Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

জন্ম দিবসে শ্রদ্ধার্ঘ : উৎপল দত্ত

✍️সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
স্বভাবরসিক ছিলেন। প্রয়াত হওয়ার কিছুদিন আগে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ব্যক্তিগত চিকিৎসককে রসিকতা করে বলেছিলেন, মৃত্যু এলে যেন আগাম জানিয়ে আসে, অনেক কাজ যে এখনো বাকি রয়ে গিয়েছে! কাজের মানুষই তো ছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই। …

 



✍️সোমনাথ মুখোপাধ্যায়


স্বভাবরসিক ছিলেন। প্রয়াত হওয়ার কিছুদিন আগে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে ব্যক্তিগত চিকিৎসককে রসিকতা করে বলেছিলেন, মৃত্যু এলে যেন আগাম জানিয়ে আসে, অনেক কাজ যে এখনো বাকি রয়ে গিয়েছে! কাজের মানুষই তো ছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই। কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়াকে মজা করে বলেছেন, ষাট বছর পূর্ণ করলে বিপ্লবী আর বিপ্লবী থাকে না, প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যায়!

মৃত্যু এসেছে যথানিয়মে। ১৯৯৩র ১৯শে অগস্ট ৬৪ বছরে থেমে গিয়েছিলেন ফেরারি ফৌজের  'অশোক'। কিন্তু আজও অম্লান তাঁর অভিনয়। বর্তমান আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর রাজনৈতিক চেতনার বিচ্ছুরণ যেন বড়ো বেশি প্রাসঙ্গিক! নাটক চলতি সময়ের কথা বলে। কখনো আরো এগিয়ে বৃহত্তর ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়। পিএলটির একের পর এক মঞ্চসফল উপস্থাপনা সেই চলতি সময়ের কথা বলেছে বারবার।


প্রায়োগিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চেতনাকে সফলভাবে মঞ্চে উপস্থাপন করাই ছিল যে তাঁর বৈশিষ্ট্য। শিল্প ও শিল্পীর স্বাধীনতা যে আদতে সংস্কৃতির প্রবহমানতাকেই মান্যতা দেয়, তা নির্ভীকভাবেই তাঁর নাটকে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। পরবর্তী কালে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ছবিতে সফলভাবে অভিনয় করলেও, রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। ১৯২৯র ২৯শে মার্চ অবিভক্ত বাংলার বরিশালের কীর্তনখোলায় (মতান্তরে শিলং শহরে) জন্মানো এই ব্যতিক্রমী শিল্পী নীরবে পার করে দিলেন তাঁর বিরানব্বইতম জন্মদিন। তিনি উৎপল রঞ্জন দত্ত। সংক্ষেপে উৎপল দত্ত।


আদ্যন্ত বামপন্থী উৎপল দত্ত। নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক, গবেষক একাধারে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাক্তিত্ব।

তাঁর নাটকে সমকালীন বিষয়কে টেনে এনেছেন বারবার। দেখিয়েছেন তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্র। বদলে যাওয়া অর্থনৈতিক অবস্থা, বদলাতে থাকা সামাজিক মূল্যবোধ তুলে এনেছেন টিনের তলোয়ার, ফেরারি ফৌজ, কল্লোল, জনতার আফিম প্রভৃতি নাটকে। ইতিহাস আশ্রিত নাটক তিতুমীর, লাল দূর্গ, রাইফেল ধাক্কা দিয়েছে জনমানসে। প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছে সাধারণের রাজনৈতিক চেতনাকে। ভাবতে শিখিয়েছে শ্রেণী সংগ্রামের পথে কেমন করে অধিকার বুঝে নিতে হয়! কেমন করে ক্ষমতার বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া খাড়া রেখে প্রশ্ন করতে হয়!


গিরিশচন্দ্র ঘোষ থেকে দীনবন্ধু মিত্র, দ্বিজেন্দ্রলাল হয়ে রবীন্দ্রনাথ, রাজনীতিকে উপেক্ষা করেননি কেউই। কিন্তু সরাসরি রাজনৈতিক মতাদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পে প্রয়োগ সফলভাবে করে দেখিয়েছেন উৎপল দত্ত। আজীবন বিশ্বাস করতেন যে রাজনীতি বিবর্জিত নাটক হয় না। শাসকের রোষে পড়ে কারাবাস করেছেন কিন্তু অবিচলিত থেকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী কন্ঠস্বর তুলেছেন। সামাজিক নিপীড়ন-নিস্পেষণের বিরুদ্ধে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলেছেন এই সফল নাট্যব্যক্তিত্ব। গণনাট্য আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী উৎপল দত্ত তাঁর পথ নাটিকা, যাত্রাপালা ও পূর্ণাঙ্গ নাটকে সময়ের নিরিখে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও বাক স্বাধীনতার পক্ষে সোচ্চার হওয়ার হিম্মত দেখিয়েছেন।


অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী মানুষটি শেক্সপিয়ার, কান্ট, হেগেল, মার্ক্সীয় সাহিত্য, দর্শন ও চিন্তাধারার মিশেল ঘটিয়েছেন তাঁর সৃষ্টিতে। সঙ্গে বাখ, বেঠোফেনের সংগীত মূর্ছনার মেলবন্ধনে সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক মঞ্চসফল কালজয়ী উপস্থাপনা। হয়তো ভূমিকা পালন করেছেন পথ প্রদর্শকের, শিক্ষকের! চেষ্টা করেছেন নতুন ভাবে দেখার চোখ, নতুন ভাবে বোঝার মন তৈরি করতে। কলকাতার সাউথপয়েন্ট স্কুলের প্রাক্তন ইংরেজি শিক্ষক উৎপল দত্তের অভিনয় সত্তা ছিল একেবারেই আলাদা। নাটক বা সিনেমায় সিরিয়াস, কমেডি, সিরিও-কমিক, ভিলেন যে কোনো চরিত্রে ছিলেন সাবলীল। সত্যজিত রায়ের হীরক রাজা, আগন্তুকের মণিমোহন বা ১৯৯৩তে গৌতম ঘোষের পদ্মা নদীর মাঝির হোসেন মিয়া অমর চরিত্র। হৃষীকেশ মুখার্জী পরিচালিত হিন্দি সিনেমা গোলমালের ভবানীশংকর আজও দর্শক মনে উজ্জ্বল। শেক্সপিয়ারের ওথেলো নাটকে তাঁর অনবদ্য চরিত্রায়ন অভিনয় জীবনের মাইলফলক। কে ভুলবে সপ্তপদীতে উত্তম কুমারের লিপে ওথেলোর ব্যারিটোন ভয়েসের সংলাপ! এমনই বৈচিত্রের মধ্যে ব্যতিক্রমী ছিলেন উৎপল দত্ত।


'রাইফেল' হাতে 'ফেরারি ফৌজ'- এর প্রাসঙ্গিক পদচারণা হয়তো ভুলতে চলেছে বাঙালি! গণতন্ত্রের মহোৎসবে উৎপল দত্তেরা থেকে যাবেন বিস্মৃতির অন্তরালে! তাতে কার কী আসবে যাবে? ছদ্ম জাতীয়তাবাদের আফিমে বুঁদ

আত্মবিস্মৃত বাঙালির টুপিতে আরো একটি পালক যুক্ত হবে মাত্র!