Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ক্যাসিওপিয়া-সাহিত্য-পত্রিকা-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#ছোটোগল্প
#দূরত্ব#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য 
                      সকালের এক চিলতে তির্যক রোদ্দুর জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বেডরুমে ঢুকে নন্দিনীর ধবধবে ফর্সা মুখের ওপর পড়েছে। বিয়ের পর এ ঘরে আজ তার প্রথম সকাল। মুখের ওপর থেকে এখনো বিয়ে…

 


#ছোটোগল্প


#দূরত্ব

#অরিন্দম_ভট্টাচার্য্য 


                      সকালের এক চিলতে তির্যক রোদ্দুর জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে বেডরুমে ঢুকে নন্দিনীর ধবধবে ফর্সা মুখের ওপর পড়েছে। বিয়ের পর এ ঘরে আজ তার প্রথম সকাল। মুখের ওপর থেকে এখনো বিয়ের মেক-আপটা পর্যন্ত ভালো করে ওঠেনি। নন্দিনী ধীরে ধীরে চোখ খোলে, আবিষ্কার করে বিছানায় পাশের বালিশটা ফাঁকা। অপরিচিত চার দেওয়ালের মাঝে নিজেকে একলা পেয়ে বড় অসহায় অনুভব করে নন্দিনী।


 উদাস কন্ঠে আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকে সে  --  শুভেন্দু মনে হয় ডিউটি চলে গেছে। আমাকে একবার ডাকলো না পর্যন্ত! শেখর আমাকে আদর না করে কোনোদিন কক্ষনো ডিউটি বেরোয়নি। আসলে ভুলটা আমার‌ই। আমার বোঝা উচিৎ ছিল, দ্বিতীয় বিয়ের ইমারতটা প্রেমের ওপর কম বোঝাপড়ার ওপর টিকে থাকে বেশী। শেখরের চলে যাওয়ার পর ঈশ্বর দ্বিতীয় একটা সুযোগ দিলেও, সেটাতো দ্বিতীয়‌ই। তা কি কখনো প্রথমের স্বাদ ফিরিয়ে দিতে পারে!

শেখরের সঙ্গে কাটানো জীবনের স্বর্ণালী মুহূর্তগুলো একে একে ছবির মতো ভেসে উঠতে থাকে নন্দিনীর চোখের সামনে। তারপর শেখরের অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনা-- ওহঃ! কি দুঃসহ। সময় যেন সুন্দর সাজানো রঙ্গোলির ওপর পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে গেছে।

নন্দিনী কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবত থাকে। পরক্ষণেই মোবাইলে নম্বর ডায়াল করলো সে।


-- কি রে! কি খবর? একেবারে সকাল সকাল? সব ঠিক আছে তো? মানে তোরা দু'জনে ঠিক আছিস তো? ফোনের অন্যদিক থেকে মায়ের সস্নেহ প্রশ্ন।


-- হ্যাঁ-- এমনি সব ঠিক আছে। আমি পলির জন্য ফোন করেছিলাম। আসলে শেখর চলে যাওয়ার পর থেকে আমি তো ওকে একবারের জন্যও কাছ ছাড়া করিনি। তুমি তো জানো, বাবা মা দু'জনের ভালোবাসাটা আমি ওকে সবসময় একাই দিতে চেষ্টা করেছি, তাই হঠাৎ ওর জন্য মনটা কেমন যেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। চোখের মাঝে টলমল করতে থাকা দুঃখটাকে আঁচল দিয়ে দু'হাতে মুছে ফেললো নন্দিনী।


ওদিক থেকে মা সান্ত্বনা দিতে থাকে মেয়েকে -- কোনো চিন্তা করিস না মা। ও আমার কাছে একদম ঠিক আছে। মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করছে তোর কথা, তবে ও আমি ঠিক বুঝিয়ে দেবো। আগে তোরা নিজেরা একটু সেট হয়ে নে, তারপর ওর কথা ভাববি। পলি এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে, ওকে জাগাবো? একটু কথা বলবি?


-- না, মা থাক। ওকে ঘুমোতে দাও। ঘুম থেকে উঠলে না হয় আমাকে একটা ফোন কোরো। এখন রাখছি আমি।


-- আচ্ছা, রাখ মা। আমি তোর অবস্থাটা বুঝতে পারছি। কিন্তু কি করবি বল, সবার ভাগ্য তো সমান হয় না.... ধীরে ধীরে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। শুভেন্দু খুব ভালো ছেলে। ওকে দেখলে কে বলবে, যে এটা ওর দ্বিতীয় বিয়ে।


-- এসব কথা ছাড়ো মা। রাখছি এখন, পরে ফোন করবো। ফোনটা ঝট করে কেটে দেয় নন্দিনী। আসলে শুভেন্দুকে মন থেকে যেন ঠিক মেনেই নিতে পারছে না সে। 


ঘুম থেকে উঠে ধীরে ধীরে কিচেনের দিকে এগিয়ে যায় নন্দিনী। গ্যাস স্টোভে চায়ের জল চাপিয়ে চায়ের পাতার কৌটোটা খুঁজতে থাকে সে।

কি অস্বস্তিকর! চারিদিকে যেন অপরিচিতের ভীড় -- ঐ দেওয়াল, ঐ বাসনকোসন, ঐ আলমারী...স--ব।  সে যেন কোনো অচেনা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে একা.....আর সমস্ত অচেনা অজানা অপরিচিত চোখ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।


--- চায়ের পাতাটা এখানে থাকে। আলমারির ভেতর থেকে একটা কৌটো বার করে নন্দিনীর সামনে ধরে শুভেন্দু।


নন্দিনী চমকে ওঠে। কখন চুপিসারে দরজা খুলে ঘরের ভেতরে ঢুকেছে শুভেন্দু, সে বুঝতেই পারেনি। শেখর‌ও এক‌ই রকমভাবে মাঝে মাঝে চমকে দিতো তাকে। পরে অবশ্য জড়িয়ে ধরে আদর‌ও করে দিতো। কেমন যেন উদাস হয়ে যায় নন্দিনী। আসলে স্মৃতির স্থির জলে, কেউ যেন ঢিল ছুড়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা যদিও তেমন কিছু নয়, কিন্তু উদাসী মন উদাসীনতার কারণ খুঁজে নেয়।


-- তুমি এখন বিছানা থেকে না উঠলেই পারতে। আসলে আমি ভাবলাম, আজ ব্রেকফাস্টটা মোমো দিয়ে সারবো দু'জনে। তাই বাইরে বেরিয়েছিলাম। তাছাড়া তুমি মোমো খুব ভা-লো-বা-সো--- নন্দিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে যায় শুভেন্দু। সে বুঝতে পারে নন্দিনীর এসব কথা মোটেই ভালো লাগছে না এখন। তাই সে একাই চুপচাপ ডাইনিং রুমে চলে যায়।


দিনগুলো এভাবেই এক এক করে কেটে যাচ্ছিল। দেওয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের তারিখ যেন সপ্তাহে পরিবর্তিত হচ্ছিল.... এদিকে সময় যেন নতুন সম্পর্কের দূরত্বটাকে কিছুতেই কমাতে পারছিল না। নতুন সম্পর্কে সব কিছু নতুন ছিল, ঠিক নতুন ঘরের মতো। ফ্রিজের দরজা কত জোরে বন্ধ করলে জোরে শব্দ হবে না, ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে নন্দিনী। কম্বল আর চাদর বেডের স্টোরেজের কোন দিকে কোনটা থাকে তার মাথায় প্রায় সেট হয়ে এসেছে এখন। এসব তো হয়ে যায়.... কিন্তু সম্পর্ক সেট হতে যে সময় লাগে এসবের চেয়ে অনেক অনেক গুন বেশী ।


নন্দিনীর সব সময় শুধু মনে হতে থাকে, শুভেন্দুর সঙ্গে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে গিয়ে তার জীবন থেকে পলি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। এই এক সম্পর্কের মূল্য চোকাতে, কত সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে হচ্ছে তাকে! তাই শুভেন্দুকে দেখলেই তার ভেতরে একটা নেগেটিভ ফোর্স কাজ করতে থাকে সবসময়। তার যে কোনো কথায় সহজে সায় দিতে পারে না নন্দিনী।

অন্যদিকে নন্দিনীর তার সাথে সহজ না হতে পারার কারণটা শুভেন্দু ভেতরে ভেতরে অনুধাবন করতে থাকে।


একদিন খুব সকালের ঘটনা -- পরিবেশে হালকা শীতের আমেজ। নন্দিনীর খুব ভোর ভোর ঘুম ভেঙে যায়। রোজকার মতো আজও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আধখোলা চোখে ধোঁয়াটে পরিবেশে ঘুমিয়ে থাকা শহরটাকে দেখতে থাকে সে। শুভেন্দুর আজ অফিস ছুটি। ধোঁয়া ওঠা গরমাগরম দু'কাপ কফি নিয়ে এসে নন্দিনীর পাশে এসে দাঁড়ায় সে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও নন্দিনী একটা কাপ হাতে তুলে নেয়।

-- চলো না, একটা দিন কোথাও ঘুরে আসি। সেই বিয়ের পর থেকে কোথাওতো বেরোনো হয়নি। শুভেন্দু একটু দুরত্ব বজায় রেখেই বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কথাগুলো বলে ফেলে।


নন্দিনীও বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই উত্তর দেয় --- আজ শরীরটা একটু কেমন কেমন লাগছে। তাছাড়া মনটাও ঠিক ভালো নেই।


অসম্মতি সবসময় শব্দে প্রকাশ পায় না, শব্দের ফাঁকে ফাঁকে ছোটো ছোটো বিরতির মাঝেই ওটা লুকিয়ে থাকে। শুভেন্দু বুঝতে পারে নন্দিনীর তার সঙ্গে বাইরে যাওয়ার সামান্যতম ইচ্ছাটুকুও নেই। সে বলতে থাকে -- জানি, তুমি আমাকে শেখরের জায়গায় ঠিক বসাতে পারছো না। আমার যে কোনোরকম কার্যকলাপে তোমার শেখরকেই মনে পড়ে যাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক নন্দিনী। আমিও ঠিক একই সমস্যার মধ্য দিয়েই এগিয়ে চলেছি। আল্পনা আমার মনে, ঘরের প্রতিটা বস্তুতে বসে আছে। সেখানে তোমার উপস্থিতিকে মানিয়ে নেওয়াটাও খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। কারণ মানুষ দ্বিতীয় সম্পর্কের গভীরতা সবসময় প্রথমটা দিয়েই মাপতে থাকে নন্দিনী। কিন্তু আমাদের যে ওখান থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে। এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায়‌ও তো নেই। আর এটা ভেবেই তো আমরা দু'জনেই এ বিয়েতে সম্মতি দিয়েছি......

আসলে কি জানো তো, জীবন যে কোনো সম্পর্ককে আমাদের সামনে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় এভাবে লিখে নিয়ে আসে না, ওটা আমরা নিজেরাই নিজেদের মতো করে বানিয়ে নিই। আমরা ভুলে যাই, সমস্ত সম্পর্ক‌ই নতুন। ঠিক নতুন প্রভাতের মতো, যেখানে ফেলে আসা রাতের সামান্যতম চিহ্ন‌ও আশা করা ভুল। কোনো একটার সাথে অন্য আর একটাকে মেলানো যায় না, বা একটা দিয়ে আর একটাকে মাপাও যায় না।

নন্দিনী অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে শুভেন্দুর চোখের দিকে। বিয়ের পর এই প্রথম এতোক্ষণ তাকালো তার দিকে -- সত্যিই তো! কষ্টটা তো শুধু আমার একার নয়, ওর‌ও তো----


শুভেন্দু আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। নন্দিনী সারাটা দিন বাড়ীতে একা । আজ তার মনের মধ্যে ভয়ঙ্কর রকমের দোলাচল কাজ করছে। পলিকেও ফোন করেনি সে। এতোদিন শুভেন্দুকে সে শুধু শত্রুই ভেবে এসেছে, তাই খুব সহজেই সম্পর্কের অন্য একটা মেরুতে নিজের অবস্থানটা করে রাখতে কোনো অসুবিধা হয়নি তার। কিন্তু আজ যেন সমস্ত হিসাবে গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে। সম্পর্কের ঠিক কোন বিন্দুতে নিজেকে দাঁড় করানো উচিৎ, সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না নন্দিনী।


ঠিক সন্ধ্যার মুখে কলিং বেলের আওয়াজ -- ডিং-ডং....

নন্দিনী অন্য দিনের মতো আজ আর দেরি করলো না, বরং একটু তাড়াতাড়িই গিয়ে খুললো দরজাটা। সে চমকে ওঠে -- দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এটা কে! আমি ঠিক দেখছি তো? পলি কি করে এলো এখানে? নন্দিনী ওখানেই পাগলের মত জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে পলিকে।

দরজার আড়াল থেকে হাসতে হাসতে সামনে এসে দাঁড়ায় শুভেন্দু-- আমাদের কি আজ আর ভেতরে ঢুকতে দেবে না? পলি! মাকে বলে দাও, আজ থেকে তুমি তোমার মায়ের কাছেই থাকবে।

নন্দিনীর গাল বেয়ে ঝরছে অশ্রুধারা। লজ্জায় সে আজ আর শুভেন্দুর দিকে ঠিক করে তাকাতেও পারছে না। শুভেন্দু এগিয়ে এসে দুই মা মেয়েকে একসাথে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। কখনো কখনো নিজের কাছে হেরে যাওয়ার মাঝেই আমাদের জয় লুকিয়ে থাকে। নন্দিনী শুভেন্দুর বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে, জড়িয়ে ধরে তাকে।


কিছু কিছু মুহূর্ত এতো শক্তিশালী হয়, যে তারা সব বাঁধ ভেঙ্গে দিতে পারে। এটা সেই মুহূর্ত। এই এক মুহূর্তে সম্পর্কের দুই মেরুর মধ্যের দূরত্বটা যেন শূন্য হয়ে গেল। সম্পর্কের কেন্দ্রে এসে মিলে মিশে এক হয়ে গেল তারা দুজনে।