Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#গল্প:-ভাঙনকাল  
#কলমে:-পৌলমী_কর
সোমরাজ আর মহুল-এর বিবাহিত জীবনের আজ পাঁচ বছর পূর্ণ হতে চলেছে।সেই উপলক্ষ্যে বাড়িতে আজ একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।নিজেদের কিছু আত্মীয়স্বজন, ওদের দুজনের বন্ধুবান্ধব আর সোমের (সোমরাজের ডাকন…

 


#গল্প:-ভাঙনকাল  


#কলমে:-পৌলমী_কর


সোমরাজ আর মহুল-এর বিবাহিত জীবনের আজ পাঁচ বছর পূর্ণ হতে চলেছে।সেই উপলক্ষ্যে বাড়িতে আজ একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।নিজেদের কিছু আত্মীয়স্বজন, ওদের দুজনের বন্ধুবান্ধব আর সোমের (সোমরাজের ডাকনাম)অফিসের কয়েকজন কলিগ,এই নিয়েই একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা। সকাল থেকেই মহুল আজ খুব ব্যস্ত।ঘর সাজানো থেকে শুরু করে রান্না ঘর সামলানো সবটাই সে নিজের হাতে সামলাচ্ছে।গত দুদিন ধরে লেক মার্কেট ঘুরে বিদেশী কায়দার আদলে গড়া কাঁচের পুতুল,বাহারি রঙের বেলোয়ারি ঝাড়বাতি,ঘরের দেয়ালের রঙের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আকাশ নীল রঙের পর্দা এবং সবশেষে অতিথি আপ্যায়নের জন্য বোনচায়নার ডিনার সেট কিনেছে।অন্যান্য দিনের তুলনায় সোমের-ও আজ তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙেছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কোনরকমে চা-এ চুমুক দিয়ে বাজারে চলে গেছে।সকাল থেকেই বাড়ির ছবিটা আজ অন্যরকম।দুপুরের খাওয়া-দাওয়া মিটতেই বিকেল তিনটে বেজে গেল।খাওয়া শেষ করেই সোম চলে গেল রান্নার ঠাকুরদের তদারকি করতে।এই ফাঁকে মহুল একটু বিছানায় গড়িয়ে নিল।কিছুক্ষণ পরে সোম এসে ডাক দেওয়ায় বিছানা ছেড়ে উঠে সোজা চলে গেল তৈরী হতে।আজ সে পরেছে দক্ষিন ভারতের বিখ্যাত কাঞ্জিভরম সিল্ক। তার সঙ্গে মানানসই ভারী গয়না।খোপায় জড়ানো জুঁই ফুলের মালা, ঠোঁটে টকটকে গোলাপি লিপস্টিক, কপালে লাল টিপ আর ডালিম রঙা শাড়িতে সে যেন আজ ফুটন্ত গোলাপ।সোম নিজেও তৈরী হয়ে নিয়েছে।মহুলের পছন্দ করে কিনে আনা মেরুন রঙের পাঞ্জাবীতে সুদর্শন চেহারার সোমরাজকেও আজ দিব্য লাগছে।ঘরে ফুলের গন্ধ আর মহুলের গায়ের বিদেশী সুগন্ধি সব মিলেমিশে সোম-কে যেন মোহাচ্ছন্ন করে তুলেছে।ঘড়িতে সন্ধ্যে সাতটা। হঠাৎ ডোরবেলের শব্দে ঘোর কাটলো সোমের।ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো সে।একে একে সমস্ত অতিথিরা আসতে শুরু করেছে।মহুল তাদের ড্রয়িং রুমে নিয়ে গিয়ে বসালো।এরই মধ্যে সোমের অফিস কলিগরা এসে হাজির, সঙ্গে বেশ কিছু উপহার আর ফুলের তোড়া নিয়ে।অফিস কলিগদের মধ্যে প্রায় সবাই মহুলের চেনা।অফিস পার্টিতে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে সবার সাথে।কিন্তু এদের মধ্যে আজ একজন অচেনা এবং অপরিচিত।এই মেয়েটাকে তো আগে কোনদিন দেখেনি মহুল।সোম সঙ্গে করে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দিলো মহুলের সাথে।আহেলী বোস।উনি আমাদের অফিসে নতুন জয়েন করেছে।মহুল বোধহয় একটু ইতস্ততঃ বোধ করছিল।যাইহোক অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখে চওড়া হাসির রেখা এঁকেই সামান্য পরিচয় পর্বটুকু সেরেই অন্যদিকে চলে গেলো মহুল।একটু পরে ফিরে এলো হাতে সফট ড্রিংস আর স্টার্টারের ট্রে সঙ্গে করে।ফিরে এসে দেখলো অফিস কলিগদের সাথে আড্ডায় বেশ মজে গেছে সোম।আর তার পাশে অবলীলায় গায়ে গা এলিয়ে বসে আছে আহেলী।দৃশ্যটা দেখেই মহুলের রাগে মাথাটা গরম হয়ে গেলো।সোম মনে হয় কিছু আন্দাজ করতে পারলো, তাই সোফা ছেড়ে উঠে মহুলের পাশে এসে দাঁড়ালো।রাত সাড়ে নটা বাজতেই ডিনারের আয়োজন করলো মহুল।ডিনার সেরে সবাই যে যার মতো বাড়ির উদ্দ্যেশ্যে রওনা দিলো।শুধুমাত্র আহেলীর রিকোয়েস্টে সোম তাকে ট্যাক্সি ধরিয়ে দিতে রাস্তার মোড় পর্যন্ত গেল।যদিও মহুলের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সোমের কাছে কিছু ধরা দিলো না।রাত এগারোটা বাজতেই পুরো বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেলো।সারাদিনের ধকলে বিছানায় পড়তেই গভীর ঘুমে ডুবে গেলো সোম।মহুল-ও কিছুক্ষণ বাদে পাশে এসে শুয়ে পড়লো।


               বেশ কিছুদিন ধরেই সোমের মধ্যে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করছে মহুল।আগে অফিস থেকে ফিরে কফির কাপ হাতে একসঙ্গে বসে দুজনে কত গল্প করতো, টিভি দেখতো।কিন্তু এখন বাড়িতে থাকাকালীন বেশীরভাগ সময়টাই হয় ল্যাপটপ না হয় মোবাইলে ডুবে থাকে সোম।রাতের খাওয়া সেরে বিছানার এককোণে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।মহুলের দিকে ফিরেও তাকায় না সোম।সে খেলো, কি না খেলো, এমনকি শরীর খারাপ হলেও তাতে কিছু আসে যায় না সোমের।এক বাড়িতে থেকেও তাদের মধ্যে আজ কয়েক ক্রোশ দূরত্ব তৈরী হয়েছে। যা অতিক্রম করে কেউ কারো কাছে যেতে পারবে না হয়তো আর কোনদিন।মহুল সারাদিন এই সব ভাবতে থাকে।সোমকে এখন তার বড্ড অচেনা লাগে।তাদের বিবাহিত জীবনের পাঁচ বছর,আর কলেজ জীবনে কাটানো তিন বছর মোট আট বছর একসঙ্গে কাটানো মানুষটা দিনের পর দিন একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে।মহুল এখন ঠিক মতো কারো সাথে কথা বলে না।স্নান খাওয়া প্রায় ভুলতে বসেছে।এমনকি কারো ফোন পর্যন্ত রিসিভ করে না।তার মা পাঁচদিন ফোন করলে সে হয়তো দুদিন কথা বলে।এরই মধ্যে একদিন মহুলের কলেজের এক বন্ধু কেকা ফোন করে বললো---হ্যালো মহুল! আজ সোমরাজদা-কে দেখলাম একটা মেয়ের সঙ্গে অলিপাবে (পার্কস্টিটের এক বিখ্যাত পাব) বসে খাচ্ছে।হ্যাঁ রে! মেয়েটা কি তোদের কোন রিলেটিভ?নাকি সোম-দার কোন বন্ধু?শুনেই মহুলের বুকের ভিতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো।কেকার দেওয়া বর্ণনায় মহুলের আর বুঝতে বাকি রইলো না মেয়েটি কে।সোম বাড়ি ফিরতেই মহুল জানতে চাইলো সে আজ সন্ধ্যেবেলা অলিপাবে কি করছিলো?আকস্মিক এই প্রশ্নের জন্য সোম প্রস্তুত ছিলো না।তাই সে আমতা আমতা করতে থাকে আর প্রশ্নটা এড়িয়ে সোজা বাথরুমে চলে যায়।সোম যে মিথ্যে বললো মহুলের কাছে তা জলের মতো পরিস্কার।অজান্তেই তার দু-গাল বেয়ে নেমে এলো নোনা জল।এই ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পর হঠাৎ একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে সোম জানায় তাকে দু-দিনের জন্য অফিসের কাজে বর্ধমান যেতে হবে।মহুল বললো--হঠাৎ বর্ধমান যেতে হবে, কই আগে তো কিছু জানাওনি।সোম ঝাঁঝিয়ে উঠে বললো---


আগে জানাইনি তো কি হয়েছে, এখন তো জানাচ্ছি।আমাকে কাল সকালেই বেরোতে হবে।সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ সোম লাগেজ গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।মহুল এসে বারান্দায় দাঁড়ালো, হয়তো ভেবেছিল সোম একবার পিছন ফিরে তাকাবে।কিন্তু মহুলের এই ধারণাকে মিথ্যে প্রমাণ করে সোম সোজা হেঁটে চলে গেলো।সারাদিন মহুল বিছানায় শুয়েই কাটালো।সন্ধ্যে হতেই নিজের মুঠো ফোনটা থেকে সোমের অফিস কলিগ রুদ্রকে ফোন করলো মহুল।ফোন করে জানতে পারলো সোম ব্যাক্তিগত কারনে দু-দিনের ছুটি নিয়েছে।আহেলী অবশ্য তার তিন -চারদিন আগে থেকেই ছুটি নিয়ে নিজের বাড়ি গেছে বাঁকুড়ায়।কোথাও যেনো একটু ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পেলো মহুল।দুদিন পর বাড়ি ফিরলো সোম।মহুল যথারীতি স্বাভাবিক আচরণ করতে লাগলো।পরেরদিন সকালে সোম অফিস চলে যায়।কিন্তু ভুলবশতই মোবাইলটা বাড়িতে ফেলে যায়। দুপুরে বিছানায় শুয়ে নিজেদের বিবাহবার্ষিকীর ছবিগুলো দেখার জন্য সোমের ফোনের গ্যালারিটা ওপেন করে মহুল।গ্যালারি ওপেন করতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সোম আর আহেলীর সমুদ্র সৈকতে তোলা অন্তরঙ্গ মুহুর্তের কিছু দৃশ্য।আর সে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। বিশ্বাসঘাতকতার কষ্টে নিজের চোখের সামনে সবকিছু ধীরে ধীরে ঝাঁপসা হয়ে যেতে থাকে মহুলের।মনে মনে সে ঠিক করলো আজ সোম ফিরলে তার সাথে কথা বলতে হবে।রাত আটটা নাগাদ সোম বাড়ি ফিরতেই মহুল বলে---তুমি কোথায় গেছিলে বলো।আর তুমি যে অফিসের কাজে কোথাও যাও নি তা আমার জানা হয়ে গেছে।সোম হঠাৎ চিৎকার করেই বলে---যা করেছি বেশ করেছি, হ্যাঁ, আমি আর আহেলী নিজেদের মতো করে সময় কাটানোর জন্যই মন্দারমনি ঘুরতে গেছিলাম।আর তুমি এটাও শুনে রাখো আমরা দুজন-দুজনকে ভালোবাসি।আমরা কেউ কাউকে ছাড়া আর থাকতে পারবো না।তোমার মতো একটা মিডল ক্লাস, ঘরোয়া,অসহ্য প্রকৃতির মেয়ের সাথে জাস্ট থাকা যায় না।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে মুক্তি দাও।একটানা কথাগুলো বলে নিজের ঘরে গিয়ে স্বজোরে দরজাটা বন্ধ করে দেয় সোম।মহুল ধড়াম করে সোফায় বসে পড়ে।নিজের কানকে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।কোনরকমে রাতটুকু ঐ ফ্ল্যাটে কাটিয়ে পরেরদিন ভোরের আলো ফুটতেই সোম-কে কিছু না জানিয়ে শুধু টেবিলের ওপর একটা চিঠি রেখে মহুল তার বাপের বাড়ি চলে আসে।কিন্তু সেই চিঠি খুলে দেখার মতো সময় আজ আর তার নেই।বাড়ি এসে বাবা-মাকে সব কথা খুলে বলে মহুল।বাবা তাকে এক বাক্যে জানিয়ে দেয়,যতদিন না পর্যন্ত সোম তোমার কাছে এসে নিজের ভুল স্বীকার করছে, ততদিন তুমি ও বাড়ি ফিরবে না।দেখতে দেখতে মাস খানেক হতে চললো। এই একমাসে সোম একবারও ফোন করেনি মহুলকে।মেয়ের অবস্থার অবনতি দেখে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সমীরবাবু (মহুলের বাবা) ফোন করে সোম-কে।কিন্তু সোম মুখে ওপর স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সে আর মহুলের সাথে সংসার করতে চায় না।এর বেশ কিছুদিন পরে স্পীড পোস্টে একটি চিঠি এলো মহুলের নামে।চিঠিটা খুলতেই একটা বড়ো ধাক্কা খেলো মহুল।সোম তাকে ডিভোর্স ফরমে সই করেই পাঠিয়েছে, এখন শুধু মহুলের সই করার অপেক্ষা। ব্যাস, তাহলেই সব শেষ।কোনরকমে নিজেকে সামলে নিল মহুল।একটি নির্দিষ্ট দিনে বাবাকে সাথে নিয়ে কোর্টে হাজির হলো মহুল।সোম অবশ্য অনেক আগেই এসে উপস্থিত তার নতুন জীবনসঙ্গী আহেলীকে সঙ্গে করে।কোনরকম কনটেস্ট ছাড়াই তাদের ডিভোর্স প্রক্রিয়া সমাপ্ত হলো।কোর্ট থেকে বেরনোর সময় মহুল একবার পিছন ফিরে তাকালো, কিন্তু ততক্ষণে সোম গাড়িতে উঠে পড়েছে।ক্যাবের মধ্যে সারাটা রাস্তা কেঁদেই চলেছে মহুল।তার বাবা তাকে অনেক সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।সে একটা কথাই খালি ভাবছে---শুধুমাত্র একটা সই দুটো মানুষকে আলাদা করে দিতে পারে।তাদের এতদিনের সম্পর্ক, এত কমিটমেন্ট, একসাথে কাটানো রঙিন মুহুর্ত, সবকিছু মিথ্যে হয়ে গেলো আজ।এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই গাড়ি এসে দাঁড়ালো বাড়ির দরজায়।গাড়ি থেকে নেমে ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো মহুল।মা ও মেয়ে দুজনেই ভেঙ্গে পড়েছে খুব।বাবার মনের অবস্থাও ভালো নয়।কোন্ বাবা সহ্য করতে পারে চোখের সামনে মেয়ের ডিভোর্স হওয়া।তবুও নিজেকে শক্ত রেখে মা এবং মেয়েকে জোরে এক ধমক দিলেন সমীরবাবু।বাবা -মার অনেক জোরাজুরি সত্ত্বেও সেদিন কিছু মুখে তুলতে পারেনি মহুল।


                    এরপর প্রায় তিনমাস কেটে গেছে।মহুল এখন এই চার দেয়ালের মধ্যেই বন্দী।ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না,কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি যায় না, কারো সাথে ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলে না, এমনকি নিজের বাবা-মার সাথেও না।দিন দিন মহুল কেমন যেনো একটা প্রাণহীন জড় পদার্থে পরিণত হচ্ছে।এরই মধ্যে একদিন সোমের সেই অফিস কলিগ রুদ্র মহুলকে ফোন করে জানায় সোম আর আহেলী এখন একসাথে থাকতে শুরু করেছে সোমের ফ্ল্যাটে।কথাটা শুনেই মহুলের দু-চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা।ঐ ফ্ল্যাটের প্রতিটি কোণ তার নিজের হাতে সাজানো।আজ সেখানে অন্য কারো বাস। তার জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বনটাই যে আজ অন্য কারোর দখলে।মহুলের পক্ষে এই কঠিন সত্যিটা মেনে নেওয়া খুবই কষ্টের। বাবা-মা অনেক বুঝিয়েও তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে পারে নি।কখনো সে নিজের মনে কথা বলে, কখনো একা একাই হাসে, আবার কখনো কাঁদে।অনেক ডাক্তার দেখানো হয়, যদিও কেউ কোন আশার বাণী শোনাতে পারে নি। কলকাতার একজন নামকরা সাইক্রিয়াটিসের কথা মতো বেশ কিছুবার কাউন্সিলিং পর্যন্ত করানো হয়েছিল তাকে, কিন্তু তাতেও খুব একটা লাভ কিছু হয়নি।এভাবেই দিন কাটতে থাকে।


                            আজ প্রায় এক বছর সোম আর মহুলের ডিভোর্স হয়ে গেছে।এরই মধ্যে একদিন সোম মহুলদের বাড়িতে আসে।দিনটা ছিল রবিবার।দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে সমীরবাবু এবং মীনাদেবী(মহুলের মা)তৈরী হচ্ছিলেন কোথাও একটা যাওয়ার জন্য।হঠাৎ অসময়ে কলিংবেলের শব্দে তিনি মনে মনে একটু বিরক্তই হলেন।একরাশ বিরক্তি নিয়েই দরজাটা খুললেন।দরজার অপর প্রান্তের মানুষটিকে দেখে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।সোম-কে দেখেই তিনি বললেন---কি ব্যাপার! তুমি এখানে??সোম কাঁচুমাচু মুখ করে বললো একটু ভিতরে গিয়ে কথা বলতে পারি?ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ভদ্রতার খাতিরে তিনি সোম-কে ভেতরে আসতে বললেন।সোমের অস্থির দুটো চোখ তখন সারা বাড়ি মহুলকে খুঁজে বেরাচ্ছে।মহুলের কথা জিজ্ঞাসা করতেই তারা বললেন মহুল এখন বাড়িতে নেই।এবার নিজের সমস্ত ভুল স্বীকার করে সোম।এমনকি সে আজ আর আহেলীর সাথে থাকে না।মহুলের সাথে ডিভোর্স হওয়ার ছ-মাস পরই আহেলী তাকে ছেড়ে চলে যায়।আজ সে তাদের অফিসেরই এম.ডি মিস্টার অভিরূপ সেনগুপ্তের ঘরনী।কিছু টাকার লোভে আর তার রূপের ছটায় সে অভিরূপকে নিজের জালে ফাঁসায়।একপ্রকার বাধ্য করে তাকে বিয়ে করতে।শুধুমাত্র এই মেয়েটার প্ররোচনায় সে তার এতো দিনের ভালোবাসাকে এক ঝটকায় নিজের জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।মহুলকে হারিয়ে সে যে জীবনে কত বড়ো ভুল করেছে,তা আজ প্রতি মুহুর্তে অনুভব করে সে। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামলো সোম। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সোমের কথাগুলো শুনছিলেন তারা।এবার ঘরের পরিবেশটা একেবারে থমথমে আর নীরব।হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করেই সোম বললো---আমি আমার সমস্ত ভুল স্বীকার করে মহুলকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।এতক্ষনে মীনাদেবী মুখ খুললেন।তিনি বললেন মহুল আর এখন এখানে থাকে না।মহুল এখন সোনারপুরের একটি মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রের স্থায়ী বাসিন্দা।প্রতি রবিবার তারা মেয়েকে দেখতে সেখানে যান,এমনকি আজও সেখানেই যাচ্ছিলেন।কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন মীনাদেবী।ভারাক্রান্ত মনে বাড়ি ফিরে সোম নিজের ঘরের আলমারিতে অস্থির হয়ে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো।হঠাৎ তার পায়ের কাছে এসে পড়লো মহুলের লেখা সেই চিঠি, যা এতোদিন হেলায় ফেলে রেখেছিল সে।দু-আঙুলের ফাঁকে জলন্ত কাঠিটা গুঁজে চিঠি হাতে বারান্দায় গিয়ে বসলো সোম।


          প্রিয় সোম,


                   আজ তুমি প্রমাণ করে দিলে শুধুমাত্র ভালোবাসার জোরে কাউকে সারা জীবন বেঁধে রাখা যায় না। স্মার্ট, সুন্দরী এবং আধুনিকা হওয়াটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।আমি তোমাকে কোনদিন সুখী করতে পারি নি।তাই হয়তো তুমি নিজেই তোমার ভালো থাকার চাবিকাঠিটা খুঁজে নিলে।যাইহোক তুমি খুব ভালো থেকো,সুখে থেকো।তুমি ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকবো। কিন্তু তুমি ছাড়া আমার এই জীবনটা অসম্পূর্ণই রয়ে যাবে।তোমার নতুন জীবনের জন্য আমার অনেক শুভেচ্ছা রইলো।


         "ভালোবাসা ভালো থাকুক"!!!


                                                      ইতি:- 


                                                     তোমার মহুল


চিঠিটা শেষ করে অঝোরে কাঁদতে থাকে সোম।একদিন যে অবহেলায় চিঠিটা ফেলে রেখেছিল,আজ সেটা স্বযত্নে তুলে রেখে দিলো ডায়রীর প্রথম পাতায়।পরেরদিন সকালে মহুলের বাবার দেওয়া ঠিকানায় সোনারপুরের সেই মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে গিয়ে হাজির হয় সোম।রিসেপ্সানে গিয়ে মহুল বসু বলতেই রিসেপ্সানিস্ট তার কাছে জানতে চায়----আপনি কে হন মহুল বসুর?কিছুক্ষণ থম্ মেরে থেকে সোম বলে---আমার পরিচিত।একজন নার্স এসে সোম-কে নিয়ে যায় মহুলের রুমে।আজ প্রায় একটা বছর পর একে অপরের মুখোমুখি।কিন্তু সোম এটা কাকে দেখছে!এটা কী মহুল!নিজের চোখ কে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।একি চেহারা হয়েছে তার! যদিও মহুল কোনদিনই ডাকসাইটে সুন্দরী ছিল না, কিন্তু এক ঝলক দেখাতেই যে কারো মন কেড়ে নিতো।কলেজ জীবনে প্রথম দেখাতেই তো মহুলকে ভালোবেসে ফেলেছিল সোম।ধীর পায়ে মহুলের কাছে এসে দাঁড়ায় সোম।তার হাত দুটো ধরে বলে----আমি অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে।তোমার আজ এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী।আমাকে ক্ষমা করে দাও মহুল।তুমি বাড়ি ফিরে চলো।কিন্তু মহুল তাকে চিনতেও পারে না।সোমের কোন কথাই মহুল জেনো শুনতে পেলো না।খালি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো তার দিকে।মনে মনে কি একটা যেনো বিড়বিড় করতে লাগলো মহুল।স্পষ্ট শোনার জন্য সোম নিজের কানটা তার মুখের কাছে নিয়ে গেলো।তখনো মহুল আপন মনে বলে চলেছে---


             "ভালোবাসা ভালো থাকুক"!!!


সেদিনের পর থেকে সোমরাজের প্রতিটা ছুটির দিন কাটে সোনারপুরের ঐ মানসিক চিকিৎসা কেন্দ্রে।আজও একটা বিশ্বাসে ভর করে সোম সেখানে ছুটে যায়-----মহুল একদিন সুস্থ হয়ে উঠবে আর সেদিন সে তার সোম-কে ঠিক চিনতে পারবে।সেদিন হাসি-খুশি আর আনন্দে ভরে উঠবে তাদের ভালোবাসার........


                "বাবুইবাসা"!!! (ওদের ফ্ল্যাটের নাম)।


                               :সমাপ্ত: