Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#হ্যাপি উইমেনস্ ডে#গল্প 
#সুস্মিতা
   চিতাবাঘের মত বিশাল কালো গাড়িটা থেকে শার্ট-প্যান্টপরা শহুরে দিদিমনিরা চেঁচিয়ে বলে উঠল- "হ্যাপি উইমেনস্ ডে...মমতার মা।"       জায়গাটা কলকাতা শহর থেকে একটু দূরে।  বসিরহাটের কাছাকাছি।  মম…

 


#হ্যাপি উইমেনস্ ডে

#গল্প 


#সুস্মিতা


   চিতাবাঘের মত বিশাল কালো গাড়িটা থেকে শার্ট-প্যান্টপরা শহুরে দিদিমনিরা চেঁচিয়ে বলে উঠল- "হ্যাপি উইমেনস্ ডে...মমতার মা।"

       জায়গাটা কলকাতা শহর থেকে একটু দূরে।  বসিরহাটের কাছাকাছি।  মমতার মা তখন বাড়ির পাশের এঁদো পুকুরটার ধারে বসে নাতি নাতনিগুলোর গুয়েমুতে মাখা ন্যাতা ধুচ্ছে। উজ্জ্বল রঙ্গীন দিদিমনিদের মুখ থেকে শক্ত ইংরেজি বাক্যটি শুনে মমতার মা একবার মাত্র ক্লান্ত উদাসীন চোখ তুলে তাকাল...

   নাহ, চিন্তার কোনো কারণ নেই। এই দিদিমনিদের একজন তার বেশ চেনা মানুষ।


     বেশ কয়েক বছর আগের কথা...

কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে আমিনা তখন সদ্য এপারে পালিয়ে এসেছিল। সহায় সম্বল বলতে কোলে চারবছরের হাবাগোবা মেয়ে মমতাজ। দেশের বাড়িতে তার মাস ছয়েক আগে মরেছে আমিনার স্বামী আর কিছুদিনের ব্যবধানে তিন তিনটে জলজ্যান্ত ছেলে।

  শাদী করা ইস্তক মরদটা ওর অসুস্থই ছিল, কাজকর্ম কিছু করতনা।বাপ দাদার ঘাড়ে বসে খেত। শুধু ছেলেপুলে হতে কোনো অসুবিধা হয়নি।শাদীর ছয় বছরের মধ্যে তিনতিনটে ছেলে হ'ল আর মরল। তারপর এই মেয়ে মমতাজের তিন বছর বয়স হ'তে  না হ'তে অসুস্থ স্বামী লিয়াকতের এন্তেকাল হ'ল। আমিনার অবশ্য তাতে বিশেষ  কোনো শোক দুঃখ হয়নি।কারণ ছেলেপুলের জন্ম দেওয়া ছাড়া লিয়াকতের আর কোনও ভূমিকা ওর জীবনে ছিলনা। কিন্তু স্বামীর মরার পরের ছয় মাসে ভাশুর শ্বশুরের কুৎসিত অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, এক গভীর রাতে মমতাজকে কোলে নিয়ে আমিনা ঘর ছাড়ল....

  অনেক জ্বালা যন্ত্রণার পথ পেরিয়ে তারপর থেকেই ওর ঠিকানা সীমান্ত পেরিয়ে বসিরহাটের কাছে এই আধা গ্রাম...আধা শহর...।


             পেটের জ্বালা সবচেয়ে বড় জ্বালা...।

  শ্বশুর ভাশুরের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচল আমিনা। কিন্তু এপারেও কি চিল শকুনের অভাব আছে? তার সাথে নেই পেটের ভাত...

একদিন জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা রোদে রাস্তার ধারে মেয়ে কোলে বসেছিল আমিনা। কিসের আশায় তা নিজেই জানে না। কারণ ততদিনে বাঁচার আশা, চোখের জল সবই শেষ হয়ে গিয়েছে...।

সেদিনও এমনই এক চিতাবাঘের মত গাড়ি চড়ে মেমসাহেবের মত কয়েকজন দিদিমনি এসে দাঁড়িয়ে ছিল আমিনার সামনে। সঙ্গে দুজন ফটোবাবু। তারা হঠাৎ গাড়ি থেকে নেমে পটাপট ছবি তুলতে লাগল আমিনা আর মমতাজের।

   অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছিল আমিনা...শেষে কি জানি কি হল তার...ক্ষিদের জ্বালায় হঠাৎ একজন দিদিমনির পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠেছিল সে। তা, সে দিদিমনির দয়ার শরীর। কি যে তিনি বললেন, আমিনা সঠিক বোঝেনি।কোথায় কোন এন.জি.ও না কিসে কাজ করেন দিদি। আমিনার সব কথা শুনে তাকে ঘরগেরস্থালি সামলানোর কাজ পাইয়ে দেওয়ার আশায় কলকাতায় নিয়ে গেলেন তিনি। কাজও জুটিয়ে দিলেন।

   শুধু কাজ পাওয়ার সুবিধার জন্য "মমতাজের মা"থেকে ওর নামটা হয়ে গেল "মমতার মা।" "আমিনা" নামটার আর কোনও অস্তিত্বই রইলনা। কোনও অনুষ্ঠান হলনা, মুসলমানি রমণীটি হয়ে গেল হিন্দু নারী।আমিনা হারিয়ে গেল। না হলে এদিকে কাজ পাওয়া আজও মুশকিল।

      এসবে অবশ্য কিছু যায় আসেনা মমতার মায়ের। কোনো ধর্মই ওকে পেটের ভাত দেয়নি...দেয়নি নারীর নিরাপত্তা। এতসব কথা বিশেষ ভাবতে টাবতেও পারেনা ও। গরীবের জীবনে ধর্মের আর কি ভূমিকা?


           যাইহোক দিদিমনির চেনা বাড়িতে  মমতাকে নিয়ে বছর দুয়েক দিব্যি কেটে গেল...।

  কিন্তু কপালে 'নিশ্চিন্ত ভাতের সুখ' সইলনা মমতার মায়ের। মেয়ে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যেতে লাগল মমতা ঠিক আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর মত নয়। সঠিক চিকিৎসা করাতে পারলে হয়ত জানা যেত,অসুবিধাটা ঠিক কোথায়? কিন্তু সে দায়িত্ব বা খরচের বোঝা কে নেবে? কাজেই সোজা বাংলায় ঘোষিত হয়ে গেল-"মমতা পাগল।"

   এই অবস্থায় দিদিমনির বান্ধবীও মমতাসহ তার মাকে আর কাজে রাখতে চাইলনা। সেটাও খুব স্বাভাবিক, তাকে দোষ দেওয়া যায়না। সকলেরই বাড়িতে ছোট ছেলেমেয়ে আছে, পারিবারিক স্বাস্থ্যের কথা তারা তো ভাববেনই। এন.জি.ও দিদিমনি তবুও অনেক চেষ্টাচরিত্র করেছিলেন, কিন্তু তিনি একাই বা আর কতদূর কি করতে পারেন?

   শেষপর্যন্ত দিদিমনির পরামর্শেই আবার বসিরহাটে ফিরে আসে মমতার মা। এখানেও আজকাল বড় বড় ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হচ্ছে।সেখানে ঠিকে কাজ করবে সে। তাছাড়া এখানে আছে পুরোনো দেশের বাড়ির চেনাজানা কয়েক ঘর মানুষ। পাগল মেয়েকে তাদের জিম্মায় রেখে কাজে যেতে অসুবিধা হবেনা।

সেই থেকে এইরকমই চলছে মমতার মায়ের জীবন...।


       দেখতে দেখতে প্রায় নয় দশ বছর কেটে গিয়েছে। পাগলী মমতা এখন পূর্ণ যুবতী। মমতার মায়ের পাগল মেয়েকেও রেহাই দেয়নি সুস্থ পুরুষ সমাজ। সে এখন চার চারটি সন্তানের জননী।তাদের পিতা কে বা কারা? মমতার মা জানেনা। মমতা নিজেও জানে কিনা বোঝা মুশকিল। গেড়ি গুগলির মত ছেলেপুলেগুলোর দিকে সে ফিরেও তাকায়না। সারাদিন গাছতলায় বসে মাথার উকুন মারে, একলা বকবক করে...আর সন্ধ্যে হলেই শরীরের জৈবিক তাড়নায় স্টেশনের পেছনে দেশি মদের দোকানের বেঞ্চে গিয়ে বসে থাকে।যাবতীয় অসামাজিক কাজের ঠেক ওই দোকান।মদের ঠেকের লাগোয়া চটের পর্দা দেওয়া ছোট একটা ঘর। ছেলে ছোকরারা ওই ঘরে ভিডিও এনে নীলছবি দেখে আর মমতাকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করে।


   আর এদিকে চার চারটে নাতি-নাতনী এঁটুলির মত সারাদিন মমতার মায়ের  গায়ে লেগে থাকে। আমিনা দিনরাত কেঁচোকেন্নোর মত বাচ্চাগুলোকে গালিগালাজ করে..."মর তোরা মর" বলে অভিশাপ দেয়। নিজের মেয়েকে 'বাজারের রেন্ডি' বলে গাল দেয়...ছয় ছয়টা পেট চালাতে মুখে রক্ত উঠে আসে অকাল বৃদ্ধা অসহায় নারীটির।


        তবু মায়া...রক্তের সম্পর্কের বড় মায়া। গভীর রাতে শিশুগুলি ঘুমিয়ে পড়লে ওদের মাথায় হাত বোলাতে থাকে মমতার মা। সারারাত কান পেতে জেগে অপেক্ষা করে...ভোররাতে কখন স্টেশনের মদের দোকান থেকে ঘরে ফিরবে ওদের মা...তার একমাত্র জীবিত সন্তান পাগলী মমতা...।


          আজ সকাল থেকে মমতার মায়ের মন বড় অস্থির, শরীরটাও আর চলছে না। তিনরাত ধরে চোখের পাতা এক করতে পারেনি সে।

     আজ তিনদিন হয়ে গেল...পাগল মেয়েটা ঘরে ফেরেনি। এর আগেও যে একরাত দুরাত এরকম হয়নি, তা নয়। তবুও মায়ের মন মানেনা। পাগল হোক...যেমনই হোক...সে যে তার শেষ সম্বল, তার একমাত্র সন্তান।

   নাতিনাতনীগুলো কি বুঝছে কি ভাবছে...কে জানে? শুকনো মুখে, শূন্য  দৃষ্টিতে ওরা নানীর পায়েপায়ে ঘুরছে।

   বেলা বাড়ছে। সকাল থেকে শুকনো মুড়ি ছাড়া কারুরই কিছু জোটেনি।একেবারে ছোট নাতনিদুটোর গতকাল রাত থেকে গায়ে জ্বর, পেটখারাপ। গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে ওদের, শরীরে মাছি বসছে।

নাহ এবার উঠতেই হবে।গুয়ে মুতে মাখা ন্যাতাগুলো ধুয়ে না ফেললে আর চলছে না...পুকুরের দিকে এগিয়ে গেল মমতার মা...।


         ঠিক এমন সময়ে কালো বড় গাড়িটা এসে দাঁড়ালো পুকুর পারে। এন.জি.ও দিদি, তার বান্ধবীরা আর ফটোবাবুরা নেমে আসল গাড়ি থেকে।তারা সকলে মিলে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল মমতার মায়ের হাতে দিয়ে সমস্বরে বলে উঠল- "হ্যাপি উইমেনস্ ডে মমতার মা"। ফটোবাবুরা আবার পটাপট ছবি তুলতে লাগল। দিদিমনি মাইক হাতে কত কি যে বলল- "আজ নাকি মমতার মায়ের মত মানুষদেরই দিন"...আরও সব কত ভালো ভালো কথা। সিনেমার মতো ছবি উঠল...সেসব নাকি টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হবে।


         

        সন্ধ্যে হ'তে চলল...। পাগল মেয়েটা এখনও ঘরে ফিরলনা। মমতার মা যেন আর শান্ত থাকতে পারছে না। বাচ্চাগুলো ক্ষিদেয় তেষ্টায় ঘ্যানঘ্যান করে কেঁদেই চলেছে।

তবে যে শহরের দিদিমনিরা বলে গেল আজ মমতার মা'দের জীবনের বড় আনন্দে দিন...বড় সুদিন?


          তারপরে আরও ঘন্টা দুই সময় কেটে গিয়েছিল...


এখন রাত প্রায় ন'টা। থানা থেকে লোকজন গিয়ে মমতার মাকে থানায় ডেকে নিয়ে এসেছে।বড়বাবুর ঘরের মেঝের এক কোণায় অঘোরে ঘুমোচ্ছে আমিনার পাগল এবং পঞ্চমবারের অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে মমতাজ ওরফে মমতা। গতকাল রাতে সে বিরাট বড় এক পাথরের চাঁই দিয়ে মাথা থেৎলে মেরেছে তাকে ধর্ষণকারী তিন তিনজন পুরুষকে। তারপর থেকে মমতার আর কোনো হুঁশ নেই। প্রত্যক্ষদর্শীরা তাকে তুলে থানায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে।


          ঘটনাটি শোনার পরে মমতার মায়েরও অনেকক্ষণ হুঁশ ছিলনা।বোবা হয়ে গিয়েছিল ও...একটাও কথা বলতে পারেনি, কাঁদতেও পারেনি...

           এইমাত্র নিজেকে সামলে, মেয়ের কাছে উঠে গিয়ে...তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে জীবনে প্রথমবার গোটা একটি ইংরেজি বাক্য উচ্চারণ করল মমতার মা- "হ্যাপি উইমেনস্ ডে"...


গায়ের সাথে এঁটুলির মত লেগে থাকা ছয় বছরের নাতনিটির হাতে তখনও সেই শহুরে দিদিদের দেওয়া গোলাপের গুচ্ছ।ফুলগুলো সে তার পাগলী মায়ের পায়ের কাছে গুছিয়ে রাখছে...


              **************