে যদি, পরস্ত্রী বানাইয়া পাঠাইলে কি হেতু? সঙ্গিনী রূপে অবতীর্ণ হইতাম যদি, মোদের প্রণয় বুঝি প্রণয় হইত না ব্রজবাসী? সঙ্গী অপেক্ষা পরপুরুষ-প্রেম অতিমাত্রায় জনবিদিত ও মুখরোচক হইয়া প্রণয়ে যৌক্তিক সার্থকতা প্রদান করিলেও ইহাতে এ কুল-রমণী'র সম্ভ্রম আহুতি দিলে গো রসসিন্ধু!
ত্রিলোকে'র শিষ্টমহল যে চিরকাল মোরে কলঙ্কিনী বলিয়া'ই চিনিবে!
এ কেমন করিয়া পারিলে হে করুণাসাগর?
শ্রীকৃষ্ণ- হে নারায়ণী, এ জনমে আয়ান ঘোষ'ই তোহে সঙ্গিনী রূপে লভিতে পারিবেক- ইহাই বিধেয় ছিল। পূর্ব জনমে সে শ্রীলক্ষী'কে পত্নী রূপে লাভ করিবার হেতু সুকঠিন সাধনা'য় নিবিষ্ট হইয়াছিল। তাহাকে বিরত করিবার সকল অনুরোধ ও প্রচেষ্টা সে তাহার দুর্নিবার তপস্যাবলে খণ্ডিত করিতে সক্ষম হয়। তথাপি আমার বারণ সত্ত্বেও তাহার মনোকামনা'য় অনঢ় রহিয়া সে শর্তাধীন আশীর্বাদধন্য হইয়াছে। সেই হেতু সে ইহজনমে নপুংসক ও গৃহবিমুখ সাধক। তুমি আজিও অনাঘ্রাতা।
রহিল কলঙ্কে'র সম্বন্ধ হে বৃন্দাবনবিনোদিনী,
একনিষ্ঠ প্রেমের উদাহরণ সূচীতে তব প্রেম সর্বোচ্চ আসনে সদা বিরাজমান রহিবে, আজি হইতে জগতে 'কৃষ্ণ' নামে'র পূর্বে সদা 'রাধা' নাম গাঁথা রহিবে কৃষ্ণস্বরূপিনী।
শ্রীরাধা- একনিষ্ঠ প্রেম? তব প্রেম একনিষ্ঠ কি'রূপে হে নয়ন-রঞ্জন? তুমি তো পূর্বজন্ম-বিস্মৃত নহ? অষ্ট পত্নীর বল্লভ তুমি, প্রদ্যুম্ন শাম্ব সহ অগণিত সন্তানের জনক। তদ-উপরন্তু তব চিত্তের ইথারে ইপ্সিত কুল-রমণী'র শিঞ্জনধ্বনি তরঙ্গায়িত!
কাহার প্রতি তব প্রেম একনিষ্ঠ হে অনঙ্গমোহন?
এ হতভাগ্য প্রগলভা পরস্ত্রী হর্ম্য দেবিকা'র?
বিরজা.. ইত্যাদি,,ইত্যাদি ক্ষণ-প্রভাগণের?
না অষ্টপত্নী'র অগ্রজোদ্বয় রুক্মিণী, সত্যভামা'র?
শ্রীকৃষ্ণ- হা হা হা হা হা....
দেবীগণ স্বীয় স্বীয় বাঞ্ছাপূর্তি'র আশীর্বাদধন্যা হইয়া মোর অষ্টচক্রের অধিকারিণী হে রাসকেশরী।
আমি অংশসৃষ্ট হইলেও শরীরজ।
শরীর চিত্তের কেন্দ্রস্থল, শারীরিক মিলনে চিত্তের ভাগিদারী প্রকৃতিজ হইয়া পড়ে, সুতরাং নিষ্ঠা'র স্থিতি সেইখানে নিঃসন্দিগ্ধ বিদ্যমান। দেবীগণ প্রতারণা-প্রাপ্ত হন নাই।
তাহা বর্জিত, এ যুগে আমি নৃপতিও বটী। রাজধর্ম অনুসারে যদুকুলে'র কল্যাণ-হিতে যাহা যথোচিত- তাহাতে অনগ্রসর থাকিতে পারি না।
মোর বহুপত্নীক হইবার উহাও হেতু বিশেষ।
তব বিষয় ভিন্ন হে কৃষ্ণপ্রিয়া। তুমি চিত্তে'র পুণ্যসলিলা স্রোতস্বিনী, যাহার আত্মিকস্পর্শে
মুহুর্তে ইহজাগতিক সকল হলাহল মিটিয়া যায়, পুনঃ পুনঃ এক নব নৈসর্গিক অমৃতকুম্ভের অভ্যুত্থান আবিষ্কার করিয়া উঠি।
আমি পূর্বজন্মবিস্মৃত নহি বলিয়া'ই চিত্তের ললিতকুঞ্জে তুমি সদা অধিষ্ঠাত্রী কৃষ্ণা...
কদাপি নিষ্ঠা'র অবমাননা হয় নাই প্রিয়ে।
শ্রীরাধা- আমি বলহীন হে মাধব। তব বিরহ-বেদনা'র তীব্র হইতে তীব্রতর লহমা- সমূহের বারংবার অভিঘাতে ধৈর্য্য ধারণে'র সামর্থ্যচ্যুত হইয়াছি। তব যৌক্তিক খণ্ডনে প্রাণপণ সম্মতি প্রদান করিয়াও আজি আপনারে ঊর্জস্বলা স্থিত করিয়া উঠিতে পারিলাম না হে গোপী-মনোহারী!
মোর অবসন্ন নেত্রযুগলে তব সৌম্যকান্তি মূরতি ক্রমশঃ আবছা হইয়া আসিতেছে। বুঝি মোর অন্তিম লগন সমাগতপ্রায়। এ জনমে আর সাক্ষাৎ হইবে না গো প্রাণপতি। না বুঝিয়া কটুবাক্যাঘাতে তব হৃদয় ক্ষত করিয়া ফেলিয়াছি। ক্ষমো নির্বোধে'রে...
প্রাসাদে ফিরিয়া যাও হে চক্রপাণি।
শ্রীকৃষ্ণ- রাধে! আসন্নপ্রসবা অনিশ্চিত ভবিতব্যে বিচলিত হইও না। যাহা অবশ্যম্ভাবী, তাহা'ই অজেয়, তাহা'ই বিধেয়, তাহা'ই আদ্রিয়। সমস্ত প্রতিকূলতা'কে নিবৃত্ত করিয়া সে তাহার অস্তিত্বে'র জানান নিশ্চিত করিয়া'ই লয়। জীবন-মৃত্যুর জাগতিক নিয়মও ইহার ব্যত্যয় মার্গে'র নহে।
চিত্ত শান্ত করো হে প্রিয়ে,
অদ্যাবধি তুমি মোর নিকট কিছুটি চাহ নাই, আজি কিছু চাহিয়া লহ হে রাধে।
শ্রীরাধা- মোর সকল জিজ্ঞাস্য সংশয় নির্বাপিত হইয়াছে হে নাথ। তব কণ্ঠে রাধা নামে'র শ্রবণে সমস্ত তনু-মন অনাবিল আনন্দধারায় সিক্ত হইয়া গিয়াছে। সার্থক মোর জনম,, ধন্য আমি।
আর কিছু'ই চাহিবার নাই হে মধুসূদন।
শ্রীকৃষ্ণ- জীবন তৃপ্তি'র অন্ত জানে না হে প্রিয়ে। পর-স্বার্থে নিঃস্বার্থে আত্মতুষ্টি অবশ্যই বর্তমান, পরন্তু আত্মসংবৃতি'তে তত নহে।
আমি যাচ্ঞা করিতেছি, কিছু'টি চাহিয়া লহ।
শ্রীরাধা- আমি পুনরায় একটিবার তব বংশীবদন স্বরূপখানি অবলোকন করিতে চাহি হে দুর্বাদলশ্যাম। তব বাঁশি'টি একবার বাজাও তবে হে যশোদানন্দন। কতকাল শুনি নাই, পরান-পিঞ্জরে'র বন্দী বিহগ কতকালে'র শ্রুতি-সুধার তিয়াসী!
দানো তারে, শেষবারে'র ন্যায় মহাতৃপ্তি'র অমৃতবিন্দু। দরশন দেও হে মুরলীমোহন!
শ্রীকৃষ্ণ- তথাস্ত,, শুভায় ভব।
[ সম্মোহনী সুর বাজিয়া উঠিল, শ্রীরাধা দেহ ত্যাজিয়া শ্রীকৃষ্ণে'র বামাংশে বিলীন হইলেন।
মুরলী দ্বিখণ্ডিত করিয়া জঙ্গলে নিক্ষেপ করিয়া শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকাভিমুখে চলিলেন।
অতঃপর বাঁশি আর কভু বাজিল না.....]