কুটনো মাসিনবনীতা সই বিভাগ- ছোটোগল্প 15,1,21
ঘ্যাচ করে আঙ্গুল টা কেটে যেতেই অন্য হাত দিয়ে কাটা অংশটা চেপে ধরে অমলা৷ সকালের এই ব্যস্ত সময়ে হাত কাটুক আর মাথা, দম ফেলার সময় নেই ৷ হাতটা ধুয়ে , একদলা চুন খাপলা মেরে কাটা অংশে দিয়ে কাপড়ের…
কুটনো মাসি
নবনীতা সই
বিভাগ- ছোটোগল্প
15,1,21
ঘ্যাচ করে আঙ্গুল টা কেটে যেতেই অন্য হাত দিয়ে কাটা অংশটা চেপে ধরে অমলা৷ সকালের এই ব্যস্ত সময়ে হাত কাটুক আর মাথা, দম ফেলার সময় নেই ৷ হাতটা ধুয়ে , একদলা চুন খাপলা মেরে কাটা অংশে দিয়ে কাপড়ের ছেঁড়া টুকরো বাঁধতে বিড়বিড় করতে থাকে অমলা৷ কেউ তো মগনা পয়সা দেবে না৷ এই ব্যস্ত সময়ে হাত নিয়ে বসে থাকলে হবে? রবিবারের বাজারে দুটো পয়সা৷
স্টেশন বাজারের এই মেছো বাজারের সারি সারি দোকানের পাশে আরও পাঁচজন মহিলার সাথে, মাছ কুটতে বসে অমলা৷ সবচেয়ে পুরাণো ছিলো খেদি দি , তারপর অমলা৷ তা খেদি দি আর মাছ কাটতে আসেনা৷ নাতি নাতিনী বড় হয়ে গেছে৷ এখন মাসি চোখে দেখেনা৷ এখন অমলা সবচেয়ে বয়স্কা৷
বাকি চারটের মধ্যে দুটো যাও চলে বাকি দুটো আসে ঢলানী করতে৷ অমলা মাসীর তো তাই মনে করে৷
মাসি ফাঁকা?
হ্যাঁ বাবু৷
ওরে বাবা সামনে তো কত প্যাকেট৷
হয়ে যাবে টুকুস করে৷
না না দেরী হয়ে যাবে৷ বলেই ছেলেটা পাশের জবার কাছে মাছটা ফ্যালে৷
বাবা সবাই ব্যস্ত হলে চলবে? আজ ছুটির দিন৷
আরে মাসি ছুটির দিনে কাজ বেশী ৷
তোমাদের কোনদিন তাড়া নেই বাবু? হাতটা টাইট করে বাঁধতে বাঁধতে , অমলা মনে মনে গালি দেয়৷
মাসি হলো?
এই হলো বাবু৷ হাতটা কেটে গেলো তো৷
আহ্ কি যে করো৷ দেখে কাটতে পারো না৷
শিঙে তো বড় লাপায় বড়৷
সাবধানে কাটো৷ সাতশ টাকা কেজি৷
এই হয়ে গেছে বলেই মাছের মাথাটা ঝপাং করে কেটে নিয়ে টুকরো করে অমলা৷ তারপর দত্ত বাবুর তেলাপিয়া মাছটা ঢালে৷ আর মনে মনে বলে, সাবধানে কাটবে, মরণ৷ তুই যদি বুঝবি তো নিজে কাটিস না ক্যানে?
এভাবেই বেলা একটা অবধি মাছ কেটে , শেষ বেলার আধসের মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরে অমলা৷ তবে হ্যাঁ পচা মাছ কেনে কিন্ত কোনদিন অমলা মাছ চুরি করেনা৷ নইলে আর চারজন থেকে আর আঁশবটির সামনে মাছের আঁশ অত জমতো না৷ সবাই জানে , অমলা যেমন মাছ ভালো কাটে তেমন চোর নয়৷ বাকি দুটো মাঝারি বয়সের আছে , দুটোই মাছ সরায়৷ আর বাকি দুটোর তো মাছ কাটায় মন কম , মাছ ধরায় মন বেশী৷
আলু , কালু, বেগনা....
এই তিনটে বেড়াল অমলার নেওটা৷ রোজ সাথে করে পায়ে পায়ে চলে আসে৷ পেট পুজো করে আবার অমলার সাথে ফেরে৷
সেই কবে কে জানে , ব্যাগে করে আলু আর বেগনা কে ফেলে গিয়েছিলো৷ আর কালু তো এখানেই হয়েছে৷ অনেক বেড়াল এই বাজারে ঘোরে৷ এই তিনটে অমলার বাড়ি অবধি যায়৷
ঘরে গিয়েই আগে স্নান সারে অমলা৷ তত সময়ে ছেলের বৌ ঝুমা মাছ কুটে নিয়ে ঠিক কিছু একটা রান্না করে নেয় ৷
দুটো মেয়ে পার হয়ে গেছে৷ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আছে কোনমতে৷ ছেলেটা বাজারে সবজি নিয়ে বসে৷ চারজনের সংসার ৷ চলে যায়৷
দড়ির দোলনায় অমলার নাতি দোলে৷ ঠিক এভাবেই অমলার ছেলে বাসু দুলতো৷ বাসুর বাপ ছিলো খুব ভালো মানুষ৷ কোনদিন অমলা কে কষ্ট দেয়নি৷ তবে একদিন কাজে গিয়ে আর ফেরেনি৷ একটা মানুষ যেন উবে গিয়েছিলো৷
দুটো মেয়ে আর বাসু তখন পেটে, সাথে ভরা যৌবন৷ কি দিন গেছে অমলার৷ না জানে পড়াশোনা না চেনে রাস্তাঘাট ৷ তখন খেদি দি নিয়ে এসেছিলো এই মেছো বাজারে৷ বড় আঁশবটি নিয়ে বসতো খেদি দি৷ সেই শুরু৷ শাশুড়ি ছিলো বলে , অমলা পেরেছে৷ তারপর কবে বড়ো মেয়েটা সংসারের হাল ধরেছে , কবে ছোটো মেয়েটা ভাই কে মানুষ করেছে সে সব হয়েই গেছে৷
একা অমলা দুটো মেয়ে আর বাসুকে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছে৷ দুটো মেয়েকে পার করেছে৷ ছেলের বিয়ে দিয়ে এখন ঝাড়া হাত পা৷ নাতি নিয়ে খেলা করার বয়স তবুও মাছের জন্য মন হাঁসফাঁস করে৷ মাছ ছাড়া খেতে পারেনা ভাত, আবার ঘরে বসে বসে হাত পায়ের হাড় গুনতেও মন চায়না ৷ তারথেকে মেছো বাজার ভালো৷ কত লোক, চিৎকার ৷ মাছের গন্ধ , আঁশের ঝাপট আর পয়সার শব্দ৷
স্নান সেরে মাথায় সিঁদুর দেয় অমলা৷ হ্যাঁ আজও সিঁদুর দেয় অমলা৷ সবাই বলেছিলো , বারো বছর পর নিরুদ্দেশ থাকলে সে বিধবা৷ কিন্তু অমলা জানে বাসুর বাপ বেঁচে আছে ৷ তিন ছেলে মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবার পর মানত পুরাতে মেয়ে জামাই আর ছেলে ছেলের বৌ নিয়ে দক্ষিণেশ্বর গিয়েছিলো অমলা৷ সেখানে গঙ্গাস্নান করে পুজো দিয়ে ফেরার সময় , দাঁড়ি গোঁফের আড়াল হলেও চিনেছিলো৷ ছেলে মেয়ে সবাই তখন কেনাকাটায় ব্যস্ত ৷ পায়ের ব্যথা আর বড় মেয়ের ছেলেটাকে কোলে করে অমলা বসেছিলো গাছের গোঁড়ায় বাঁধানো চাতালে৷
স্পষ্ট দেখেছে অমলা৷ সেই লোক৷ কোন ভুল নাই ৷ সাথে বোষ্টমী ৷ দুজনে গান গায়, ভিখ মাগে আর মাঝে মাঝেই ঝগড়া করে৷ অমলা কে কি দেখেছিলো বাসুর বাপ ? হয়ত ভোলার জন্য ভুলেই গেছে৷ ছেলে মেয়েদের চেনার কথা না ৷
কিন্তু অমলা? মোটা গোলগাল অমলা, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, দাঁত গুলো দক্তায় কালো ৷ নাহ্ মাথায় ঘোমটা দিয়ে যেন কাঁপছিলো অমলা৷ মনে হচ্ছিলো সবাই কে ডেকে, বাসু কে ডেকে বলে ওরে এদিক পানে আয় , ঐ যে তোদের বাপ ৷ সেই সুদুর বর্ধমান থেকে কোলকাতা এসে অন্য মেয়েছেলে নিয়ে এখানে মরেছে মড়া ৷ না অমলা পারেনি৷ ওরা যখন ঘুরেছে অমলা বসে বসে দেখেছে কি ভাবে বাসুর বাপ ভিখ মাগে৷
বাড়ি ফিরে ভেবেছিলো, শাখা সিঁদুর মুছে ফেলবে৷ কতদিন কত প্রলোভন অমলা স্বীকার করেনি৷ তখন অমলা ভেবেছিলো, সব দায় কি মেয়েদের? চরিত্র ঠিক রাখবে৷ ত্যাগ করবে সব??? সুখ কি অমলার দরকার ছিলো না? সবছিলো৷ পরে এর জবাব অমলা পেয়েছে, সব মেয়েদের সুখের অধিকার আছে, কিন্তু একটা মায়ের কাছে সবচেয়ে আগে সন্তান৷ অমলা নিজের সুখের জন্য তিনটে সন্তানের কপালে আগুন লিখতে পারবেনা৷ আর পারেও নি৷ ছেলে মেয়েদের কিছু বলেনি৷ তারা জানুক বাবা আছে, বাবা নিরুদ্দেশ ৷ শুধু অমলা জানে , তার স্বামী নিজের সুখের জন্য সব ছেড়ে চলে গেছে৷ পথের সুখে ঘর ত্যাগ করেছে৷ আর অমলা কে করে গেছে কুটনো মাসি ৷
শেষ৷