Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস

জয়দীপ পন্ডা
মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা এবছর ৮০তম বর্ষে পদার্পণ করল। প্রসঙ্গত ১৯৪২ এর ২৯সেপ্টেম্বর তমলুক মহাকুমাবাসীর ওপর ব্রিটিশ সরকার জেনিসংস নাটকীয় হত্যালীলা চালিয়েছিল এবং তারপর ১৬ ই অক্টোবর প…



জাতীয় সরকারের ত্রয়ী অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় সতীশচন্দ্র সামন্ত ও সুশীল কুমার ধারা ।

জয়দীপ পন্ডা

মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা এবছর ৮০তম বর্ষে পদার্পণ করল। প্রসঙ্গত ১৯৪২ এর ২৯সেপ্টেম্বর তমলুক মহাকুমাবাসীর ওপর ব্রিটিশ সরকার জেনিসংস নাটকীয় হত্যালীলা চালিয়েছিল এবং তারপর ১৬ ই অক্টোবর প্রাকৃতিক ঝড় বন্যা মহামারী সেই সঙ্গে ব্রিটিশ প্রশাসনের নির্দয় আচরণের প্রতিবাদে এখানকার কংগ্রেস নেতৃত্ব সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেও সমান্তরাল জাতীয় সরকার ।


দিনটি ছিল ১৭ ই ডিসেম্বর ১৯৪২ সালে বাংলা পয়লা পৌষ ১৩৫০ সন। নাম ঠিক করা হলেও মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার । তমলুক মহাকুমার কংগ্রেস কমিটির মুখপাত্র বিপ্লবী পত্রিকা ২৬শে জানুয়ারি ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে তমলুকে নবযুগ স্বাধীন তাম্রলিপ্ত জাতীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন শিরোনামে লিখল মেদিনীপুর জেলার তমলুক মহাকুমার ব্রিটিশ রাজ্যের পরম আরামের সুখ শাসন ঘরের মতো মুহূর্তে ভেঙে পড়েছে। তখন থেকে চলছে অস্ত্রশস্ত্র ও সৈন্য-সামন্ত সুরক্ষিত কয়েকটি মাত্র ছোট ছোট ঘাঁটি থেকে পল্লী অঞ্চলে ব্রিটিশ পশুর অবর্ণনীয় অত্যাচার । এইভাবে তমলুক মহাকুমার সম্প্রতি এমন এক অবস্থার মধ্যে এসে পড়েছিল যে ঐরকম অরাজক মগের মুল্লুক অবস্থা আর চলতে দেওয়া যায় না ।

তাই মহকুমা কংগ্রেস শুভ পয়লা পৌষ ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৪২, মহা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত তাম্রলিপ্ত জাতীয় শাসনব্যবস্থা সংক্ষেপে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার প্রবর্তন করেছে। ভাবি মহা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হইবার উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনের সংকল্প নিয়ে, বর্তমান অস্বাভাবিক অবস্থার জন্য পূর্ণ ব্যবস্থা না করা পর্যন্ত একজন সর্বাধিনায়ক এর উপর জাতীয় শাসনের সকল দায়িত্ব ও ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে ।

তিনি তার মন্ত্রী মন্ডলী নিয়ে শাসন চালাচ্ছেন শুধু  ঠিক এইভাবে ২৬ শে জানুয়ারি কোন ১৯৪৩ স্বাধীনতা দিবসে নন্দীগ্রাম মহিষাদল সুতাহাটা ও তমলুক থানার একজন করে অধিনায়ক এর উপর তার মন্ত্রী মন্ডলী গঠন করে নিয়ে থানায় জাতীয় সরকার চালাবার ভার দেওয়া হয়েছে । আশা ও বিশ্বাস করি তমলুক মহাকুমার তাদেরই জাতীয় সরকার কে শক্তি, সমর্থন, অর্থ ও আনুগত্য দিয়ে এই মহাকুমা থেকে ব্রিটিশ শাসনের সকল চিহ্ন একেবারে ধুয়ে মুছে ফেলে পূর্ণ নবযুগের প্রবর্তন করবে ।

প্রসঙ্গত দক্ষিণ নারকেলদা গ্রামের কংগ্রেস কর্মী শ্রী মহেন্দ্রনাথ দলুই  মহাশয় এর দোকান ঘরের দোতালায় এক গোপন সভায় জাতীয় সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল । এই সভায় উপস্থিত ছিলেন সতীশচন্দ্র সামন্ত অজয় কুমার মুখোপাধ্যায় সুশীলকুমার ধারা রমেশচন্দ্র কর প্রমুখ কংগ্রেস নেতৃত্ব। সম্ভবত এই সভাতেই ঠিক হয়েছিল একজন সর্বাধিনায়ক এর অধীনে এই সরকার পরিচালিত হবে। সর্বজন সম্মতভাবে তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের সর্বাধিনায়ক ছিলেন কংগ্রেস নেতা অজাতশত্রু শ্রী সতীশচন্দ্র সামন্ত মহাশয়। তার হাতে রইল সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর । অর্থ সচিব হলেন জননেতা অডিও পুরুষ অজয় কুমার মুখোপাধ্যায়। সমর ও স্বরাষ্ট্র সচিব হলেন চিরতরুণ বিপ্লবী শ্রী সুশীল কুমার ধারা মহাশয়। সেই সঙ্গে ঠিক হলেও শিক্ষা প্রচার জনরক্ষা ইত্যাদি দপ্তর গঠিত হবে এবং এইসব দপ্তর গুলিতে একজন করে সচিব থাকবেন যারা বিষয়গুলি দেখাশুনো করবেন। এছাড়া অবিভক্ত তমলুক মহাকুমার বিভিন্ন থানার বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের নিয়ে একটি পরামর্শ পরিষদ গঠিত হবে। সর্বাধিনায়ক সতীশচন্দ্র সামন্ত এর নির্দেশ অনুযায়ী ২৬শে জানুয়ারি   ১৯৪৩সালে গঠিত হল থানা জাতীয় সরকার। প্রতিটি থানায় একজন করে অধিনায়ক ও কয়েকজন সচিব নির্বাচিত হলেন যারা ওই থানা দেখাশুনো করবেন। সেইমতো তমলুক থানার প্রথম অধিনায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা গুণধর ভৌমিক। তার গ্রেপ্তারের পর হলেন শ্রী প্রিয়নাথ জানা এবং পরে শ্রী অমূল্যচরণ মাইতি মহাশয়। ঠিক অনুরূপভাবে মহিষাদল থানায় প্রথমে শ্রী নীলমণি হাজরা, পরে বরদাকান্ত কুইতি মহাশয় সুতাহাটা থানা শ্রী জনার্দন হাজরা পরে শ্রী রাজবিহারী দেবেন্দ্রনাথ কর এবং নন্দীগ্রাম থানা শ্রী কুঞ্জ বিহারী ভক্ত দাস। 

কিন্তু ময়না ও পাঁশকুড়া থানায় জাতীয় সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি। এই জাতীয় সরকারের নিজস্ব বিচার বিভাগ গণস্বাস্থ্য বিভাগ শিক্ষা বিভাগ আইন শৃঙ্খলা বিভাগ প্রচার বিভাগ অর্থ দপ্তর ছিল। ব্রিটিশ সরকারি ত্রাস জনসমর্থন পুষ্ট এই জাতীয় সরকার দীর্ঘ ২১ মাস  ১৭ডিসেম্বর  ১৯৪২ থেকে পয়লা সেপ্টেম্বর হাজার ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ চালাবার পর জাতির জনক মহাত্মাজির  নির্দেশ অনুসারে জাতীয় সরকারের অবলুপ্তি ঘটানো হয়। জাতীয় সরকারের চতুর্থ সর্বাধিনায়ক বরদাকান্ত কৃতি মহাশয় গান্ধীজীর নির্দেশ শিরোধার্য করে সরকার ভেঙে দিতে নির্দেশ দিলেন ৮ই আগস্ট ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু পরের দিন তিনি গ্রেফতার হলে মহাকুমা কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক শ্রী সুশীল কুমার ধারা মহাশয় এক বিবৃতিতে ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ হতে জাতীয় সরকারের সমস্ত কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। 

ঐতিহাসিক ডক্টর হীতেশ রঞ্জন সান্যাল জাতীয় সরকারের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে লিখেছেন, বাস্তবিকপক্ষে তমলুকের জাতীয় সরকার একটা সমান্তরাল সরকারের উপর জনসাধারণ পূর্ণ আস্থা দায়িত্ব এবং ক্ষমতা অর্পণ করেছিল। 


ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী লিখেছেন, আগস্ট আন্দোলনের সময় আমাদের মেদিনীপুরের তমলুকে যে বীর্য ও সূর্যের যে ধৈর্য ও সহ্যশক্তি যে বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার পরিচয় শুধু কতিপয় নেতা নয় আপামর জনসাধারণ দিয়েছিলেন তা ভারতের ইতিহাসে স্বাধীনতা সংগ্রামের অধ্যায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।  

এককথায় উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হলেও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার তার  ২১মাসের শাসনকালে জনগণের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। গঠনমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নে এই সরকার সমগ্র ভারতবাসীর কাছে এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। মহিষাদল এ২৫ শে ডিসেম্বর ১৯৪৫ সালে বাপুজী   তমলুক মহাকুমার কাছে দ্বিধাহীন ভাষায় বললেন, তোমরা যা করেছো তা বিরচিত ও গৌরবময় কিন্তু তোমরা অহিংসার পথ হইতে বিচ্যুত হয়ে ছিলে।