Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন #বিভাগ_গল্প#শিরোনাম_পয়লা_বৈশাখ#কলমে_সমর্পিতা_হালদার
(১)
বেশ কিছুদিন ধরেই নানা কারণে সৃজনীর মুড অফ। ইদানিং তো সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে মাঝে মাঝে যে, ও সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করেছে ভালো কোনও সাইকোলজিস্টের ক…

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_যাপন 

#বিভাগ_গল্প

#শিরোনাম_পয়লা_বৈশাখ

#কলমে_সমর্পিতা_হালদার


(১)


বেশ কিছুদিন ধরেই নানা কারণে সৃজনীর মুড অফ। ইদানিং তো সেটা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে মাঝে মাঝে যে, ও সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করেছে ভালো কোনও সাইকোলজিস্টের কাছে কয়েকটা সিটিং নেবার কথা। কিছুই যেন ঠিকমতো চলছে না। অফিসেও প্রায় হয়ে যাওয়া প্রোমোশনটা হঠাৎই আটকে গেল। ওদিকে মৃণালেরও হঠাৎ কিছু কাজ এসে পড়ায় এতদিন ধরে প্ল্যান করে রাখা ওদের ইওরোপ ট্যুরটা ক্যানসেল করে দিতে হলো। মেয়ে তুতুলের বোর্ড এক্সামের স্কোর যতটা আশা করেছিল, তার থেকে তিন/চার পার্সেন্ট কম। ভীষণরকম ডিপ্রেসিং লাগে আজকাল।


অন্যদিনের তুলনায় আজ কিছুটা তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরেছে দু'জনে। মৃণাল বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে ওঠে "শোনো না, বলছি একটু শপিংয়ে যাবে নাকি আজ? পয়লা বৈশাখ তো এসেই গেল। আজ হঠাৎ করে খুব মনে পড়ছে ছোটবেলার দিনগুলোর কথা। প্রত্যেকবার এই সময়ে মা-বাবার সঙ্গে চৈত্র সেলে নতুন জামাকাপড় কিনতে যেতাম, আর কিছু না কিছু খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। সেটা আইসক্রিম, মিষ্টি বা কচুরি-ছোলার ডাল যাই হোক না কেন, আমাদের কাছে সেটাই ছিল অমৃত। বাড়ি এসে রাতে আবার অল্প করে ভাতও খেতাম। বাইরে থেকে ডিনার করে আসার চলটা তখনও একেবারেই আসেনি আমাদের বাড়িতে। কেনাকাটা সেরে যখন বাসে করে ফিরতাম, বাবার হাতে ধরা ওই ব্যাগগুলোর মধ্যে মনে হতো যেন রাজৈশ্বর্য আছে। কী অল্পেতেই মন ভালো হয়ে যেত তখন..."


কথাগুলো বলতে বলতে নিজের অজান্তেই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস যেন বেরিয়ে আসে মৃণালের ভেতর থেকে। এতক্ষণ ওর মুখের দিকে অবাক চোখে তাকিয়েছিল সৃজনী। এবার বলে ওঠে "সেই মিডলক্লাস মেন্টালিটি থেকে কোনওদিন বেরিয়ে আসতে পারলে না না তুমি? এখন আমি তোমার সঙ্গে চৈত্র সেলে বাজার করতে যাব?" 


থেমে যায় মৃণাল। কী যেন ভেবে সৃজনী আবার বলে "এমনিতেও অবশ্য কিছুই করার নেই বাড়িতে। চলো তাহলে, বেরোই একটু। তবে চৈত্র সেলে কেনাকাটা করতে নয় অবশ্যই! মেইন রোডের ওপরেই নতুন একটা শপিং মল খুলেছে দেখলাম। ওখানে গিয়ে কিছু শপিং করে দেখি যদি মনটা একটু ভালো হয়। একেবারে ডিনার করেই ফিরব। তুতুলের আজ সময় হবে না। বলেছিল বন্ধুদের সঙ্গে বেরোবে। ওর খাবারটা নাহয় প্যাক করে নিয়ে আসব।"


মনে মনে বেশ খুশি হলো মৃণাল। ক'দিন ধরে বাড়ির পরিবেশ যা গুমোট হয়ে ছিল, আজ অন্তত একটু নর্মাল কথাবার্তা বলছে সৃজনী। ওর ড্রিম ডেস্টিনেশন সুইজারল্যান্ড যেতে না পাওয়ার শকটা কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তাহলে। মৃণাল অবশ্য প্রমিস করেছে অফিস প্রজেক্টের চাপটা একটু কম হলেই আবার প্ল্যান করবে ট্যুরটার।


(২)


প্রচুর শপিং করে মনটা একটু ফুরফুরে হয়েছে সৃজনীর। মলের ভেতরেই দারুণ ফুডকোর্ট। সেখানেই পছন্দমতো ডিনার সেরে মল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে, হঠাৎ এক মহিলার সঙ্গে ধাক্কা লেগে কাঁধের ভ্যানিটি ব্যাগটা ছিটকে পড়ে গেল ফুটপাতে। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তিরস্কার করতে যাবে, ঠিক তখনই মহিলাটির চোখে চোখ পড়ে মুখ বন্ধ হয়ে গেল সৃজনীর। ভীষণ চেনা চেনা লাগছে মহিলাটিকে। হ্যাঁ ঠিকই চিনেছে, শ্রীতমাই তো! সেই পানপাতার মতো মুখ, বড় বড় দুটো চোখ, আর তুলি দিয়ে আঁকা ঠোঁট দুটোতে সেই একইরকম অমলিন হাসির রেখা। সৃজনীর মনে পড়ে না এই মেয়েটাকে আদৌ কোনওদিন হাসিমুখ ছাড়া দেখেছে কিনা সে। কলেজে সবাই বলতো ওর নাকি ভুবন ভোলানো হাসি। ওই হাসি দিয়েই তো দেবব্রতকে...থাক সে সব পুরনো কথা।


একসময় সৃজনীর বেস্টফ্রেন্ড না হলেও বেশ কাছের বান্ধবী ছিল শ্রীতমা। শ্রীতমার বাবার কাছে প্রাইভেটে পড়তেও যেত সৃজনী। এলাকার সবথেকে ভালো কেমিস্ট্রির শিক্ষক ছিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস। যদিও গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা পয়সায় পড়ানো, কিছু ছাত্রের পড়াশোনার খরচ নিজে বহন করা, এইসব করতে গিয়ে বড়লোক হতে পারেননি কোনওদিন। মেয়েটাও হয়েছিল একদম বাবার মতো। রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার প্ল্যান থেকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গিয়ে কলেজের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খেত, পাশের বস্তির বাচ্চাগুলোকেও নিজের পয়সায় খাওয়াত আবার। তাতেই নাকি ওর শান্তি।


সৃজনী জানে সারাজীবন ওইভাবে চলে না। সংসারে ঢুকে ধাক্কা খেতে খেতে এইসব মূল্যবোধ ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ে চলে যায় কোথায়। গভীর প্রেমও জানলা দিয়ে পালায় আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলে। কীইবা এমন হাইফাই চাকরি করত দেবব্রত? এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে শ্রীতমা কত বড় ভুল করেছিল সেদিন। দেবব্রত অবশ্য ব্রিলিয়ান্ট ছিল খুব; কিন্তু মেন্টালিটিটাই ছিল ছাপোষা হয়ে থাকার। তবুও দেবব্রতর কথা মনে পড়াতে বুকের ভেতরটা কি একটু মোচড় দিয়ে উঠল একবার? এই জন্যই শ্রীতমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেছিল সৃজনী। কিন্তু কী করার ছিল আজ? হঠাৎই তো সামনে এসে ধাক্কা দিল শ্রীতমা।


(৩)


সাধারণ একটা আকাশ নীল শাড়িতেও কী অপূর্ব দেখাচ্ছে শ্রীতমাকে! তবুও ওর দিকে ভালোভাবে না তাকিয়ে কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরেই জিজ্ঞাসা করল সৃজনী "কেমন আছিস? এখানে শপিং করতে আসিসনি নিশ্চয়ই!" একটু হেসে শ্রীতমা বললো "না না, চৈত্র সেলে পাশের মার্কেট থেকে বাড়ির সবার জন্য জামাকাপড় কিনে বাড়ি ফিরছি রে। ভালো আছি আমরা। তোর কী খবর? তোর মুখের হাসিটা এরকম লাগছে কেন রে? সব ঠিক আছে তো?"


অবাক হয় সৃজনী। মেয়েটা কি মানুষের মন পড়তে পারে নাকি? কীভাবে বুঝে গেল সৃজনীর মন‌ ভালো নেই? ও কি ধরা পড়ে গেল শ্রীতমার কাছে? এদিকে সস্তার জামাকাপড় ভর্তি ব্যাগ হাতে নিয়ে কত সহজেই বলে দিলো শ্রীতমা "ভালো আছি।" অথচ সৃজনী? কী উত্তর দেবে সে শ্রীতমার প্রশ্নের? এই ছোট্ট প্রশ্নটা তার কাছে যে  খুব ভারী বলে মনে হচ্ছে আজ! তবুও যথাসম্ভব সুখী মুখ করে বলার চেষ্টা করল "আমিও...ভালোই আছি..."


শ্রীতমা সৃজনীকে ওদের বাড়িতে যাবার জন্য বারবার বলতে থাকে। সৃজনী না বলতে গিয়েও ভাবে -যাই না একবার! দেখে আসি কী নিয়ে এত সুখে আছে শ্রী! ও কি তাহলে সব পেয়েছে জীবনে? এখন হয়তো অনেক বড় কোনও জায়গায় কাজ করছে দেবব্রত! সে যোগ্যতা তো ওর ছিলোই। আর শ্রীতমাও পড়াশোনায় বেশ ভালো ছিল বরাবর। সেও হয়তো...পরক্ষণেই আবার ভাবে, তবে যে বললো চৈত্র সেলে কেনাকাটা করেছে! সে হয়তো স্বভাবে। কে বলতে পারে? ও তো বরাবরই ওরকম। ভাবনার দোলাচলে দুলতে দুলতে অবশেষে রাজি হয়ে গেল সৃজনী। ঠিক করে ফেললো শ্রীতমার সুখের খোঁজ নিতে সামনের উইকেন্ডেই সশরীরে হাজির হবে ওদের বাড়িতে। সৃজনী আসবে জেনে আরও একটু চওড়া হলো শ্রীতমার মুখের হাসিটা।


সৃজনী এবার নিশ্চিত, শ্রীতমা নিশ্চয়ই দারুণ বিলাসবহুল জীবনযাপন করে এখন। দামি বাড়ি, গাড়ি, আড়ম্বর সবকিছু দেখাবে বলেই এত আগ্রহ নিয়ে ডাকছে তাকে। যদিও তেমন স্বভাবের মেয়ে ছিল না শ্রীতমা; কিন্তু মানুষের মনের পরিবর্তন হতে কতক্ষণ! তা নাহলে নিজের ভিখারি দশা দেখাতে নিশ্চয়ই ডেকে নিয়ে যেত না বড়লোক বান্ধবীকে! এতটা বোকাও নয় শ্রীতমা।


(৪)


কাবার্ড থেকে অনেক বেছে একটা দামি নেটের শাড়ি বের করল সৃজনী। সঙ্গে ম্যাচিং অ্যাকসেসরিজ। নিজেকে নিখুঁতভাবে সাজিয়ে দামি পারফিউম লাগিয়ে মৃণালকে বললো "চলো, আমি রেডি।" মৃণালের চোখে মুগ্ধতা দেখে মনে মনে আরোই খুশি হলো সৃজনী। আজ নিশ্চয়ই একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পড়বে দেবব্রতর। শ্রীতমাও নিঃসন্দেহে সুন্দরী, কিন্তু এমন সাজপোশাকের জৌলুস তার কোথায়? টাকা হয়তো হয়েছে এখন, কিন্তু রুচিটাই বড় বেশিমাত্রায় মিডিওকার। কলেজের বেশিরভাগ মেয়ের ক্রাশ ছিল দেবব্রত। সৃজনীও কি চেষ্টা করেনি তার কাছে আসার? কিন্তু দেবব্রত শ্রীতমার মধ্যে যে কী খুঁজে পেয়েছিল কে জানে! আর কারও দিকে চোখই পড়ত না তার। সৃজনী কোনওদিন মন থেকে মেনে নিতে পারেনি ওদের সম্পর্কটাকে। ওদের বিয়েতে আসেওনি সে।


যাইহোক, এসব কথা ভেবে আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়ল সৃজনী। পাশে দেবব্রত। তুতুলের যথারীতি বন্ধুদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করা আছে আগে থেকেই। তাই যেতে পারবে না সে বাবা-মায়ের সঙ্গে। আজ পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে তুতুল তার বন্ধুদের সঙ্গে পার্টি করতে যাবে শুনে প্রথমে বেশ অবাকই হয়েছিল মৃণাল। থার্টি ফার্স্ট নাইটের পার্টির কথা শুনে এসেছে চিরকাল, কিন্তু পয়লা বৈশাখের পার্টি? নৈব নৈব চ। ভাবে আরও কতকিছু যে শিখতে হবে মেয়ের কাছে কে জানে!


(৫)


একগাল হাসি নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শ্রীতমা। ওদেরকে দেখেই  বলে উঠল "এই সময়ে বেলের আওয়াজ পেয়েই বুঝেছি তোরাই এসেছিস। আয় আয় ভেতরে আয়।" সৃজনীর অনুসন্ধিৎসু চোখ সারা বাড়ি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে শুধু। না, অট্টালিকা তো নয়! সৃজনীর সুবিশাল ডুপ্লেক্সের তুলনায় যথেষ্ট ছোট। তবে বেশ সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়িটা। রুচিশীলতার ছাপ ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।


হঠাৎ ভেতর ঘর থেকে তুতুলের বয়সী একটা মেয়ে বেরিয়ে এলো। বেশ পুতুল পুতুল দেখতে। শ্রীতমার মেয়ে হবে নিশ্চয়ই! সৃজনী ওকে দেখে হাসিমুখে জানতে চায় "কী নাম তোমার?" মেয়েটিও ঠিক একইভাবে ওর কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করে চলে। কিছুটা বিস্ময় নিয়ে শ্রীতমার মুখের দিকে তাকায় সৃজনী। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শ্রীতমা বলে "ছোট থেকেই আর পাঁচজনের থেকে একটু আলাদা ও। একটু বেশি স্পেশাল। এখন অবশ্য অনেক কিছু শিখেছে। স্কুলে যায়। নিজের কাজ নিজে নিজেই করতে পারে অনেকটা।" শ্রীতমার কথা শেষ হওয়ার আগেই কোথা থেকে একটা মিষ্টি নিয়ে এসে জোর করে ওর মুখে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে মেয়েটি। ও বাধা দিতে গেলে বলে ওঠে "কিচ্ছু খাওনি তুমি (সকাল থেকে)।" মুখের ভেতর অত বড় মিষ্টিটাকে ঠিকঠাক জায়গা দিতে দিতে হেসে ফেলে শ্রীতমা। সৃজনী ভালো করে তাকিয়ে দেখে ওর মুখের দিকে। না, কোথাও কোনও হতাশার লেশমাত্র নেই শ্রীতমার মুখে। বড় স্বতঃস্ফূর্ত ওর হাসিটা। সৃজনী জানতে চায় দেবব্রতর কথা।


শ্রীতমা হাসিমুখে ওদেরকে পাশের ঘরে নিয়ে যায়।  খাটের ওপর বসে আছে দেবব্রত। পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আঁকার সরঞ্জাম। বরাবরই ভীষণ ভালো আঁকত দেবব্রত। কিন্তু খাটের পাশে রাখা ওই হুইলচেয়ারটা কার? নিশ্চয়ই শ্রীতমার শাশুড়ি মায়ের হবে!


ওদেরকে দেখে খুশি হয় দেবব্রত। ভেতরে এসে বসতে বলে। তারপর শ্রীতমার দিকে তাকিয়ে অভিমানের সুরে বলে "এখনও পরোনি? কখন পরবে বলো তো শাড়িটা? আজ পয়লা বৈশাখ। নতুন শাড়িটাতে আজকের জন্যই তো তাড়াতাড়ি ফেব্রিক করে রাখলাম তুমি পরবে বলে। তোমার কি পছন্দ হয়নি শাড়ির ওপর আমার আঁকা শকুন্তলার ছবিটা?" ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শ্রীতমা বলে "তোমার আঁকা কারও অপছন্দ হওয়ার উপায় আছে? আমার আসলে সময় হয়নি সকাল থেকে। রান্নাঘরে একটু ব্যস্ত ছিলাম তো, তাই। এই তো, এবার পরবো।" কথাগুলো বলতে বলতেই শাড়িটা তুলে গায়ে জড়িয়ে নেয় শ্রীতমা। দেবব্রতর মুগ্ধ দৃষ্টি আর শ্রীতমার চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়া উজ্জ্বল আলোই বলে দেয় অনেক কথা। কী বোকার মতো ভাবছিল সৃজনী, ওকে দেখে নাকি চাপা দীর্ঘশ্বাস পড়বে দেবব্রতর। আসলে দেবব্রতর মুগ্ধ দৃষ্টি আজও যে এক জায়গাতেই বাঁধা! কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এসব দেখে এই মুহূর্তে একটুও রাগ হচ্ছে না সৃজনীর। বরং ভালো লাগছে তার। মনটা বোধহয় ভালো হচ্ছে একটু একটু করে।

ওদেরকে বসিয়ে চা-খাবার আনতে ভেতরে যায় শ্রীতমা। 


(৬)


নেহাতই কৌতুহলবশত হুইলচেয়ারটার দিকে তাকিয়ে সৃজনী জানতে চায় "এটা কি কাকিমার?" অসহায়ভাবে হেসে দেবব্রত বলে "না রে, আমার। আমাদের বাড়িতে সবই উল্টে গেছে এখন। পুরো ছবিটাই। আমি পড়ে আছি বিছানায়, বয়স্কা মা আর শ্রীতমা খেটে চলেছে অবিরাম। শ্রীতমার কথা আর কী বলবো? সবদিকটা একা হাতে সামলে চলেছে দিনের পর দিন। তবুও ওর মুখে এতটুকু হতাশার ছাপ দেখিনি কোনওদিন। কোনও ক্ষোভ নেই জীবনের প্রতি। কখনও আক্ষেপ করতে শুনিনি 'কী পেলাম' বলে।


আকাশ থেকে পড়ে সৃজনী। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে কোনওমতে জানতে চায় "কী করে হলো এসব?" দেবব্রত বলে "বছর দুয়েক আগে একটা ভয়ঙ্কর বাইক অ্যাক্সিডেন্টে শরীরের বাঁদিকটা প্যারালাইজড হয়ে যায় আমার। শ্রীতমা স্কুলের চাকরির সঙ্গে অনেকগুলো টিউশন ব্যাচ পড়াতে শুরু করে। মাও সেলাইয়ের কাজ করতে থাকে ওকে একটু সাহায্য করার জন্য। আমার চিকিৎসার খরচ, মেয়ের স্পেশাল এডুকেশন কোর্স সবকিছু একা সামলেছে শ্রী। এখন আমি অনেকটা ভালো। ডক্টর বলেছেন আর ছ'মাসের মধ্যে হাঁটাচলাও করতে পারব আশা করা যায়।"


চোখের কোণদুটো ভিজে ভিজে লাগছে কেন সৃজনীর? ও কি কাঁদছে? শ্রীতমার স্ট্রাগলের কথা জেনে কষ্টে আজ ওর চোখে জল! নাকি শ্রীতমার প্রতি গভীর শ্রদ্ধায়? এও কি সম্ভব!


ইতিমধ্যে খাবারের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকে পড়েছে শ্রীতমা। হাসতে হাসতে বলে "ওর কথায় একদম কান দিস না রে। সবসময় বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলে আমার ব্যাপারে। এটা কি বলেছে যে নিজেও আজকাল ড্রয়িং ক্লাস করাতে শুরু করেছে বাড়িতেই? আর আমার টিউশনের ব্যাচও অনেক কমিয়ে দিয়েছে জোর করে। আমার ওপর নাকি খুব বেশি চাপ পড়ে যাচ্ছিল।" কথাগুলো বলতে বলতে হাসিমুখে খাবারগুলো এগিয়ে দেয় ওদের দিকে।


(৭)


সৃজনী আজ প্রথম মন খুলে গল্প করে শ্রীয়ের সঙ্গে। মনটা যে কী ভীষণ হালকা লাগছে আজ! মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে কোথাও কোনও কষ্ট নেই, হতাশা নেই, ক্ষোভ নেই। শুধু আনন্দ ছড়িয়ে আছে চারিদিকে।


অনেকক্ষণ আড্ডা, খাওয়া-দাওয়ার পর বাড়ি ফেরার সময় শ্রীতমাকে একা পেয়ে জিজ্ঞাসা করে সৃজনী -"তুই সত্যি ভালো আছিস শ্রী? তোর মুখে তো কোনও ক্লান্তির ছাপ নেই! কত স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাসতে পারিস তুই এখনও!" শ্রীতমা হেসে বলে "পারব না কেন বল? আমাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো সবাই কত ভালোবাসে আমায়। কত বোঝে ওরা আমাকে। যে যার মতো করে চিন্তা করে আমার জন্য। যত্নে রাখে আমার মনটাকে। ওরাই তো আমার শক্তি। ওরা এভাবে পাশে থাকলে আমার কীসের দুঃখ বল? সত্যিই আমি ভালো আছি রে। খুব ভালো আছি।" 


খুব শীঘ্রই আবার আসার অঙ্গীকার করে শ্রীতমার চৌকাঠের বাইরে পা রাখে সৃজনী। রাস্তায় বেরিয়ে মৃণালের হাতটা ধরে বলে "বাড়ি ফেরার আগে একটু বাইরে কোথাও বসবে আজ? না না, কোনও কফিশপে নয়। কোনও পার্কে, গাছের তলায়। খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে আজ ভীষণ।" সৃজনীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে মৃণাল। আজ যে বড় নতুন লাগছে তার এত বছরের চেনা সঙ্গিনীটিকে!


সত্যিই আজ একটা নতুন দিন। এবারের পয়লা বৈশাখে শুধু নতুন একটা বছর নয়, একটা নতুন সময়েরও সূচনা হলো ওদের জীবনে। শ্রীতমার সুখের খোঁজ করতে এসে সত্যিকারের সুখের সন্ধান পেয়ে গেল সৃজনী। 


হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ঢোকার শব্দে ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে দেখে শ্রী লিখেছে "আরে এত কথার মাঝে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানাতেই তো ভুলে গেছি! শুভ নববর্ষ।" মুচকি হেসে সৃজনী টাইপ করে "শুভ পয়লা বৈশাখ।"

©চুপকথা-কলমে সমর্পিতা হালদার