দৈনিক কলম সম্মাননা -------------------------------- গল্প------------ তাং: 8/6/21.
* খেয়ালী পুতুল * -------------------------- শৈলেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী। কোন্নগর, হুগলি। --------------------…
দৈনিক কলম সম্মাননা
--------------------------------
গল্প
------------ তাং: 8/6/21.
* খেয়ালী পুতুল *
--------------------------
শৈলেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী। কোন্নগর, হুগলি।
---------------------------------------------------------
মিতুল নামে পুতুলটি। না ,পুতুল পুতুল বাচ্চাঐ মেয়েটি। কেউ বললে ও নাচবে না, মোবাইলে মিউজিক দিয়ে সাধাসাধিতেও না। যখন ওর বন্ধুরা হুল্লোড়ে মত্ত মিতুল নাচছে আপন খেয়ালে। কারো দিকে তাকাচ্ছেই না। দুধ কিছুতেই খাবে না, মা বাবা মাথা খুঁড়ে মরে গেলেও না। সেদিন বাবার কাছে এসে বললো
" আমি এক বাটি দুধ খাবো । " রঙ তুলি দিয়ে
দেয়াল আঁকিবুঁকি করতে ওর জুড়ি নেই। ওকে তো রঙ তুলি কিনে দেয়নি বাড়ি থেকে। বছর
চারেকের মিতুল এখনও স্কুলে যায়নি। সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে এই কাজ ও করে। ক্লাস টু-য়ে পড়া দিদির রঙ তুলি চুরি করে করা। মিতুল কখনো পুতুল নিয়ে খেলে না। " এই মিতুল আয় না আমাদের সঙ্গে পুতুলখেলা খেলবি। " বন্ধুদের আহ্বানে সাড়া দিতে ওর বয়েই গেছে। ভালো লাগে না, কিছুই ওর ভালো লাগে না। না সময়ে খাওয়া, না পড়াশোনা, না ঘুম। অপাট কুপাট ও করে না। কিন্তু সকলের চোখের আড়ালে ও কি যেন সব কথা বলে। আধো আধো বোলে বলেই যায়।
আস্তে আস্তে বড়ো হয় মিতুল। স্কুলের
গণ্ডী পেরিয়ে কলেজ। বিদ্যেবুদ্ধি মোটামুটি উঁচু
মানের। তারই জোরে আই এ এস। বর্তমানে
জেলাশাসক। দিদির দেওরের সঙ্গে ওর বিয়ে
দিতে চায় বাড়ির লোক। আরও অনেক যোগ্য
পাত্রের সম্বন্ধ আসছে। মিতুল নিরুত্তর নিশ্চুপ।
মিতুল তার বর্তমান কর্ম নিয়ে অতি ব্যস্ত। পাত্রী
দেখার দিন সে বাড়িতে থাকে না। থাকা না থাকা নিয়ে কিছুতেই সে মুখ খোলে না।অফিস থেকে তার বাড়ি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। অফিসের গাড়ি না, অতি সাধারণভাবে কোনো টোটোয় চেপে বাড়ি ফেরে। মাঝে মাঝে টোটোওলাকে পিছনে বসিয়ে নিজেই চালিয়ে নিয়ে আসে। " ঐ দ্যাখ্ ডি, এম নিজেই টোটো চালাচ্ছে। "- অল্পবয়সীরা ছুটতে ছুটতে কাছে আসে। দৃশ্যটি তারিয়ে তারিয়ে সে উপভোগ করে। টোটো - ওলা বিড়ি ধরালে বিরক্ত হয় মিতুল। মুখে কিছু বলে না। হাবেভাবে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু যখন ও গুণ্ গুণ্ করে গান ভাঁজে প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়। টোটোওলার আবার প্রশংসা সহ্য হয় না। ফেরার সময় বললে, " ম্যাডাম, কাল থেকে আপনি অন্য গাড়ি দেখে নেবেন। " সেদিন মিতুল একটু বেশি প্রশংসা করেছিলো কি না।
এপাড়া ওপাড়ার বেশ কিছু বাচ্চাদের নিয়ে
চিড়িয়াখানা দেখাতে নিয়ে যায় দুটো বড়ো গাড়ি ভাড়া করে। সারাদিন তাদের সঙ্গে হৈ হৈ।
দিন কেটে যায়। এক এক দিন বয়স্ক ব্যক্তিদের
কলকাতার হলে নিয়ে গিয়ে থিয়েটার দেখায়।
দিন কেটে যায়। দিব্যি দিন কেটে যায় এপাড়া ওপাড়ার মেয়ে-বউদের নিয়ে চড়ুইভাতিতে মেতে। নিরাপত্তা- রক্ষী ছাড়া জেলাশাসক নয় ,
সাধারণ এক মেয়ে হয়ে এইভাবে আনন্দ তৈরী
করে মিতুল । ছেলেবেলায় পুতুল- খেলা পছন্দ না করলেও এখন পুতুলের বিয়ে দেয়। সারি সারি পুতুলের মতো গরীব দুঃখীদের কতো মেয়ে। সাজিয়ে গুছিয়ে তাদের বিয়ে দেওয়ার হ্যাপা সামলায় মিতুল। বিয়ের খরচপত্রও কিছু কম নয়। মোটা মাইনের চাকুরী। তাতেও লোন নিতে হয় তাকে এইসব সামাল দিতে।
একদিন ও নিজে সাজলো বিয়ের কনের
সাজে। ও বিশেষ একটা সাজতে পছন্দ করে না। সাদামাটা মেক-আপ আর চন্দনের টিপ।
পাড়ার মেয়ে - বউরা ওকে ঘিরে বসে আছে।
এক নিম্ন মধ্যবিত্তর ঘরে বসেছে বিয়ের আসর।
মিতুল নিজের বাড়ি ছেড়ে এই ঘরটাকেই বেছে
নিয়েছে। পুরোহিত এসে গেছেন। বরও এসে
গেছে। ছেঁড়া ধুতি ছেঁড়া পাঞ্জাবি পরে সাইকেল
চেপে বসন হাজরা,যে বাজারে চট বিছিয়ে মাল
বেচে, সেই পাত্র। ঘরে তার চাকরি করা ছেলে,
ছেলের বউ। বিয়ে করে বাড়ি থেকে বাপকে বের করে দেয়। বসনের বউ গত হয়েছে বছর
কয়েক আগে। রাস্তার ধারে একটা টিনের চালাঘরে এখন তার আস্তানা। স্ত্রীর একটা ফটো কখনো কাছ-ছাড়়া করে না বসন। স্ত্রীকে
বড্ড ভালোবাসে সে। আজ প্রায় পাঁচ বছর স্ত্রী
চলে গেছে। মানে না সে। ভাবে এখনও তার স্ত্রী তার সাথেই। ফটোটা সুযোগ পেলেই বের করে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ।
সেদিনও সে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল মিতুলের দিকে। মিতুলের বাড়ানো হাতে টাকা।
বাজার করা সব্জীর মূল্য। কিন্তু কে নেয়? চোখ
সরাতে পারে না বসন। মিতুলও বিরক্ত হতে
পারে না। " কেন গো আমার দিকে অমনকরে
তাকিয়ে আছো? " উত্তর না দিয়ে ব্যাগ থেকে
বের করে স্ত্রীর ফটোটা মেলে ধরে বসন। হুবহু
এক দুটি মুখ। ভালোবাসার ভুবনে পঁচিশ - পঁয়ষট্টি একাকার।