Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

ইতিহাসের পাতায় ব্রাত্য তমলুকের অগ্নিকন্যা বীরাঙ্গনার সাবিত্রী দেবী

ইতিহাসের পাতায় ব্রাত্য তমলুকের অগ্নিকন্যা বীরাঙ্গনার সাবিত্রী দেবী। বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের অবিস্মরনীয় ঐতিহাসিক কর্মক্ষেত্র মেদিনীপুর। সন্ত্রাসবাদি আন্দোলন হোক অথবা অসহযোগ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন ই হোক এই জেলার অপরিসীম ধৈর্য ও কর…

 

বীরাঙ্গনা মাতঙ্গীনি দেবী

জয়দীপ পন্ডা (ইতিহাস গবেষক)
ইতিহাসের পাতায় ব্রাত্য তমলুকের অগ্নিকন্যা বীরাঙ্গনার সাবিত্রী দেবী। বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলনের অবিস্মরনীয় ঐতিহাসিক কর্মক্ষেত্র মেদিনীপুর।

 সন্ত্রাসবাদি আন্দোলন হোক অথবা অসহযোগ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন ই হোক এই জেলার অপরিসীম ধৈর্য ও কর্ম সহিষ্ণুতা সমগ্র ভারতের বিস্মিত দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। চির দারিদ্র্যের ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের লীলাক্ষেত্র এই জেলার নর নারীর স্বাধীনতা অর্জনের ও সংগঠনের ঐকান্তিক আগ্রহ অতুলনীয়। 1947 সালের 15 ই আগস্ট যুগান্তর পত্রিকায় মেদিনীপুর বাঁশির স্বাধীনতার সংগ্রামের অনন্য ভূমিকার মূল্যায়ন করা হয়েছিল এইভাবে। মেদিনীপুর জেলার অবিভক্ত তমলুক মহাকুমার ছিল আন্দোলনকারীদের অন্যতম বিচরণ ক্ষেত্র।

 এতদঞ্চলে আন্দোলনকে সফলতায় রূপ দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পতিতাপল্লীর অশিক্ষিতা রমণীরা নিজেদের জীবনের পরোয়া না করে। আমাদের আলোচ্য বিষয় স্বাধীনতা আন্দোলনে তমলুকের অগ্নিকন্যা বীরাঙ্গনা সাবিত্রী দেবীর অবদান। সাবিত্রী দেবীর জন্ম বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা শহরের নিকট ধেরুয়া এলাকার চাঁদরা গ্রামে। পিতার নামঃ সীতানাথ মাইতি এবং মা সুখোদা দেবী। অনাদির দুই কন্যা ও এক পুত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় হলেন সাবিত্রী। সাবিত্রী দেবীর জন্ম তারিখ সঠিক জানা যায় না, তবে আনুমানিক হাজার 1912 সালে উনার জন্ম। অসাধারণ অপূর্ব সুন্দরী সাবিত্রীর খুবই অল্প বয়সে বিবাহ হয় পার্শ্ববর্তী গ্রামের শ্রী উমাচরণ দে মহাশয় এর সঙ্গে।


 দরিদ্র কৃষক ঘরের মেয়ে। তাই বর্ণপরিচয় এর সুযোগ ঘটে নি তার। শহরের মেয়েরা যদিও গুটিগুটি পায়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছেন, গ্রামে গ্রামে তখনও সেই বার্তা পৌঁছয়নি। শোনা যায় বিবাহিত জীবনে তিনি সফলতা অর্জনের সুযোগ পাননি ,তাকে তমলুক শহরে এসে বারবণিতার বৃত্তি অবলম্বন করতে হয়। উনার একটি কন্যা সন্তান হয়েছিল নাম দিয়েছিলেন গৌরী। জানাজায় তমলুকের তথাকথিত বাবু সম্প্রদায় তাকে 17 বছর বয়সে নিভৃতে তমলুকে তুলে নিয়ে আসে। ইউ জানা যায় এ ব্যাপারে তমলুক শহরের অবস্থাসম্পন্ন বিজয় পাহারির ভূমিকা ছিল। এইভাবে বাবু সম্প্রদায়ের মনোরঞ্জনের জন্য সাবিত্রী দেবী তমলুক শহরে এলেন এবং শেষ পর্যন্ত বারবণিতার জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। হাজার 930 সালের 12 ই মার্চ গান্ধীজী 79 জন সত্যাগ্রহী কে সঙ্গে নিয়ে 24 দিনে 241 মাইল পথ পায়ে হেঁটে গুজরাটের সবরমতী আশ্রম থেকে আরব সাগরের তীরে ডান্ডি নামক স্থানে উপস্থিত হন 5 ই এপ্রিল হাজার1 930 সালে। সেখানে আরব সমুদ্রের জল ফুটিয়ে লবণ তৈরি করে আইন অমান্য আন্দোলনের সূচনা করলেন। এই আন্দোলন গুজরাট থেকে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল। বাংলার মেদিনীপুর জেলা তমলুক টু কাঁথি মহকুমা এই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করল। জেলার দক্ষিণ দিকে তরঙ্গায়িত হলদি নদীর তীরবর্তী নরঘাট ছিল তমলুক মহাকুমার ডান্ডি।

 গান্ধীজীর আওহান অনুযায়ী 6 ই এপ্রিল মহকুমার সত্যাগ্রহী দা তমলুক শহরের রাজবাটি হতে গণমিছিল করে আইন ভঙ্গ করার শপথ নিয়ে নরঘাট এর উদ্দেশ্যে রওনা দিল। মিছিল তমলুক শহর পরিক্রমা সময় জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের দেশপ্রেমাগ্নি তে ভরা জ্বালাময়ী ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্য লবন এর উপর কালা আইন প্রত্যাহারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে সত্যাগ্রহী দের সাথে পা মিলানো অষ্টাদশী সাবিত্রী। 

শোভাযাত্রা সম্বন্ধে আনন্দবাজার পত্রিকা লিখল, শোভাযাত্রা প্রায় দুই মাইলব্যাপী এক বিরাট জনসমুদ্রে পরিণত হয়। প্রায় 30 হাজার লোক ওই সভায় যোগদান করেছিলেন। 10 ই এপ্রিল 1 930 আনন্দবাজার পত্রিকা। সত্যাগ্রহী দা 6 ই এপ্রিল বিকাল চারটায় নরঘাট এ পৌছলেন। সত্যাগ্রহী দা সেখানে একটি জনসভার আয়োজন করেছিলেন। এই জনসভায় বক্তা ছিলেন প্রখ্যাত মহিলানেত্রী চারুশীলা দেবী, জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলী প্রমুখেরা। 

এদিকে মেদিনীপুরের জেলাশাসক প্রবল অত্যাচারী মিস্টার প্যাডি সাহেব জনসভা বানচাল করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং নরঘাট 144 ধারা জারি করে মিটিং সমাবেশ বন্ধ করার নির্দেশ জারি করেন। কংগ্রেস নেত্রী জ্যোতির্ময়ী দেবী পুলিশের বাধা অগ্রাহ্য করে জনতাকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, যারা বুকের রক্ত দিতে প্রস্তুত আছেন তারা এই সভায় এগিয়ে আসুন, যারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবেন তারা ফিরে যান। এই আওহান শুনে বারাঙ্গনা সাবিত্রী সামনে এসে বললেন, আমরা বুকের রক্ত দেব কিন্তু পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবো না। 

সাবিত্রী দেবীর সঙ্গে প্রায় আটশত গ্রাম্য মেয়ে লবণ আইন ভঙ্গের জন্য প্রস্তুত হলেন। তারা পুরুষদের ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলেন। এদিকে ম্যাজিস্ট্রেট পাদ্রির নির্দেশে সশস্ত্র পুলিশ নিরস্ত্র সত্যাগ্রহী দের ওপর ব্যাপক লাঠিচার্জ করল। লবণ প্রস্তুতির সমস্ত সরঞ্জাম ভেঙ্গে দিল। শিশু বালকরা ও তাদের অত্যাচারের হাত থেকে সেদিন রেহাই পায়নি। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নিজেই একটি 10 বছরের বালকের চোখে এমন আঘাত করেছিল যে বালকটির চোখ বেয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ল। সেই সময় সাবিত্রী দেবী ছুটে এসে নিজের পরনের খদ্দরের শাড়ি ছিঁড়ে বালকটির চোখ বেঁধে পরম স্নেহে কোলে নিয়ে বসলেন।

 এমনকি এও জানা যায় সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করার অপরাধে তিনি বেশ কয়েকদিন জেল খাটেন। তমলুক শহরে ফিরে এসে স্বয়ং এসডিও সাহেবকে সুকৌশলে স্বদেশের তৈরি লবণ বিক্রি করেছিলেন বলে শোনা যায়। শহরে অবস্থানকালীন তিনি মাঝে মধ্যেই চলে যেতেন কংগ্রেসিদের নানান সভা সমিতিতে। নেতাজির কন্ঠে পরাধীনতার যন্ত্রণার কথা, গান্ধীজীর আন্দোলনের কথা শুনতেন। এইভাবে তিনি সঞ্জীবিত হতে লাগলেন যা তাকে পরবর্তী সংগ্রামে প্রেরণা দিয়েছিল।:

 অবশেষে এলো বহুকাঙ্খিত বছর 1 942 সাল। ইংরেজি তুমি ভারতছাড়ো জাতির জনকের এই রণ টংকা 42 এর 28 আগস্ট মুম্বাইয়ের কংগ্রেস থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল সমগ্র ভারতবর্ষের শহরে প্রান্তরে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাংলার অন্যতম সংগ্রামী জেলা মেদনীপুর বাসীকে উদ্বেল করে তুলেছিল মুক্তির অদম্য স্পৃহা। এই জেলার অবিভক্ত তমলুক মহাকুমার ছিল আন্দোলনের অন্যতম ঝটিকা কেন্দ্র। ওই বছর 29 সেপ্টেম্বর তমলুক থানা সকল অভিযানের সামিল হয়েছিলেন প্রায় 50 হাজার মানুষ।

 পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী তমলুক শহরের পাঁচটি প্রবেশ পথ দিয়ে শোভাযাত্রা বন্দেমাতরম ইংরেজি তুমি ভারতছাড়ো হয় জয় নয় মৃত্যু অর ডাই ইত্যাদি মন মাতানো ধ্বনি দিতে দিতে অগ্রসর হচ্ছিল। শহরের দক্ষিণ দিক থেকে আসা প্রায় পাঁচ হাজার নর-নারীর একটি দল শহরে প্রবেশের চেষ্টা করলে সংকরারা ব্রিজের কাছে অবস্থানরত সশস্ত্র পুলিশ ও মিলিটারির দল শোভাযাত্রার পথ অবরোধ করে এবং এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। ফলে ঘটনাস্থলে বহু শোভাযাত্রা গুরুতর জখম হয়।

 নিহত হলেন উপেন্দ্রনাথ জানা, গুরুতর আহত পূর্ণ চন্দ্র মাইতি দুদিন পরে হাসপাতালে মারা গেলেন। সংকরারা ব্রিজের কাছে পড়ে থাকা আহত ব্যক্তিরা যখন একটু জলের জন্য আর্তনাদ করছে তখন পাশের বারাঙ্গনা পল্লী থেকে সাবিত্রী দেবী বালতি ভর্তি জল নিয়ে ছুটে আসেন।সশস্ত্র পুলিশ বন্দুক উঁচিয়ে তাকে তাড়া করলে তিনি তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে তার ডেরা থেকে কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে বটি ও গতি নিয়ে তেড়ে এলেন। সিপাহীদের দিকে বটি উঁচিয়ে ধরে বললেন দেখ সোগীর ব্যাটারা,এদিকে আর এক পাও এগোবে না। এই আহত লোকগুলো যদি সেবা করতে বাধা দিস তবে এই বটি দিয়ে তোদের সব নাক কান কেটে ফেলবো। সিপাহীর দল সাবিত্রীর রণরঙ্গিনী মূর্তি দেখে থমকে। সাবিত্রী দেবী রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে সুকৌশলে কয়েকজন গুরুতর আহত দেশপ্রেমিক কে তার নিজের ঘরে নিয়ে এসে সারা রাত্রি জেগে সেবা-শুশ্রূষা করেছিলেন।

 তিনি কয়েকজন আহত দেশপ্রেমিককে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন।  1942 এর 17 ই ডিসেম্বর তমলুক মহাকুমার কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ যথা শ্রী সতীশচন্দ্র সামন্ত শ্রী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় শ্রীশচন্দ্র শ্রী সুশীল কুমার ধারা প্রমুখের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলেও মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার। ব্রিটিশ সরকারের ত্রাস এই সরকারের সামরিক বাহিনীর নাম ছিল বিদ্যুৎ বাহিনী। বাহিনীর সর্বাধিনায়ক commander-in-chief ছিলেন সুশীলকুমার ধারা। আমাদের আলোচ্য বারাঙ্গনার সাবিত্রী দেবী গোপনে এই বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের কাজ করতেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের অন্ধকারে গোপনে সংবাদ আদান-প্রদান করতেন।

 সেই সংবাদ রমেশ কর এর মাধ্যমে সুশীল বাবুর হাতে পৌঁছে যেত। ভারতের মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিয়ে এইভাবে একবার বনিতা তমলুকের অগ্নিকন্যা এ পরিণত হয়েছিলেন তার জীবদ্দশাতেই। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার আত্মদান আগামী প্রজন্মের কাছে প্রেরণা হয়ে রইবে। সুখ1994 সালের 20 মার্চ এই বীরাঙ্গনা রমণী পরলোকগমন করেন। তিনি জাতির ভাগ্যাকাশে প্রেরণা হয়ে থাকবেন।