✍সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
তিনি বরাবরই ব্যতিক্রমী। এক ব্যতিক্রমী লেখক। এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। আক্ষরিক অর্থেই। ঠিকই তো। ব্যতিক্রমী না হলে লেখক হবেন কি করে! ওইরকম দশটা পাঁচটার পেশাদার লেখক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আসলে তিনি যে সমরেশ বসু! জ…
✍সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
তিনি বরাবরই ব্যতিক্রমী। এক ব্যতিক্রমী লেখক। এক ব্যতিক্রমী চরিত্র। আক্ষরিক অর্থেই। ঠিকই তো। ব্যতিক্রমী না হলে লেখক হবেন কি করে! ওইরকম দশটা পাঁচটার পেশাদার লেখক। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আসলে তিনি যে সমরেশ বসু! জীবনের জোয়ার ভাঁটার টানাপোড়েনের মাঝে দিয়ে যাবেন একের পর এক ব্যতিক্রমী ও কালজয়ী উপন্যাস। মানুষ চেনা আর নিজেকে জানার যুগপৎ সৃষ্টি বৈচিত্র্যের ডালি সাজাবেন। বোধকরি জীবনানন্দকে কোট করা যায়-"সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি!"
প্রথাগত শিক্ষা বিশেষ ছিল না অথচ দুর্বার গতিতে এগিয়েছে তাঁর কলম। আসলে তিনি যে ভয়ঙ্কর রকমের ব্যতিক্রমী!
কিন্তু দিনের শেষে লেখক তো আদতে একজন মানুষ। জীবনের প্রতিটি দিক নানা আঙ্গিকে নেড়েচেড়ে দেখে লেখা তো আসলে জীবনের প্রতি প্রেমকেই স্বীকৃতি দেওয়া। সেই নিয়ম মেনেই জাগতিক প্রেম এসেছে তাঁর জীবনে বারবার। গ্রহণ করতে একটুও দ্বিধা করেননি। সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেই প্রেমকে স্বীকৃতি দিয়েছেন জীবন নিয়ে তীব্র অনুভূতি সম্পন্ন লেখক সমরেশ বসু।
ঢাকা থেকে এপারে কলকাতার উপকণ্ঠে নৈহাটিতে আসেন বালক সুরথনাথ। পরে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল হবেন এই সুরথনাথ। সমরেশ বসু নামে। কালকূট ও ভ্রমর নামেও লিখবেন। বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে যাবেন দুশোর মতো গল্প, শখানেকের মতো উপন্যাস।
দেশে থাকাকালীন নয় বছরের এক বালিকার প্রেমে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। নিজের তখন বারো বছর বয়স। পরে নৈহাটিতে দাদা মন্মথনাথের কাছে থাকার সময় খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ম্যালেরিয়া ও জন্ডিস একযোগে থাবা মারে শরীরে। সেবা করতে এগিয়ে আসেন বন্ধু দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের বিবাহবিচ্ছিন্না দিদি গৌরীদেবী। সুস্থ হয়ে ওঠেন সমরেশ। কিন্তু হৃদয় বিনিময় হয়ে গিয়েছে যে ততদিনে! সমরেশ আঠারো আর গৌরী একুশ। বিবাহবিচ্ছিন্না বয়সে বড় ব্রাহ্মণ কন্যা গৌরীর সঙ্গে কায়স্থের ছেলের বিবাহ তৎকালীন সময়ে বৈপ্লবিক বইকি! দুজনে সংসার পাতলেন শ্যামনগর ও জগদ্দলের মাঝে আতপুরের এক দেড় কামরার ঘরে। তীব্র দারিদ্র্য। কখনো সবজি, কখনো ডিম ফেরি করেছেন সমরেশ। গান শিখিয়ে, সেলাই করে সংসার চালিয়েছেন গৌরী। এত কিছুর মধ্যে সমরেশের কলম কিন্তু থামেনি। চলেছে নিরবিচ্ছিন্ন। বলা ভালো, থামতে দেননি গৌরী। একে একে আসবে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রতন 'বিটি রোডের ধারে', 'শ্রীমতী কাফে', 'শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে', 'মহাকালের রথের ঘোড়া'-র মতো উপন্যাস। পরবর্তীতে 'উত্তরঙ্গ', 'কোথায় পাব তারে' প্রভৃতি। 'উত্তরঙ্গ' জেলে বসে লেখা। এ বিষয়ে মিল পাওয়া যায় রুশ লেখক ফিওদর দস্তয়েভস্কির সঙ্গে। দ্য ইনসাল্টেড অ্যান্ড দ্য ইনজিওর্ড জেলে বসেই লিখেছিলেন দস্তয়েভস্কি। পরে আবার নৈহাটিতে ফিরে আসেন বসু দম্পতি।
চটকলে চাকরি করেছেন সমরেশ। বামপন্থী রাজনীতির কারণে কারাবাস। ফলে চাকরি হারিয়েছেন। চার সন্তান নিয়ে দশভুজা হয়ে সংসার চালিয়েছেন গৌরী। একইসঙ্গে জায়া-জননী-বন্ধু-সঙ্গীনি-কমরেড। পরে তাঁর ব্যতিক্রমী লেখার মধ্যে দিয়ে খ্যাতির চূড়ায় উঠবেন সমরেশ। বাংলা সাহিত্য চমকে উঠবে 'বিবর' বা 'প্রজাপতি'-র মতো উপন্যাস পড়ে। আসলে কালকূট তো বরাবরই ব্যতিক্রমী! তাই তো আসবে 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে'-র মতো উপন্যাস, যেখানে মানুষকে চেনা আর নিজেকে জানা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। একে একে চলচ্চিত্রায়ণ হবে 'গঙ্গা', 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে', 'তিন ভুবনের পারে'-র মতো অসামান্য উপন্যাস। সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার আসবে ১৯৮০তে। 'শাম্ব' উপন্যাসের জন্য। ১৯৮৬তে আনন্দ পুরস্কার।
কিন্তু সহধর্মিনীও যে সমান ব্যতিক্রমী। কতটা সাহসী হলে বলা যায়, তুমি চাকরি করতে যেও না। তুমি লেখক। তোমার কাজ লেখা। সংসারের চিন্তা আমার। গায়ে কাঁটা দেয় না! শ্রদ্ধায় মাথা নত হয় না, যখন ছেলেমেয়েদের গর্বের সাথে মা বলেন, তোদের বাবা একজন লেখক!
জীবন কখনো এক খাতে বয় না। অন্তত সমরেশ বসুর মতো মানুষদের তো নয়ই। নদী বাঁকের মুখে পড়লেও থেমে যায় না। আবার প্রেমের প্রকাশ পেল। এবার গৌরীর সহোদরা ধরিত্রী, অর্থাৎ সমরেশের শ্যালিকা। ততদিনে প্রতিষ্ঠিত লেখক সমরেশ। প্রথম সন্তান কন্যা বুলবুলের থেকে মাত্র কয়েক মাসের বড় ধরিত্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় সংসার পাতলেন কলকাতায়। আবারও ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত। বিপরীতধর্মীতার জটিল রসায়ন ক্রিয়াশীল ছিল হয়তো বা! বেশি বয়সে আরো এক পুত্র সন্তান লাভ। অথচ গৌরীকে না ভোলা। সময় করে নৈহাটিতে দেখা করতে যাওয়া। সহযোদ্ধা কমরেডকে কি ভোলা যায় না সম্ভব! কি বলা যায় একে! বাস্তববাদী আত্মবিশ্বাসী অথচ অপরিমানদর্শিতায় ভেসে চলা? না কি বৈপরীত্যের মধ্যেও ব্যতিক্রমী? আসলে এভাবেই তাঁর উপন্যাস গঙ্গার মতোই ভেসে গিয়েছেন সমরেশ বসু। ১৯৮০তে চলে গেলেন গৌরী। ১৯৮৮তে সমরেশ। তবু তাঁর জোয়ার ভাঁটার সৃষ্টিবৈচিত্র্য নিয়ে আজও প্রবলভাবেই আছেন সমরেশ বসু। কালকূটের তীব্র বিষ সরিয়ে অমৃত মন্থন করে গিয়েছেন পাতায় পাতায়। জীবনে, প্রেমে, সাহিত্যে।।