#ভর#সায়নদীপা_পলমল
নাম - ভরকলমে - সায়নদীপা পলমল
ভীড় ঠেলে একটু এগোতেই কাদুকে দেখতে পেল পলান। এ কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার! কদিন আগেই তো দেখা করেছিল ওরা দু’জন, নিভৃতে কিছুটা সময় কাটিয়ে ছিল একসঙ্গে। তখনও তো সব স্বাভাবিক ছিল, তাহলে আচমকা এ…
#ভর
#সায়নদীপা_পলমল
নাম - ভর
কলমে - সায়নদীপা পলমল
ভীড় ঠেলে একটু এগোতেই কাদুকে দেখতে পেল পলান। এ কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার! কদিন আগেই তো দেখা করেছিল ওরা দু’জন, নিভৃতে কিছুটা সময় কাটিয়ে ছিল একসঙ্গে। তখনও তো সব স্বাভাবিক ছিল, তাহলে আচমকা এমন...! কাদুর দিকে ভালো করে তাকাল পলান; চোখ দুটো লাল, বিবর্ণ মুখ, ধুলোয় ধূসরিত চুল, জামাকাপড়ের অবস্থাও সঙ্গীন, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া ঠোঁটের দু’পাশ কষ গড়াচ্ছে অবিরত, কপালে ইয়া বড় সিঁদুরের তিলক। ওর দিকে এগিয়ে যেতে গেল পলান কিন্তু পেছন থেকে কারা যেন সব হইহই করে উঠল - “লাইনে দাঁড়াও...লাইনে দাঁড়াও…”
★★★★★
কাদু, পোশাকি নাম কাদম্বরী, তবে সে নামে তাকে আর কেউ ডাকেনা বিশেষ। কোনোকালেই ডাকতো না অবশ্য। গরীবের ঘরে পোশাকি নামের মান ইজ্জত থাকে না, তবুও দাদু শখ করে নামখানা রেখেছিলেন। দাদু আজীবন তাকে ওইনামেই ডাকতেন, দাদু চলে যাওয়ার পর আর কেউ ডাকে না। দাদু চলে যাওয়ার পর গ্রামের পাটও তাদের চুকে গেছে। গ্রামে সেবার কি যেন একটা কারখানা হবে বলল। বড় বড় গাড়ি করে কোট প্যান্ট পরা সব লোক এলো তারপর তারা গ্রামের মানুষদের অনেক কিছু বোঝাল। তখন কাদু অনেক ছোটো তাই বিশেষ কিছু বোঝেনি, তবে বাবাকে পরে প্রায়ই বিলাপ করতে শুনেছে এই বলে যে সেদিন যদি গ্রামের মানুষগুলো ওই শহুরে বাবুদের দেখে ভিরমি না খেতো তাহলে আবাদী জমিগুলো ঐভাবে কম পয়সায় হাতছাড়া হত না। এখন বাবার আয় বলতে এই মফঃস্বলের বুকে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুজোআচ্চা।
ক্যালেন্ডারে এখন আষাঢ় মাস, কিন্তু মৌসুমী বাতাসের বোধহয় মান হয়েছে তাই তার দেখা নেই এ’বছর। আষাঢ়ের ভোরেও ঘামে চুকচুকে হয়ে ব্রাশ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো কাদু। বাইরেও বিশেষ বাতাস নেই, তবুও ভোরের প্রকৃতির এক নিজস্ব স্নিগ্ধতা থাকে তাই ভোর বেলায় ঘরের বাইরে কিছুক্ষণ বসলে মনটা ভালো হয়ে যায়। কাদুদের টিনের চাল দেওয়া বাড়িটার একমাত্র বিলাসিতা বোধহয় ওদের ঘরের পাশে থাকা নিজেদের কুঁয়োটা। যদিও গ্রীষ্ম আসতে না আসতেই সে বোবা চাতক পাখি হয়ে যায়, তবুও তো নিজেদের জিনিস। আজ ঘুরতে ঘুরতে কি মনে হতে কুঁয়োর কাছে এসে ভেতরের দিকে একবার উঁকি মারল কাদু, আর তখনই দেখতে পেল তাকে। কালো চকচকে শরীরটাকে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে কুঁয়োর মধ্যকার একটা পাথরে। একটা ঢোক গিলল কাদু, কুঁয়োটা বিশেষ গভীর নয়, যে কোনো মুহূর্তে সে ওপরে উঠে আসতে পারে। মা বলে ওদের নাম নিতে নেই, তাই কাদু চিৎকার করে মাকে ডাকলো। মিনতি বেরিয়ে আসতেই ইশারায় তাকে জিনিসটা দেখালো কাদু। ছোটোবেলাতেই শহরে চলে আসায় সাপখোপ বিশেষ চেনেনা মেয়েটা, কিন্তু আদ্যন্ত গ্রামে মানুষ মিনতি তো ঠিকই চেনে --- এ যে সাক্ষাৎ মা মনসার পোষ্য! মা মেয়ের চিৎকারে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল রঘু মল্লিকও। তাকে দেখে মিনতি বলল, “মায়ের দূতকে তো অভুক্ত রাখা যায়না গো, কিন্তু আমরা কি দেবো? ঘরে যে কিছুই নেই…!”
মিনতির কথার জবাব দিলো না রঘু, এক দৃষ্টিতে কুঁয়োর দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবতে লাগল। অচিরেই তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি…
★★★★★
“কিরে পলান বলেছিলাম না তোর বউ এর উপর আজ চারদিন হল মা মনসা ভর করেছেন দূত পাঠিয়ে। নিজের চোখে এবার দেখছিস তো? ওই কুঁয়ার মধ্যে দেখ তিনি বসে আছেন।”
“চুপ কর। আমি এসব বুজরুকি বিশ্বাস করিনা, কিছু গন্ডগোল একটা নিশ্চয় আছে। এসব ভর টর বলে কিছু হয়না।”
“আহারে কি আমার এলেন পন্ডিত মশাই। মাধ্যমিক অবধি পড়ে নিজেকে খুব কেউকেটা ভাবছিস! তুই কি বলতে চাস এই যে সারা শহরের লোক ভেঙে পড়েছে এখানে, সেসব মিথ্যে? তারা সবাই অশিক্ষিত!”
“কিন্তু… আরে একি ওকে এভাবে কাঁচা দুধ খাওয়াচ্ছে কেন! আর ওই ফলগুলো ধুলোতে…!"
"সবই মায়ের ভোগ।"
"কিন্তু এসব খেলে ওর শরীর খারাপ করবে তো! সবাই কি পাগল হয়ে গেছে!"
“কি যে বলিস না তুই! মায়ের আশীর্বাদে কিচ্ছু হবেনা ওর দেখিস। এখন তো সাক্ষাৎ মা ওর শরীরে।”
“আরে তুই কেন বুঝছিস না, একে এই বীভৎস গরমে এভাবে সারাদিন বাইরে ও… আর ওই খাবারগুলো…!
এই কাদু কিরকম করছে না! ওর কি শরীর খারাপ করছে! কাদু… কাদু… এই প্লিজ আমাকে ওর কাছে যেতে দিন… প্লিজ… ওর মা বাবা কোথায়?”
দিনের শেষে বড় নোট খুচরো মিলিয়ে ভর্তি থলিটা মিনতির সামনে ফেলে রঘু মল্লিক গর্ব করে বলল, “দেখলে কেমন বুদ্ধিটা করেছিলাম? তিনদিনে এতো টাকা।”
“সত্যি তোমার কি বুদ্ধি গো। এই শহরে এসে দেখছি তোমার বুদ্ধিটা বেশ খোলতাই হয়েছে। সে সময়ও যদি এমন…" একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো মিনতির ভেতর থেকে।
ধমকে উঠল রঘু মল্লিক, "তোকে কতবার বলেছি না ও কথা আমাকে আর মনে করাস না। আমার বুদ্ধি কম ছিল না কিন্তু সব গ্রামের লোক যখন…"
"আহা ছাড়ো ওসব পুরোনো কথা", পরিস্থিতি সামাল দিতে বলে উঠল মিনতি, "এখন আমার কাদুও অভিনয়টা কেমন করছে বলো।”
“এই আস্তে আস্তে দেওয়ালেরও কান আছে। তা তোমার মেয়েকে আমি ধমক না দিলে সে রাজি হত কোনোদিন!” চোখ পাকিয়ে কথাগুলো বলল রঘু মল্লিক।
মিনতি কোনো জবাব দেওয়ার আগেই আচমকা একটা দমকা ঝড় উঠল আর ঘরের ভেতরে থাকা বাসনকোসনগুলো ঝনঝন শব্দে পড়তে লাগলো মেঝেতে। অন্যদিকে বাইরে তখন কালো মেঘের ঘনঘটায় আকাশের কোণে থাকা ম্রিয়মান সূর্যটা ঝপ করে গেল নিভে…
শেষ।