Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

তমলুকের ঐতিহ্যময় বারুনী মেলা ইতিহাস ও পূজা

দেশ মানুষ ডেস্ক, জয়দীপ পন্ডা,তমলুক : তমলুকের সবচেয়ে প্রাচীন মেলা বারুণী বা পৌষ সংক্রান্তির মেলা । এই মেলাকে কেন্দ্র করে অনেক লোকও কাহিনী প্রচলিত রয়েছে । এক কাহিনী হলো পুরাকালে প্রজাপতি দক্ষ অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। সেই যজ্ঞে উপ…

 


 দেশ মানুষ ডেস্ক, জয়দীপ পন্ডা,তমলুক : তমলুকের সবচেয়ে প্রাচীন মেলা বারুণী বা পৌষ সংক্রান্তির মেলা । এই মেলাকে কেন্দ্র করে অনেক লোকও কাহিনী প্রচলিত রয়েছে । এক কাহিনী হলো পুরাকালে প্রজাপতি দক্ষ অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। সেই যজ্ঞে উপলক্ষে সমস্ত দেবদেবীকে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিলেন একমাত্র মহাদেব। মহাদেবের শ্বশুর ছিলেন দক্ষ। মহাদেব নিজের জামাই হলেও নানান কারণে দক্ষ তাকে অপছন্দ করতেন। সেই জন্য যজ্ঞে মহাদেব কে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যজ্ঞের কথা জানতে পেরে জামাতা মহাদেব যেমন অপমানিত বোধ করলেন তেমনি দক্ষকন্যা সতীমাতা মনে মনে পিতার এহেন আচরণে ক্ষুব্ধ হলেন। সতী বিনা নিমন্ত্রণে যজ্ঞস্থলে পিতার গৃহে উপস্থিত হলেন। এদিকে যজ্ঞস্থলে সতী মাতা কে দেখতে পেয়ে দক্ষ জামাতা মহাদেবের নিন্দা করতে শুরু করলে পতি নিন্দা সহ্য করতে না পেরে সতী যজ্ঞস্থলে দেহ ত্যাগ করলেন।


 এদিকে সতীর ফিরতে বিলম্ব দেখে মহাদেব তার সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। দঃখের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে মহাদেব সতীকে মৃত অবস্থায় দেখে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে শ্বশুরের মুন্ডচ্ছেদ করলেন। আশ্চর্য দক্ষ এর কাটা মুণ্ড টি মহাদেবের হাতে আটকে রইল। মহাদেব বারবার ফেলতে চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হলেন। এরপর তিনি সতীর মৃতদেহ কাঁধে তুলে নিয়ে প্রচন্ড ক্রোধের পৃথিবীর পরিক্রমণ বেরিয়ে পড়লেন। 

প্রলয় নৃত্যে মত্ত মহাদেবকে থামানোর জন্য ভগবান বিষ্ণু সুদর্শন চক্রের সাহায্যে সতী মাতার দেহকে টুকরো টুকরো করে কাটতে থাকলেন। সতীর দেহের খন্ডিত অংশ যেখানে যেখানে পড়েছে সেই সব স্থানে সৃষ্টি হয়েছে এক একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র এক একটি শক্তিপীঠ। এদিকে ব্রাহ্মণ হত্যাজনিত মহাপাপ এর ফলস্বরূপ মহাদেবের হস্তচূত না হলে তিনি বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। বিষ্ণু ভগবান মহাদেবকে উপদেশ দিয়ে বললেন___ যেখানে গমন করিলেন শিব অল্পকালের মধ্যেই পাপমুক্ত হয় সকল পাপ বিনষ্ট হয় আপনাকে সেই স্থানের কথা বলব ,এই বলে তিনি সেই স্থানের বর্ণনা করলেন। তিনি বললেন ভারতবর্ষের দক্ষিনে তাম্রলিপ্ত বর্তমান তমলুক নামে মহাতীর্থ আছে। সেখানে স্নান করলে লোকে বৈকুন্ঠে গমন করে। অতএব আপনি পিপড়াদের দর্শনের উদ্দেশ্যে সেখানে গমন করুন। বিষ্ণুর উপদেশ শিরোধার্য করে মহাদেব তাম্রলিপ্তের উদ্দেশ্যে রওনা হন। পৌষ সংক্রান্তির দিন তিনি তাম্রলিপ্ত উপস্থিত হয়ে তমলুকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বর্গভীমা মন্দির ও জিষ্ণুহরির মন্দির এর মধ্যবর্তী ক্ষুদ্র এক সরসী তে অবগাহন করে স্নান করায় তার হাত থেকে দক্ষের মাথা খসে পড়ল। 


সেই থেকে তাম্রলিপ্ত কপাল মোচন তীর্থ রূপের খ্যাতি লাভ করেছে। মহাদেব দক্ষ মুণ্ড হস্তচ্যুত হওয়ার পর বললেন, কপাল মোচনে স্নান করে জগৎপতি ও বর্গভীমা মায়ের মুখ দর্শন করলে আর পুনর্জন্ম হয় না। এইভাবে তাম্রলিপ্তের কপাল মোচন তীর্থ জনপ্রিয় হয়ে উঠলো। এই ঘটনার বিবরণ ব্রহ্মপুরাণ উল্লেখ রয়েছে।

 আরিফ কিংবদন্তি অনুসারে জানা যায় পান্ডবদের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া তাম্রলিপ্ত এসে পৌঁছলে এখানকার তৎকালীন রাজা তাম্রধ্বজ সেই ঘোড়াকে বন্দী করেন। ফলে পান্ডবদের সঙ্গে তাম্রধ্বজ এর যুদ্ধ বাঁধে। যুদ্ধে প্রবল পরিশ্রমের ফলে ঘর্মাক্ত হলেন অর্জুন সারথি কৃষ্ণ। কৃষ্ণের কপাল থেকে ঘাম এর জল ভূপৃষ্ঠে পড়লে তৎক্ষণাৎ সেই স্থানে একটি কুণ্ড বা জলস্রোতের সৃষ্টি হয়। কপালের ঘাম পড়ে এই কুন্ডের সৃষ্টি হয় বলে এর নাম কপাল মোচন তীর্থ। কপাল মোচন তীর্থ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ব্রম্ভ পুরাণে তাম্রলিপ্তকে কপাল মোচন তীর্থ রূপে অভিহিত করা হলেও পদ্মপূরাণে উত্তরখণ্ডে মায়াপুর, প্রভাষ খন্ড গুজরাটের অন্তর্গত প্রভাস তীর্থ, রেবা খন্ডে রেবা তীরে, উৎকল খন্ডে উড়িষ্যার মধ্যে কপাল মোচন তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। বিভিন্ন পুরানে এই তীর্থ সম্বন্ধে এরূপ মতভেদ দেখে পণ্ডিতেরা অনুমান করেছেন যে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সময় পুরান লিখেছেন। তারা বিভিন্ন প্রান্তের অধিবাসী ছিলেন। তাদের দেশের মাহাত্ম্য বাড়ানোর জন্য নিজেদের স্থান এর দিকে তথ্যগুলিকে টানবার চেষ্টা করেছেন। পণ্ডিতদের মধ্যে এ নিয়ে মতভেদ যা-ই থাকুক না কেন তাম্রলিপ্ত তথা তমলুকের স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস তাম্রলিপ্ত ছিল প্রকৃত কপাল মোচন তীর্থ।


 কালের গ্রাসে কপাল মোচন সর্বাধিক বর্তমানে বিলুপ্ত হলেও রূপনারায়ণের তীরে উত্তরা রাখাল সংলগ্ন একটি বাঁধানো পুকুর বর্তমান ওয়ার্ড নম্বর 14, পুজো নিবেদন করে নিজেদের ধন্য মনে করেন। পুণ্যার্থীরা তাদের বিভিন্ন মনস্কামনা সিদ্ধির উদ্দেশ্যে দেবী গঙ্গা মায়ের পুজো দেন। সংসারের মঙ্গল কামনায় ব্যবসার সাফল্যে চাকুরী লাভের আশায় এমনকি অসুস্থ স্বামী স্ত্রী পুত্র সন্তানের আরোগ্য কামনায় পুজো দেন। 

লক্ষ্য করা গেছে অনেকে দেবীর উদ্দেশ্যে জোড়া হাঁস ডিম উৎসর্গ করেন। সন্তান যাতে অকালে জলে ডুবে মারা না যায় সেই জন্য হাঁস ডিম গঙ্গার জলে নিবেদন করার রীতি রয়েছে। বারুনী মেলা উপলক্ষে প্রায় সাত দিন ধরে অনুষ্ঠান ও মেলা চলে। মেলা উপলক্ষে প্রচুর দোকানপাট বসে। পার্শ্ববর্তী জেলা হাওড়া ও দক্ষিণ 24 পরগনা থেকে দোকানদারেরা ব্যবসার জন্য এখানে ভিড় জমান। বর্তমানে করনা ভয়াবহ মরণব্যাধিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে উচ্ছ্বাস অনেকটাই কম। যদিও দেবীর পূজার্চনা যথারীতি শাস্ত্রীয় নিয়ম মেনে সম্পন্ন হচ্ছে। তাম্রলিপ্ত পৌরসভা ও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার সতর্কীকরণ করা হচ্ছে করণাভাইরাস বিধি সঠিক ভাবে পালনের জন্য। 

স্থানীয় পুজা কমিটি শান্তি সংঘের পক্ষ থেকে সরকারি নিয়ম মেনে সমস্ত রকম অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। মেলা কমিটির সম্পাদক সৌমেন গজেন্দ্র মহাপাত্র জানান, করোনার বাড়বাড়ন্তে সবাই আতঙ্কিত। অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তাই আমরা করোনা বিধি মেনে পুজো করছি । সমস্ত রকম  সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকবে। দূরত্ব বিধি মেনে দোকান বসেছে। মাস্ক এবং স্যানিটাইজার মেলায় আসা দর্শনার্থীদের দেওয়া হচ্ছে। 

সংস্থার সম্পাদক, অপূর্ব মিশ্র মহাশয় জানান, এবার আমাদের বাহান্ন বছরের গঙ্গামায়ের আরাধনা। পুজো উপলক্ষে বারুনী মেলা বসে। বিভিন্ন রকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং মরনোত্তর দেহ ও চক্ষু দানের কর্মসূচি থাকে। স্বাস্থ্য শিবির ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু বিগত দুই বছরে করোনার বাড় বাড়ন্তে অনেক কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। এবারে সরকারি নির্দেশে মেলা চললে ও কোন রকম অনুষ্ঠান করা হচ্ছে না। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার দর্শনার্থীদের ভিড় অনেক কম। মেলাও অনেক ম্লান। তবে আশা করছি আগামী দিনে আমরা এই অতিমারী ভাইরাস থেকে মুক্ত হয়ে আগের মতোই উৎসব করতে পারবো। সরকারি নির্দেশে তিন দিন  পূজা উদযাপন হবে।