Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

"মাঞ গো ইবার যাবই সারহুল পরবে"

"মাঞ গো ইবার যাবই সারহুল পরবে"
গৌতম মাহাতো, মেদিনীপুর
আজ যেখানে এসে পৌঁছলাম এটা উড়িষ্যার লাগোয়া একটি গ্রাম। এর আগে বহুবার এসেছি এখানে কিন্তু বিগত ক-বছরের মধ্যে এর চেহারাটাই পাল্টে গ্যাছে। একটা চেকনাই ব্যাপার চট করে নজরে আ…

 


"মাঞ গো ইবার যাবই সারহুল পরবে"


গৌতম মাহাতো, মেদিনীপুর


আজ যেখানে এসে পৌঁছলাম এটা উড়িষ্যার লাগোয়া একটি গ্রাম। এর আগে বহুবার এসেছি এখানে কিন্তু বিগত ক-বছরের মধ্যে এর চেহারাটাই পাল্টে গ্যাছে। একটা চেকনাই ব্যাপার চট করে নজরে আসে। আসলে একটা দেহাতি মানুষ হঠাৎ করে স্যুট পরে নিলে য্যামোন একটা অকথিত অস্বস্তি চোখে মুখে ফুটে ওঠে অনেকটা তেমনই মনে হয়। এই অঞ্চলে মূলত লোধা আদিবাসী ও কুড়মিদের বসবাস বেশি। এখানের ভাষার মধ্যেও একটা ব্যতিক্রমী ব্যাপার লক্ষ্যনীয়। কেউ কেউ এই ভাষার নাম দিয়েছিলেন  সুবর্ণরৈখিক ভাষা তবে এখানকার মানুষ এই ভাষাকে হাটুয়া ভাষা হিসেবেই জানে। সব জনজাতির ওপরই এই হাটুয়া ভাষার অল্পবিস্তর প্রভাব পড়লেও সংস্কৃতিগত রীতি রিওয়াজে আগ্রাসনটা অন্যান্য জায়গার মত অতটা প্রকট নয়। 


     ঘনজঙ্গল জুড়ে মহুল শাল পিয়ালে ঘেরা একটা আলাদা দেশ। য্যানো ভারতের ভেতর এ এক নতুন ভারতবর্ষ। তবে আগের মত পলাশ আর তেমন চোখে পড়ে না। নদীটিও ক্যামোন ক্ষীণাঙ্গী। তবে পাখিরা আজও বাতাসে ভর করে। বাবুইএর ঝোপে সড়াৎ করে সরে পড়ে দু একটি খ্যাঁকশেয়ালের পরিবার কিম্বা কোয়েল বা তিতিরের ছা। আহা গো গ্রে ফ্র্যাংকোলিন, তোমার দেখা পেলে কাকা যে কি যারপরনাই খুশি হত সে আর বলি কি ভাবে!


     সে যাক যা বলার সেই মোদ্দা কথায় আসি।


   রাঢ় বাংলার আপামর আদিম কুড়মি জনজাতির বারো মাসের তেরো পার্বণের ((আইখান, সিঝান, সারহুল, গাজন, রহৈন, আমাবতী/রজঃস্বলা, বারি/ জাঁতাল, করম, জিতুয়া, ছাতা, জিহুড়, বাঁদনা, মকর)) একটি পরব হল সারহুল। কুড়মালি দিনপঞ্জি অনুসারে বিহামাসের(ফাল্গুন) পর আসে চৈতমাস(চৈত্র)। এই পুরো চৈতমাস জুড়েই পালন করা হয় সারহুল পরব। তবে আনুষ্ঠানিক রীতি রিওয়াজ সম্পন্ন হয় স্থানানুপাতে(মূলত শনি বা মঙ্গলবার)।




       এই পরবের প্রধান লক্ষ্য হল নতুনের আবাহন ও তার তারুণ্যের স্বীকৃতি। প্রকৃতি এই সময় নবরূপে সজ্জিত হয়। জঙ্গল জুড়ে শাল মহুলের নতুনরূপ আজ আর গ্রাম বাংলায় শুধু নয় নগরকেন্দ্রিক সভ্যতাকেও আলোড়িত করে পলাশের লালিমা। সমগ্র কিশোর-কিশোরী থেকে প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া কেউই এই নবরঞ্জনের থেকে ব্রাত্য নয়।

      তবে এই পরব মূলত আদিম কুড়মি জনজাতিদের প্রথম তিনটি পরবের একটি। এটা নতুন তারুণ্যকে আবাহন। অনেকের মতে শাল গাছে নতুন ফুল(শালৈ) এলেই এই পরবের তোড়জোড় শুরু হয়। আবার কারুর কারুর মতে বিহামাসের পর নবদম্পতি যাতে প্রকৃতির নবরূপ নিজেদের মধ্যে শরীরে তথা মনে ধারণ করতে পারে তারই একটা অন্তর্নিহিত পদ্ধতিমাত্র। সৃষ্টির প্রারম্ভকে আগামি প্রজন্ম যাতে পরম্পরাগত ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে তারই এক অনন্তর পদ্ধতি।


        জনজাতিদের কোনকিছুই লিপিবদ্ধ নয় বরং বলা ভালো পরম্পরা কেন্দ্রিক। তাঁরা মনে করেন যা কিছু সৃষ্টির নিয়ন্ত্রানাধীন সে সবই তাদের আপনজন, কুটুমজন।পরে সেটাই উদ্ধৃত হত "বসুধৈব কুটুম্বকম"। একটা বিশ্বভাতৃত্ব বোধ।

        এই সারহুল সম্পন্ন হয় গরাম থানে। এখানেই কুড়মি জনজাতির সর্বশক্তিমান বুঢ়াবাপের অধিষ্ঠান। পুরোনো গাছের গোড়ায় দেহরি (পুজারি) স্নান করে এসে নতুন বস্ত্রে ৯ উপাস্যের উদ্দেশ্যে এক পায়ের ওপর বসে অন্য পা মুড়ে সিঁদুর ও শালৈফুল নিবেদন করে।এই নয় উপাস্য হল - বুঢ়াবাপ(সর্বশক্তিমান), মহামাঞ(আদিসৃষ্টির দেবী),বানসিন(জলদেব), ধরম(নৈতিকতার দেবতা), বঙা, চাঁদরায়(ক্ষণ নির্ধারক), গঁসাইরায়, গরামঠাকুর ও বাকহুত(বায়ুদেব)। নৈবেদ্য হিসেবে থাকে এই সময়ের জাত ফুল-ফল-মূল যেমন- আম মহুল শালৈ ইত্যাদি। সাথে কৃষিজ ফসলের কিছু কিছু যেমন আতপচাল,ধান,দুর্বা,আখের গুড়, গম বা ছোলার ছাতু প্রভৃতি।



         গ্রামের ছোটদের জন্য বরাদ্দ হয় নতুন জামা প্যান্ট। বড়রা ধুতি গেঞ্জি। সবাই ভক্তিতে ভর করে জমা হয় থানে। মেলা বসে ছোলা সিঝা(ছোলা সেদ্ধ), ঘুগনি, পকোড়ি ঝিলাপী ডাইল ভাজা। বারভাজা। এছাড়াও পেয়ে যাবেন বেলুন ফিরফিরি, পেঁপতি, চঙা, চেড়চেড়ি। এই দিন গাঁয়ের সব ঘরেই মাস ভাত। আজ সবাই সমান সাম্যবাদের মুখোমুখি দাঁড়ায় এইদিন এসে সারহুল স্বয়ং।