Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনি-সম্মাননা

সৃষ্টি সাহিত্য যাপনবিভাগ ---- ছোটগল্প শিরোনাম ---- অনাথবন্ধুর পাঠশালা ✍️ শাশ্বতী মুন্সী 
             হাওড়া জেলার ডোমজুড় নিবাসী অলকেশ ঘোষদস্তিদার বাবু পেশায় একজন শিক্ষক | ডোমজুড়ের এক বেসরকারি বিদ্যালয়ের (মাধ্যমিক) শিক্ষক হিসেবে ত…

 


সৃষ্টি সাহিত্য যাপন

বিভাগ ---- ছোটগল্প 

শিরোনাম ---- অনাথবন্ধুর পাঠশালা 

✍️ শাশ্বতী মুন্সী 


             হাওড়া জেলার ডোমজুড় নিবাসী অলকেশ ঘোষদস্তিদার বাবু পেশায় একজন শিক্ষক | ডোমজুড়ের এক বেসরকারি বিদ্যালয়ের (মাধ্যমিক) শিক্ষক হিসেবে তিনি জীবনের ২২টি বছর অতিবাহিত করেছেন | স্ত্রী নীলিমা দেবী ও সন্তান রাজেশকে নিয়ে মোটামুটি স্বচ্ছল ভাবেই সংসার জীবন যাপন করে আসছিলেন | কিন্তু আকস্মিক বিপর্যয়ের ধাক্কায় তাঁর সাজানো সংসার ভেঙে ছত্রাখান হয়ে গেছে! ছোট পরিবারের তিনটি সদস্যের দুজনের মৃত্যু অলোকেশবাবুর দেহ ও মনকে নিদারুন আঘাত দিয়েছিলো!

                    বছর দেড়েক আগের ঘটনা | স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে অলোকেশবাবু গৌহাটির কামাখ্যা মন্দির দর্শনের জন্য আসামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন | গৌহাটি পৌঁছে কামাখ্যা মায়ের মূর্তি ও মন্দির সংলগ্ন আরো কয়েকটি মন্দির দর্শন করে ভক্তিভরে পুজো দিয়েছিলেন | তাঁর স্ত্রীর অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল মা কামাখ্যার দর্শন লাভের | তাই স্কুলে আবেদন করা দিন সাতেকের ছুটি মঞ্জুর হতে পূর্বনির্ধারিত ভ্রমণস্থলের অভিমুখে রওনা দেন | মন্দির দর্শনের পরের দিনগুলোতে আরো কিছু দর্শনীয় স্থানে (যেমন -- মাজুলি দ্বীপ, শিবসাগর, কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যান) গিয়েছিলেন যা তাঁদের ভ্রমণসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল | ভ্রমণপিপাসু বাঙালির মতো অলোকেশবাবুও ঘুরতে বেড়াতে খুব ভালোবাসেন | বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে বেনারসে মধুচন্দ্রিমায় যাপন করা দিনগুলোতে তিনি বুঝেছিলেন নীলিমা দেবীও ঘুরতে যেতে ভীষণ ভালোবাসেন | বিশেষ করে যেসব ভ্রমণ স্থানে বিখ্যাত দর্শনীয় জায়গার সাথে কোনো দেবদেবীর মহিমান্বিত মন্দির আছে সেইসব স্থানের দিকে তাঁর মন অসীম আকর্ষণে ধাবিত হয় | আর তাই মধুচন্দ্রিমায় কোথায় বেড়াতে যেতে চাও? এই প্রশ্নের জবাবে অলোকেশবাবুকে একবাক্যে বলেছিলেন, "বেনারস যেতে চাই... "!

                  কামাখ্যা মন্দিরসহ আসামের কিছু বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ শেষে উৎফুল্ল মনে বাড়ি ফেরার জন্য ট্রেনযাত্রা করেছিলেন | ছেলে রাজেশ এবারের ভ্রমণের প্রতিটা দিন বাবা মায়ের সাথে সমান তালে উপভোগ করেছিল, বিশেষত কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণের দিন উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে বিচরণকারী পশুপক্ষীদের চাক্ষুষ দেখতে পাবার উত্তেজনায় সে গৌহাটি আসার আগে থেকেই হাঁড়িতে ফুটন্ত গরম জলের মতো টগবগ করে ফুটছিল..... সারা ভারত তথা আসামের এই বিখ্যাত জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণকালীন সময়ের প্রতিক্ষণের ছবি সে মনের অদৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করে স্মৃতির অ্যালবামে সজ্জিত রেখেছিল....!

                 ট্রেনযাত্রার সময় রাতের অন্ধকারে ঘটা দুর্ঘটনায় অন্যান্য অনেক যাত্রীর সাথে অলোকেশবাবুর স্ত্রী ও পুত্রর মৃত্যু হয় | কিন্তু ভাগ্যক্রমে অলোকেশবাবু বেঁচে গেলেও হাত পায়ে চোট পেয়েছিলেন... শরীরের বাইরের আঘাতের ক্ষত চিকিৎসায় সেরে উঠেছিল | কিন্তু স্ত্রী সন্তানকে হারানোর অসহনীয় আঘাত প্রতিনিয়ত তাঁর হৃদয়কে ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিচ্ছিলো! এতো বছর হাসিখুশিতে ভরা যে সংসার সুর-তাল-ছন্দে হিল্লোলিত ছিল, দুর্ঘটনার কবলে পড়ে সেই সংসারের চারিদিক থেকে ভেসে আসা বেসুরো ধ্বনি অলোকেশবাবুকে অহরহ বিদ্ধ করছিল.... সুগৃহিনী নীলিমা দেবী এবং অষ্টম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্র তথা ছেলে রাজেশের অস্তিত্বহীন এই সংসার জীবন তাঁর কাছে দুঃসহনীয় হয়ে উঠেছিল! তাঁদের দুজনের সযত্নে সাজানো সংসার ধু ধু মরুভূমির ন্যায় শূন্যতায় গ্রাস করেছিল! একাকী বাড়িতে টিকতে না পেরে দিন রাতের বেশিরভাগ সময় উদাস মনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন স্কুলে যাবার সময়টুকু বাদে!

                প্রথম থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের বাংলা, ইংরেজি,ইতিহাস, ভূগোল, পরিবেশ বিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে সময় নিয়ে সহজবোধ্য ভাবে পড়াতেন | সৎ,নিষ্ঠাবান,দায়িত্বশীল শিক্ষক হিসেবে অলোকেশবাবু স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সহশিক্ষক শিক্ষিকাদের এবং ছাত্রছাত্রীদের কাছে সুনাম অর্জন করেছিলেন | ছাত্রছাত্রীরা তাঁর সন্তানতুল্য | স্কুলের পাশাপাশি এলাকার বেশ কিছু গরিব বাবা মায়ের সহজাত মেধাসম্পন্ন সন্তানদের বিনা পয়সায় পড়াতেন | বিদ্যা এমনই এক অর্জিত ধন যা নির্দ্বিধায় দান করা যায় ----- চিরসত্য এই কথাটি অন্তর থেকে বিশ্বাস তিনি করতেন! তাই সংসার জীবননির্বাহের জন্য স্কুল শিক্ষকের প্রাপ্য পারিশ্রমিক ব্যাতীত গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে তিনি একটি পয়সাও নিতেন না | নিজের ছেলের মতোই সযত্নে, সস্নেহে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার কাজে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করতেন না....!

              পরিবারের এক তৃতীয়ংশের বেশি জায়গা জুড়ে থাকা বৌ - ছেলের অকাল মৃত্যুর শোকের পাষানভার ভগ্ন হৃদয়ে বয়ে বেড়ানো অলোকেশবাবুর পক্ষে দুর্বিষহ হয়ে গেছিলো | স্কুলে নিয়মিত যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছিলেন, যদিওবা সপ্তাহের দু'তিনদিন মনের জোরে যেতেন কিন্তু আগের মতো সম্পূর্ণ মনোযোগ সহকারে পড়ানো সম্ভব হচ্ছিলো না! প্রায়শই কোনো বিষয় পড়াতে পড়াতে জানলার বাইরে ভাষাহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন... মাঝপথে পড়ানো থামিয়ে দেওয়ায় যখন শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীদের মৃদু গুঞ্জন শুরু হতো, তখন তাঁর আনমনা ভাব কেটে নিজেই লজ্জিত হয়ে পড়তেন! এইভাবে শিক্ষাদানে যে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ক্ষতি হচ্ছে, তা ভালোই উপলব্ধি করেছিলেন | সে কারণেই মনস্থির করলেন স্কুলের শিক্ষকের পদ থেকে স্বেচ্ছাবসর নেবেন | এবং ডোমজুড়ের বসতবাড়ি বিক্রি করে তাঁর দেশের বাড়ি লক্ষীকান্তপুরে চলে গিয়ে সেখানেই জীবনের বাকি দিনগুলো পৈতৃক ভিটেয় কোনোক্রমে যাপিত করে যাবেন....

             বিদ্যালয়ের সকল ছাত্রছাত্রীর এবং শিক্ষক শিক্ষিকাদের শত অনুরোধ উপরোধেও অলোকেশবাবু নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন | স্কুলের ও বাড়িতে পড়ানো ছেলেমেয়েদের চোখের জল মুছিয়ে মাথায় আশীর্বাদের হস্তস্পর্শ দিয়ে দেশের দায়িত্ববান নাগরিক এবং দশের হিতকরী হবার উপদেশ প্রদান করে শিক্ষক জীবনের প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটিয়ে অজানা ভবিষ্যতের পথে পা বাড়ালেন...!

           

                        -----------------------


          শস্য শ্যামলা সবুজ ধরণীর ক্রোড়ে একটুকরো জায়গা জুড়ে রয়েছে চাপাডাঙ্গা গ্রাম | চারিদিকে সবুজের সমারোহ আর দিগন্তরেখায় বৃত্তাকারে বেষ্টন করে থাকা তাল - নারকেলের সারি দেওয়া গাছেরা যেন সদাজাগ্রত প্রহরীর মতো গোটা গ্রামকে ঘিরে রয়েছে | হরেক রকমের ফুলের সুবাস গ্রামের বাতাসকে দিবারাত্রি মিশ্র গন্ধে সুবাসিত করে রাখে | দিনমনির প্রথম গোলাপি কিরণের সাথে সাথে জেগে ওঠা পাখপাখালির সুমধুর কলতানে ঘুম ভাঙে এই গ্রামের গ্রামবাসীর | এমনই একটি গ্রাম হলো অলোকেশবাবুর দেশের বাড়ি | ওনার দুই পূর্বপুরুষের বসবাস ছিল চাপাডাঙ্গা গ্রামে | বাবা মহিমারঞ্জন ঘোষদস্তিদার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বাড়িতেই কাটিয়ে গেছেন | তাঁর মৃত্যুর পর এতগুলো বছর এই বাড়ি খালি পড়েছিল! ডোমজুড়ের বাড়িতে সাজানো সংসারে ইতি টেনে দিয়ে তিনি পাকাপাকি ভাবে পৈতৃক ভিটেতে কাটানোর ব্যবস্থা করে জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করলেন.....

                 গ্রামের কয়েকজন দিনমজুরদের সাহায্যে পরিত্যক্ত একতলা বাড়িটি মেরামতি করে নিলেন | তিনটি বড়ঘরে পঠন পাঠনের জন্য রূপে সাজিয়ে, বাকি দুটি ছোট ঘরের একটিতে নিজে থাকার ব্যবস্থা করে অন্য ঘরটি আপাতভাবে খালি রেখে দিলেন.... পরে কোনো প্রয়োজনে কাজে লাগাবেন ভেবে..!


           গ্রামে এসে বসবাস শুরু করার পরে মাস ছয়েক কেটে গেছে | অলোকেশবাবুর পৈতৃক ভিটা বর্তমানে অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং আশ্রয়হীন, দুস্থ, অনাথ ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ছাত্রাবাসে পরিবর্তিত হয়েছে | জায়গার প্রয়োজনে একতলা বাড়িটি করা হয়েছে দোতলা | চাপাডাঙ্গা গ্রাম এবং আশেপাশের গ্রামের পথে পথে ভিক্ষে চেয়ে ঘুরে বেড়ানো নিরাশ্রয় অনাথ শিশুদের জন্য দোতলাটি নির্মাণ করা অতি অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিল | দোতলায় চারটি বড়ো ঘরে নিরাশ্রয় ছেলেমেয়েদের থাকা, শোয়া এবং লেখাপড়ার জন্যে ব্যবহৃত হয়, চারটি ঘরের শেষে ছোট সাইজের দুটো বাথরুম বানানো হয়েছে যাতে শৌচকর্মের জন্য নিচের একতলার বাথরুমে রাতে আর নামতে না হয় | রান্নাঘরের সংলগ্ন একতলার খালি ঘরটিতে ছাত্রছাত্রীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাছাড়া রান্নাঘরে জায়গার সংকুলান হওয়ায় রন্ধন সামগ্রীর অনেকটাই খাওয়ার ঘরের দেয়ালে গাঁথা তাকে রাখা হয়েছে | একতলার তিনটি বড়ো ঘরের সামনে টানা লম্বা দালান রয়েছে আর মাঝে দন্ডায়মান চারটি থাম বাড়ির সামনের অংশকে এতো বছর ধরে অটুট রেখে এসেছে | দালানের একদম শেষপ্রান্তে চৌবাচ্চাসহ একটি মাঝারি মাপের বাথরুম আছে | স্কুল চলাকালীন ছাত্রাবাস এবং গ্রামের গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা ওই বাথরুম ব্যবহার করে |

                অলোকেশবাবু ডোমজুড়ের স্কুলের শিক্ষক পদ থেকে অবসর গ্রহণের মেয়াদ আসার আগেই স্বেচ্ছাবসর নেওয়ায় এককালীন বেশ অনেক টাকাই পেয়েছিলেন, সাথে ছিল প্রভিডেন্ট ফান্ডের জমানো টাকা | এছাড়া তাঁর সহকর্মী তথা বন্ধু প্রভাস লাহিড়ীর সহায়তায় আসবাবপত্রসহ বসতবাড়ি বিক্রির ন্যায্যমূল্য হিসেবে যা টাকা পেয়েছিলেন-----সেইসব টাকা দিয়ে পৈতৃক বাড়িটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানুষ রূপে গড়ে তোলার কারখানায় রূপান্তরিত করেছিলেন | বিয়ের যৌতুকে পাওয়া খাট,স্টিলের ছোট আলমারি (বড়ো আলমারি বদলে ছোট কিনেছিলেন), লেখাপড়ার জন্য অতি প্রিয় একটি টেবিল - চেয়ার এবং সামনের অর্ধেকটা কাঁচ দেওয়া কাঠের বই রাখার আলমারি যা পুরোনো অথচ মজবুত বলে সস্তায় কিনেছিলেন ---- এই কয়েকটি আবশ্যকীয় আসবাবপত্র দৈনন্দিন প্রয়োজনে ডোমজুড়ের বাড়ি থেকে আনিয়েছিলেন | স্ত্রী নীলিমার অবশিষ্ট কয়েকটি গয়না পরম যত্নে সঞ্চিত রেখেছিলেন অজানা ভবিষ্যতের সম্বল হিসেবে | ডোমজুড়ের ছোট একতলা বাড়িটি তৈরির সময় নীলিমা দেবীর দেওয়া বিয়ের গয়নার কয়েকটি ভীষণ কাজে লেগেছিলো, কিন্তু গ্রামের বাড়িটিকে অবৈতনিক বিদ্যালয় এবং ছাত্রছাত্রীদের আবাসস্থল রূপে গড়তে ওই গয়নায় তিনি হাত দেন নি | স্ত্রীকে হারালেও স্ত্রীয়ের ছোঁয়া মাখা গয়নাগুলিকে আগামী দিনের চলার পথের পাথেয় করে গচ্ছিত রেখে দেন.....

                গ্রামের দরিদ্র পরিবারের বাবা মায়ের যেসব সন্তানেরা দুবেলা দুমুঠো খাবারের চাহিদা মেটাতে শিশুকালেই কৃষিজমিতে, অবস্থাপন্ন লোকেদের বাড়িতে ঘর মুছতে - বাসন মাজতে, এমনকি চায়ের দোকানে ফাইফরমাশ খাটার কাজে লেগে পড়তো, লেখাপড়া যাদের কাছে বিলাসিতার নামান্তর ছিল.... চাপাডাঙ্গা ও আশেপাশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে সেইসব শিশুদের পঠন পাঠনের সুযোগ করে দিয়ে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের তালিকাভুক্ত করেছিলেন তিনি | যদিও কাজটা করতে প্রথমে কিছু অসুবিধা হয়েছিল, তবুও হাল না ছেড়ে গ্রামের দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোকে বোঝানোতে সফল হয়েছিলেন, অবশ্য তাঁর এই নিঃস্বার্থ কাজে পাশে পান গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান ৩০/৩২ বছরের যুবক শৈবাল ভৌমিককে | পরে যার চেষ্টায় শিক্ষার উন্নতি প্রকল্পের জন্য নির্ধারিত টাকার সামান্য কিছু সরকারি অনুদান হিসেবে পেয়েছেন |

              সকালের প্রাতঃরাশ, দুপুরের খাবার (পঠন পাঠন চলাকালীন মাঝের বিরতির সময়), সন্ধ্যের জলযোগ এবং নৈশাহার ----- এই চারবেলা সকল ছাত্রছাত্রীদের খাদ্যের আয়োজন স্কুলেই রোজ করা হতো | গ্রামবাসীর ছেলেমেয়েরা সকাল থেকে রাত অবধি স্কুলবাড়িতে থেকে,লেখাপড়া, খেলাধুলা করে, রাতের ভোজন সেরে বাড়ির লোকেদের সাথে বাড়ি চলে যায় | কচি কচি শিশুদের কোমল কণ্ঠের কলকাকলিতে সারা বাড়িতে আন্দোলিত হয় আনন্দের ঢেউ..... এতদিনের পরিত্যক্ত ইঁট কাঠের বাড়িটি যেন প্রাণের স্পন্দন ফিরে পায়....!

       স্কুলের রান্নার যাবতীয় ভার তিনি গ্রামেরই এক অল্পবয়স্কা বিধবা মহিলাকে দিয়ে নিশ্চিন্ত রয়েছেন | ৮ বছরের ছেলে মিন্টু আর ৬ বছরের মেয়ে রুমির সাথে রমলাও সারাটা দিন স্কুলবাড়িতে থাকে এবং খাওয়া দাওয়া করে | রন্ধন কার্যের উপযুক্ত পারিশ্রমিক তো রমলা পায়ই, উপরন্তু তার দুই সন্তানকে অলোকেশবাবু অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের মতো সমান শিক্ষা প্রদান করেন | স্বামীর হঠাৎ মৃত্যুতে উপার্জনহীন অসহায় রমলা যখন সন্তানদের নিয়ে চরম দারিদ্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই করে যাচ্ছিল, সেই দুঃসময়ে অলোকেশবাবুর দেওয়া বিদ্যালয়ের রন্ধন কাজের প্রস্তাবে দারিদ্র্যের অতল সাগরে সন্তানসহ ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিল সে | দরদী মনের এই মানুষটিকে "মাস্টারবাবু" বলে সম্বোধন করলেও হৃদয়ের আসনে অলোকেশবাবুকে দেবতা রূপে অধিষ্ঠিত করতে দু'বার ভাবে নি রমলা.....,!

              স্কুলের একতলার তিনটি বড়ো শ্রেণীকক্ষে রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, ঋষি অরবিন্দ,বিবেকানন্দ,শ্রী রামকৃষ্ণ, সারদা দেবী, বাঘা যতীন, ক্ষুদিরাম, মাদার টেরেসা, ভগিনী নিবেদিতা, নজরুল ইসলাম, মাস্টারদা সূর্য সেন, বিদ্যাসাগর, রামমোহন, রানী লক্ষ্মীবাঈ,ছত্রপতি শিবাজী,দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, রাসবিহারী বসু, রানী রাসমণি, আশাপূর্ণা দেবী, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, ইন্দিরা গান্ধী ---- প্রমুখ মহান মানুষদের ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখেছেন | প্রাথমিক পর্যায়ের স্কুল পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি বীর ভারতীয়দের জীবনী এবং ঐতিহাসিক কাহিনী গল্পাকারে ছাত্রছাত্রীদের বলেন, যা দেশাত্মবোধ জাগরণে তাদের চিত্তকে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে! ঘরের মেঝেতে পাতা শতরঞ্চিতে বসে ছেলেমেয়েরা যখন তাঁর বলা গল্পগুলি বিভোর হয়ে শোনে, তখন তাদের চোখ মুখের তন্ময় ভাব দেখেই অলোকেশবাবুর মন - প্রাণ প্রশান্তিতে ভরে ওঠে...!

      শ্রেণীকক্ষের সামনের দালানে লম্বালম্বি দাঁড়িয়ে "জন গণ মন অধিনায়ক জয় হে " সম্পূর্ণ গানটির প্রথম স্তবকটি (যা জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি পেয়েছে) প্রার্থনা সংগীত হিসেবে সমস্বরে গেয়ে শুরু হয় সাপ্তাহিক পাঠাভ্যাস | দোতলার বাইরের দিকের দেয়ালে টাঙানো লাল-সাদা কালিতে বড়ো বড়ো হরফে লেখা "অনাথবন্ধুর পাঠশালা" নামের সাইনবোর্ডটি প্রতিদিন সূর্যের স্বর্ণকিরণে জ্বলজ্বল করতে দেখে অলোকেশবাবুর মনন ও মস্তিষ্কে নতুন উদ্যমে কর্মস্পৃহা সঞ্চারিত হতে থাকে! শিশুদের জন্য ওনার স্নেহ-মমতা-কর্তব্যনিষ্ঠ মনভাবের সাথে মানানসই উপরোক্ত নামটি দিয়েছিলেন গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান শৈবাল ভৌমিক ----- যা একবার শুনেই পছন্দ হয়েছিল গ্রামবাসীর শ্রদ্ধেয় মাস্টারবাবুর......

             কচি কচি দূর্বাদলসম শিশুগুলির উচ্চারিত "বন্ধুমাস্টার" সম্বোধন এক পিতার হৃদয়ের শূন্যস্থানে সন্তানসুখের পরশ দেয় যা অলোকেশবাবুর সন্তানশোকের গভীর ক্ষতে ভালোবাসার প্রলেপ মাখিয়ে শান্তিময়তা অনুভব করায়! ছাত্রছাত্রীদের কাছে আগে তিনি বন্ধু তারপর মাস্টার, কারণ নানা বয়সের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মানসিকতার সাথে পরিচিত হবার জন্য সর্বাগ্রে তাদের সমমনস্ক বন্ধু হয়ে ওঠা খুবই দরকার....তবেই তো শিক্ষাদানের কাজটি সহজপথে সম্পন্ন হবে!

              কুঁড়ি যেমন একটি একটি করে পাপড়ি মেলে সম্পূর্ণ ফুল রূপে প্রস্ফুটিত হয়, তেমনি শিশুদের জীবনের একেকটি স্তরকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে প্রকৃত অর্থে মান ও হুশের অধিকারী রূপে গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্পে নিজের সমগ্র সত্তাকে নিয়োজিত করেছেন অলোকেশ ঘোষদস্তিদার | বড়ো হয়ে এইসব ছাত্রছাত্রীরা আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে এবং পায়ের নিচের মাটি শক্ত করে ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ ও সমাজের সুসভ্য, কর্তব্যপরায়ণ এবং দায়িত্ববান, সৎ নাগরিক হিসেবে দাঁড়াতে পারবে----- এমন আশাই পোষণ করেন অলোকেশবাবু, যা "শিক্ষক" তকমা প্রাপ্ত তাঁর জীবনকে সার্থকতা দেবে......!!


                           ~সমাপ্ত~