Page Nav

HIDE

Post/Page

Weather Location

Breaking News:

latest

সৃষ্টি-সাহিত্য-যাপন-দৈনিক-সেরা-লেখনী-সম্মাননা

#সৃষ্টি_সাহিত্য_পরিবার #ছোটগল্প 
রাঙিয়ে দিয়ে যাও  ✍সায়ন্তনী দাস ধর                     "আ মোলো যা! ধিঙ্গি মেয়েগুলোর আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি নে!" জানলার পর্দা একটু সরিয়ে বাইরের রঙিন মেলার আনন্দ দেখে বড়ই বিরক্ত হন শশিকলা, &qu…

 


#সৃষ্টি_সাহিত্য_পরিবার 

#ছোটগল্প 


রাঙিয়ে দিয়ে যাও  

✍সায়ন্তনী দাস ধর     

      

                "আ মোলো যা! ধিঙ্গি মেয়েগুলোর আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি নে!" জানলার পর্দা একটু সরিয়ে বাইরের রঙিন মেলার আনন্দ দেখে বড়ই বিরক্ত হন শশিকলা, " ছেলেদের সাথে একসাথে রঙ মাখামাখি! মাগোঃ! ছিঃ!"

কিন্তু কৌতুহল নিবারণে অক্ষম শশিকলা পরদার ফাঁক দিয়ে বাইরের দৃশ্য না দেখেও স্বস্তি পান না। মুখে 'ছিঃ' 'ছিঃ' করতে করতে বড় বড় চোখে সবকিছু দেখতে থাকেন তিনি।  

" ও পিসিঠাকমা, দরজাটা একটু খোলো না গো!" নতুন নাতবউ সোহিনীর গলার আওয়াজ পাওয়া যায় বন্ধ দরজার ওপারে। 

" কেন, কি হলো কি? এত হাঁকডাক কেন? জান না, আমি দরজা খুলি না এই অনাচ্ছিস্টির দিনে?" খরখর করে বলে ওঠেন শশিকলা। 

" তোমার সাথে খুব দরকার আছে। একটু খোলো না দরজাটা!" অনুনয় করে সোহিনী। 

দোনামনা করে দরজাটা খুলেই দেন শশিকলা। হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকেই সোহিনী শশিকলার পায়ে আবির ছুঁইয়ে তাঁর মুখও গোলাপি আবিরে রাঙিয়ে দেয়। শশিকলার ধবধবে সাদা শাড়িতে লাগে  গোলাপি আভা।

" নাতবউ..." আর্তনাদ করে ওঠেন শশিকলা, "আমাকে কলঙ্কিত করে দিলে!"

" পিসিঠাকমা, এ কেমন কথা বলছ?" 

" চুপ কর...এত সাহস তোমার!" এক ধমকে সোহিনীকে থামিয়ে দেন শশিকলা। 

চিৎকার চেঁচামেচি শুনে চলে আসেন সোহিনীর শাশুড়িমা রঞ্জনা, শ্বশুরমশাই সমর, স্বামী অভিরূপ ও শশিকলার নাতনি তনয়া। এ ভয়ানক ঘটনার পরিণাম কি হতে পারে ভেবে সকলেই ভয়ে কাঁটা হয়ে যায়। 

" তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?" অভিরূপ অস্বস্তি নিয়ে প্রশ্ন করে তার নতুন বউকে।

" কি কাণ্ড..." সমর আর কিছুই বলতে পারে না।

" আসলে ও জানে না তো..." পরিস্থিতি সামাল দিতে বৃথা চেষ্টা করে রঞ্জনা। 

" চুপ কর সবাই। তোমাদের আস্কারাতেই আজ এই ঘটনা ঘটেছে। বাড়ির বউকে মাথায় তোলার ফল ভুগতে হবে তো! বেহায়া মেয়ে, নিয়মকানুন কিছুই কি বাপের বাড়ি থেকে শিখে আসো নি?" 

" আ...আমি ভাবলাম, পিসিঠাকমা একা একা ঘরে রয়েছে, আমরা সকলে মিলে আনন্দে মেতেছি, পিসিঠাকমাকেও আমাদের আনন্দে সামিল করি। তাই..." আমতা আমতা করে বলে সোহিনী। 

" হ্যাঁ, পাড়ার যত ছেলে ছোকরার সাথে তুমি রঙ মাখামাখি কর আর আমাকেও ঐ পাপের ছোঁয়া না দিলে তোমার শান্তি হবে কেমন করে?" শশিকলার কথায় লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হয় সোহিনীর।

" কিসব কথা বলছ, ঠাকমা? ছেলে ছোকরা আবার কি? পাড়ার সকলে মিলেই তো প্রতি বছর আমরা রঙের খেলায় মাতি। সেই আনন্দে বৌদিভাই তোমাকেও সামিল করতে চেয়ে অপরাধ করে ফেলেছে নাকি?" প্রতিবাদ করে তনয়া। 

" ব্যস্, কদিন তোমার পায়ের ধুলো পড়েছে এ বাড়িতে? এর মধ্যেই আমার নাতনিটাকে প্রতিবাদী বানিয়ে ফেলেছ?" ভীষণ রেগে যান শশিকলা। 

" আঃ! পিসি, তুমি এবার একটু বেশিই বকাবকি করছ! ও বেচারি একটা ভুল করে ফেলেছে। আর হবে না। বৌমা, পিসিঠাকমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নাও দেখি।" সমর ঘরোয়া শান্তি বজায় রাখতে চেষ্টা করেন।

" থাক, থাক, আর ন্যাকামো করতে হবে না।" দুপদাপ পা ফেলে কাপড় পাল্টাতে যান শশিকলা। 

চোখের জল মুছে এক দৌড়ে নিজের ঘরে চলে যায় সোহিনী। জানলার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে বাইরের রঙিন পৃথিবীর দৃশ্য দেখছিল সে, দুই চোখে জলের ধারা, বিষন্নতা ছেয়ে রয়েছে ওর সারা মুখে। দুই হাতে একমুঠো আবির নিয়ে চুপিচুপি ঘরে ঢোকে অভিরূপ, পিছন থেকে এসে সোহিনীর মুখ আবিরে রাঙিয়ে দেয়। চমকে ওঠে সোহিনী। 

" জান তো পিসিঠাকমা ঐরকমই। প্রতি বছর দোলের দিনে দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন। আমরাও ডাকাডাকি করি না। তুমি শুধুশুধু মনখারাপ করছ। ঐ নিয়ে আর ভেবো না। আমাদের বিয়ের পর প্রথম দোল! এমনভাবেই দিনটাকে বৃথা যেতে দেবে?" এই বলে অভিরূপ সোহিনীকে কাছে টানে।

সোহিনী অভিরূপের কাছে আসার ছলে ওর মুখে রঙ মাখিয়ে পালায়। অভিরূপ সোহিনীকে ধরতে দৌড়োয়। আবার হাসি মজায় ভরে ওঠে বাড়িটা।

              শশিকলা নিজের ঘরে বসে ভাবছেন, নতুন নাতবউকে একটু বেশিই কড়া করে কথা শুনিয়েছেন বোধহয়। মেয়েটা তাঁকে ভালবেসেই তো রং মাখাতে এসেছিল, তিনি যা নয় তাই বলে অপমান করে ফেলেছেন! ইস্, নিজেকে বড্ড ছোট মনে হচ্ছে তাঁর। এ কি করলেন আজ এই শুভ দিনে! মেয়েটার কি দোষ? দোষ তো তাঁর কপালের। লজ্জায় ঘর ছেড়ে বেরোতেই ইচ্ছে করছে না তাঁর। 

" ও পিসিঠাকমা, দরজাটা একটু খুলবে? একটু মালপোয়া বানিয়েছি, তোমার জন্য এনেছি।" সোহিনীর ডাকে হুঁশ ফেরে শশিকলার। ও বাবা, অনেক বেলা হয়ে গেল, নাঃ! আর রাগ দেখানোর দরকার নেই। 

দরজা খুলে দিয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকেন শশিকলা, " কি হল কি? নিজের ঘরে কি শান্তিতে থাকতেও দেবে না?"

" না, দেব না। অনেক একা একা থেকেছো, এবার খাও আর চল, একসাথে সবাই মিলে গল্প করব। তোমাকে ছাড়া আমরা যে অসম্পূর্ণ। "

সোহিনীর কথায় হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকেন শশিকলা। এভাবে কেউ তো কখনও ডাকেনি তাঁকে! মনের সব কষ্ট, ক্ষোভ, ইচ্ছে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে চায়, সব উজাড় করে দিতে ইচ্ছে হয় এই একরত্তি জেদি মেয়েটার সামনে। কিন্তু কিছুই বলে উঠতে পারেন না শশিকলা, শুধু কয়েক ফোঁটা অবাধ্য জল চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে। কয়েক মূহুর্ত সোহিনী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে শশিকলার দিকে। 

দ্রুত নিজেকে সামলে সোহিনী তাঁকে এক টুকরো মালপোয়া খাওয়ায়, " কেমন হয়েছে পিসিঠাকমা?"

শশিকলা সোহিনীর মাথায় হাত রাখেন, " খুব ভাল বানিয়েছিস তো!"

" তুমি রঙ খেলা পছন্দ কর না কেন পিসিঠাকমা?" সোহিনীর প্রশ্নে বুক কেঁপে ওঠে তাঁর। 

একসময় দোল উৎসব ছিল শশিকলার প্রাণের উৎসব। তাঁকে নিরুত্তর দেখে সোহিনী আবার প্রশ্ন করে। সোহিনীর আন্তরিক ব্যবহার ও জোরাজুরিতে শশিকলার মনের বদ্ধ  দরজাটা হাট করে খুলে যায় আজ। যে কথাগুলো কোনদিন কাউকে বলতে পারেন নি, আজ সেগুলোই কিভাবে যেন বলে ফেলেন এই একরত্তি সেদিনের মেয়েটাকে।

                ছোটবেলায় শশি ছিল বড্ড দস্যি মেয়ে। এক দঙ্গল ছেলে মেয়েদের নিয়ে এর বাগানে, তার পুকুরে দস্যিপনা করেই তার দিন কাটত। কারোর কথা না শোনাটাই তার স্বভাব ছিল। একমাত্র  পাড়ার ভূষণদাদাকেই শশি একটু যা ভয় পেত। ভূষণদাদার বাড়িতে শশির অবাধ যাতায়াত ছিল। ওর মাও শশিকে খুব ভালবাসত। আর শশির মা তো সারাক্ষণ বলতেন যাতে শশি একটু ভূষণদাদার মত হবার চেষ্টা করে! সেকথা অবশ্য শশি এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিত। ছোট্ট শশি বড় হল, বসন্তের ছোঁয়া লাগল তার মনেও। অবাক হয়ে সে আবিষ্কার করল ভূষণদাদাকে সারাদিনে একবার না দেখলে তার বড় মনখারাপ হয়! বাড়িতে বিয়ের কথাবার্তা শুরু হতেই শশির মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। প্রথম অনুভব করল, সে কবে যেন স্বামীর আসনে ভূষণদাদাকেই বসিয়ে ফেলেছে। দুই বাড়িতেই শশি ও ভূষণকে ভাইবোনের মতোই ভাবা হত। হয়তো বা ভিন্ন জাতের হবার কারণেই দুজনের বিয়ের কথা কোন বাড়িতেই কেউ ভাবার অবকাশ পায়নি। এরই মধ্যে এল দোল উৎসব। প্রতিবার ছেলেমানুষি করে রঙ মাখালেও এবার ভূষণ শশিকে রঙ মাখাল আপন করে। তাতে ভাসল শশিও। কিন্তু বাড়ির অমতে কিছু বলা বা করার সাহস কারোরই ছিল না। তারপর যা হয় আর কি, শশির বিয়ে হয়ে গেল অন্য কারোর সাথে। নিয়ম মেনে সংসার করল, মা হল, সন্তান প্রতিপালন করল... কিন্তু শশির স্বামী অকালে মারা যাওয়ায় তাকে নিজের বাড়িতেই সন্তানের হাত ধরে ফিরে আসতে হল। সেখানেই তার ছেলে বড় হল, বিয়ে করল। শশির কপাল বড়ই খারাপ।  তাই এক দুর্ঘটনায় ছেলে বউমা দুজনেই এ সংসারের মায়া কাটিয়ে চলে গেল। শশি রয়ে গেল একমাত্র নাতনি তনয়াকে নিয়ে। তনয়া এ বাড়িতেই মানুষ হল। 

             " ভূষণদাদার কি হল শশিঠাকমা?" সবটা শুনে বিস্ময়ে থ সোহিনী। 

" সে আর বিয়েই করেনি। সেনাবাহিনীতে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল।" শশিকলা লাজুক হেসে বলেন।

" এখন ওনার খবর জান না?" উদগ্রীব হয় সোহিনী। 

" ঐ তো তোদের পাড়ার মিলিটারি দাদু... " এই বয়সেও এত লজ্জা পান শশিকলা, নিজেই জানতেন না! 

          

         পরের বছর। বসন্ত এসে গেছে। দোল উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে। সোহিনী শশিকলাকে  টানতে টানতে উঠোনে এনে হাজির করেছে। পাড়ার অনেকের সাথে আজ মিলিটারি দাদুও উপস্থিত রঙ নিয়ে। বাড়ির সকলে হতবাক! শশিকলা রঙের উৎসবে যোগদান করেছেন! সকলে আনন্দে শশিকলার পায়ে আবির ছুঁইয়ে প্রণাম করে মেতে ওঠে রঙের ঝর্ণায়। কোন এক অবকাশে মিলিটারি দাদু অর্থাৎ শশিকলার ভূষণদাদা রঙ ছুঁইয়ে দেন শশিকলার গালে। লাজুক হেসে শশিকলাও তাঁর ভূষণদাদাকে রাঙিয়ে দেন। বহু বহু বছর পর অতীতের স্মৃতিরা খেলা করে জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছনো মানুষদুটিকে ঘিরে। 

             দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে সোহিনীর মন আনন্দে ভরে ওঠে। দুটি ভালবাসার মানুষকে কাছে আনা এত আনন্দের অনুভূতির জন্ম দেয়!