#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন #ছোটোগল্পভয়তপতী মন্ডল চ্যাটার্জী১০/২/২১
আমার পশু ভীতি আমাকে যাঁরা চেনেন সবাই জানেন। যেকোনো পশু যেখানেই দেখি, চিৎকার করে লোক জড়ো করি।
বেশির ভাগ রাতেই আমি কাজ থেকে বাড়ি দেরিতে ফিরি।বাড়ি আসার আগেই রিক্সা থেকে ফ…
#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন
#ছোটোগল্প
ভয়
তপতী মন্ডল চ্যাটার্জী
১০/২/২১
আমার পশু ভীতি আমাকে যাঁরা চেনেন সবাই জানেন। যেকোনো পশু যেখানেই দেখি, চিৎকার করে লোক জড়ো করি।
বেশির ভাগ রাতেই আমি কাজ থেকে বাড়ি দেরিতে ফিরি।বাড়ি আসার আগেই রিক্সা থেকে ফোন করে মেয়েকে ডাকি।
--- রাস্তায় কুকুর কিলবিল করছে।আমাকে বাঁচা।
আমার মেয়ে নাইট সুট পরে হাতে একটা ঝাঁটা বা লাঠি নিয়ে রবিন হুড়ের মত আমাকে উদ্ধার করতে আসে গলির মুখে।পড়ার লোক আমার আর্তচিৎকার আর মেয়ের আশ্বাসবানী জালনার ফাঁক দিয়ে দেখেন, শোনান আর মজা নেন।মিড নাইট থিয়েটার।
একবার বাড়িতে টেবিলে বসে খাচ্ছি। টেবিলের তলায় একটা বিড়াল বসেছিল।দেখিনি।আমার পা তার গায়ে লাগাতে সে একবার মাত্র আস্তে ম্যাঁও করে ওঠে।আমি তার উত্তরে এমন চিল-চিৎকার দিয়েছিলাম, যে এক বর্ষীয়ান ভদ্রমহিলা বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে, ভয়ে বুক চেপে আমাদের বাড়ীর সামনে বসে পড়েন।হার্ট অ্যাটাক হবার জোগাড়। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়েছিল। আর আমার ভাগ্যে কি জুটেছিল, বুঝতেই পারছেন!!
বাড়ির বাকী সব সদস্যরা আবার পরম পশু প্রেমিক।এমনকি আমার মেয়ে, যাকে দেখে সবাই আমার জেরক্স কপি বলেন,সে অবধি।
সে আমার চোখ ফাঁকি দিয়ে স্কুল থেকে ফেরার পথে খেতে না পারা টিফিন রাস্তার কুকুরদের খাওয়াতে খাওয়াতে বাড়ি আসতো।বাড়ির সবাই এটা জানতো।কিন্তু আমি হাতে নাতে ধরার আগে পর্যন্ত কেউ বলেনি।
আমার বন্ধু, সহকর্মী, প্রতিবেশী,আত্মীয় সবার পশু প্রেমে আমি অস্থির। তারা নিজেদের ঘরে নানা পোষ্য নিয়ে আসে আর আমি সে বাড়ি যাওয়া বন্ধ করি।একান্ত লৌকিকতা বা প্রয়োজনে যদি যেতেই হয়। তবে আগেই ফোনে ভদ্রলোকের চুক্তি
---আমি যেতে পারি।কিন্তু তোমাদের বিজাতীয় ছেলে বা মেয়েকে আমার চোখের বাইরে রাখতে হবে, যতক্ষন আমি তোমাদের বাড়ি থাকবো।
পশু নিয়ে আমি যেমন কোনো আদিখ্যেতা করি না,তেমনি তাদের ক্ষতিও করি না।ওদের গায়ে রং দেওয়া,বাজি লেজে বেঁধে দেওয়া, ঢিল মারা, আঘাত করা, বিষ খাওয়ানো, এমনকি খাঁচায় আটকানো... আমার কাছে বর্বরতা।
আমার সাফ যুক্তি, ওদের জামা পরিয়ে,এসিতে রেখে,ফিডিং বোতলে খাইয়ে জীবন বিমুখ করার কোনো মানে নেই। ওরাও মানুষের মত লাইফ স্টাইল ডিজিসের শিকার হবে।
"বন্যরা বনে সুন্দর.... " ইত্যাদি, প্রভৃতি।
জানি, এই অবধি পড়েই কেউ কেউ ভীষন রেগে পড়া বন্ধ করে দেবেন।কিন্তু এই পশুভীতিকে ইংরেজি কেন zoophobia বলে... না বলে চলে যাবেন না। প্লিজ।
zoo মানে চিড়িয়াখানা। যেতে আমার কোনোই ভয় নেই। জীবনে কতবার চিড়িয়াখানা গেছি গুনে বলতে পারবো না।খাঁচায় বন্দী বাঘ-ভাল্লুকের মতো হিংস্র প্রানী আমাকে কাবু করতে পারে না।কিন্তু চারিদিকের নিরীহ কিন্তু মুক্ত পশুদের দেখলেই আমার কেন 'ফালতু ফোবিয়া '--- আজ অবধি বুঝলাম না।
ওরা কোনো দিন আমাকে কামড়েছে,খিমচেছে...এমন মিথ্যা বলতে পারবো না।বরং কামড়ানি খেয়েও মানুষ সেই পশুটিকেই ভালবাসে দেখলে আমার মনটা খিঁচড়ে যায়।
ক্লাস টেনের ইংরেজি বইতে বিড়ালের ধুরন্ধর স্বভাব নিয়ে একটি গদ্য আছে।আমি আমার সমস্ত শক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে সেই লেসেনটি পড়িয়ে ছাত্র -ছাত্রীদের বিড়াল বিমুখ করে তোলার প্রবল চেষ্টা করি।
তারপর শুনি তাদের মধ্যে অনেকেই মার্জার প্রমিক।তখন শিক্ষিকা হিসাবে নিজের অক্ষমতা বিচার করে মুষড়ে পড়ি।
তারা কেউ কেউ আমার দ্বারা দারুণ প্রভাবিতও হয়।কিন্তু আমাকে হতাশ করে, তারা অনেক সময় বিড়াল তাড়িয়ে, কুকুর,খরগোশ, কাঠবিড়ালি ; আরো না জানি কত বিচিত্র জীব বাড়ি নিয়ে আসে পোষার জন্য।
একবার এক বাড়িতে বিশিষ্ট অতিথি হয়ে গেছি।আমাকে আদর করে তাঁরা এ.সি যুক্ত ঘরে বসালেন।গ্রীষ্মের প্রকপে সবে এ.সি তে বসে হাঁফ ছাড়ছি ; দেখি সে ঘরে ঢুলুঢুলু চোখে ৪টি পাগ ঘোরাঘুরি করছে।ওদের জন্যেই এই শীততাপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা।আমার নিজেকে যে কত হীন মনে হয়েছিল বলে বোঝাতে পারবো না।
আমি বললাম
---চলুন ও ঘরে ফ্যানের তলায় বসি।ওরা এখানে থাক।
কিন্তু সে বাড়ির লোকজন আমার ভয়কে যথেষ্ট সম্মান দেখালেন।কুকুরগুলোকে খাটে বিছানার ওপর তুলে দিলেন।আমি জড়সড় হয়ে চেয়ারে বসে আছি।কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই খুব রিল্যাক্সড ফিল করলাম। যখন বুঝলাম ওই ধুমসো কুকুর গুলো আমার থেকেও ভীতু। ওরা খাট থেকে লাফিয়ে নীচে নামতে পারে না।
আর এক বান্ধবীর সারমেয় প্রীতি ঘর ছেড়ে,পাড়া ছেড়ে, মহকুমা, জেলা এমনকি রাজ্যেও ছড়িয়ে পড়ার জোগাড়। তার বাড়ি যেতে হলে পাড়ার সব কুকুরের পারমিশন নিয়ে তবে ওপরে উঠতে হয়।পাড়ায় ঢুকলেই তারা ছেঁকে ধরে। তাদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে আমাকে ফোন করতে হয়।বাড়ি থেকে কেউ এসে আমাকে এসকট করে নিয়ে যায়।
পাড়ায় ওদের ভয়ে লোক ঢোকেনা।অনেকে বাড়ি অবধি বিক্রি করে দিচ্ছে। আমার বান্ধবী জলের দামে সে বাড়িগুলো কিনে পশুশালা বানাচ্ছে ।
এমনি কোনো একদিন হাঁফাতে হাঁফাতে ওর ঘরে গেছি।আগে বলা থাকায় ও ওর বাচ্চা দুটোকে(দুটো দানবের মত কুকুর) পাশের ঘরে ওর মেয়েদের কাছে আটকা রেখেছিলো।
রাস্তার কুকুরদের তাড়া খেয়ে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ।আমি হাতের কাছে রাখা বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেলাম। যখন বোতলের মুখ আটকাতে যাবো তখন ক্যাপে ও বোতলের মুখে ফুটো ফুটো দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম
----ও গুলো কি?
আমার সেই মাতৃরূপা বান্ধবীটি বলল
----তুই আসার জাস্ট আগে বাচ্চাদের জল খাওয়াচ্ছিলাম এই বোতল থেকেই।ওরাই কামড়ে বোতলের ঢাকনার ও বোতলের এই হাল করেছে।আমি এরপর ওর ফোন নম্বর ব্লক করে দিই।
সব থেকে বাড়বাড়ি হয়ে গেছিল, আমি যখন দিল্লিতে থাকতাম।সবে বিয়ের হয়েছে। কর্তা, ফ্লাটে রেখে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাজে গেছেন
----কেউ এলে তুমি যেন কোনো অবস্থাতেই ফ্ল্যাটের দরজা খুলবে না।অপরিচিত জায়গা। কাউকে চেনো না তুমি।
কিন্তু একদিন হঠাৎ দেখি জালনা দিয়ে এক সাদা কালো ঢোড়া কাটা বিড়াল ঘরে এসে একেবারে বিছানায় বসে আছেন।ভয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি সোজা দরজা খুলে পাশের ফ্ল্যাটে। ওদের গিয়ে যখন বললাম
---এক বিল্লি গুস গেয়ি মেরে ফ্ল্যাটমে।তোড়া ভাগা দিজিয়ে!!
গৃহিণী প্রায় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
আমি যাবার আগে এই ফ্ল্যাটে আমার কর্তা একাই থাকতেন।তার যত অবিবাহিত বন্ধু সেখানে আসতো।হৈ হল্লা করতো।পাশের পরিবারটি দক্ষিণ ভারতীয় ।তারা দরজায় রঙ্গোলী করতো। ছেলেরা তা মাড়াতো।তাই এই দুই ফ্ল্যাটের মধ্যে একটা ঝাঁঝালো পাড়াতুতো বৈরীতা ছিলো। যদিও আমার সেটা জানা ছিলো না।(নিজের কুকীর্তির কথা কোনো পুরুষই যেচে তার নতুন বউকে বলে না।)
তাই আমার মত প্রাপ্তবয়স্ক এমন লম্বা -চওড়া মহিলা এই ফ্ল্যাট থেকে পাশের ফ্ল্যাটে সাহায্য চাওয়া এ পক্ষের এক রকম পরাজয়ই মনে করেছিলেন ও তরফের লোকেরা।
একটু ধাতস্থ হয়ে গৃহকর্ত্রী তার বছর ১০ এর একটি গাবলু বাচ্চা মেয়েকে বললেন
---চিন্টু, যাহ্। আন্টিকি ঘরসে বিল্লি ভাগা দে।
চিন্টু একটি যারপরনাই নাদুসনুদুস, ফর্সা, হাফ প্যান্ট আর টিশার্ট পরা বাচ্চা। সে বীরাঙ্গনার মতো আগে আগে খোলা ফ্ল্যাটে এলো। তার পিছনে আমি এলাম, কিন্তু চৌকাঠে দাঁড়িয়ে।
---এ বিল্লি।
চিন্টু সোফার তলা দেখলো।
---বাহার আজা
চিন্টুর বাথরুম দেখা হয়ে গেলো।
---কাঁহা হ্যায় বিল্লি
রান্না ঘরে নেই।
----মিয়াও মিয়াও
ডাইনিং টেবিলের তলায় উঁকি
---আরে তু হ্যায় ক্যায়
চিন্টু আমাদের শোবার ঘরে ঢুকলো ও বেরোলো।
---আন্টি,বিল্লি তো চলি গেয়ি
তার গাল টিপে বললাম
---তুম বহত সুইট হো।
---আপ সুইট।ইসি লিয়ে বিল্লিসে ভর গেয়ী।বিল্লিকো ভি আপকি ডর দেখকে শরম আগায়ি।
বিড়ালকে লজ্জায় ফেলেও আমি নির্লজ্জের মতো জীবজন্তু দেখলেই ভয় পাওয়া চালিয়ে যাচ্ছিলাম।পশু প্রেমিকরা বলেন
---ওরা কিচ্ছু করে না।ওদের দেখে ভয় পাও কেন?তুমি তো ওদের কোনো ক্ষতি করো না।ওরাও তোমাকে কিছু বলবে না।
এই ভয় নিয়ে আমারও কম অস্বস্তি হয় না।যেখানে সেখানে নিজের ভীত চেহারাটা দেখিয়ে ফেলতে হয়।এটা আমার চরিত্র বিরোধী।
ভয়ের কারণ আমি নিজেও অনেক খুঁজেছি।অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, আমি যখন খুব ছোটো তখন আমাদের পাড়ায় একই সময় জলাতঙ্ক ও ডিপথেরিয়া হয়ে আমার বয়সী দুটি শিশু মারা যায়।ওরা আমার খেলার সাথী ছিলো।এই ঘটনা দুটো আমার শিশু মনের এত ভিতরে গেঁথে রয়েছে, যে সেটাই হয়তো আমার এই অকারণ ভয়ের কারণ।
লক ডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে আমাকে নানা কাজে বাইরে বেরোতে হয়।রাতে বাবা মাকে দেখে যখন ফিরি পাড়ার ও বেপাড়ার অভুক্ত কুকুগুলো রাস্তায় ছড়িয়ে থাকে।
এতদিন যাদের ভয় পেয়েছি আজ তাদের থেকেও বেশি ভয় পাচ্ছি অতিমারীকে।পাড়ায় পাড়ায় তার জটলা ।
তবু কুকুর দেখেই চিৎকার করি।লাফঝাঁপ দিই।পুরনো অনীহা যেতে চায় না।মেয়ে রোজ আমাকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে।
একদিন বাবা-মাকে দেখে ফিরছি।সন্ধ্যা।লক ডাউনে রাস্তা ফাঁকা।মেয়েকে ফোন করতেই ও বলল
---পাড়ার কমিউনিটি কিচেনের এখনো খোলা।ওটার সামনের ভ্যাটে কুকুরের ফিস্ট চলছে।আজ তুমি তাড়াতাড়ি আসছো।কেউ তোমায় বিরক্ত করবে না।একা চলে এসো।
---না না,আমাদের উঠোনে যে কুকুরটা থাকে,তোরা বাঘা বলিস।ও কিছুতেই আমার পিছু ছাড়ছে না।
---ও আছে, তাই তোমার কোনো ভয় নেই। আমি যাবো না।তোমাকে একাই আসতে হবে।
ভীষণ রেগে বাড়ি ফিরি।মেয়েকে সামনে দেখে ভীষণ অভিমান করে বলি
---তোর জন্য করিনি, এমন কাজ নেই। আর তুই একটা কুকুরকে আমার সামনে থেকে তাড়াতে আসতে পারলি না??
---মা, বাঘার জায়গায় কোনো মানুষ তোমার পিছু নিলে তুমি কি কম ভয় পেতে?? রাতে রোজ তোমার রাস্তা জুড়ে যত কুকুর থাকে, ততোগুলো যদি মানুষ থাকতো?? ভাবো একবার।
---আমার ওদের ভয় করে। আমি কি করবো?
---তুমিও জানো ওরা অবুজ আর অভুক্ত। ওদের ভালোবাসো।দেখবে ওরা তোমার কথা শুনবে।
আজ দুপুরে খাবার পর বাড়ির কাজের মেয়েটা যখন রাস্তায় কুকুরদের খেতে দিচ্ছিল, আমার মেয়ে জোর করে ওখানে আমায় নিয়ে গেলো।আমাকে দিয়ে জোর করে খাবার দেওয়ালো।আমি ওর জোরের কাছে হার মেনে ভয়ে ভয়ে কিছু ভাত ছিটিয়ে দিলাম রাস্তায়। ওদের খাওয়া দেখে একটা কেমন দুঃখবোধ জেগে উঠলো।
আজ রাতে আবার আমার বাড়ি ফেরার পথে বেশ কয়েকজন আমার পিছু নিলো আর পথ আটকালো।তাদের বকা দিয়ে বললাম
---এখন না।খাওয়া হোক তারপর তোদের খেতে দেবো।
ওরা কি বুঝলো জানি না।পথ ছেড়ে দিলো। বাড়ি এলাম।কিন্তু রাস্তা থেকে আমার গলার স্বর বাড়ি পৌঁছেছিল। আমার কর্তাটি জিজ্ঞেস করলেন
---রাস্তায় কেউ কি তোমায় ডিসটার্ব করলো?
আমি বললাম
---না, কুকুরগুলো পেছন পেছন আসছিল।তাই বকা দিলাম।
শুনে বাড়ির সবাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
---ভয় পেলে না?
----ভয়ের করোনা হয়েছিলো।মরে গেছে।
তপতী মন্ডল চ্যাটার্জী