: 💘'এবং দ্বিতীয়'(6)অর্পিতা কামিল্যা
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষায় বন্যার পরিবারের সদস্যরা।পরিচিত গন্ডির বাইরে শুধুমাত্র রনি। এতোক্ষন রনির সাথে বন্যার বাবার পরিচয় করা হয়ে ওঠেনি। বারংবার দেখেছেন তিনি, ছেলে টি সব ক…
: 💘'এবং দ্বিতীয়'(6)
অর্পিতা কামিল্যা
অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষায় বন্যার পরিবারের সদস্যরা।পরিচিত গন্ডির বাইরে শুধুমাত্র রনি। এতোক্ষন রনির সাথে বন্যার বাবার পরিচয় করা হয়ে ওঠেনি। বারংবার দেখেছেন তিনি, ছেলে টি সব কাজে সবার আগে এগিয়ে আসছে সাহায্য করতে--
"তুমি কে,চন্দনের বন্ধু"?-বন্যার বাবা মিস্টার সাহা বললেন।
"আ -আ -আমি? মানে- আমি রনি"
"বাবা, ও রনি, কনিকা আমার বান্ধবী ও তার ভাই। আমাদের সাথেই তো গিয়েছিল, ও খুব হেল্পফুল"
---বন্যা।
অতি অল্পতেই খুশী রনি,এই টুকু প্রশংসায় তার অন্তরের অভিযোগ গর্জন আর ঝড়ের তাণ্ডব, সাইক্লোনের লীলাভূমি রনির উচাটন মন, নিমেষেই শান্ত হয়ে গেলো।
"অপারেশনটা সাকসেসফুল হবে ,ডোন্ট ওরি
আমি বলছি"।--রনি।
রনির দেওয়া ভরসার ঝাপটা বাতাস, বন্যার জংধরা তালা ঝম করে খুলে দিয়ে গেল। বন্ধুত্ত্ব বা ভালোবাসার চাবিগোছা দিয়ে।
কয়েক ঘন্টা পর, অপারেশন সাকসেসফুল।কিন্তু প্রায় আগামী কয়েক মাস চন্দনকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। বন্যার সাথে চন্দন কথাও বললো। যাক খানিকটা সময়ের জন্য একটু স্বস্তি ফিরে এলো।
"রনি?তুমি তো কিছু খাওনি? আর আমার ও খাওয়া হয়নি, চলো কিছু একটা খেয়ে আসি,খুব খিদে পেয়েছে।"---বন্যা।
"হ্যাঁ চলো,খুব খিদে পেয়েছে"--রনি ।
লাখো লাখো ভালোলাগার অনুভূতি উঁকি মারে রনির মনের ঘরের ভিতর, রনির চোখ হয় আবেগে আপ্লুত প্রায় । শুধু মাত্র এইটুকু কথা বার্তায় যেন কোন দেশের প্রেমের হাওয়া এসে বিষাক্ত বিষাদ উড়িয়ে নিয়ে গেলো। ছোট্ট রেস্টুরেন্টে এক টেবিলে রনি ও বন্যা। রনির কাছে এটা যেন একটা ফার্স্ট ডেটিং। ভালোবাসার আবেগে রনির চোখ হলো ঝাপসা, রাতের অন্ধকারকে ও হার মানায় সেই প্রেম আবেগ ঝাপসা। দারুণ বাস্তবতা একদম ঝাঁকুনি দেয়না রনিকে । চোখ রগড়ে কিছুই দেখেনা রনি, শুধু মাত্র বন্যাকে ছাড়া, আর তার জগত সংসার, জীবন, কেরিয়ার সব যেন দারুণ অবহেলায় আজ ধ্বস্ত বিধ্বস্ত। রনির কাছে বন্যা রঙিন চাবিগাছি। হৃদয়ের রহস্য যেন আপাতত বিমূর্ত থেকে প্রকাশিত তালা খোলা সিন্দুক।
খাবার খেয়ে ফিরে আসার পথে,রনির মা এর ফোন, বাড়িতে ফিরতে বলছে তার মা।কিন্তু রনির বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না।
" এক সাথেই ফিরবো সবাই।এখানে তেমন কেউ নেই ,একজন এক্টিভ মানুষ থাকা দরকার।" --রনি।
"তুমি ফিরে যাও,আমি সব সামলে নেবো,বিপদ অনেটাই কেটে গেছে।"--বন্যা।
"তোমাকে ছেড়ে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।"
---রনি।
"রনি, তুমি কেন এমন করছো বলোতো?অবাস্তব কান্ড কারখানা তোমার। আমি তোমাকে খুব জোর ভালো বন্ধু ভাবতে পারি,তার চেয়ে বেশী আর কি! হ্যাঁ! এবার এসব বন্ধ করো।"---বন্যা।
" কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি বন্যা, তোমার জন্যে আমি সব করতে পারি।যে কোনো মুহুর্তে তোমার জন্যে জীবন দিতে পারি।"--রনি।
কথা বলতে বলতে নার্সিংহোমে পৌঁছে গেলো ওরা। ওখানে চন্দনের মা ও বন্যার বাবা ওয়েটিং রুমে বসেছিলেন। কথা হলো নার্সিং হোম কতৃপক্ষের সঙ্গে,চন্দনকে এখনই নার্সিং হোম থেকে ছুটি দেবেনা। আরও বেশ কয়েকটি দিন লাগবে। পেশেন্ট পার্টি কে তাহলে প্রতিদিন যাওয়া আসা করতে হবে বাড়ি থেকেই ।শুধুমাত্র ভিজিটিং আওয়ার্সে পেশেন্ট ভিজিট করতে পারবে। তাই চন্দনকে নার্সিংহোমে রেখে সবাই বাড়ি ফিরে এলো।
রনিও নিজের বাড়ি ফিরে গেলো। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে রনির শয়নে স্বপনে নিদ্রা জাগরণে শুধুই বন্যা । বার বার বন্যা কে মেসেজ করে, কল করে, গান গেয়ে গেয়ে পাঠায়, আর ওদিকে বন্যা খুব ব্যস্ত। অসুস্থ স্বামী তার ফার্স্ট প্রায়োরিটি। নার্সিংহোম থেকে ফিরে, বন্যার কারোর মেসেজ দেখার সময় নেই!
প্রথম দু একদিন বন্যার কাছের আত্মীয় স্বজন বন্যার সাথে চন্দনকে দেখতে গেছে কোলকাতায়। কিন্তু রোজ রানাঘাটের থেকে কোলকাতায় আসা খুব সমস্যা হচ্ছে। তাই ঠিক হলো বন্যা কোলকাতায় নার্সিং হোমের কাছাকাছি কোন একটা রুম রেন্টে নেবে। একটি লেডিস মেসে বন্যা নিজের জন্যে রুম ঠিক করলো। কোলকাতায় পড়াশোনা করা মেয়ে বন্যা, কোলকাতায় বেশ কয়েক বছর ছিলো, কোলকাতার মোটামুটি অনেক টাই জানাশোনা তার।
এদিকে বন্যা কোলকাতায় গেছে শুনে, রনি ও অজুহাত খুঁজে বের করার চেষ্টা করে কিভাবে কোলকাতায় এসে থাকবে। কিন্তু এবার -রনির মা অঞ্জলী আন্টী -রনির এই অস্বাভাবিক আচরণে অবাক হয়ে যেতে থাকেন। হাজার হোক মা তো , ছেলের মতি গতি একটু হলেও টের পেয়ে যান তারা। যাইহোক ভাগ্যের সহায়তায় রনি একটা অজুহাত খুঁজে পেলো--
"কোলকাতায় একটা ব্যান্ড কনটেস্ট হচ্ছে,ওখানে সমস্ত ছোট ছোট ব্যান্ড গুলো পারফর্ম করবে। আমি ও যাবো ,আমাদের ব্যান্ড টা ও পারফর্ম করবে।"--রনি।
"না , এই তো ঘুরে এলাম,একটু চাকরি বাকরির চেষ্টা কর না 'হুলো', গীটার বাজিয়ে কি হয়! এসব পাগলামি বন্ধ কর এবার।"--রুঢ় গলায় অঞ্জলী দেবী বললেন।
" মা,ওখানে রূপম ইসলাম থাকবে, এজ আ জাজ, বাংলাদেশের 'অসমাপ্ত' টীম আসছে। ফসিলস এর ওরা থাকছে ,এতো বড় একটা ইভেন্ট, তুমি বারন করলেও আমি যাবো,আমাকে যেতেই হবে মা।
কারণ-- আমার একটা দায়িত্ব আছে"--রনি।
মাঝরাতে মায়ের সাথে অশান্তি করে,রনি কি দায়িত্ব বোঝাতে চাইছিলো রনি খুব ভালো করে জানে।বন্যার প্রতি রনির ভালোবাসার দায়িত্ব।বন্যার দেখা পেতে হবে। বন্যা কে না দেখে রনি থাকতে পারছে না, মোদ্দাকথা সেটা।ব্যান্ড কনটেস্ট একটা বাহানা মাত্র।
কোলকাতায় ব্যান্ড পারফরম্যান্সে রনির ব্যান্ড 'স্পেশি' খুব ভালোই পারফরম্যান্স করলো। রনি মেইন ভোকাল। তদুপরি গীটারিস্ট। রনির অন্য স্যাঙ্গাৎ দের কাছে এটা একটা বিগ এচিভমেন্ট। কিন্তু রনি!নৈব নৈব চ।ঐ একটি গানই জানে সে বন্যার জলে ভেসে যায় দিন রাত, মানে বন্যার প্রেমে হাবুডুবু খায় প্রতিদিন- প্রতিনিয়ত। পারফরম্যান্স শেষে রনি তার বন্ধুদের ছেড়ে বন্যার সাথে দেখা করতে গেলো। চন্দনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ টুকু সেরে বন্যা কোথায় থাকে নাড়ি নক্ষত্র জেনে নিলো।
বন্যা নার্সিংহোম থেকে ফিরছে,সঙ্গে আছে রনি।
"আমি ও একটা রুম ঠিক করেছি,পেয়িং গেস্ট থাকবো, তোমার মেসের কাছাকাছি"--রনি ।
"সেকি কেন? তোমাকে কোলকাতায় থাকতে হবে কেন? তোমার ইভেন্ট তো শেষ,বাড়ি ফিরবে না?---বন্যা।
" আমার বেশ কয়েকটি ওয়াকিং ইন্টারভিউ দিতে হবে। একটা ট্রেনিংয়ে ডেকেছে । কতোবার আর বাড়িতে যাবো আসবো। এখানেই থাকি।"---রনি।
"ঠিক আছে তুমি থাকো,তোমার মতো, আমার সাথে কোনো যোগাযোগ রেখো না আর।"---বন্যা।
"আমি কিন্তু তোমার জন্যই কোলকাতায় এসে থাকছি বন্যা, বাকি সব কিছু আমার বাহানা"---রনি।
"আমি জানতাম, তুমি এমনই কিছু একটা করতে পারো, তুমি কেন এমন করছো রনি! আমি তো তোমাকে কোনো দিনও বলিনি যে আ আ আমি তোমাকে ভালোবাসি!- তাহলে?"---বন্যা।
"কেন ভালোবাসো না আমাকে?আমি কোন দিক থেকে খারাপ? হ্যাঁ?কত মানুষ কত কিছু করে! আর তুমি আমাকে একটু ভালোবাসতে পারো না?"---রনি।
"না ভালোবাসতে পারিনা, প্রেমের একটা পরিনতি থাকে,সেটা কে বিয়ে বলে। আমাকে বিয়ে করতে পারবে?তোমার মা, তার একমাত্র ছেলের জন্যে একটা বিবাহিত মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেবে? আচ্ছা বলোতো রনি, আমিই কি তোমার যোগ্য ? তুমি একটা ইয়াঙ্গ ছেলে! কতো ভালো ভবিষ্যৎ তোমার, যাও বাড়ি ফিরে যাও রনি,ফিরে যাও"---বন্যা।
(কাঁদতে কাঁদতে) "আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবোনা বন্যা, কি করে বাঁচবো বলো? শোনোনা তুমি যা বলবে, আমি তাই করবো,তোমার সব কথা শুনবো, স অঅঅঅঅ ব। শুধু আমাকে একটু ভালোবাসবে,একটু ভালোবাসো,প্লিজ"।
--রনি কথা গুলো বলতে বলতে বন্যার হাত ধরতে গেলো।
"রনি!বি হ্যাভ ইউর সেল্ফ, আমার একটা সন্মান আছে, আমি একটা বাড়ির বৌ। চন্দনের সাথে আমার ছয় বছরের সম্পর্ক। সব সম্পর্কের একটা দায়িত্ব থাকে।চন্দন আমার স্বামী, রনি তুমি কি জানো না স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন?"--- বন্যা।
স্বামী অসুস্থ হয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি, আর রাস্তার মাঝে রনির একটা আধ পাগলের মতো প্রলাপ, বন্যার ক্রমেই অসহ্য লাগতে শুরু করলো।
"আমি মেসের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশীক্ষন থাকবো না।তোমাকে আমি শেষ কথা বলে দিলাম। তুমি তোমার মতো থাকো,আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও।"---বন্যা।
"ছেড়ে দেবো?আ আ আমি তোমাকে ছেড়ে দেবো? কি করে ছাড়বো? তোমার জন্যে আমি আবার ও বাঁচতে পারছি! আমি ড্রাগ নেওয়া স্টপ করেছি, ইউ নো দ্যাট,আমার বন্ধুরা আজ পার্টি করছে,আর আমি তোমার কাছে এভাবে--!"-----রনি।
"রনি, পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে বন্ধু ছাড়া আর কিছুই ভাবিনি কোনো দিন।
যাও ফিরে যাও, আর নেশার ওষুধও খেয়ো না।আমি মাঝে মাঝে তোমার খোঁজ খবর নেবো,কিন্তু সেটা একজন বন্ধু হিসেবে। ঠিক আছে।"
---- একটু নরম সুরে বন্যা বললো।
বন্যা মেসের গেট খুলে ভিতরে ঢুকে গেলো। আর গেট বন্ধ করার ধড়াম করে আওয়াজটা যেন সোজা রনির বুকে ধাক্কা মেরে রনিকে একটা বাস্তবের সমুদ্রে ফেলে দিলো। পিঠে গীটার, বুকে স্কাইব্যাগ, একগাদা পকেট ওলা একটা প্যান্ট,তাতে একটা ঢাউস মোবাইল,একটা কালো রঙের প্যান্টেরা টি শার্ট পরে রনি! হেরে যাওয়া রনি! পাগল ছেলে রনি! ক্ষত বিক্ষত রনি!
সন্ধ্যায় রনি, কোলকাতায় যেখানে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকার কথা , ওখানেই এলো। বন্ধুদের ও ফোন করে ডাকলো রনির ওই বন্ধুরা প্রায় বেশির ভাগই এডিক্টেড। আর তাই আবার ও শুরু হলো ড্রাগ সেবন যজ্ঞ। এবার আর শুধু ট্যাবলেট নয়।এবার একেবারে 'কুবুকু' । সেটি একটি বিশেষ ধরনের ড্রাগ, অনেক টা গাঁজা জাতীয়।বা গাঁজার মতো করেই খায়। নেশার ঘোরে রনির মাথা থেকে দারুণ লিরিক্স বেরোয়, রনি গাইতে থাকে---
" ও ও ও আমার নেশার কারন,
কেন আজ তুমি ই অকারণ।
তোমার নেশায় পড়ে আজ
আমি পাগলা দিওয়ানা।
ভবঘুরের মতো আজ
আমি হারাই আমার ঠিকানা।
তোমার মতো থাকো তুমি ,
আমার খবর নিও না।
তবু পড়ে থাকবো আমি
শুধু তোমার আঙিনায়।
থাকবো তোমাকে ছাড়া
এমন তো কথা ছিলো না।
আমার ঘরে এখন ধোঁয়া ছাড়া কিছুই থাকে না
মরি আমি,বাঁচি আমি, তোমার যায় আসে না।
আমার সব টুকু দিয়ে তোমায় ভালোবাসলাম।
তবু তুমি ভালোবাসলে না।ভালোবাসলে না। না না --আ আ আ।
নেশা নেশা আয় আয় আমাকে নিঃস্ব করে দে।
শেষ করে দে আমাকে আমি পাগল হয়ে যাই।
আমি মরে যাই।
আমার সব টুকু তুই আর তুই।তোকে ছাড়া আমি মরে যাই---
নেশা আয় ,একশো বার আয়।--হাজার বার আয়। লাভ মি মাই লাভ ,লাভ মি ইউ নেশা--শুনে নে এক পৃথিবী প্রেম দিয়ে মুড়বো তোকে।
কাম অন বেবি লাভ মি। নেভার লেট মি গো,ডোন্ট টেইল ইউ লাই ,কাম অন বেবি, লাভ ইউ ম্যাড লি ,বেবি লাভ মি ফর এভার, ইউ নে-এ এ এ এ -শা"।
এভাবেই নেশার ঘোরে বক বক করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে রনি । ঘুমের অন্ধকারে রনির দুই চোখ ,একটা এডিক্টেড মানুষের ,এভাবেই জীবনের সবটা অন্ধকারে তলিয়ে যায় হয়তো!
সকালে উঠে বন্যা যথারীতি ভিজিটিং আওয়ার্সে চন্দনের সাথে দেখা করতে যাবে ।ফল,বিস্কিট, ও বাকি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে নার্সিংহোমে পৌঁছে গেলো। নার্সিং হোমের রিসেপ্শন থেকে বললো--চন্দনের সাথে দুই জন দেখা করতে এসেছে। ওরা উপরে গেছে চন্দনের কেবিনে। ওরা নীচে নেমে এলে তারপর যেন বন্যা উপরে যায়।বন্যা
খুব আশ্চর্য হলো! চন্দনের সাথে আজ তো কারোর দেখা করার কথা নেই।তাছাড়া যারা দেখা করতে আসবে,সবাই আগে বন্যা কে ফোন করে,তারপর দেখা করে চন্দনের সাথে। তাহলে এরা কারা! হয়তো অফিসের কলিগ বা চন্দনের পুরোনো কোনো বন্ধু হবে।কিন্তু কার কাছে খবর পেলো!
বন্যা বসে ছিলো নার্সিং হোমের ওয়েটিং রুমে। এমন সময় একটি মহিলা এবং একটি বাচ্চা মেয়ে লিফট্ দিয়ে নীচে নেমে এলো। তারপর রিসেপ্শন এ বললো সে নাকি মিস্টার চন্দন সেনকে রোজই দেখতে আসবে, মহিলাটি প্রায় তিরিশোর্ধ হবে, ঐ চন্দনের সম বয়সী বলা যায়, গায়ের পোশাক আশাক সব বিদেশি ব্রান্ডের, কথা বার্তায়,চাল চলনে মহিলা টির আভিজাত্যের ছাপ। বাচ্চামেয়েটিও খুব মিষ্টি।
বন্যা থাকতে না পেরে তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা করলো-
"আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না! চন্দনের সাথে দেখা করতে আসবেন, এমন সবাই কে মোটামুটি আমি চিনি, কিন্তু আমি আপনাকে চিনতে পারলাম না"--- বিনয়ের সাথে বন্যা বললো।
"আমি কে,সেটা না তোমার না জানাই ভালো "।
রুক্ষভাবে মহিলা টি বললো।
"মানে! আমার হ্যাজব্যান্ড কে দেখতে এসেছেন, আর আমিই জানবো না! কে আপনি? --বন্যা।
"তোমার হ্যাজব্যান্ড ! তাহলে ওকেই জিজ্ঞেস করো না,আমি কে!"--মহিলা টি।
( ক্রমশ)
💘'এবং দ্বিতীয়'(7)
অর্পিতা কামিল্যা
"আপনি কে, সেটা আপনি নিজে বলতে পারবেন না বুঝি! এর জন্যে অন্য একজনের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিচ্ছেন?আর আমার হ্যাজব্যান্ডকে কেন বলতে হবে, যে আপনি কে!--বন্যা।
"দায়িত্ব ! অধিকার দেখিয়ে যার উপর তোমার এতো খবরদারি ,সেই তাকেই কি তুমি পেতে! যদি না,আমি উদারতা দেখাতাম"--মহিলা টি।
"কি সব আবোল তাবোল বকে চলেছেন তখন থেকে! নেহাত ভিজিটিং আওয়ার্স পেরিয়ে যাচ্ছে, নাহলে আপনার কথার উপযুক্ত জবাব দিয়ে দিতাম, সময় নিশ্চয় আসবে পরে, তখন কথা হবে"---বন্যা।
এরপর বন্যা তাড়াতাড়ি লিফট্ ধরে সোজা চন্দনের কেবিনে চলে এলো, এসে যেমন রোজ কথাবার্তা বলে, ফল টল কেটে খাওয়াতে থাকে , ঠিক তেমনটা করতে থাকলো। এভাবে কুড়ি পঁচিশ মিনিট কেটে যাওয়ার পর বন্যা, চন্দন কে নীচে দেখা হওয়া অপরিচিত মহিলাটির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলো।
চন্দন একটুও থতমত খেয়ে যায়নি, উপরন্তু মনে হলো মানসিক দিক থেকে একটা প্রস্তুতি নিয়ে ভেবে রেখেছে কিছু বলার জন্য তাই ধীর স্থির ভাবে বন্যা কে বলতে থাকলো--
"ও তো অন্বেষা,আমার ক্লাসমেট,আমরা একসাথেই ইন্জিনিয়ারিং পাশ করি"---চন্দন।
"কিন্তু ওর কিছু কথা বার্তা ,কেমন যেন একটা অদ্ভুদ"--বন্যা।
"হ্যাঁ ও ঐ রকমই একটু ,রগ চটা ,বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়েতো"--চন্দন।
"বড়লোক তো কি হয়েছে! নিজেকে কি মনে করে?এতোদিন কোনো যোগাযোগ নেই, ফোনাফুনি নেই, হঠাৎ ধুমকেতুর মতো হাজির, আশ্চর্য!"---বন্যা।
"এতোদিন বিদেশে ছিলো, কোলকাতায় আগে যেখানে জব করতাম ,ওখানে আমার অফিস কলিগ প্রিয়াঙ্কা, সে অন্বেষার ফ্রেন্ড, ঐ অন্বেষাকে আমার এক্সিডেন্টের খবরটা দিয়েছে"--চন্দন।
"তো, ও হলো তোমার পুরানো বন্ধু, প্রেমিকাতো আর নয়, এমন একটা ভাব করছে যেন তোমাকে কিনে নিয়েছিলো"---বিরক্ত হয়ে বন্যা বললো।
"কেন ও তোমাকে কি বলেছে!"--চন্দন।
"ও নাকি খুব উদার, তাই তোমাকে দিয়ে দিয়েছে , আমি নাকি তাই তোমাকে পেয়েছি, তুমি ভাবো! জাস্ট একবার ভাবো! এতো টেনশনের মধ্যে এই সব অবান্তর কথাবার্তা কার ভালো লাগে!--বন্যা।
" অন্বেষা খানিকটা নিজের মতো করে ভেবে নেয় সব কিছু ,সব দিনই এমন। নিজে যেটা বলবে বা ভাববে সেটাই সঠিক মনে করে, সব সময়। তাই বলছে মনে হয় কিছু কিছু অবান্তর কথা !
(একটা ঢোঁক গিলে আবারো বলতে থাকে)--কোনো দিন তোমাকে বলা হয় নি, ওর কথা , আমার একটা অতীত আছে ঐ অন্বেষাকে ঘিরে, এমনকি আমার মা, দিদি কেউই জানে না। তাই তোমাকেও ইচ্ছে করে বলিনি, বাড়িতে পুরানো কথা আলোচনা করে বর্তমানের সুন্দর সময়গুলো নষ্ট করতে চাইনি।
আসলে নিজেরও কিছু বোকামি ছিলো -- (আবার ও একটু দম নিয়ে চন্দন বলে) --আর এই সব কথা গুলো বলার জন্যে একটু সময় লাগে, প্রয়োজনীয়তা লাগে, সেটাও আমার নেই, তুমি তো জানো আমি কত ব্যস্ত থাকি"-- চন্দন।
থম মেরে বসে আছে বন্যা, চন্দনের বেডের পাশে, চন্দনের দিকে অবাক একটা চাহনী নিয়ে। ছয় বছর ধরে যে মানুষটাকে পারফেক্ট ম্যান ভেবে এসেছে, সে কি করে কোনো কিছু গোপন করে! কি এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো, যে এড়িয়ে যেতে হয়েছে! আবার, এটা নাকি ইচ্ছা করেই করেছে চন্দন! বন্যা অবাক হয়ে যায়। চন্দনকে কেমন অচেনা লাগতে থাকলো তার ,মুহুর্তের মধ্যেই। কিন্তু তবুও চন্দনের শরীর ভালো নেই, গাদা গাদা ওষুধ চলছে, এই সবে মাত্র স্যালাইন খোলা হয়েছে। এই সব সাত পাঁচ ভেবে বন্যা চুপ করে থাকলো,আর নিজেকে বেশ সংযত করেই --"এখন তো তোমার তাড়া নেই এখন বলো,আমি শুনতে চাই, ও তোমার কত বড় বন্ধু যে আমাকে শাসিয়ে গেলো"--বন্যা।
"অন্বেষা ও আমি খুব ভালো বন্ধু ছিলাম। শুরুর দিকে আমি ওকে বন্ধুর মতো সব কাজে সব সময় সাহায্য করেছি কলেজের প্রথম এক দুই বছর। ওর জোরাজুরিতে ওদের বাড়িতেও গেছি বেশ কয়েক বার। আর অন্বেষার মা বাবা আমাকে খুব পছন্দ করতেন। আমি পড়াশোনাতে ভালো ছিলাম অন্বেষার থেকে। এই জন্যে সব সময় অন্বেষার মা ও বাবা চাইতেন যেন আমি ওকে গাইড করি, মোটিভেট করি। অন্বেষা পড়াশোনাতে মোটামুটি ভালোই ছিলো কিন্তু ও খুব বেপরোয়া জীবনযাপন করতো, নিজে ড্রাইভ করে কলেজে আসতো, সিগারেট খেতো, এমনকি ড্রিন্ক ও করতো, কিছু খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়েছিলো, ইলেভেন টুয়েলভ টায়।
(আরও খানিকটা দম নিয়ে,ঈষৎ হেসে) এদিকে আমার সিম্পলিসিটি, সাদামাটা জীবন যাপন, আমার দায়িত্ব কর্তব্য বোধ, আমার কথা বার্তা অন্বেষার মা আর বাবা আলাদা করে ভালো লাগার কারন হয়ে দাঁড়ালো। তারপর একদিন হঠাৎই অন্বেষা আমায় প্রপোজ করে! আমারো ওকে ভালোই লাগতো। কিন্তু তবুও আমি প্রেম ভালোবাসা তে রাজি হয়ে যাই নি--কিছুতেই রাজি হইনি, কারন অন্বেষার ইকোনমিক স্ট্যাটাস লাইফস্টাইল অনেক হাইফাই, অনেক বেশী লাক্সারি আর আমি কেমন যেন বেমানান, সেই সময় ওদের আভিজাত্যের ভীড়ে। আমি এতোটা এফোর্ট করতে পারতাম না !
--এদিকে হঠাৎ ব্রেইন স্ট্রোকে আমার বাবা চলে গেলেন একেবারে চিরকালের মতো। আমার মা এত বড় শোক সামলাতে না পেরে দিনের পর দিন তখন খুব অসুস্থ হয়ে যেতে থাকলেন। তখন দিদিরও বিয়ে হয়নি , কথা বার্তা চলছে, দেখাশোনা চলছে দিদির বিয়ের , তখন আমিই আমাদের একমাত্র পরিবারের ভরসা। আমিই সব কিছু। আমাকে নিয়ে মায়ের, আমার দিদির --অ অ নে এ এ ক স্বপ্ন , সংসারের প্রতি তখন আমার অনেক দায়িত্ব তাই ইন্জিনিয়ারিং শেষ করে আমার চাকরী খোঁজার পালা শুরু হলো।
এদিকে অনু মানে অন্বেষা আমার উপর খুব অভিমান করলো। ওর প্রপোজালটা আমি মেনে নিইনি যে,তাই। সেই সময় অন্বেষা ওর বাবার সুপারিশে অস্ট্রেলিয়ায় একটা খুব বড় কোম্পানিতে দারুণ চাকরির অফার পেয়ে যায়। অন্বেষা ওখানে যেতে চাইলো, আর তারপর বলাই বাহুল্য আমাকেও ওর সঙ্গে যেতে বললো, কিন্তু আমি রাজিই হলাম না। এবং কারণ টা আমিযে অন্বেষাকে পছন্দ করতাম না তা নয়, অন্বেষার বাবা আমার সাথে অন্বেষার বিয়ে দিতে চাইলেন। আর তারপর একসাথেই বিদেশে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। এদিকে আমার মা আর দিদিকে ছেড়ে আমি তখন অতোটা সাহস করে উঠতে পারিনি"--চন্দন।
বন্যা চোখ বড় বড় করে চন্দনের কথা গুলো শুনছিলো, এবং প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিলো কিন্তু তবুও ধৈর্য্য ধরে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছিলো। চন্দনকে তো বন্যা তার জীবনের সব কিছুই বলেছে। কিছুই গোপন করেনি। ক্লাস নাইনে একটা ক্লাসমেট এর উপর ক্র্যাশ ছিলো, ক্লাস ইলেভেনে মামাতো দাদার বন্ধুকে ভালো লাগতো। ফার্স্ট ইয়ারে একটি ছেলে প্রপোজ করে। তার সাথে কিছু দিন প্রেম টেম করার কথা ভেবেও বেশীদুর এগোয় নি। কারন ছেলেটির কিছু কিছু জিনিস বন্যার পছন্দ ছিলো না। তারপর নতুন একটা গানের স্যার তাকে ঘিরে কিছু গল্প ।এগুলো কিন্তু বন্যা সব কিছুই চন্দনের সাথে শেয়ার করেছে। বন্যার জীবনে বলার মতো লুকিয়ে রাখার মতো এক্সাইটিং কিছুই নেই। চন্দনের এতো বড় সত্য গোপন, বন্যার মাথাটা একেবারেই গরম করে দিচ্ছে তবুও ধৈর্য্য ধরে---
"এতো বড় কথা আমাকে কোনোদিন বলোনি চন্দন!
তাছাড়াও এখন রোজ তোমার সাথে দেখা করতে আসবে বলছে কেন? আসলে তুমি বলতে চাইছো যে অন্বেষা শুধুমাত্র একটা প্রোপোজাল নিয়ে আসে! সে রকমতো আমার ও অনেক কয়টা বিয়ের সন্বন্ধ এসেছিলো , দেখাশোনা হয়েছিল, তাতে কি হয়?
ওই অন্বেষার এতো সাহস কি করে হলো হ্যাঁ? আমার অনুমতি ছাড়া তোমাকে যেন কেউ দেখতে না আসে-- আমি কিন্তু বলে দিলাম, আমি নীচে রিসেপ্শনে বলে দিয়ে যাবো, আর তোমার মা আর দিদিকে ও সব কথা খুলে বলবো।"-- প্রচণ্ড বিরক্তি প্রকাশ করে বন্যা বললো।
ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে গেলো, বন্যা ওখান থেকে বেরিয়ে এলো। নীচে নেমে রিসেপ্শনে ভালো করে বলে দিলো, যেন কেউ তার পারমিশন ছাড়া চন্দনের সাথে দেখা না করে।
যাইহোক রুমে ফিরে বন্যা ওর শাশুড়ী আর ননদকে ফোনে সব কথা বললো। ওরাও অবাক হয়ে গেলো, অন্বেষা নামের ঐ মেয়েটির অনধিকার প্রবেশ ও তার অদ্ভূত ব্যাবহার এর কথা শুনে।
রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে বন্যা অনেক বার ভেবেছে,হতে পারে যে এই মুর্তিমান উৎকট সমস্যা অন্বেষাকে অন্বেষণ করে, শয়তান রমেশটা বন্যার ঘর ভাঙার চেষ্টা করছে!
অথবা রনি! হতে পারে এটা , বন্যার সংসার ভেঙে বন্যাকে একেবারে নিজের করে পাওয়ার জন্য রনির পাগলামী! রনিকে নিয়ে বন্যার ভয়,সংশয়, দুঃচিন্তা সব কিছু মিলিয়ে অদ্ভুত এক অস্থিরতা হতে থাকলো।
বন্যা মাঝরাতে কনিকাকে ফোন করে--অন্বেষার বিষয়ে বিস্তারিত বললো। রমেশ খারাপ লোক হলেও কনিকা খুব ভালো মেয়ে।তাই বন্যার বিশ্বাস কনিকা সঠিক জায়গায় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
পরদিন সকালে বন্যা,শাশুড়ী ও ননদকে নিয়ে, চন্দনের সাথে দেখা করতে এলো। এদিকে নার্সিংহোমে আগে থেকেই ঐ অন্বেষা ও তার আট নয় বছরের বাচ্চা মেয়েটি এসে বসে আছে। কিন্তু তাকে রিসেপ্শন থেকে দেখা করতে দেয়নি।
ওদের আবার দেখে বন্যা তখন আবারো খুব বিরক্ত হলো। স্বাভাবিক ভাবেই বেশ বিরক্তির সুরে--
"আজ তাহলে আমিই উদারতা দেখাই নাকি?চন্দনের সাথে দেখা করার জন্যে, আমার পারমিশন লাগবে,মাইন্ড ইট !"--বন্যা।
" ইউ ইলটিটারেট! গাঁইয়া কোথাকার! তুমি যদি সব ঘটনা শোন তাহলে স্টান্ড হয়ে যাবে, সো ডোন্ট টক রাবিশ"---বেশ চেঁচিয়ে অন্বেষা বললো।
"এ আবার কি অসভ্য ব্যাবহার হ্যাঁ! আমার ছেলেকে আমার বৌমা, আমরা দেখতে যাবে, এতে তোমার এতো নাক গলানো কেন বাছা? তুমি কে বলোতো? হ্যাঁ ? তোমার কথা চন্দন আমাকে কোনো দিন বলেই নি, কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসলে তুমি"?
---চন্দনের মা ও বেশ চেঁচিয়ে ই বললেন।
"আর দেখো মা এতো ডিটেইলস, নার্সিংহোমের এড্রেস সব কালেক্ট করেছে, অদ্ভুত মহিলা আবার বড় বড় কথা বলে !"---চন্দনের দিদি।
বন্যা তখন যেন আরো মনে জোর পায় চন্দনের মা ও দিদিকে যে পাশে পেয়ে। তবুও মাথা ঠান্ডা রেখে --
"আচ্ছা আপনার দাবী টা কি? শুধুমাত্র চন্দনকে একবার দেখে চলে আসবেন তাইতো? তাহলে নীচে ওয়েট করুন, একসাথে তো এতোজনকে উপরে যেতে দেবেনা"---বন্যা।
"আমার মেয়েকে সঙ্গে করে উপরে নিয়ে যান, আমার না গেলেও হবে--অন্বেষা।
"কেন? শুধুমাত্র আপনার মেয়েই কেন, আপনি নয় কেন?--বন্যা।
"হ্যাঁ, শুধুমাত্র আমার মেয়ে উপরে গেলেই হবে, কারণ ও শুধুমাত্র আমার মেয়ে নয়--- ও, চন্দনের ও মেয়ে! তাই"!---এবার শান্ত গলায় অন্বেষা বললো।
"সেকি!আপনি জানেন আপনি কি বলছেন?মানে আমি তো জাস্ট ভাবতে পারছি না,পাগলামোর তো একটা সীমা থাকে"--চন্দনের দিদি জয়া।
" লিসেন,আই এম নট আ ম্যাড, 'গুনগুন' চন্দন আর আমার মেয়ে, আমাদের মেয়ে"--অন্বেষা।
" তাই নাকি ! তুমি কোথায় ছিলে এতোদিন বাছা? সংসার ভাঙতে এয়েচো,এক্কেরে ছক কষে যে! উরি বাবা রে আমার শরীরটা খারাপ লাগতেছে, প্রেসার বেড়ে যেতেছে মনে হতেছে।"----চন্দনের মা শোভা দেবী।
বন্যা এতোক্ষন সব শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে।ওর কোনো হুঁশ দিশাই নেই। শাশুড়ীর শরীর খারাপ হোক, সুনামী আসুক, সাইক্লোন আসুক, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাক, প্রলয় আসুক ,বন্যার চোখ অন্বেষার মুখ থেকে সরছে না। পাথরের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে ছল ছল চোখে অন্বেষার মুখের দিকে তাকিয়ে--কে কি বলছে, কে কি করছে বন্যা যেন কিচ্ছুটি বুঝতে পারছেনা, শুনতেও পাচ্ছে না। বন্যার হাতে একটা প্যাকেট ছিলো, হাত থেকে পড়ে গেলো, প্যাকেট এর ভিতরে ফল গুলো গড়িয়ে গড়িয়ে দুরে চলে যাচ্ছে।
একটার পর একটা ধাক্কায় বন্যা পুরো বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, আর গায়ে বল শক্তি নেই। চোখের সামনে সব যেন অন্ধকার হয়ে গেলো -- বন্যা উল্টে পড়ে যাচ্ছিলো। তৎক্ষণাৎ 'জয়া' এসে বন্যাকে ধরে ফেলে আর একটা চেয়ারে বসিয়ে দেয়।
"কিছু ভয় নেই বন্যা, সব সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলছে! নিশ্চয়ই কোনো উদ্দেশ্য আছে ওর" কেউ কিছু একটা করছে।পুরো ছক কষে সংসার ভাঙার প্ল্যান!--জয়া।
কথা গুলো জড়িয়ে যাচ্ছে বন্যার তবুও অস্ফুটে-- "আ আ আ আমি বিশ্বাস করি না দিদিভাই, ওকে এখান থেকে চলে যেতে বলো, চন্দন আমাকে সব বলে, দিদিভাই-কিন্তু এই অন্বেষার কথা,কোনো দিন ও বলেনি,বলো?-- কেন লুকালো? বলো?কেন? এখন এই বাচ্চা মেয়ে টা আবার কি বলছে ও হ্যাঁ ?" কাঁদতে কাঁদতে বন্যা বললো।
" এই আপনি ,যেটা বলছেন তার কি প্রমাণ আছে? আমার ভাইকে আমি চিনি হ্যাঁ , আর ছোট লোক দেরও ভালো করে , কোথা থেকে আসেন? টাকার লোভে?"--জয়া।
"আমার টাকার কোনো অভাব নেই, শুধুমাত্র স্বীকৃতি চাই,শুধুমাত্র 'গুনগুন' এর জন্যে।"-দৃঢ়তার সাথে অন্বেষা।
"ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে যাবে,কেউ একজন উপরে চলে যান"--রিশেপশন থেকে।---
ক্রমশ
: 💘 'এবং দ্বিতীয়'(8)
অর্পিতা কামিল্যা
"আ আ আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে, দিদিভাই। আমি উপরে যেতে পারবো না। দিদিভাই ,তুমি মা কে নিয়ে উপরে যাও ,ওর সাথে দেখা করে এসো। আর শোনো ,নীচে যা কিছু হলো চন্দনকে এখন এসব কথা কিছুই বলো না যেনো"।
--- জোর করে কান্না চেপে রেখে বন্যা।
"ঠিক আছে আমি আর মা উপরে যাচ্ছি, তুমি এখানে শান্ত হয়ে বোসোতো , শরীর খারাপ লাগলে, আমাকে তখুনি ফোন করো,হ্যাঁ"--জয়া।
ওরা উপরে চলে যাওয়ার পর বন্যা ওখানেই থম মেরে বসেছিলো, কোলের মধ্যে সাইড ব্যাগটা রেখে,দুটো হাত দিয়ে নিজের কপাল,ভ্রু আর চোখ গুলো বার বার করে চেপে রগড়ে উপরে তুলছে ঠিক তখনই দেখতে পেলো অন্বেষা ও তার বাচ্চা মেয়েটি বন্যার একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে আছে। এটা দেখে বন্যার অস্থিরতা,বিরক্তি আবার বেড়ে গেলো। প্রচণ্ড বিরক্তিতে বন্যা তার মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলো। দেখেও যেন দেখেনি এমন একটা ভাব করার চেষ্টা করলো।
" ও হ্যালো,আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে"।
--অন্বেষা।
" ও প্লিজ লিসেন টু মি,হ্যালো, আমি ভালো করেই বলছি,-এদিকে তাকাও,-দেখো।আমি কোনো দিন ও তোমার সংসার ভাঙতে চাইনা, নেভার -আমি জানি চন্দন তোমার সাথে ভালো আছে "-অন্বেষা একটু জেদের ভাষায় কথা গুলো এক নিশ্বাসে বললো।
বন্যা এবার অন্বেষার দিকে তাকালো, পরিস্থিতিটা তার প্রানান্তকর লাগছে , তবুও তাকালো ,কিন্তু মুখে কিছুই বললো না।
" আমি জানি তোমরা খুব ভালো আছো, আমি আমার কাজিন প্রিয়াঙ্কার কাছ থেকে অল আপডেটস পাই। বাট মাই বেবি, আমার মেয়ে ,ও যখন জিজ্ঞেস করে ওর বাবা কোথায়! তখন! আমি ! আই হ্যাভ নাথিং টু ডু"---অন্বেষা।
চোখের উপর এলোমেলো চুল গুলো সরিয়ে কানের পিছনে গুঁজে নিয়ে, মেরুদন্ড সোজা করে বসলো বন্যা, এবার সরাসরি অন্বেষার চোখের উপর চোখ রেখে "উপযুক্ত প্রমাণ আছে কি?"--বন্যা।
"ডেফিনেটলি আই হ্যাভ,প্লিজ, লিসেন, সব জেনে শুনে আমার মেয়েটাকে ওর বাবার পরিচয় কেন দেবো না,তুমি বলো?"--অন্বেষা।
রাত জাগা পাখি গুলো যেমন অন্ধকারেই উড়তে পারে পথ চিনে। বন্যা তেমন দৃঢ় প্রত্যয়কে আঁকড়ে আঁধারে সসন্মানেই তার অশান্ত মনকে স্থির করে রাখার চেষ্টা করতে থাকে।অশান্ত সময়, কষ্টের সময় শেষ হয়ে গেলে হয়তো বন্যার একদিন জয় হবেই। সব দুঃখের, যন্ত্রণার পথের সমাপ্তি নিশ্চয় আছে।তাই বুকের ভেতর সৎ সাহস করে, মাথাটা উঁচু করে দৃঢ়তার সাথে পরম ব্যাক্তিত্বময়ী বন্যা বলে--
" শুনুন --যদি সত্যিই চন্দন আপনার সন্তানের পিতা হয় তাহলে, আপনার সন্তান পিতৃ পরিচয় পাবেই।কিন্তু এখন আপনি বাড়ি ফিরে যান, আমি আগে চন্দন কে বাড়ি নিয়ে যাই। তারপর আপনি আমাদের বাড়িতেই আসবেন,তখন সব কথা হবে"।
কয়েকদিন পর---
"এই হুলো! সব গোছানো হলো? টিকিট টা নিয়েছিস? সব দরকারী কাগজপত্র? মনে থাকে যেন আমি রোজ তোকে ভিডিও কল করবো। ও হ্যাঁ আর 'মাম্পি'র মামা কে আর একবার ফোন কর। প্রথম বার অনেক দুরে কোথাও যাচ্ছিস । ব্যাঙ্গালোরটা ছিলো দেশের ভিতরেই, কিন্তু দুবাই ! সেটা তো অন্য দেশ ! একেবারে অন্য মহাদেশ"--অঞ্জলী দেবী বললেন।
" ছোটবেলা থেকে আমাকে ছেড়েই তো থাকো মা, এতো চাপ নেই"-- অনেকটা সুখ বিহীন কৃত্রিম হাসি হেসে রনি বললো।
" তোর জন্যে কি আমার চিন্তা হোতোনা ,দুরেই থাক বা কাছেই থাক, সব সময় তোর জন্যই ভাবনা হয়। যাইহোক, 'মাম্পি'র মামা না যোগাযোগ করে দিলে এই সাত তাড়াতাড়ি চাকরিটা হতো! আর একবার ফোনে সব কিছু জেনে, ভালো করে সব সার্টিফিকেট আর সব গুছিয়ে নে"--অঞ্জলী দেবী।
হ্যাঁ রনি দুবাইএ যাচ্ছে। বন্যার কাছ থেকে নিজেকে চিরতরে সরিয়ে এনে, রনি-কোলকাতা থেকে ফিরে, নিজের হাতে নিজেকে প্রায় আধমরা করার তাল খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। ক্রমাগত নিজের চারপাশের সব কিছুই তার অর্থহীন মনে হচ্ছিলো। ঠিক সেই সময় ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো রনির ছোট বেলার বন্ধু 'মাম্পি' এসে হাজির হয়। নার্সারি থেকে প্রাইমারী পর্যন্ত মাম্পি আর রনি একসাথেই পড়াশোনা করেছে। তারপর 'মাম্পি' স্থানীয় রানাঘাট কলেজেই তার পড়াশোনা শেষ করে। মাম্পি রনির প্রায় পাশের বাড়ির মেয়েটি হলেও রনিকে তেমন ভাবে পায়নি। কারন রনির তো বেশিরভাগ পড়াশোনা, ছোটবেলা থেকে হস্টেলে থেকেই । রনির বাড়ির পিছনের দিকে প্রায় পাশাপাশি দুটি ছাদ,
--শীতের কমলালেবু, কয়েৎবেল, গ্ৰীষ্মের আম মাখা, বর্ষায় বৃষ্টির জলে কাগজের নৌকা ভাসানো, শরতের পরিষ্কার আকাশে ঘুড়ি ওড়ানো, একসাথে গানের দিদিমণির কাছে যাওয়া, একসাথে টিউশন পড়া এমন অনেক মিষ্টি মধুর শৈশব স্মৃতি মাম্পি আর রনির মিলিয়ে মিশিয়ে আছে। তারপর যতবার রনি ছুটিতে বাড়িতে আসতো, মাম্পির সাথেই খেলা ধুলো, পুজোর সময় সবাই মিলে ঠাকুর দেখা। সেই সময় মাম্পি কে কেউ বিরক্ত করলে, তাদের সাথে মারপিট করা, শৈশব থেকে কৈশোরে তারপর যৌবনে - মাম্পি যেন রনি কে তার 'গুড এন্ড বেস্ট ফ্রেন্ড' এর তালিকায় শীর্ষে রেখেছে সব সময়। সর্বোপরি রনি যে একটি ভালো ছেলে। মাম্পি সেটা জানে ফেসবুক, হোয়াটসআপ, ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্ৰাম রনির সব কিছুতে মাম্পির অবারিত দ্বার সব সময়।
স্পেশি ব্র্যান্ডের উৎশৃঙ্খল গাঁজাখোর বন্ধুদের সাথে রনির মেলামেশা মাম্পি লক্ষ্য করেছিলো প্রায় বেশ কয়েকদিন আগেই। তখন থেকেই মাম্পি ভেবেছিলো একবার রনির সাথে দেখা করে, একেবারেই ওদের সাথে মেলামেশা করতে বারন করবে। কারন ওই দলের একটি ছেলের সাথে মাম্পির একটা সময় ঘনিষ্ঠতা ছিলো। তারপর কোনো কারনে ব্রেক আপ হয়ে যায়। কয়েক মাস আগে ঐ ছেলেটিকে ড্রাগস পাচারকারী চক্রের সদস্য সন্দেহে পুলিশ গ্ৰেপ্তার করেছিলো, সন্দেহ সত্য প্রমাণিত হয়ে সে জেল ও খেটেছে । মাম্পি তারপর রনিকে সেই কথা বলে ও বোঝায়। সেদিন রনির পরিবারের সাথে দেখা করার সময় রনির মা অঞ্জলী দেবী কথায় কথায় রনির একটা চাকরির দরকার -- বলতেই মাম্পির দুবাই এ থাকা মামার সোর্স ধরে,-- রনির একটা চাকরির পাকাপোক্ত ব্যাবস্থা হয়ে যায় ঐ দুবাই নগরীতেই।রনি আজ সেখানেই যাচ্ছে।মাম্পি বারবার বলে দিয়েছে রনিকে, যখনই একা লাগবে রনির যেন তখনই মাম্পিকে ফোন করে।কিন্তু রনি সময় পেলে কনিকা কে ফোন করে বন্যার খোঁজ খবর নেয়।বন্যার বর্তমান জীবনের সব টানাপোড়েনের খবর রনির জানা।
চন্দনকে নার্সিংহোম থেকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে। সে বাড়িতে এসেছে এবং অনেকটাই সুস্থ হয়েছে। আর এরমধ্যে অন্বেষা বার বার চন্দনের সাথে দেখা করতে চেয়ে ফোন করছে। কথায় বলে সুখে দুঃখে জীবন আর পদ্ম পাতায় জলের মতো ক্ষণস্থায়ী সুখ , প্রত্যেকটি জীবনেই কাছাকাছি পাশাপাশি মানুষের সাথে সব সময় এক বোঝাপড়ায় এক যুগ এক সাথে হাঁটার পর ও চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যায়। সামান্তরাল ভাবে সম্পর্ক গুলো চলতে থাকে, রেল লাইনের মতো। গন্তব্য হয়তো একদিন সবারই মৃত্যু। তবুও তো সবাই বাঁচার লড়াই চালিয়ে যেতে চায়। সময় বলে দেয় কার কাছে কে দামী, শেষ ঠিকানায় অন্তিম গন্তব্যে। তাই মানুষের সময় আর সম্পর্ক চিরকাল একরকম ভাবে চলে না।
অন্বেষা এসে জানায়, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার শেষের দিকে চন্দনকে অন্বেষা প্রপোজ করেছিলো এবং চন্দন সেই প্রপোজাল রিফিউজ করে। তারপর অন্বেষা এটা কিছুতেই মানতে পারেনি। অন্বেষা জোর করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় চন্দনকে। নিজের বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করায়। অন্বেষার বাবা মা বুঝিয়ে বলার পর ও চন্দন রাজি হয়নি অন্বেষাকে বিয়ে করে, বিদেশে পাড়ি দিতে।
এরপর কিছুদিন অন্বেষা মানসিক ভাবে একেবারেই ভেঙে পড়ে। এবং চন্দনের সাথে সব রকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই ঘটনার কিছু দিনপর , অপ্রত্যাশিত ভাবে একটি বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে চন্দন ও অন্বেষা দুই জনই নিমন্ত্রিত ছিলো।চন্দনকে দেখে অন্বেষার মাথায় একটি ছেলেমানুষি বদবুদ্ধি আসে, তারপর ঐ পার্টিতে চন্দনের ড্রিংকস এর গ্লাসে,লুকিয়ে একধরনের উত্তেজক নেশায় ওষুধ মিশিয়ে দেয়।চন্দন নেশায় ঘোরে একেবারেই বেসামাল তখন। অন্বেষা তারপর চন্দন কে নিয়ে একটা হোটেলে চলে আসে। সেখানে একটা রুম বুক করে, ঐ রুমের খাটে শোয়ায়। চন্দনের জামা কাপড় খুলে ফেলে, এবং নিজেরও। এবার অন্বেষা তার নিজের মোবাইল দিয়ে চন্দনের সাথে শুয়ে, জড়িয়ে একেবারেই খোলামেলা দৃশ্যের কিছু আপত্তিকর অবস্থায় ছবি তোলে। অন্বেষা তখন ভেবেছিলো ঐ ছবিগুলো চন্দনকে দেখালে চন্দন তাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু ছবি গুলো তোলার পর, অন্বেষা নিজেও মদ খেয়ে নেশার ঘোরে একই বিছানায় চন্দনের সাথে সারারাত কাটায়। সকালে ঘুম ভেঙ্গে ওঠে চন্দন আর অন্বেষার প্রচণ্ড ঝগড়া বিবাদ হয়। এতে অন্বেষা আবার রেগে গিয়ে ওখান থেকে চলে আসে। এবং দুই সপ্তাহের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। ওখানে গিয়ে একমাস পরেই অন্বেষা বুঝতে পারে যে সে -----প্রেগনেন্ট। কিন্তু তখন সে কথা তার মা বাবাকে জানানোর একদম সাহস হয়নি। অস্ট্রেলিয়াতে অনেক বার,অন্বেষা ভেবেছিলো আ্যবোর্সান করার কথা। কিন্তু চন্দন ছিলো অন্বেষার সত্যি কারের ভালোবাসা। জীবনে চন্দনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বাঁচতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত সেটা হয়ে উঠেনি। এবং সিঙ্গেল মাদার হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেবে এই রকম একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে অবশেষে একটি ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়। গুনগুন জন্ম নেওয়ার পর অন্বেষার মা বাবা সব জানতে পারে, এবং চন্দনের সাথে অন্বেষার বিয়ের কথা বলতেই অভিমানী অন্বেষা কিছুতেই চন্দনের কাছে ভালোবাসা ভিক্ষা চাইতে রাজি হয়নি।
এভাবে কিছু দিন কেটে যায়।গুনগুন একটু একটু করে বড় হতে থাকে। তারপর অন্বেষা হঠাৎ একদিন শোনে যে চন্দনের বিয়ে হয়ে গেছে । অন্বেষা তখন ও জেদ ধরে বসেছিলো । পরে অন্বেষা এটাও শুনেছে যে চন্দন তার বিবাহিত জীবনে খুব ভালোই আছে। অন্বেষা ও ওর মেয়ে কে নিয়ে ভালো ছিলো। কিন্তু জীবন সবসময় সমান যায় না। গুনগুন এখন একটু বড় হয়েছে। বিদেশে বড় হচ্ছে ঠিকই।কিন্তু গুনগুন এর বাকি বন্ধুদেরও বাড়িতে বাবা বলে একজন পরিবারের সদস্য থেকে থাকে। গুনগুন নিজে নিজে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ায়-- বার বার ওর বাবার কথা জিজ্ঞেস করে,অন্বেষাকে। ভাগ্যের পরিহাসে একপ্রকার হাস্যকর জীবনে জর্জরিত অন্বেষা,এতো বড় সাহস করে উঠতে পারেনি, যে চন্দন বেঁচে থাকা সত্ত্বেও বলবেযে গুনগুনের বাবা নেই। সমস্যার সমাধান খোঁজ করতে গিয়ে, বার বার নিজেকে ছোট করা হবে ভেবে, অন্বেষা দ্বিধা বোধ করেছে।বহু বার বলার চেষ্টা করেছে।চন্দনের ফোন নাম্বার ও ছিলো, কিন্তু কষ্টে বুক ফেটে গেছে তবুও অন্বেষা চন্দনকে কিছুই বলেনি। এদিকে অন্বেষার বাবা খুব অসুস্থ হয়। হঠাৎই হার্ট এটাকে এখন তিনি একেবারে মৃত্যু শয্যায়। ইন্ডিয়াতে সেই জন্যই অন্বেষা ফিরে এসেছে। এরপর প্রিয়াঙ্কার কাছ থেকে যখন শোনে চন্দনের এক্সিডেন্টের কথা। তখন থাকতে না পেরে দেখা করতে চলে আসে। অন্বেষা ভয় পেয়েছিলো, যদি চন্দনের কিছু একটা হয়ে যেতো তাহলে গুনগুন তার বাবাকে কোনোদিন চোখের দেখাও দেখতে পেতো না।
এখন চন্দন পারমিশন দিলেই ডি এন এ টেস্ট করে প্রমাণ করে দিতেই পারে যে 'গুনগুন' চন্দনের ই মেয়ে। এছাড়াও নেশাগ্রস্ত চন্দনের সাথে তোলা আট বছর আগের সেই ছবি গুলিও অন্বেষা দেখিয়ে দেয়, বন্যা ও চন্দনকে।
বন্যার ভালোবাসা এখন একপ্রকার মর্যাদাহীন,কিন্তু নিজের কাছে নিজের মর্যাদা স্বাভাবিক ভাবেই অনেক। থাকা টা উচিৎ ও। বন্যা অভিমানী, চন্দনের উপর যত রাগ তার , সত্য গোপনের মতো অপরাধ করে চন্দন আজ বন্যার কাছে অপরাধী। তাদের দাম্পত্য এখন নড়বড়ে,যেন ডুবন্ত নৌকো।কারণ তাদের সময় এখন খারাপ আর ভাগ্য অসহায়।
শেষ পর্যন্ত চন্দনকে বন্যাই রাজি করালো ডি এন এ টেস্ট করানোর জন্যে। কিছু দিন পর রিপোর্ট এ প্রমাণিত হলো যে চন্দনই গুনগুনের বাবা। পরম ব্যাক্তিত্বময়ী বন্যা এবার একটা বড় সড় সিদ্ধান্ত নেওয়া কথা ভাবতে থাকলো।
বিয়ের পর বন্যার মনে মনে,স্বপনে,সচেতনে একটি সন্তানের রূপ কল্পনায় বার বার আসতো, মিষ্টি একটা পরী , ঠিক যেন গুনগুন। বন্যা ভাবে , ফুলের মতো নিষ্পাপ গুনগুন যেন বন্যার চেয়েও অসহায়।একটা শিশু তার বাবা জীবিত থাকা সত্বেও কোনো দিন বাবার স্নেহ পায় নি! গুনগুন ওর বাবা আর মা কে নিয়ে ভালো থাকবে!যদি বন্যা মিচুয়াল ডিভোর্স দেয়। বন্যা তাই ডিভোর্স এর জন্য এপ্লাই করলো।
রনি কিন্তু এখনও দুবাই এ, কনিকার কাছে সে বন্যার ব্যাপারে সব শুনেছে,বন্যাকে বারবার ফোন ও করেছে,কিন্তু রনি ফোন করলেও বন্যা রিসিভ করে না। স্বাভিমানী,ব্যাক্তিত্বময়ী বন্যা, এখন তার বাবার কাছে থাকে।----(ক্রমশ)
#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন
💘 'এবং দ্বিতীয়'(9)
কয়েক মাস পর--
"আপনার হ্যাজব্যান্ড কিন্তু আপনার সাথেই থাকতে চায়, কিছুতেই ডিভোর্স দিতে চাইছেন না মিসেস সেন, বি প্র্যাকটিক্যাল, আপনি কিন্তু জেদ করে অদ্ভূত একটা অজুহাত দেখিয়ে পালিয়ে যেতে চাইছেন।ওই বাচ্চাটা কিন্তু আপনার দায়িত্ব নয়! জেদ আর অভিমানের বশে জীবনে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে সারাজীবন পস্তাবেন না যেন। আপনার বাবা আমার বাবা খুব ভালো বন্ধু, কথাটা তাই ব্যক্তিগত ভাবেই বললাম"---এডভোকেট রায়।
"আপনি প্লিজ আমাকে, মিসেস সেন বলে ডাকবেন না। ঐ পদবী থেকে আমি চিরতরে মুক্তি পেতে চাই। চন্দন সেনের সাথে আমি আর কোনো রকম সম্পর্ক রাখতে চাই না। ও থাকুক ওর পুরানো প্রেমিকা আর ওর নিজের মেয়ে কে নিয়ে"--বিরক্ত হয়ে বন্যা।
"এইতো! হ্যাজব্যান্ড একটা সত্য গোপন করেছে বলে ওর উপর প্রচন্ড পরিমাণে রেগে একটা ভুল ভাল সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন, মিসেস সেন! আমরা কিন্তু সংসার ভেঙেই টাকা কামাই। আমরা উকিল, পুরোহিত নয়! যে বিয়ে থা দেবো, তবুও আমি ফ্রী তে আপনাকে জ্ঞান দিচ্ছি।"---বেশ একটা বুদ্ধিদীপ্ত মুচকি হাসি হেসে এডভোকেট রায়।
এডভোকেট রায় কথাগুলো বলে চলে গেলেন। কথা গুলো তখন বন্যার মাথায় বন বন করে ঘুরছে। কোর্ট চত্বরে একটা গাছের তলায় বসে আছে বন্যা।মাথাটা তার প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। হতে পারে রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে এই দশা হয়েছে। মাইগ্ৰেনের অসহ্য যন্ত্রণা। হাই এঙ্জাইটি থেকেই হয়েছে হয়তো।কোন কাজের পর কোন কাজ করতে হবে এই সব কিছু যেন খেই হারিয়ে যাচ্ছে।ওখানে কিছুক্ষণ বসে থেকে তারপর একটা অটো ধরে বন্যা গেল 'কনভেন্ট এন্ড জিসাস মারি' স্কুলে, বন্যার বাপের বাড়ির নিকটবর্তী এই স্কুলে একটা টিচারের ভ্যাকেন্সী ছিলো। তাই ওখানে শিক্ষিকা হিসাবে জয়েন করার উদ্দেশ্য নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে যায় বন্যা। স্কুলের প্রিন্সিপাল বন্যার পুর্ব পরিচিত।এবং বন্যার বর্তমান পরিস্থিতি সব কিছু শুনে প্রিন্সিপাল সেখানে বন্যার চাকরির বন্দোবস্ত করে দিলেন।
ঐদিনই স্কুল থেকে ফেরার পথে, বন্যার দেখা হলো একজন পুরোনো বান্ধবী, সোমার সাথে। সেও বন্যার সব ঘটনা শুনেছিলো---
"তুই কিন্তু মারাত্মক ভুল করছিস বন্যা । চন্দনের জীবনে তুই প্রথম এসেছিস! তাই তোর অধিকার সবচেয়ে আগে। কারণ শাস্ত্র মতে,আইন মতে তুইই চন্দনের একমাত্র স্ত্রী।কেউ কিভাবে একজন সতীন কে প্রশয় দেয়!তুই কি পাগল? অন্বেষার বেবীর লাইফ সিকিওর করা তোর দায় নয়, নাকি তুই ও কোনো অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে আছিস?বাচ্চা টা অজুহাত করে সম্পর্ক থেকে সরে আসতে চাইছিস্"? --সোমা ।
অন্য সম্পর্ক বলতেই বন্যার রনির কথাই মনে আসে।হয়তো রনি ভালোবাসাটা বন্যার মনে এই টুকু বোধ জাগিয়েছে যে বন্যা অনায়াসে কারোর ভালোবাসা হতেই পারে। তবুও বন্যা সোমাকে রনির কথা কিছুই বললো না,শুধুমাত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো-" না আমার জীবনে আর কোনো অন্য মানুষ নেই, শুধু মাত্র চন্দন ছাড়া।কিন্তু আমি ও বাড়ি থেকে একেবারেই চলে এসেছি, আর যাবো না রে "---বন্যা।
" আরে সব কিছু ঐ অন্বেষার জন্যে হয়েছে রে।স্থান কাল পাত্র কান্ড জ্ঞানহীন অন্বেষা নিজেই নিজের জীবনে একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, চন্দনের অজান্তে। চন্দনের তো কোনো দোষই নেই। হ্যাঁ তোকে বলেনি হয়তো তুই তোদের দাম্পত্য জীবনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ব্যাপারটা কে জটিল করে দিবি,আর তাছাড়া তুই তো ওকেই ভালোবাসিস। তোর শাশুড়ী, ননদ কেউ এই ডিভোর্স এ রাজি নয়! চন্দন ও তো নয়,তাহলে? "---সোমা।
সোমার সাথে দেখা হওয়ার পর বন্যা বাড়ি ফিরে আসে। বন্যা বার বার ভাবে, চন্দন কে ক্ষমা করলেই যদি ভালোবাসার মানুষটি কে আবার ও কাছে পাওয়া যায়! --বন্যা যে চন্দনকেই খুব ভালোবাসে। আর কাউকে নয়। রনির উল্টো পাল্টা কান্ড কারখানা বন্যার একঘেয়ে জীবনে একটা মনোরঞ্জন হয়েছিল ছিলো মাত্র, হয়তো!
হঠাৎ ভালোলাগা আর ভালোবাসার দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করলে সব সময় চন্দনের জয় হবে।চন্দন হলো বন্যার জীবনের বাস্তব। আর রনি হলো হঠাৎ ভালোলাগা ,যদিও বন্যার সেটা বুঝতে দেরী হয়েছিল।যাইহোক বন্যা জানে যে তার জীবনের সুন্দর ও সুখের সময়, সবটা চন্দনকে ঘিরেই।একটা দাম্পত্য অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে , তিল তিল করে তৈরী হয়,এবং দিনের পর দিন সেটি সমৃদ্ধ হয়। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক একটা কথা দিয়ে কথা রাখার পদ্ধতির মতো। একটা নিরাপদ সামাজিক আশ্রয়।এভাবেই এক একটি দিন, মানসিক উচাটনে বন্যার কেটে যেতে থাকে।
একদিন সন্ধ্যায় বন্যার ফোনে একটা ফোন!
আননোন নাম্বার থেকে!
"হ্যালো ,আমি"-- রনি
কিছু না বলে বন্যা ফোনটা কেটে দেয় ।
আবার ও ফোনটা আসে করে--
"প্লিজ,প্লিজ, প্লিজ কথা বলো সোনা, লক্ষীটি।
আমি সব জানি, দিভাই আমাকে সবকিছু
বলে "---রনি।
" কেন ফোন করেছো? তুমি তো সব কিছু কনার কাছে শোনো তাইনা? আমার তোমাকে কোনো প্রয়োজন নেই,তুমি তোমার মতো থাকো"--বন্যা।
"তুমি নিজের মতো হাজারটা যুক্তি দেখিয়ে, তর্ক করে, আমাকে কি বোঝাবে হ্যাঁ?তোমার আর চন্দনদার সংসারটা অলমোস্ট ভাঙাচোরা।তুমি নিজের কথা একটু ভাবো এবার"---রনি।
"চেষ্টা করছি রনি। আমি খুব চেষ্টা করছি ভালো থাকার"---ফোন টা বুকে জড়িয়ে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো বন্যা।সোফা থেকে মাটিতে বসে ফোনটা দুরে সরিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একটু চুপ হয়ে আবার ফোনটা কানের কাছে নিয়ে আসে বন্যা।
ওপারে ফোনে রনি বলে যাচ্ছে "কেঁদে নাও সোনা।মন প্রাণ হালকা করে কেঁদে নাও। একদম চুপ করো না।এরপর আমি তোমাকে আর কখনোই কাঁদতে দেবোনা।আই প্রমিস।আই প্রমিস।আই প্রমিস।"
পরের দিন সন্ধ্যায় রনি আবার ফোন করে।এভাবেই কয়েকটি দিন রনি আর বন্যার ফোনালাপ চলতে থাকে। রনি বার বার বিভিন্ন রকম কথাবার্তা বলে বন্যাকে বোঝাতে থাকে।
"চন্দন একটা সত্য গোপন করেছে, তো, না জানি আরো কত সত্য গোপন করেছে।আবারো কোনো একটা কেঁচো খুঁড়তে কেউটে সাপ বেরিয়ে আসবে। অথবা বাচ্চাটার জন্যে চন্দন আবার পুরানো সম্পর্কে জড়িয়েও যেতে পারে, তাই একেবারেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাক" তুমি তাতেই ভালো থাকবে--রনি।
"আর তারপর?"--বন্যা
"তারপর আমি তোমাকে বিয়ে করবো, বাড়ির সবাই কে আমি রাজি করাবো ,আই প্রমিস"--রনি।
রনির এই আশ্বাসের কথায় বন্যা একটুও টলে যায়নি। উপরন্তু বন্যা বলে যে, সে চন্দনকে বিশ্বাস করে। আর অন্বেষার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার মতো ব্যাপারতো চন্দন বিয়ের পর আর করেনি। তাহলে বন্যা নিশ্চয়ই বুঝতে পারতো। বন্যা একদম দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে ভাবে যে সে চন্দনকেই ভালোবাসে। চন্দনের চেয়ে আর কাউকে নিয়ে বেশী সুখী, সে হতেই পারবে না। চন্দনকে ভুলে যাওয়া কি এতোই সোজা! রনির মতো 'ধর তক্তা মার পেরেক' জাতীয় ভালোবাসার বিশ্বাস করে বন্যা, আর তাই এতটুকুও আশ্বস্ত হয়না। কারন বন্যা রনির মতো নয়। বন্যা তো বন্যারই মতো। এইসব ভেবে বন্যা এরপর থেকে আননোন নাম্বারে ফোন এলেও আর ফোন ধরে না ।এবং চন্দন ও যদি কোনো সময় ফোন করেছে সেই ফোনটাও ধরে না অভিমানে।
কয়েক মাস পর---
ইদানীং বন্যার শরীরটা খুব একটা ভালো নেই ।রাতের পর রাত ভালো ঘুম হয় না। বন্যার বাবা ও চাপা টেনশনে রাতে ঘুমোন না। অস্থির হয়ে তিনি বারান্দায় পায়চারি করেন। ঠিক যেমনটা বন্যার মায়ের ক্যানসার ধরা পড়ার পর করতেন। সেই অন্ধকারময় দিন গুলো যেন আবার ফিরে এসেছে। বন্যা যখন ক্লাস টুয়েলভ পাশ করলো,তখন বন্যার মা একেবারেই না ফেরার দেশে চলে যায়।প্রিয়জনের বিচ্ছেদের কষ্ট বন্যা খুব ভালো করেই জানে। আর এখনো যেন বন্যার ঐ রকমই একটা অনুভূতি হয় সব সময়। বন্যা তার মা এর মৃত্যুটা আটকাতে পারেনি। কারন মৃত্যুর উপর তো কারোর হাত নেই।
কিন্তু চন্দনের সঙ্গে ডিভোর্স টা! বন্যার হাতের মুঠোয় আছে। ছাড়াছাড়ি তো করাই যেতে পারে কিছু দিন পরেও। বন্যা তার ভালোবাসার মানুষটিকে সুযোগ দিলে হয়তো শুধরে যেতেও পারে। সব থেকে বড় কথা অন্বেষা বন্যার সংসার ভাঙতে চায়নি। সে শুধুমাত্র তার সন্তান এর পিতৃ পরিচয় দাবী করেছে, আর সেটা পেয়েছেও। তাই এর চেয়ে বেশী উদারতা দেখিয়ে বন্যা কেন নিজের জীবনে যত কষ্ট ,দুঃখ একাকিত্ব ডেকে আনবে! চন্দন তো একান্ত ভাবেই বন্যার। সাতজন্ম ধরে একসাথে থাকার কথা তাদের। যদি ভগবান চাইতেন তাহলে অন্বেষার সাথেই চন্দনের বিয়ে হতো। আর এখন হয়তো ভগবান পুরাতন সত্যিটা পরিস্কার করে বন্যা ও চন্দনের জীবন আরো সুন্দর করে গুছিয়ে দিতে চাইছেন।
কয়েক মাস পর---
চন্দন এখন সুস্থ, হাঁটতে পারে।নিজের কাজ নিজেই করতে পারে।আবার নতুন করে অফিস জয়েন করার কথা বার্তা চলছে। একদিন বিকেলে হঠাৎই বন্যার কাছে চন্দন আসে--
"বাড়ি চলো"--চন্দন।
" বাড়ি! কার বাড়ি?"--বন্যা।
"তোমার বাড়ি,তোমার আর আমার বাড়ি,আমাদের বাড়ি, মা আর দিদিভাই তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। বাড়ি চলো"--চন্দন।
বন্যা এখন চুপচাপ, চন্দন একবার অন্তত ক্ষমা চাইতে পারতো। কিন্তু কই সেটাতো একবারো করলোনা। এমন সময় বাড়ির বাইরে রাস্তায় একটা গাড়ি থামানোর শব্দ।
"বৌমা,বৌমা,চলো মা লক্ষী বাড়ি চলো। তুমি আমার ঘরের লক্ষী,নিজের বাড়ি চলো মা।নিজের মানুষকে ক্ষমা করে দিলে পুন্য হয়,সব দোষ আমার ছেলের।তুমি বাড়ি চলো"--চন্দনের মা।
বন্যা আর এক কথায় না করতে পারছেনা,শাশুড়ি ননদ সবাই এসেছে বন্যাকে ও বাড়ি নিয়ে যেতে।
বন্যার বাবাও বন্যাকে চন্দনদের বাড়ি ফিরে যেতে বললো।
"আমাকে ক্ষমা করে দাও বন্যা। আমার আর কিছুই বলার নেই আমি দিনের পর দিন তোমাকে ফোন করেই চলেছি আর তুমি ফোন ধরছো না। তোমার বাবাকে ফোন করে করে তোমার খবর নিয়েছি।আর জোরাজুরি করে মান অভিমান ভাঙিয়ে তোমাকে নিয়ে যেতে ভয় পেয়েছি।যদি আমাকে ক্ষমা করতে না পেরেছো ,যদি অপমান করো সেই ভয়ে।"--চন্দন।
চন্দনে চোখের দিকে তাকিয়ে বন্যা।বন্যার চোখ ছাপিয়ে জল তুলতুলে দুগাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।বন্যার বাবা এসে বন্যা আর চন্দনের হাতে হাত মিলিয়ে দিলেন।
" মা রে,তোরা ভালো থাক মা,আমার শরীর ভালো নেই।এই বয়সে এসে আর টেনশনটা যে একদম নিতে পারছি না মা "--বন্যার বাবা।
অবশেষে এভাবেই নানাবিধ ছলে বলে কৌশলে বেকায়দায় পড়ে বন্যা। আর শেষ পর্যন্ত চন্দন তাকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। এবং অনেক টানা পোড়েনের পর বন্যা আর চন্দন আবারো একসাথে থাকতে শুরু করে। কিন্তু! ওরা একসাথে এক ছাদের তলায় থাকে , এক খাটেই রোজ ঘুমায় অথচ কোনো রকম মানসিক সম্পর্কও তৈরী হচ্ছে না শারীরিক তো দূরঅস্ত।শুধুমাত্র সৌজন্য সাক্ষাত টুকুও করতে যেন অসুবিধা দুজনেরই। বিশেষ করে বন্যা বুঝতে পারছে চন্দনের সাথে আর তার কথা বলতে ভালো লাগে না।অফিস থেকে কখন ফিরবে আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছে করেনা।ভালো লাগে না সন্ধ্যায় একসাথে বেলকনিতে চা খেতে খেতে গল্প করতে।কোনো কিছুই যেন আর আগের মতো নেই।
আয়না ভেঙে যাওয়ার পর জুড়ে দিলেও যেমন দাগ গুলো ঠিক থেকেই যায়। ঠিক তেমনি বছ্ন্যা্ আর চন্দনের সম্পর্ক টা কিছুতেই আর আগের মতো স্বাভাবিক ছন্দ পাচ্ছে না। সম্পর্কে স্বাভাবিক অস্বচ্ছতা,এযাবৎ যা ঘটনা ঘটেছে তারই ফলাফল বা পরিনতি। চন্দন বন্যার সম্পর্কটা বেডরুমের বাইরে একটা লোক দেখানোর মতো স্বাভাবিক।আর বেডরুমের ভিতরে এক বিছানায় যেন এক আলোকবর্ষ দূরত্ত্ব।যে মানুষের জন্য অনেক শ্রদ্ধা ছিলো সেটা যেন কোথায় দম আটকে মরে গেছে।আর চন্দন ভাবতে থাকে সময় হয়তো সব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে দেবে।
কিন্তু অনেক সময় মানুষ ভাবে এক,হয় আর এক। কিছু দিনপর চন্দন একটা নতুন প্রস্তাব দিলো-- গুনগুনকে চন্দন নিজের কাছে রাখতে চায়, উদারমনা বন্যা তাতে সহমত পোষণ করে।
কিন্তু-- ওদিকে অন্বেষা এই প্রস্তাবে একদম রাজি হয়না।কারন অন্বেষা আর বিদেশে ফিরে যাচ্ছে না। সে এখন দেশে থেকেই তার বাবার অনেক বড় বিজনেসকে সামাল দিচ্ছে। তাই এই দেশে নিজের মেয়েকে নিয়েই থাকতে চায় সে।চন্দনের মনে গুনগুনের জন্যে একটা অসম্ভব টান তৈরী হলো।স্বাভাবিক রক্তের টান। কিছুদিন পর গুনগুন কে নিয়ে আলোচনা করার জন্য অন্বেষার সাথে চন্দনের বার বার দেখা হতে থাকে। সারাদিনে অফিসে থাকাকালীন অন্বেষা কতবার ফোন করে সেটা ছুটির দিন চন্দন বাড়িতে থাকলেই বন্যা বুঝতে পারলো। এতোবার ফোনাফুনি । এতো কথা বন্যার কাছেই, বেডরুমে! বন্যার অসহ্য লাগলো।চন্দনের বোধবুদ্ধি যেন দিন দিন লোপ পাচ্ছে।সারাধণ সৌজন্যেবোধ টুকুও নেই তার।বিছানায় শুয়ে শুয়ে গুনগুনের খবর নেওয়ার সাথে সাথে সারাদিন অন্বেষা যা করেছে সেসবের খবরাখবর ও অবিরাম ফোনালাপে চলতেই থাকে। আর এই সবকিছু বন্যা, একদম মেনে নিতে পারছে না! তারপর!
(ক্রমশ)©® copy right by arpita Kamila:
#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন
💘'এবং দ্বিতীয়' (অন্তিম পর্ব)
এখন চন্দন রোজ অফিস থেকে ফিরে অন্বেষাকে জানিয়ে দেয় যে সে বাড়িতে পৌঁছে গেছে। তারপর ফ্রেশ হয়ে অন্বেষাকে আবার ফোন করে গুনগুনের খোঁজ নেয়। যেন প্রতি মুহুর্তের আপডেটস নিয়েই চন্দনের শান্তি হয়। বন্যা লক্ষ্য করে , চন্দনের দিনের পর দিন কেমন পরিবর্তন হতে থাকে!সে সারাদিনের মাঝে অফিসে থাকা কালীন, বা অফিস থেকে ফিরে রাতেও বার বার অন্বেষাকে ফোন করে গুনগুন এর খোঁজ নিতে থাকে।
আইনগত ভাবে বন্যা ও চন্দন, গুনগুনকে নিজের কাছে রাখতে চাইলে, অন্বেষা বলে গুনগুনকে ছেড়ে সে নাকি থাকতেই পারবে না। তাই গুনগুন অন্বেষার কাছেই থাকবে। এরপর অফিস থেকে বেরিয়ে গুনগুনকে নিয়ে অন্বেষার সাথে একসাথে ঘোরা, শপিং মলে যাওয়া, আইসক্রীম খাওয়া সব চলতে থাকলো। চন্দনের দামী গাড়ি নেই বলে একটা দামী গাড়িও এলো বাড়িতে। এখন ঐ গাড়িতে গুনগুনের সাথে দেখা করতে যায় চন্দন, বন্যা জানে ওই গাড়ি অন্বেষাই দিয়েছে। চন্দন এখন খুব ভালো আছে।
আর এদিকে দিনের পর দিন বন্যার সাথে! চন্দনের কেমন যেন অজানা আচরণ,ব্যবহার। সবার অজ্ঞাতসারেই শুধু দূরত্ত্বটা তৈরী হতে থাকে। চন্দন অফিস থেকে ফিরে বন্যার সাথেই একসাথে খায় আর একসাথেই ঘুমায় তবুও সম্পর্কে প্রান নেই। বন্যা আর চন্দনের দূরত্ত্ব বাড়ে ক্রমাগত। আবারো ঝগড়া, ঝামেলা, অশান্তি। আবারো কোর্টের দ্বারস্থ হয় বন্যা, এডভোকেট রায় এসে সমস্যা মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। বললেন চন্দন যেন ফোন করে সপ্তাহে একদিন গুনগুন এর সাথে দেখা করে। চন্দন তাতেই কি শোনে, রোজ চলে যায় অফিস থেকে বেরিয়ে গুনগুনের নতুন স্কুলে, যেখানে সে ভর্তি হয়েছে।স্কুল থেকে নিতে আসে অন্বেষা, তার সাথেও দেখা হয়ে যায়।
তারপর যত দিন যায় ততই গুনগুনের উপর,চন্দনের মা,দিদি সবার ভালোবাসা তৈরী হতে থাকলো। বন্যার শাশুড়ী,ননদ গুনগুনকে খুবই ভালোবাসে।বন্যাও কিন্তু গুনগুনকে ভালোবাসে, কিন্তু! হলে হবে কি বাস্তব বড় নিষ্ঠুর! গুনগুন একদিন নিজেই বলে যে বন্যা তার মা হয় না !বন্যা তার আন্টী হয়। মা এর থেকে নাকি বেশী কেউ ভালোবাসে না! হায়রে পৃথিবী!একদিন এই বাচ্চাটার মুখ চেয়ে বন্যা নিজেই নিজের সংসার ভেঙে চলে যেতে চাইছিলো!এখন সেই গুনগুন কিনা বন্যাকে কান ধরে বাস্তবটা বোঝায়।
বন্যা এখন আবারো অসহায়। অন্বেষাকে নিয়ে অশান্তি হচ্ছে চন্দনের সাথে, প্রতিটি দিন প্রতিটি ক্ষণে। আর এখন খুব প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলেনা চন্দন ও বন্যা। মুমুর্ষ দাম্পত্যে এমন করে কয়েকটি মাস কেটে গেলো-- ধীরে ধীরে বন্যা বুঝতে পারলো চন্দনের জীবনে আর চন্দনের বাড়িতে এখন সে বড্ড বেশি বেমানান।ঐ যে বলে পরিস্থিতি পুরোপুরি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে না।অনেক সময় মানুষের কর্ম অনেকাংশেই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকে।
কনিকার সাথে বন্যার প্রায়ই কথা হয়।আর এটা রমেশ মোটামুটি সবই জানতো। তারপর রাস্তার নেড়ি কুকুরের মতো গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিক খুঁজে খুঁজে চলে যায় অন্বেষার অফিসে। সেখানে গিয়ে খুলে বলে বন্যা এবং রনির কথা। বন্যার ভাঙাচোরা সংসারের নাম নিশান সব মিটিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠে অন্বেষা।বন্যার সাথে রনির অবৈধ সম্পর্ক আছে প্রমাণ করতে পারলেই তো চন্দন অন্বেষার সুখের সংসার।গুনগুনের সুস্থ সুন্দর ভবিষ্যৎ।
এই ভেবে অমনি অন্বেষা একটা পথ খুঁজে বের করে- বন্যা এবং চন্দনকে চিরকালের মতো আলাদা করার জন্য। অন্বেষা হ্যাকার দিয়ে বন্যার স্মার্ট ফোন হ্যাক করায়-- বন্যার ফোনের যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সেখানেও রমেশ আর অন্বেষা সাফল্য অর্জন করতে অসফল। কারন দেখা গেলো কয়েকটি দিন মাত্র কথা বার্তা হয়েছে একটি বিশেষ নাম্বারে। আর ফোনে পাওয়া যাবতীয় মেসেজ গুলোও সব এক তরফা সেখানে বন্যার নাম্বার থেকে রনিকে প্রেমের জন্যে কোনো প্রস্তাব বা প্রশয় দেওয়ার কিছু নমুনা পাওয়া গেলো না।সুতরাং
চন্দনের কাছে বন্যাকে ছোট করার ,অন্বেষার এই চেষ্টায়,কোনো লাভ হলো না।
এদিকে রনি, সেতো এখন অনেক ম্যাচিওরড,ফুল কর্পোরেট, দুবাই এ একটি এম এন সি কম্পানিতে ভালো জব করে কনিকার কাছে বন্যার নিয়মিত খবরাখবর নিতে থাকে।রনি রীতিমতো ড্রাগের নেশা ছাড়তে পেরেছে, নাহলে এতো বড় চাকরি সামলাতে পারতোনা। আর অঞ্জলী দেবীও বাড়িতে রনির বিয়ের জন্যে পাত্রীর খোঁজ চালাচ্ছেন। রনি একবার দেশে ফিরে এলেই অঞ্জলী দেবী একটা ভালো মেয়ে দেখে রনির বিয়ে দিয়ে একেবারে সংসারী করে দেবে। এই সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পনা করাই আছে।
ওদিকে বন্যার জীবনে তখন ঝড়, ঘন কালো অন্ধকার আর ভালোবাসার মানুষের বড় অভাব। বন্যার জীবনে এখন শুধু অভিযোগ। অভিযোগের তালিকায় শীর্ষে স্থান হলো চন্দনের। স্বাভাবিক ভাবেই বন্যা এখন খুব একা।অন্বেষার সাথে চন্দনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শুধুমাত্র যে বন্ধুর মতো নয় এটা বন্যা জানে । স্বামী স্ত্রী আর সন্তান যেমন একসাথে, চন্দন অন্বেষা আর গুনগুন ও যেন একটা ঠিকঠাক ফ্রেম।তাই অবাঞ্ছিত বন্যা এখন আবার তার বাবার কাছে থাকে আর স্কুলের চাকরি টাও করে।
রনির সাথে বন্যার কোনো যোগাযোগ নেই। এখন বন্যার ব্যাক্তিগত ব্যাপার কনিকার বা কারোরই সাথে বন্যা আলোচনা করে না। রোজ স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে, সন্ধ্যায় অন্ধকারে শুয়ে থাকে। যেন বাঁচতে হয় বলে বাঁচে।তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কষ্ট গুলো অভ্যাস হয়ে যায় বন্যার।সে বুঝতে পারে তার বাবার বর্তমান মানসিক অবস্থা। তাই তখন বাবার সাথে হাসিমুখে কথা বলার চেষ্টা করে। মাঝে মাঝে মেডিটেশন করে।বাবাকে নিয়ে সামনের মন্দিরে পূজো দিয়ে আসে। কাছাকাছি ঘুরতে যায়।চেষ্টা করে নিজে ভালো থাকার, আর বাবাকে ভালো রাখার।
এভাবে প্রায় কয়েকটি মাস কেটে গেলো।তারপর একদিন পুজোর আগেটায় সেপ্টেম্বর মাসে, স্কুলের কোনো একটি কাজে বন্যা সল্টলেকে যায়। বুকে একটা মোটা ফাইল চেপে ধরে একটা সাইড ব্যাগ নিয়ে, ছাইরঙা শাড়িটা পরে বড্ড বিবর্ণ দেখাচ্ছিলো সেদিন বন্যাকে। কাজ সেরে নেওয়ার পর রাস্তায় দাঁড়িয়ে উবের এর জন্যে অপেক্ষা করছিলো। এমন সময় কোথা থেকে বাইকে চড়ে একজন ছিনতাইবাজ এসে, বন্যা সাইডব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে যায়! বন্যা তার পিছনে ধাওয়া করার চেষ্টা করে, কিন্তু রাস্তার মাঝে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। ঠিক তখনই একটা গাড়ি এসে সজোরে ব্রেক কষে। গাড়ি থেকে নামে ---রনি! হ্যাঁ রনি!
দেখতে শুনতে অনেকটা টিভি সিরিয়াল বা সিনেমার মতো হলেও ঠিক এই ভাবেই রনি ও বন্যার আবার দেখা হলো। এটাই বাস্তব। আর বাস্তব ঘটনা গুলো দেখে শুনেই টিভি সিরিয়াল বা সিনেমা তৈরী হয়।এবং গল্প,উপন্যাস রচিত হয়।
রাস্তায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া বন্যা, রাস্তা থেকে নিজে নিজেই উঠতে যাবে, ঠিক সেই সময় এসে হাত বাড়িয়ে দিলো রনি।
"ওঠো"---রনি।
"তুমি!"--বন্যা।
"আজই দুপুরে দেশে ফিরেছি। ফ্লাইট থেকে নেমেই সোজা তোমার খোঁজে সল্টলেকে। তুমি তো জানো তোমার রনি কতোটা ডেসপারেট"----
( কথাটা বলেই একটু হেসে,বন্যার হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টেনে সোজা নিজের বুকে বন্যাকে জড়িয়ে নিলো রনি।)
"তু তু তুমি কি করে জানলে আমি কোলকাতা এসেছি"--রনির বুকের মধ্যে থেকেই রনির দিকে তাকিয়ে বলে বন্যা।
"তোমার খবর আমি না জানলে আর কে জানবে?"
--- রনি (আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বন্যাকে।কপালে একটা চুমু খায়।)
এরপর বৃষ্টি নামে।বন্যার শাড়ি ভেজে।ফাইল ভেজে।ভেজে রনি।ভেজে শুকনো বুক।সারে কষ্টের অসুখ।আনন্দে আত্মহারা হয়ে শুধু কাঁদতে থাকে দুজনে।অনেক সময় জীবনের অংক গুলো সোজা সাপটা হিসেব নিকেশ করে মিলতেই চায়না।কিন্তু অনেক চেষ্টার পর যদি অংকের উত্তর মিলে যায়,তখন যেমন আনন্দ হয়। রনি-বন্যার এখন ঠিক সেই রকম।
চোখের জলে শেষে
বৃষ্টির জল মেশে
কারনে -অকারনে
দুই মনে- সংগোপনে
এলোমেলো হাওয়ায়।
প্রেমের আসা যাওয়ায়।
বৃষ্টি আনে সুখ
ভুলিয়ে দিয়ে দুখ
বৃষ্টি এসে ভেজায়
অবাক ভালোবাসায়!
জীবনের কঠিন অংক হঠাৎ মিলে যায়!
সুখের সাথে হঠাৎ করে দেখা হয়ে যায়!
তাই হাত হাতে,
চোখ চোখে,
ঠোঁট ঠোঁটে
চোখের কাজল
লিপস্টিক যায় ঘেঁটে।
কেউ জড়িয়ে ধরে কাউকে আগলে রাখে বুকে।
কেউ কাঁদতে কাঁদতে মুখ গুঁজে সুখ খুঁজে পায় বুকে।
সেই রাতেই বন্যাকে নিয়ে সোজা রনি নিজের বাড়িতে ফেরে।বন্যাকে দেখে প্রথমে অঞ্জলী দেবী আশ্চর্য হয়ে যান! এরপর রনি পরিস্কার বলে দেয যে বন্যাকেই সে বিয়ে করবে আর কাউকে নয়।অঞ্জলী আন্টী প্রথমে একটু আপত্তি করেন।কিন্তু রনি আগে থেকেই কনিকাকে সব বলে বুঝিয়ে রেখেছিলো।তাই পরে সবাই রাজী হয়ে যায়। আর রনি-বন্যার বিয়েটা শেষ পর্যন্ত হয়েই যায়।
বিয়ের পর রনি -বন্যা সোজা দুবাই এসে থাকতে শুরু করে। রনি-বন্যার ছোট্ট সংসারে বন্যা এখন দারুণ সুখী। দুজনেই দুজনের ছোট্ট ছোট্ট ভালোলাগা গুলোকে যত্ন করে।গুরুত্ব দেয়।দুজন দুজনকে আঁকড়ে ধরে অনেক সুখের স্বপ্ন দেখে।আর রনি বন্যাকে যত রকম ভাবে সুখী করা যায় ,সেটার চেষ্টা করে।বন্যার জীবনের সব না পাওয়া গুলো মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।বন্যা, রনির মধ্যে একজন প্রেমিক একজন বন্ধুকে খুঁজে পায় প্রতিনিয়ত।তাই স্বাভাবিক ভাবেই তাদের দাম্পত্য জীবনে এখন প্রেমের প্রাচুর্য, প্রেমের আকুলতা, দুজন দুজনের মধ্যে প্রবল আকর্ষণ ,মানসিক টান, দায়িত্ব বোধ, কর্তব্যবোধ, সুখ এবং শান্তি।
প্রায় তিন বছর পর --
দুবাই এর একটি বহুতল নার্সিংহোমে, বেডে হেলান দিয়ে বসে বন্যা।কোলে তার মিষ্টি একটি বাচ্চা!
----ভিডিও কলে কথা হচ্ছে অঞ্জলী দেবীর সাথে। ভারতে অঞ্জলী দেবীর পাশাপাশি কনিকা ও রমেশ দাঁড়িয়ে। দুবাই এ বন্যার বেডের পাশে রনি, ও বন্যার বাবা দাঁড়িয়ে আছে---
"মা দেখো তোমার নাতনী, ঠিক তোমার মতো নাক টা হয়েছে, দিদিভাই তোর মতো চোখ গুলো দেখ, আর আমার মতো বদমাইশ হবে। আর ওর মা এর মতো খুব ভালো হবে"------রনি।
অঞ্জলীদেবী ও কনিকা খিল খিল করে হেসে উঠলো।রমেশে বাবু ও তার পানখেঁকো দাঁতাল খ্যাঁক খ্যাঁকে হাসি হেসে বলেলো--" শালাবাবুর কি কান্ড! বন্যা কে বিয়েও করলো,বাচ্চাও পয়দা করলো!"
রমেশের মতো বিষাক্ত ভিলেন সবার জীবনেই থেকে থাকে। কেউ কেউ কারোর জীবনে খুব তাড়াতাড়ি মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। আর কেউ স্লো পয়জনিং করে । তবে এই বিষাক্ত মানুষগুলো চাইলেও কারোর ক্ষতি করতে পারে না। ভগবান সবার হিসাব করে রাখেন।
কিন্তু বাস্তবে সবার জীবনে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটি জীবন যাপনে ভালো ও মন্দ সময় সব পালা করে আসে। সুখের সময় দুঃখের দিন গুলো ভেবে ব্যালেন্স করতে হয়। আর দুঃখের সময় সুখের জন্যে চেষ্টাও করতে হয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জীবনে ডিটাচড এটাচমেন্টে থাকার অভ্যাস করা।কারোর জন্যে কোনো কিছু থেমে থাকেনা। তাই কাউকে নিজের থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ ভাবা উচিৎ নয়।এটা বাস্তব সম্মত। প্রতিটি জীবনে মানুষ একা জন্মায়, একা খায়,একা মল ত্যাগ করে,একা ঘুমোয়, আর একাই মরে।তাই কখনো কেউ যদি বলে কেউ নাকি কাউকে ছাড়া একদম বাঁচতে পারবেনা। এটা খুবই ভুল কথা বলে।বলাটা উচিৎ নয়।আর কেউ বললেও একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের বিশ্বাস করাও উচিৎ নয়।
জীবন একটাই।আমরা আমাদের অতীতটা পাল্টাতে পারবো না। আর ভবিষ্যতে কি আছে সেটাও আমরা জানিনা। জানি শুধু মাত্র বর্তমানে কি কি হচ্ছে।শুধু বর্তমানটা আমাদের হাতে।তাই সেই সময়টা সঠিক ভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে সহজ সুখী হওয়ার চেষ্টা ,আমাদের করে যেতে হবে।
সবশেষে বলা যায় আমরা বেঁচে বর্তে আছি মানেই আমরা অনেক ভাগ্যবান।বাদ বাকি অন্যের ক্ষতি না করে ভালো থাকার চেষ্টায় কোনো অন্যায় নেই। জীবন একটা, কিন্তু অপশন অনেক-- প্রথম টা না হলে দ্বিতীয়টি অবশ্যই ভালো হতেই পারে। এবং যে কোনো ক্ষেত্রেই, সৎ ভাবে, আবার নতুন করে শুরু করার চেষ্টা। আবার ও বাঁচার চেষ্টা দ্বিতীয় বার।আবারো সুখ খোঁজা দ্বিতীয়বার --জীবনের অপশন হলো------ 'এবং দ্বিতীয়'।
***************(সমাপ্ত)******************
©® copy right by arpita kamilya