সৃষ্টি সাহিত্য যাপন #গল্প_পলাশ_শিমূল#কলমে_মহুয়া_মিত্র
পঞ্জিকা মতে সকাল ছটার সময়ে দ্বিতীয়া লেগেছে । অন্য দিন সূর্য ওঠার আগেই বিছানা ছাড়ে তৃপ্তি । কিন্তু আজ ঘড়িতে আটটা বেজে গেলেও ওঠার তাগিদ অনুভব করছে না । বেশ কিছুক্ষণ ধরে আশপাশে…
সৃষ্টি সাহিত্য যাপন
#গল্প_পলাশ_শিমূল
#কলমে_মহুয়া_মিত্র
পঞ্জিকা মতে সকাল ছটার সময়ে দ্বিতীয়া লেগেছে । অন্য দিন সূর্য ওঠার আগেই বিছানা ছাড়ে তৃপ্তি । কিন্তু আজ ঘড়িতে আটটা বেজে গেলেও ওঠার তাগিদ অনুভব করছে না । বেশ কিছুক্ষণ ধরে আশপাশের বাড়ি থেকে শাঁখ, উলুর আওয়াজ আসছে, শুয়ে শুয়ে তাই শুনছে । অন্যান্য বার আজকের দিনে ভোর রাত থেকেই বাড়িতে ব্যস্ততা শুরু হয় । কিন্তু এবারে সব শুনশান ।
আরো একটু বেলা বাড়তে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠল তৃপ্তি । পাশের ঘরে গিয়ে দেখল বিছানা খালি । বাথরুমে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে । তার মানে শিমূল আজ মায়ের আগেই উঠে পড়েছে । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তৃপ্তি দেখল যথেষ্ট বেলা হয়ে গেছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শাঁখ উলুর শব্দ । আর হবেই বা না কেন! আজ যে ভাইফোঁটা ।
পাঁচ সাত চিন্তার মধ্যে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল শিমূল , মাথা দিয়ে জল ঝরছে । মেয়েকে দেখে তৃপ্তি বলল , -- " স্নান সেরে নিয়েছিস্ , ভালো করেছিস । যা , এবারে বরং ঠাকুর ঘরটা মুছে একটু মিষ্টি কিনে আন্ । আমি ঝট করে স্নান সেরে গোপাল পূজোয় বসি । আজকের দিনে মিষ্টি ছাড়া ঠাকুর পূজো করতে ইচ্ছে করছে না । "
হঠাৎই মাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলল শিমূল , -- " আমি একবার রাজডাঙা যাব মা? "
মেয়ের কথা শুনে মনে মনে কেঁপে উঠলেও গম্ভীর স্বরে তৃপ্তি ' না ' বলে বেশ জোরে দরজা বন্ধ করে বাথরুমে ঢুকে গেল । শিমূল জানে মা এখন জোরে কল খুলবে যাতে কান্নার আওয়াজ বাইরে না আসে ।
ঠাকুর ঘর মুছতে মুছতে শিমূলেরও খুব কান্না পাচ্ছে । কেন যে দাদাটা এমন করল , কে জানে! সেই ছোট্ট বেলা থেকে আজকের দিনে ও নিজে হাতে শিশির ভেজা দুর্বা তুলে , চন্দন বেটে পরম যত্নে দাদার কপালে ফোঁটা দিয়েছে । সারা বছর দুই ভাই বোনে ঝগড়া, মারামারি হলেও আজ কিন্তু শিমূল দাদা পলাশের পা ছুঁয়ে প্রণাম করত । চার বছরের বড়ো পলাশও বোনের মাথায় আশীর্বাদী হাত রাখত । আগে মায়ের থেকে টাকা নিয়ে পলাশ বোনের জন্য টুকটাক উপহার আনত । কিন্তু ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে হঠাৎ করেই যখন ওদের বাবা মারা গেলেন তখন থেকেই ও টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ তুলত । সেই টাকা জমিয়ে আজকের দিনে বোনের জন্য টিপ , পাউডার, নেলপলিশ, চুলের ফিতে এসব নিয়ে আসত । একটু বড়ো হতে শিমূল এই দিন নিজের হাতে দাদার জন্য রান্না করত বিশেষ করে সুজির পায়েস, পলাশের খুব পছন্দের খাবার । কিন্তু শিমূল ঠিক করেছে আজও বানাবে পায়েস, তারপর গোপালকে নিবেদন করে পাড়ার বাচ্চাগুলোকে ডেকে খাইয়ে দেবে । ওর বা মায়ের গলা দিয়ে আজ পায়েস কেন , জল অবধি নামবে না । অবশ্য গত চার মাস ধরে এই চলছে । ইস্ , যদি একবার রাজডাঙা গিয়ে দাদাকে খাওয়াতে পারত ! কি জানি আবার কবে দাদাকে দেখবে শিমূল! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবল , আচ্ছা, দাদারও কি আজ বোনের কথা একটুও মনে পড়ছে না?
ওদিকে ছেলের জন্য খুব মন খারাপ করছে তৃপ্তির কিন্তু মেয়ের সামনে কিছু বলতে পারছে না পাছে বেচারী বেশি কষ্ট পায় । মা যেমন সন্তান স্নেহে অন্ধ তেমনি বোনও তো দাদা অন্তঃপ্রাণ । কিন্তু পলাশ এসব কিছুই ভাবল না । বড়ো লোকের মেয়ে বিয়ে করে একেবারে ঘরজামাই হয়ে উঠল শ্বশুর বাড়ি । সে গেছিস ঠিক আছে কিন্তু গরীব বলে একেবারে মা বোনের মুখের সামনে বলেই দিলি যে এখন থেকে আর এই বাড়ির সঙ্গে ওর কোন সম্পর্ক নেই! সেই যে গেলি আর ফিরে তাকালি না । কোথায় আছে, কেমন আছে , আদেও বিয়ে করেছে কিনা তার কিছুই জানা নেই তৃপ্তির । শুনেছে পাশের গ্রাম রাজডাঙায় ছেলের শ্বশুর বাড়ি । কিন্তু খোঁজ খবর করার উপায় নেই । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনকে শক্ত করে তৃপ্তি । ভেঙে পড়লে চলবে না, বিশেষ করে আজকের দিনে না হলে শিমূলকে সামলাবে কে ? যাক এবারে সব কাজ গুছিয়ে পূজোর জোগার করতে হবে, একটু ভোগ রান্না করবে ঠিক করে মনে মনে ভাবতে থাকল শিমূলকে দিয়ে কি কি জিনিস আনাতে হবে । ওদিকে শিমূল তখন ব্যস্ত পুরনো কাঁসার থালা ঘষে ঘষে নতুন করার কাজে, এতে করে আজ পায়েস নিবেদন করবে ঠাকুরকে ।
আসলে দুই নারী নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে নানান অজুহাতে । একজন মানুষকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে এক মাতৃ হৃদয় ও এক বোনের অন্তরাত্মা । কিন্তু পলাশ কি বুঝতে পারছে যে ওর বিরহে ক্রমাগত ক্ষয়ে যাচ্ছে দুটো জীবন নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে আছে!